#নেশা
#পর্ব_০৭
#Tabassum_Kotha
শাওয়ারের নিচে হাটু চেপে বসে আছি। দুচোখ বেয়ে অঝোরে পানি পরে যাচ্ছে। ঝরনার পানি আর চোখের পানি মিশে এক হয়ে গেছে। সকালে হসপিটালে গিয়ে তিতলির অসুস্থতার মিথ্যে নাটকের কথা জেনেছি, সামান্য জ্বরের জন্য তিতলিকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল তন্ময়। কিন্তু আমার কাছে তিতলির সম্পর্কে এতোবড় মিথ্যা বললো! অবশ্য তার মতো একটা দুশ্চরিত্র মানুষ আর কি করতে পারে।
ভুল টা তো আমারই ছিল। আমিই মানুষ চিনতে ভুল করেছি। তিতলিকে ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচবো? আমাকে মাতৃত্বের প্রথম অনুভূতি দিয়েছে তিতলি। মা হওয়ার পরিপূর্ণতা আমি তিতলির ছোট ছোট হাতের স্পর্শে পেয়েছি। জন্ম না দিয়েও আমি তিতলির মা হয়ে উঠেছি। রূপা আপুর মৃত্যু শয্যায় তাকে কথা দিয়েছিলাম তিতলিকে সবসময় নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখবো। কিন্তু কিভাবে? তন্ময়ের যে রূপ আজ দেখলাম তাতে করে তার উপর আর বিশ্বাস করা যায় না।
ভীষণ ভয় করছে তিতলিকে হারানোর। সেই সাথে এতোবড় ধোঁকা পেয়ে কষ্টও হচ্ছে প্রচুর।
শাওয়ারের পানিগুলো দ্রুত বেগে আসা তীরের মতো শরীরে পরছে। জানি না কতোক্ষণ এভাবে ছিলাম।
অনেকক্ষণ পর ভেজা শাড়িটা পাল্টে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি পাচ্ছি না। মাথাটাও কেমন ভার হয়ে আছে। ভেজা চুলেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কখন যে ঘুমের দেশে পারি দিয়েছি বলতে পারবো না।
.
.
.
.
রাত ১১ টার দিক দিয়ে আকাশে মেঘ গর্জে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টি শুরু হওয়া কিছুক্ষণ আগেই নির্ঝর বাড়ি ফিরে। ঘরে ঢুকে সে তৃষ্ণাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পায়। ল্যাপটপ রেখে টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে সে। বেশ লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসে তৃষ্ণাকে আগের মতোই ঘুমিয়ে থাকতে দেখে কিছু একটা খটকা লাগে নির্ঝরের। বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে তৃষ্ণার কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠে সে।
জ্বরে তৃষ্ণার গা পুড়ে যাচ্ছে। এই জ্বর টা যে কাল সারা রাত ব্যালকোনিতে দাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য হয়েছে এটা নির্ঝর ভালোই বুঝতে পারছে। নির্ঝর তৃষ্ণাকে অনেক ডাকাডাকি করে কিন্তু তৃষ্ণা সাড়া দেয় না।
রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি তার ওপর মুষলধারে বৃষ্টি। নির্ঝর তার এক ডাক্তার ফ্রেন্ডকে ফোন করলে সে তৃষ্ণার মাথা ধুইয়ে দিয়ে তৃষ্ণাকে যথা সম্ভব উষ্ণতায় রাখতে বলে। নির্ঝর কোনো সার্ভেন্ট কে না ডেকে নিজেই তৃষ্ণার মাথায় পানি ঢালতে থাকে। অনেকক্ষণ পানি ঢেলে শরীর মুছিয়ে দেওয়ার পর তৃষ্ণার জ্বর হালকা একটু কমে এলে নির্ঝর ক্লান্ত শরীরে তৃষ্ণার পাশেই ঘুমিয়ে পরে।
.
রাত ৩ টার দিকে তৃষ্ণা ঘুমের মাঝে নির্ঝর কে আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরে। একটু আগেই নির্ঝরের চোখ লেগেছিল। তৃষ্ণার এভাবে জরিয়ে ধরায় নির্ঝরের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে তৃষ্ণার মুখটা ঠিক তার মুখের সামনে দেখতে পায় নির্ঝর। জ্বর থাকায় তৃষ্ণার মুখে একটা লাল আভা ফুঁটে উঠেছে। সেই সাথে তার গরম নিশ্বাস নির্ঝরের চোখে মুখে আঁছড়ে পরছে।
নির্ঝর বাম হাত দিয়ে আলতো করে তৃষ্ণার কপালে এলোমেলো হয়ে পরে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিলো। তৃষ্ণার ঘুমন্ত লালচে মুখটা নির্ঝরের চোখে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। তৃষ্ণার হালকা গোলাপী ওষ্ঠদ্বয় জ্বরের কারণে শুকিয়ে গেছে। নির্ঝরের ইচ্ছে হচ্ছে তৃষ্ণার চোখে মুখে ভালোবাসার পরশ ছুইয়ে দিতে। শুকনো ঠোঁটদ্বয় ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে ভিজিয়ে দিতে।
নির্ঝর পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে তৃষ্ণার কাছে থেকে একটু দূরে সরে গেলো। সে যা করতে যাচ্ছে সেটা ঠিক না, তৃষ্ণার অবচেতন অবস্থার সুযোগ নিয়ে কিছু করা তার উচিত হবে না।
নির্ঝর একটু সরে গেলে তৃষ্ণা অর্ধচেতন অবস্থায় নির্ঝরের দিকে পুনরায় এগিয়ে গিয়ে নির্ঝরকে জরিয়ে ধরে। এবার আর নির্ঝর তৃষ্ণার ভালোবাসার উষ্ণতাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। সে নিজেও তৃষ্ণাকে সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। তৃষ্ণা অন্তর্জ্ঞানীয় অবস্থায় থাকলেও জ্বরের ঘোরে কোনো বাঁধা দিচ্ছে না। নির্ঝরের ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে সে নির্ঝরের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে।
বাইরে বৃষ্টির বেগ যেনো আগের থেকেও অনেকাংশে বেড়ে গেছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বইছে ঝড়ো হাওয়া। মনে হচ্ছে সব যেনো লন্ডভন্ড হয়ে যাবে আজকে রাতেই। সারা রাতের বর্ষণ শেষে ভোরের দিকে বৃষ্টি থেমে যায়।
.
.
.
.
সকালে প্রায় অনেক বেলা করেই ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলতেই মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা করছে। হঠাত এতো মাথা ব্যথার কারণ অনুসন্ধান করতে করতে উঠতে গেলেই শরীরের উপর ভারী কিছু অনুভব করলাম। পাশ ফিরে তাকাতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। নির্ঝর আমাকে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছেন। দুজনের একজনের শরীরেও কাপড় ঠিক মতো নেই। কাল রাতে কি হয়েছে কিছুই মনে নেই। তবে এটা বুঝতে বাকি নেই যে উনি আমার অবচেতন হওয়ার সুযোগ নিয়েছেন।
নির্ঝর আমার সাথে এমনটা কিভাবে করতে পারলেন! শেষ পর্যন্ত এইভাবে আমাকে ইউজ করলেন! সবাই একরকম। তন্ময় ধোঁকা দিলো, আর নির্ঝর এইভাবে আমার সম্মাণ! কষ্টে বুকের ভিতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আমার সাথেই সবসময় কেনো এমন হয়। কেনো আমাকেই সবসময় কষ্টের ভুক্তভোগী হতে হয় কেনো?
নির্ঝরকে নিজের উপর থেকে সরিয়ে নিয়ে নিচে পরে থাকা কাল রাতের শাড়িটি উঠিয়ে কোনো মতে শরীরে পেঁচিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।
রাগে, কষ্টে, ক্ষোভে আমার নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে। বেটা বজ্জাত আমার সুযোগ নিয়েছে। এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
মনে মনে উনার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে গোসল সেরে নিলাম। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজের দিকে তাকাতেই কেমন যেনো লজ্জা লাগছে।
.
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নির্ঝরকে ঘরে পেলাম না। উনি ঘুম থেকে উঠে ব্যালকোনিতে গিয়ে দাড়িয়ে আছেন। উনাকে দেখে আমার কষ্ট টা পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। তবুও নিজেকে যথেষ্ট সংযত রেখে চুল আচড়ানোতে মনোযোগ দিলাম।
— তৃষ্ণা! তোমার জ্বর কমেছে?
— হুম।
— রাতে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল। তারপর,,
— তারপর আপনি আমার অবচেতন হওয়ার সুযোগ নিয়ে আমাকে নিজের করে নিলেন। এই তো!
— হোয়াট! আমি তোমার সুযোগ নিয়েছি?
— আর নয়তো কি! জোরপূর্বক এই ধরনের অসভ্যতামি করেছেন।
— এক্সকিউজ মি! আমি জোরপূর্বক কিছুই করি নি। তুমিই আমার দিকে এগিয়ে এসেছিলে। আমি একবার দূরে সরে গেলে তুমি পুনরায় আমার কাছে এসেছিলে।
— একদম মিথ্যে বলবেন না। মিথ্যে বললে আপনার সবগুলো দাঁত পরে যাবে। আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই তাই না! যে আপনার কাছে যাবো।
— সব ভুলে বসে আছো দেখছি। কাল রাতে যে আমাকে জরিয়ে ধরে আমার ঠোঁটের উপর হামলা চালালে,, তারপর ঠোঁট থেকে উঠে আমার ইজ্জতে হামলা চালালে!!
— ছি ছি কতো মিথ্যা বলতে পারেন আপনি। আমি এমন কিছুই করি নি। যা করার আপনিই করেছেন।
— সব তুমিই করেছো। আমার কাছে প্রমাণ আছে। দেখবা কিভাবে করেছো?
— হ্যাঁ আমিও দেখতে চাই। দেখান।
— দেখো।
নির্ঝর আমার হাত ধরে হেঁচকা টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে আমার ঠোঁটৈ ঠোঁট চেপে ধরলেন। উনার এহেম কান্ডে আমার চোখ কপালে উঠে গেছে। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য উনার বুকে হাত পা ছোড়া শুরু করে দিয়েছি। কিন্তু উনার বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছি না। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করার পরেও ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম।
কিছুক্ষণ পর উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আমি হ্যাবলা কান্তের মতো উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। ব্যাপার টা হলো টা কি? হঠাত করে উনার মনে আমার জন্য এতো ভালোবাসা এলো কিভাবে!
.
.
.
নির্ঝর অফিসে গেছে অনেকক্ষণ হয়েছে। কালকে থেকে তিতলির কোনো খোঁজ পাই নি আর। খুব চিন্তা হচ্ছে তিতলির। তন্ময়ের মতো একটা নরপিশাচের হাতে তিতলিকে ছেড়ে দিয়ে আমি কিভাবে শান্তিতে থাকতে পারি! রূপা আপুর শেষ চিহ্ন তিতলি।
দশ বছরের একটা বাচ্চা মেয়েকে এতিমখানা থেকে নিজের বোন বানিয়ে নিয়ে এসেছিল রূপা আপু। আমার মতো একটা এতিমকে চাচা নিজের মেয়ের মতো দেখেছেন সবসময়। রূপা আপু নিজের বোনের জায়গা দিয়েছিলেন। সেই আপুর শেষ স্মৃতি তিতলি। দূর্ভাগ্যক্রমে সেই রূপা আপুর ভাগ্যে তন্ময়ের মতো একটা পশু জুটেছিল। এক বছর আগে রূপা আপুর হঠাত মৃত্যুর পর থেকে তিতলিকে আমি নিজের মেয়ের মতোই আগলে রেখেছিলাম। তিতলির ভাগ্যে যাতে সৎ মা না আসে সেই কারণেই তন্ময়কে বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিলাম।
এক দিক থেকে ভালোই হয়েছে যে বিয়েটা হয় নি। এখন শুধু তিতলিকে তন্ময়ের কাছে থেকে আনতে হবে। তন্ময়ের মতো একটা খারাপ মানুষের কাছে আমি তিতলিকে কিছুতেই থাকতে দিতে পারি না।
.
আলমারি থেকে কিছু টাকা বের করে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পরলাম তিতলির কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সদর দরজার কাছে গিয়ে আমাকে হতাশ হয়ে ফিরতে হলো। নির্ঝর দরজা বাইরে থেকে লক করে রেখে গেছেন। কিন্তু কালকে তো দরজা খোলা ছিল, আর বাসায় সার্ভেনস্ ছিল। তবে আজ কেনো আমাকে আটকে রেখে গেলেন নির্ঝর!!
চলবে..
[ব্যস্ততায় এডিট করা হয় নি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। ধন্যবাদ।]