নেশা #পর্ব_০৯ #Sumaya_Tabassum_Kotha

0
1038

#নেশা
#পর্ব_০৯
#Sumaya_Tabassum_Kotha

চিলে কোঠার ঘরের এক কোনায় হাটুর ভাজে মুখ গুজে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছি। আমার কষ্ট সহ্য করার সীমা ক্রমেই অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে। আর পারছি না। আর কতো কি সহ্য করবো! সহ্যেরও তো একটা সীমা থাকে! ছোট থেকে তো সহ্যই করে আসছি।

জন্মের পর মা বাবা তাদের পরিচয় দেয় নি, এতিমখানার দরজায় ফেলে দিয়ে চলে গেছে। জীবনের শুরুর দশটা বছর এতিমখানায় একা একা কেটেছে। রূপা আপু আর চাচা আমার মতো এতিমকে তাদের মেয়ে বানিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেও চাচি কখনও আমাকে আপন ভাবতে পারে নি। জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করেই টিকে থাকতে হয়েছে।

অতঃপর ভাগ্যের খেলায় প্রিয়জনকে হারিয়ে হতে হলো নিঃস্ব। প্রিয়জনের ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকার অভিশাপও পালন করে নিয়েছি।

ভাগ্যের নিষ্ঠুর জুয়া খেলায় আবার সবার হাতের পুতুল হয়ে গেলাম। যাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম সেই তিতলি এখন আমার থেকে ক্রোশ দূরে। যিনি আমার স্বামী সে সবার সামনে আমাকে সার্ভেন্ট বলে পরিচয় দেয়! অবশ্য তারই বা কি দোষ? বিয়ের শর্তই ছিল তিন মাসের সংসার,, বাসর রাতেই তো নিজের তালাকনামায় সই করে দিয়েছি!


চিলে কোঠার ঘর টা তে জিনিসপত্র আর ধুলা দিয়ে আস্তরণ পরে গেছে। চোখের পানি মুছে আঁচল কোমড়ে গুজে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে নিলাম। নির্ঝরের পরিবারের জন্য রাতে রান্না করলাম।

যেহেতু বাড়ির নতুন সার্ভেন্ট আমি সেহেতু তাদের খাওয়া শেষ করিয়ে সবকিছু ধুয়ে পরিষ্কার করে রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার পরে পুনরায় চিলে কোঠার ঘরে গেলাম। চিলে কোঠার ঘরটায় ছোট একটা জানালা আছে। আমার মতোই বিষন্ন রাতের আকাশ দেখার জন্যই হয়তো জানালা টা বানানো।

.
.
.

পুরো আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে। ইদানিং মেঘ বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেছে। আকাশও আমার সাথে পাল্লা দিয়ে অশ্রু বর্ষণ করে। গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে। মাঝে মাঝে পুরো ধরাকে আলোকিত করে বিদ্যুত চমকাচ্ছে! আলো ছায়ার সেই খেলা আমি চিলে কোঠার মেঝেতে শুয়ে দেখে যাচ্ছি!

হঠাত দরজায় টোকা পরাতে উঠে দরজা খুলে দেখলাম নির্ঝর দাড়িয়ে আছেন।

উনাকে দেখে আমার বুক কেঁপে উঠলো। চোখমুখ লাল হয়ে আছে উনার। কেনো যেনো মনে হচ্ছে উনি এতোক্ষণ কান্না করেছেন। কিন্তু উনি কেনো কান্না করবেন!

.
দরজা খুলে দিয়ে আমি ভিতরে চলে এলাম। উনি পিছন থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে আমাকে জরিয়ে ধরলেন। উনার গরম নিশ্বাস আমার গলায় ঘাড়ে পরছে। অন্য কোনো দিন হলে হয়তো আমার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন হতো কিন্তু আজ তার প্রতিটা স্পর্শ আমার শরীরে ধারালো তীরের মতো বিঁধছে। উনি আমার গলায় ঘাড়ে অনবরত চুমু খেয়ে যাচ্ছেন। গলা থেকে উঠে ঠোঁটে ঠোঁট ছোয়াতে গেলে আমি বাঁধা দেই।

— দ্য নির্ঝর আহমেদ চৌধুরীর একটা সার্ভেন্টের সাথে এই ধরনের সম্পর্ক লোকে জানলে কি বলবে আপনাকে?

নির্ঝর আমার কথায় তব্দা মেরে দাড়িয়ে আছেন। কিন্তু আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে উনি পুনরায় আমার ঠোঁটে স্পর্শ করতে গেলে আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়।

নির্ঝর কে একটা ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছে থেকে সরিয়ে দিলাম।

— শরীর ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না দেখছি। যেই শরীর টা প্রতিনিয়ত ভোগ করছেন সেই শরীরেও যে একটা মন আছে সেটা কি জানেন। মানছি আপনার সাথে আমি চুক্তিবদ্ধ। টাকার বিনিময়ে সব করছি কিন্তু আমি কি করবো। আমারও যে ভীষণ কষ্ট হয়। আর সহ্য করতে পারছি না। চুক্তির বিয়ে হলেও আপনার স্ত্রী আমি। কিন্তু সবার সামনে আমার পরিচয় সার্ভেন্ট হিসেবে।

— লুক তৃষ্ণা, স্নিগ্ধা আমার ফিয়ান্সে। ওর সামনে আমি তোমাকে স্ত্রী বলে পরিচয় দিতে পারতাম না। আর আমার বাড়িতে সার্ভেন্ট ব্যতিত অন্য কেউ থাকেও না।

— স্নিগ্ধা আপনার হবু স্ত্রী তাহলে আমাকে কেনো বিয়ে করলেন।

নির্ঝর কোনো উত্তর না দিয়ে একপা দু পা করে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। ঘরটা এতোই ছোট যে আমি পিছাতেও পারছি না। নির্ঝর আমার কাঁধ থেকে আঁচল ফেলে দিয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলেন। গভীর একটা চুমু দিয়ে কানের কাছে তার মুখটা এনে ফিসফিসিয়ে বললেন,

— তুমি আমার নেশা তৃষ্ণা। তুমি খারাপ আমি জানি। তবুও আমার তোমাকে চাই।

— মেরে ফেলুন আমাকে। আর কিছু বাকি নেই জীবনে। যা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। এই কষ্ট আর নিতে পারছি না আমি। প্লিজ মেরে ফেলুন আমাকে। মুক্তি চাই আমি।

— আমি তোমাকে মরতে দেবো না আর শান্তিতে বাঁচতেও দেবো না!!

.
.
.
.
.
.
.
দুচোখের কার্নিশ বেয়ে অজস্র অশ্রু কণা গড়িয়ে পরে যাচ্ছে। শুধুমাত্র রাতের ভালোবাসার পর্বটুকু শেষ করে নির্ঝর ক্লান্ত হয়ে তার সমস্ত ভার আমার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। আমার গলায় মুখ গুজে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন। ঘুমের ঘোরেও আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন। হয়তো তার মনে হচ্ছে বাহুর বন্ধন একটু আলগা হলেই আমি হারিয়ে যাবো।



নির্ঝরের প্রতিটি স্পর্শেই ইদানিং ভীষণ ভালো লাগা কাজ করে। এই চুক্তির বিয়ের মায়ায় পরে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। স্বামীর জন্য ভালোবাসা হয়তো প্রতিটা মেয়ের জীবনেই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু আমার যে নিজের স্বামীকে ভালোবাসার অধিকার নেই।

আর মাত্র দুইমাস সময় বাকি আছে। এর পর স্বামী নামক মানুষটাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। উনাকে যদি আমার দুচোখে বন্দী করে আমার সাথে নিয়ে যেতে পারতাম! নাহ আমি সেটা করতে পারি না।

নির্ঝরের জন্য, স্নিগ্ধার জন্য, সবার ভালোর জন্য আমাকে একাই সবার থেকে দূরে যেতে হবে।

.
.
.
.
.
.
.
.

পরদিন সার্ভেন্ট না আসায় সারাদিন তৃষ্ণার একা খাটা খাটুনি করতে হয়। সারাদিনের কাজ শেষে সবাইকে ডিনার করিয়ে দিয়ে খাবার গুছিয়ে রেখে চিলে কোঠার ঘরের দিকে পা বাড়ায় তৃষ্ণা। ঘড়িতে রাত প্রায় বারোটা। কিন্তু এখনও নির্ঝর বাড়ি ফেরে নি। সিড়ির কাছে গিয়েও তৃষ্ণা ড্রয়িং রুমে ফিরে আসে।

.
.
ডান হাতে মদের গ্লাস আর আঙুলের চিপায় জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে একটা বারে বসে আছে নির্ঝর। প্রায় দেড় ঘন্টা যাবত ড্রিংক করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে চোখে ঘোলাটে দেখা শুরু করে দিয়েছে। সে বুঝতে পারছে মদ খাওয়া বেশি হয়ে গেছে আজ। তবুও শেষ বার ভর্তি করা গ্লাস টা খালি না করে উঠার ইচ্ছে করছে না।

নির্ঝরের ঠিক সামনের টেবিলে বেশ সুন্দরী এক রমণী মিনি স্কার্ট পরে বসে ড্রিংক করছে। মেয়েটির পোশাক আশাক আর গায়ের ফ্যাকাশে রং দেখেই বোঝা যায় সে বিদেশি।

মেয়েটি ঢুলু ঢুলু পায়ে নির্ঝরের দিকে এগিয়ে এসে টেবিলে ভর দিয়ে একটু ঝুঁকে দাড়ালো।

— ওয়ানা ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড? (মেয়েটি)

— নট ইন্টারেষ্টেড। গো আওয়ে।

— লুক আই এম সো হট।

— আই এম নট ইন্টারেষ্টেড.. লিভ মি এলোন।

— জাষ্ট লুক অ্যাট মি। ইউ উইল ফাইন্ড মি ইন্টারেষ্টিং।

— মাই ওয়াইফ ইজ মোর হট এন্ড বিউটিফুল দ্যান ইউ। নাউ গেট লষ্ট ফ্রম হিয়ার।

নির্ঝরের কথায় মেয়েটি রেগে আগুন হয়ে সেখান থেকে চলে যায়।

.
বেশকিছুক্ষণ পুরো ড্রয়িং রুমে পায়চারি করে উনার ফেরার অপেক্ষা করলাম। কিন্তু উনার ফিরে আসার কোনো লক্ষণ না দেখে ড্রয়িং রুমে রাখা ল্যান্ড লাইন ফোন টা হাতে নিলাম উনাকে ফোন করার জন্য। ঠিক তখনই কলিং বেল টা বেজে উঠলো। ফোনের স্পিকারটা নিচে রেখে দরজার কাছে ছুটে গেলাম।

নির্ঝরের বডিগার্ড নির্ঝরকে ধরে রেখেছে। আর উনি মাতাল হয়ে আছেন।

উনার বডিগার্ডকে বিদায় করে দিয়ে উনাকে জরিয়ে ধরে ধীরে ধীরে ঘরে এনে শুইয়ে দিলাম। উনার শরীর থেকে মদের বিশ্রী গন্ধ আসছে। না জানি কতো মদ গিলেছেন।

উনার শার্ট খুলে দিয়ে উঠে আসতে গেলে উনি আমার হাত ধরে হেঁচকা টেনে নিজের বুকের উপর ফেলে দিলেন।

নেশার ঘোরে নির্ঝর বারবার আমার নাম নিচ্ছেন। আচ্ছা উনি কি আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পরছেন? না আমি তো সেটা হতে দিতে পারি না। উনার মনে আমার জন্য শুধু ঘৃণা থাকবে। উনার ভালোবাসার যোগ্য আমি নই, কিছুতেই উনার মনে আমার জন্য ভালোবাসা তৈরি হতে পারে না।

নির্ঝর কে ছেড়ে উঠতে গিয়েও উঠতে পারলাম না। কেনো যেনো আজকে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে উনাকে আমি হারিয়ে ফেলবো। যদিও কিছুদিন পর এটাই সত্যি হবে। তবুও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।

উনার বুকের উপর মাথা রেখে দুহাতে উনাকে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরলাম।

.
.
.
.

দরজায় কারো জোরে ধাক্কা দেওয়ার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ খুলতেই নিজেকে নির্ঝরের বুকে পেলাম। বাইরে অনেক বেলা হয়ে গেছে আর আমার চোখই খুলে নি। নিজেকে সামলে উঠে বসলাম। দরজায় ধাক্কার পরিমাণ ক্রমশ বেড়েই চলছে। শাড়ির আঁচল ঠিক করে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম।

দরজার বাইরে স্নিগ্ধা চোখ মুখ গরম করে তাকিয়ে আছে।

— তুমি আমার নির এর ঘরের ভিতরে কি করছো? তাও আবার বন্ধ দরজার আড়ালে নির এর অবচেতন হওয়ার সুযোগ নিচ্ছিলে তাই না!

— না না ছিঃ! এসব কি বলছেন। আমি তো এই ঘরে!

— তুমি তো,, এই ঘরে,, কি? বলো? বলো! মুখে তালা মেরেছো নাকি?

— আসলে আপনি ভুল ভাবছেন।

— ভুল! আমি একদম ঠিক ভাবছি। আমার তো কালকেই সন্দেহ হয়েছিল তোমাকে এই বাড়িতে দেখে।

— না,,

— তোমার মতো লো ক্লাসদের আমি ভালোই জানি। আমার নির কে ফাঁসানোর জন্যই এসব করেছো তাই না!

— আপনি ভুল ভাবছেন।

— ওহ জাষ্ট শাট আপ। আই নো ওয়েল। তুমি একটা ক্যারেক্টারলেস মেয়ে। নিজের রূপ দেখিয়ে আমার নির এর টাকা হাতাতে চাও। এতো টাকার লোভ তোমার। তুমি তোমার মোটিভে সাকসেসফুল হতে পারবে না।

— দেখুন আপনি আমার কথা টা তো শুনুন।

— কি শুনবো? তুমি আমার নির এর নেশার ঘোরে হওয়ার সুযোগ নিয়ে ওর সাথে এক ঘরে থেকেছো সারা রাত। এখন কিছুদিন পরেই প্রেগন্যান্ট হওয়ার নাটক করে টাকা ডিমান্ড করবে তাই তো।

— ছিঃ! কি বলছেন এসব?

— তোমার সব খেলা আমি আজকেই শেষ করে দেবো। বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।

স্নিগ্ধা আমার হাত ধরে আমাকে টানতে লাগলেন। ঠিক তখনই পিছন থেকে অন্য হাতে টান অনুভব করলাম।

চলবে..

[কালকে সারাদিন বিদ্যুত না থাকায় গল্প দিতে পারি নি। আজকেও ভীষণ ব্যস্ত যার জন্য পর্ব ছোট হয়েছে। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। ধন্যবাদ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here