#নেশা
#পর্ব_১১
#Sumaya_Tabassum_Kotha
আলমিরা থেকে সমস্ত জিনিসপত্র বের করে লাগেজে পুরছে স্নিগ্ধা। এক হাতে চোখের পানি মুছে অন্য হাত দিয়ে লাগেজ আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে। নির্ঝরের এভাবে বিয়ে করে নেওয়া, তার সাথে প্রতারণা করা সে কিছুতেই মানতে পারছে না।
স্নিগ্ধার পিছন পিছন নয়না বেগমও ছুঁটে এসেছেন। স্নিগ্ধার এই অবস্থা মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। যেখানে সব দোষ তার নিজের ছেলের, সেখানে তার কি বা করার আছে!
নয়না বেগম স্নিগ্ধার কাছে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে স্নিগ্ধাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন।
— একটা বাইরের মেয়ের জন্য তুমি তোমার সংসার, নিজের ভবিষ্যত ছেড়ে চলে যাবে? (নয়না বেগম)
— আমার সংসার? আম্মু তুমি হয়তো শুনতে পাও নি নির কি বলেছে! আমার ওর প্রতি কোনো অধিকার নেই। নির ওই চিপ মেয়েটার সাথেই হ্যাপি।
— দেখো স্নিগ্ধা,, নির ওই মেয়েটাকে কেনো বিয়ে করেছে সেটা আমরা কেউই জানি না। এভাবে হুটহাট ডিসিশন না নিয়ে মাথা ঠান্ডা করে নির এর সাথে আমরা কথা বলি দ্যান আসল সত্যি টা বেরিয়ে আসবে।
— আই কান্ট টলারেট এনিমোর আম্মু। নির আমাকে অনেক ইনসাল্ট করেছে ওই লো ক্লাস মেয়েটার জন্য।
— রিলাক্স স্নিগ্ধা। লেট মি হ্যান্ডেল দিস।
.
নয়না বেগমের কথায় স্নিগ্ধা শান্ত হলেও তার মনে আগুন জ্বলছে। নির্ঝর অন্য কাউকে বিয়ে করেছে এটা ভাবতেই তার মাথায় আগুন ধরে যাচ্ছে। ভিতরে ভিতরে রাগে ফুসলেও বাইরের দিকটা যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে।
.
.
.
.
.
.
সোফায় বসে ল্যাপটপে মুখ গুজে আছেন নির্ঝর। নিজেকে এতোটাই স্বাভাবিক দেখাচ্ছেন যে, তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না একটু আগে কিছু হয়েছিল। খুবই রিল্যাক্স ভাবে সেন্টার টেবিলে এক পায়ের উপর অন্য পা তুলে কফির মগে চুমুক দিচ্ছেন। উনাকে দেখে আমার ভয় হচ্ছে। উনার রাগি জল্লাদ টাইপ রূপ অনেক দেখেছি। কিন্তু এতো শান্তরূপ এই প্রথম দেখলাম। তাও আবার এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পর। আচ্ছা সত্যি কি উনার কিছু আসছে যাচ্ছে না যা হলো তাতে?
.
সকালের কান্ড হওয়ার পর উনিই সার্ভেন্ট ডাকিয়েছেন। সার্ভেন্ট বাড়ির সব কাজ করছে! আর আমাকে উনার সামনে মূর্তির মতো বসিয়ে রেখেছেন। এক চুলও নরতে দেয় নি। একটু এদিক সেদিক হলেই উনার চিলের মতো তীক্ষ্ম চোখ দুটো দিয়ে অগ্নি বর্ষণ করা শুরু করে দেয়।
নির্ঝরের হঠাত একটা কল এলে উনি উঠে ব্যালকোনিতে চলে যায়। আমার ভীষণ ক্ষুধা পাওয়াতে আমি পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে কিচেনের দিকে পা বাড়ালাম।
.
” দাড়াও মেয়ে!”
তৃষ্ণা কিচেনে ঢুকার আগে নয়না বেগম তৃষ্ণাকে ডাকলেন।
— জি?
— তোমার উদ্দেশ্য টা কি?
— মানে?
— খুব ভালো সাজা হচ্ছে তাই না! তুমি কি মনে করো আমি তোমার চালাকি প্ল্যানিং বুঝি না!
— আপনি কি বলতে চাইছেন আন্টি?
— কে আন্টি? কল মি ম্যাম।
— জি ম্যাম।
— তোমাকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। এক বছর আগে আমার ছেলের জীবনে যেই ঝড় তুলেছিলে সেই ঝড় অনেক কষ্টে সামাল দিয়েছে স্নিগ্ধা। আর এখন সেই স্নিগ্ধার কাছে থেকে নিরকে কেঁড়ে নিচ্ছো!
নয়না বেগমের কথায় ইতোমধ্যে তৃষ্ণার দুচোখ পানিতে টইটুম্বুর হয়ে গেছে। কিন্তু চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পরার সাহস পাচ্ছে না। তৃষ্ণা মাথা নিচু করে রেখেছে যাতে সেই পানি কেউ না দেখতে পায়।
— তুমি এতোটা স্বার্থপর সেটা আমার জানা ছিল না। তুমি আমার ছেলেকে আবার সেই কষ্ট দেওয়ার জন্য ফিরে এসেছো ওর জীবনে। (নয়না বেগম)
— আমি আপনার ছেলের জীবনে ফিরে আসি নি ম্যাম। আপনার ছেলে আমাকে নিজের জীবনে এনেছে পুনরায়। আমি সব ছেড়ে তার জীবন থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। উনি আমার জীবনে ঝড় তুলে দিয়ে আমাকে নিজের করে নিয়েছেন।
— কি বলতে চাইছো? আমার নির আবার তোমাকে ওর জীবনে ফিরিয়ে এনেছে? হতেই পারে না! আমার ছেলে তোমার মতো একটা মেয়েকে দ্বিতীয় বার মনেই করতে পারে না। বউ বানিয়ে জীবনে ফিরিয়ে আনা তো অনেক দূরে!
— আপনি বিশ্বাস না করলে আমার কিছুই করার নেই। যা সত্যি আমি সেটাই বলেছি। নির্ঝরের জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়ার জন্যই অন্য একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু নির্ঝর জোর করে আমাকে নিজের কাছে এনেছে।
— আমাকে কি তোমার বোকা মনে হয়? তুমি নিজে বিয়ে না করলে নির্ঝর কেনো কারো ক্ষমতা নেই তোমার আর নির্ঝরের বিয়ে করানোর। তুমি স্বেচ্ছায় কবুল বলেছো।
— আমি স্বেচ্ছায় কবুল বলেছিলাম কিন্তু!!
— কিন্তু কি ?
— আমি নিরুপায় ছিলাম। আমার টাকার ভীষণ প্রয়োজন ছিল। এজন্যই বিয়েতে রাজী হয়েছি।
— টাকার জন্য তুমি আমার ছেলের জীবন নষ্ট করে দিলে! কেনো করলে তৃষ্ণা? স্নিগ্ধা নির এর জন্য এতোকিছু করেছে সেই স্নিগ্ধার জীবন তুমি নষ্ট করে দিলে!
— কারো জীবন নষ্ট হয় নি। সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার আগের মতো হয়ে যাবে।
— ঠাট্টা করছো আমার সাথে?
— সত্যি বলছি। সব আগের মতো হয়ে যাবে। স্নিগ্ধার জীবনেও নির্ঝর আবার ফিরে আসবে।
— কি বলতে চাইছো?
— নির্ঝর আর আমার বিয়েটা চুক্তির বিয়ে। এই বিয়ের সময়সীমা মাত্র তিনমাস। তিনমাস পর আমি আর নির্ঝর আলাদা হয়ে যাবো।
— মানে?
— আমার টাকার খুব প্রয়োজন ছিল। সেই টাকা নির্ঝর দিচ্ছে। বিনিময়ে আমি উনার বৈধ শয্যসঙ্গী হচ্ছি।
.
তৃষ্ণার এরূপ কথায় নয়না বেগম আর কিছু বলতে পারে না লজ্জায়।
সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও ফিরে আসে নয়না বেগম।
— এক বছর আগে নিজের স্বার্থের জন্য আমার ছেলেকে অনেক কষ্ট দিয়েছিলে তুমি। আবারো সেই একই কষ্ট আমার ছেলের জন্য সাথে করে নিয়ে এসেছো।
— এবার উনার কোনো কষ্ট হবে না ম্যাম। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।
তৃষ্ণা খাবার এর ট্রে হাতে নিয়ে উপরের ঘরে চলে যায়। নয়না বেগম কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তৃষ্ণার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে স্নিগ্ধার ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
.
নির্ঝর ব্যালকোনিতে দাড়িয়ে স্মোক করছেন কিন্তু তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি আমার ওপর।
— আম্মুকে সব বলে দিয়ে এখন খুব শান্তি পাচ্ছো তাই না!
— আপনি কিভাবে জানলেন?
— তোমার কি মনে হয় তুমি লুকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আম্মুকে সব বলে দেবে আর আমি বুঝতে পারবো না?
— আজ নয়তো কাল সবটা সবার জানারই ছিল। তাই আজকে বলে দেওয়াটাই উচিত মনে হলো আমার।
.
নির্ঝর আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আচমকা আমার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে আমার গলায় মুখ গুজে দিলেন। অন্য কোনো দিন হলে হয়তো উনাকে দুহাতে জরিয়ে নিতাম। কিন্তু আজ কেনো যেনো সাহস পাচ্ছি না। হাত গুটিয়ে ঠায় দাড়িয়ে আছি। উনার গরম নিশ্বাস আমার চিবুকে পরছে। উনি আস্তে করে উনার মুখটা একটু তুলে আমার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বললেন,
— তুমি কি ভেবেছো,, আম্মুকে সব বলে দিলে আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবে? ট্রাষ্ট মি তৃষ্ণা! “আই উইল নট লেট ইউ ডাই ওর লিভ ইন পিছ!”
তোমার থেকে আমার পাওনা প্রতিশোধটা এখনও বাকি আছে তৃষ্ণা। বি রেডি।
কথাগুলো বলে নির্ঝর আমার গলায় গভীর একটা চুমু দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলেন।
.
বরাবরের মতো আমার চোখ দুটো ভিজে গেছে। দুইমাস সময় যতো শেষের দিকে আসছে, বুকের বা পাশের চিনচিনে ব্যথাটা ততোই প্রকট আকাড় ধারণ করছে। এক বছর আগে আমি নিজের স্বার্থের কারণে নির্ঝরকে কষ্ট দিয়েছিলাম। হয়তো এবারও সেটাই করতে যাচ্ছি। এই বার হয়তো নির্ঝর আমাকে সারাজীবনের জন্য ভুলে যাবেন!
” এখনও মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছো! খাবার দাও আমাকে।”
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে তৃষ্ণাকে নির্ঝর কথাটা বললো।
— আপনি বসুন। (তৃষ্ণা)
.
নির্ঝর তার লম্বা চুলগুলো আধ ভেজা রেখেই সোফায় বসে পরলো। পরোটা আর দম আলু করা হয়েছে নাস্তার জন্য। নির্ঝরের চুল থেকে টপটপ করে পানি মেঝেতে আর সেন্টার টেবিলে পরছে। সদ্য গোসল করে আসাতে শুধু ট্রাওজারে বসে আছেন উনি। ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে উনাকে। ইচ্ছে হচ্ছে উনাকে দুচোখে বন্দী করে নেই। সেই সাথে একটু লজ্জাও করছে।
আচ্ছা আমি কি উনার প্রতি দুর্বল হয়ে পরছি? এটা আমি করতে পারি না। কিছুতেই না। আমার জন্য উনার মনে ঘৃণার জন্ম দিতে হবে আমাকে। অনেক ঘৃণা।
— দশ লাখ টাকা দিয়েই হাত পা তুলে নিয়েছেন। এদিকে প্রায় দেড় মাস হয়ে এলো আপনার সাথে থাকছি। যেভাবে চাইছেন নিজেকে সেই ভাবে আপনার সামনে প্রস্তুত করছি। তাহলে টাকা দিচ্ছেন না কেনো আর?
আমার কথায় নির্ঝর খাওয়া বন্ধ করে বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বুঝতে পারছি ভীষণরকম কষ্ট পেয়েছেন আমার কথায়। বুকের ভিতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে আমার কষ্টে। তবুও নিজেকে যথা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার অভিনয় করে যাচ্ছি।
— কি হলো? এভাবে কি দেখছেন? আমার শরীর টা ইউজ করার কথা, প্রতিরাতে ভালোবাসা দেখানোর কথা তো ঠিকই মনে থাকে। তবে আমার পাওনা টাকা দেওয়ার কথা কেনো ভুলে যান?
.
হঠাত নির্ঝর এক ঝটকায় বসা থেকে উঠে দাড়ালেন। মুহূর্তেই উনার চোখ মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। তার চোখে আগ্নেয়গিরির লাভা টগবগিয়ে উঠছে। যেকোনো মুহূর্তেই তার চোখ দিয়ে আগুন ঝড়ে পরবে!
চলবে..
[অতীত অনেকটা ক্লিয়ার করে দিলাম🙆♀️। আপনাদের দোআয় আলহামদুলিল্লাহ অনেকটা সুস্থ আছি। এখন থেকে রেগুলারিটি মেইনটেইন করার চেষ্টা করবো। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। ধন্যবাদ।]