#নেশা
#পর্ব_১৩
#Tabassum_Kotha
” আপনি তো জানেন, নির্ঝরকে এত ভালোবাসার পরেও আমি কেন ছেড়ে দিয়েছিলাম। যেখানে আমার নিজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার সেখানে নির্ঝর কে আমার সাথে জড়ানোটা বোকামি?”
নয়না ম্যামের সামনে দাড়িয়ে কথাটা বলে দম নিলো তৃষ্ণা।
— হ্যাঁ, আমি জানি তুমি কেন নির্ঝরকে ছেড়ে দিয়েছিলে। এজন্যই বলছি আমার ছেলেকে আর কষ্ট দিওনা। চলে যাও ওর জীবন থেকে অনেক দূরে। (নয়না বেগম)
— জানেনতো ম্যাম, ভীষণ কষ্ট হয় নিজের অসম্পূর্ণ জীবন নিয়ে বাঁচতে। আমার অন্ধকার জীবনের সাথে আমি নির্ঝরের কে জড়াতে পারি না। নির্ঝরের জন্য আমি সারাজীবন নিঃসন্তান থাকার অভিশাপ ডেকে আনতে পারি না।
— জানি, এই জন্যই তোমাকে অনুমতি দিয়েছিলাম নির্ঝরের জীবন থেকে সরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি তুমি যাওয়াতে আমার ছেলের কষ্ট বাড়বে। সে তোমাকে পুনরায় নিজের জীবনে ফিরিয়ে আনবে!
— এক বছর আগে, বিয়ের আগের দিন যখন জানতে পারলাম আমি কখনো মা হতে পারবো না সেদিনই নিজেকে নির্ঝরের কাছে থেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। এতো ভালোবাসার পরেও তাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম! আমার কপালে আসলে ভালবাসাই নেই।
— আমি বুঝতে পারি তোমার কষ্টটা তৃষ্ণা।
— না ম্যাম! আমার কষ্টটা আপনি বুঝতে পারবেন না। ইনফ্যাক্ট কেউই বুঝতে পারবে না। মা না হতে পারার কষ্ট,,সারা জীবন বন্ধা থাকার কষ্ট একমাত্র সেই ভালোভাবে বুঝতে পারে যে কখনো মা হতে পারবে না। ঠিক যেমন টা আমি।
— লুক তৃষ্ণা আমি জানি তোমার,,
— ম্যাম আপনি প্লিজ এখান থেকে চলে যান। আমার এখন কারো সাথে কথা বলার ইচ্ছা করছে না। দুঃখিত আপনাকে এভাবে বলার জন্য কিন্তু সত্যি আমার এই মুহূর্তে কারো সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছা হচ্ছে না আপনি প্লিজ এখান থেকে চলে যান।
.
নয়না বেগম কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তৃষ্ণার দিকে একটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে নয়না বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
নয়না ম্যাম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে ঘরের দরজা বন্ধ করে ব্যালকনিতে গিয়ে দাড়ালাম।
.
.
.
.
.
.
এক বছর আগে..
নির্ঝর আর আমার বিয়ের দুইদিন আগে সামান্য পেটে ব্যথার জন্য ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম। ডাক্তার কিছু টেস্ট করতে দিলে, টেষ্ট করতে দিয়ে বাড়ি চলে আসি। একদিন পর বিয়ে, তাও আবার আমার ভালোবাসার মানুষের সাথে। আমার খুশি আর দেখে কে! বুকভরা ভালোবাসা আর স্বপ্ন নিয়ে বিয়ের আয়োজন করছিলাম।
ঠিক তখনই টেস্টের রিপোর্ট হাতে পেলাম। টেস্টের রিপোর্টে ধরা পরল আমি কখনো মা হতে পারব না। রিপোর্ট টা দেখে মনে হয়েছিল আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো! মাথায় আকাশ ভেঙে গেলোও হয়তো এতোটা কষ্ট পেতাম না যা সেদিন পেয়েছিলাম। তাও আবার আমার বিয়ের ঠিক আগের দিন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস তাই না! বিয়ে নিয়ে এত স্বপ্ন দেখছিলাম। পরদিন নতুন করে নির্ঝরের সাথে জীবন সাজাবো! কত স্বপ্ন ছিল আমাদের দুজনের একসাথে বাঁচবো। আমাদের সন্তানেরা আমাদের আম্মু আব্বু বলে ডাকবে। নির্ঝরের সব স্বপ্ন বৈধ ছিল কোন স্বপ্নই অতিরিক্ত চাওয়া ছিলনা। অপূর্ণতা তো আমাকে ঘিরে রয়েছে। আমি নির্ঝরের কোন স্বপ্ন পূরণ করতে সক্ষম ছিলাম না। মা হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। একটা মেয়ে পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠে সন্তান জন্ম দিয়ে। আর আমার তো সেই ক্ষমতাই ছিল না সন্তান জন্ম দেওয়ার। একজন পরিপূর্ণ নারী হওয়ার ক্ষমতা আমার কখনোই হবে না। যেখানে আমি নিজেই অপূর্ণ সেখানে নির্ঝরকে পূর্ণ করব কিভাবে?
.
নির্ঝরের জীবন থেকে চলে যাওয়া উচিত আমার। তাকে আমি সন্তানের সুখ কখনো দিতে পারব না। তাকে সন্তানের সুখ একমাত্র স্নিগ্ধা দিতে পারবে। তার সাথেই উনার ভবিষ্যৎ আছে। আমার সাথে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। নির্ঝর আমার ভালোবাসা তাকে আমি অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে পারিনা। ভালোবাসার জন্য তো মানুষ জীবন দিয়েছে আমি কি আমার সুখ টুকু বিসর্জন দিতে পারব না!
.
এক বছর আগে বিয়ের আগের দিন যেদিন প্রথম নির্ঝর কে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম,, জানতাম নির্ঝর রাগ করবেন.. আমাকে ঘৃণা করবেন। হয়তো সেদিনের পর থেকে আমার চেহারাও দেখতে চাইবেন না। কিন্তু তবুও মনে একটা শান্তি ছিল যে নির্ঝর হয়ত সুখে থাকবেন। কাউকে বিয়ে করে স্যাটেল হয়ে যাবেন লাইফে। আর অনেকগুলো বাচ্চা হবে নির্ঝরের আর তার বউ এর।
নিরঝরের আগে থেকে বাচ্চা খুব পছন্দ ছিল। প্ল্যানিং করেছিলেন তিনটে বাচ্চা নেবেন। এক বছর আগে ভেবেছিলাম তার সব স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তু নির্ঝর আমার প্রতি তার ঘৃণা কে প্রাধান্য দিয়েছেন। এই এক বছর তিনি নিজের মনে আমার জন্য ঘৃণা আর প্রতিশোধের মনোভাব পুষে রেখে নিজেকে কষ্ট দিয়েছেন।
যে কারণে তাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম সেই কারণ তো কখনো সফলই হয়নি। উল্টো আমার উপর প্রতিশোধের মনোভাব পুষে রেখে নিজের জীবন নষ্ট করেছেন। উনাকে কিভাবে বলবো আমি উনাকে কখনো সন্তানের সুখ দিতে পারবো না? আমাকে জীবনসঙ্গী বানিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য সুখী হলেও সারা জীবনের কষ্টের ভাগী হতে হবে তাকে।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
” আই ওয়ানা টক টু ইউ।”
ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম আচমকা স্নিগ্ধার কন্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকালাম।
দুই হাত একসাথে গুঁজে ব্যালকনির কাচের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধা।
— কিছু বলবেন স্নিগ্ধ। (তৃষ্ণা)
— তুমি আমার নির এর জীবন থেকে চলে যাও তৃষ্ণা।
— আমি নির্ঝরের জীবনে থাকতে আসিনি। কন্ট্রাক্ট এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেই চলে যাবো। আর দেড় মাসের মতো বাকি আছে।
— আমি অত দিন অপেক্ষা করতে পারব না। নির্ঝর ক্রমেই তোমার ওপর দুর্বল হয়ে পড়ছে। ঠিক এই মুহূর্তে তুমি নির্ঝরের জীবন থেকে না গেলে নির্ঝর কখনো তোমাকে ভুলতে পারবে না। তুমি কি চাওনা নির্ঝর আমার সাথে সুখে থাকুক?
— আমি নির্ঝরের সুখ চাই বলেই এতকিছু করেছি। এক বছর আগে তাকে ছেড়েছি, যে কিনা আমার প্রাণ ছিল। জীবন ছিল নির্ঝর আমার। আমার প্রথম ভালোবাসা তবুও তাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ তার সুখটাই আমার কাছে সবকিছু।
— তাহলে সে সুখের জন্যই নির্ঝর কে পুনরায় ছেড়ে দাও। আমার সাথে নির্ঝর অনেক সুখে থাকবে। কারণ নির্ঝরকে আমি সন্তানের সুখ দিতে পারব, যেটা তুমি পারবেনা।
— হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন আমি পারবো না নির্ঝরকে সন্তানের সুখ দিতে। কিন্তু আপনি কেনো নির্ঝরকে আমার মত কেউ ভালবাসতে পারবে না।
— সেটা আমার দেখার বিষয় না। আমি শুধু চাই তুমি নির্ঝরকে ছেড়ে চলে যাও। আর এটাই মোক্ষম সময়, আজকেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। নির্ঝর এখন বাড়িতে নেই,, আমি সবটা ম্যানেজ করে নেব। এক বছর আগেও নির্ঝরকে আমি সামলে ছিলাম। এখনও সামলে নেব। তুমি শুধু চলে যাও আমাদের জীবন থেকে, আমাদের একটু সুখে থাকতে দাও।
কিছু বলছি না। শুধু চুপচাপ টলমল চোখে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে আছি। নির্ঝরের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি। আর আমি নির্ঝরের অতীত। এমন একটা কালো অতীত যেটা নির্ঝরের ভুলে যাওয়াই সব থেকে ভালো।
— আচ্ছা, আমি চলে যাচ্ছি তুমি তোমার জিনিসপত্র গুলা গুছিয়ে নিও, কেমন? নির্ঝর বাড়িতে আসার আগেই বেরিয়ে গেলে ভালো হবে। না হলে তোমাকে যেতে দেবে না। ইমোশনাল করে তোমাকে থামিয়ে দেবে। তারপর আমাদের বিয়েটা আর হবেনা। তুমি প্লিজ আগে চলে যাও এদিকটা আমি সব সামলে নেব।
.
স্নিগ্ধা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি এখনো ব্যালকনিতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। জীবনের চূড়ান্ত নির্ণয় এসে দাঁড়িয়েছে। তন্ময় এর কাছে আমি ফিরে যাব না। কখনোই না। তন্ময়ের মত একটা প্রতারক, চরিত্রহীন এর কাছে ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয়না। হয়তো মা হওয়ার সুখ আমার জীবনে কখনোই আসবেনা। তিতলিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম কিন্তু শেষ অবলম্বন টুকু আর পেলাম না। এই জীবন নির্ঝর আর তিতলিকে ছাড়াই কাটাতে হবে, তাদের দুজনের ভালোর জন্য। তিতলি কে পেতে হলে তন্ময় এর কাছে ফিরতে হবে। কিন্তু আমি তন্ময়ের কাছে ফিরতে চাই না, তার মত একটা প্রতারক এর কাছে ফিরে বাকি জীবনে নরক পোহাতে চাই না।
জন্মের পরে মা বাবা একা ছেড়ে দিয়েছিল সেই একা জীবনই সব সময় কাটাতে হবে। যে সন্তান মা-বাবার কাছে আনওয়ান্টেড হয় সেই সন্তানের ভাগ্যে সুখ কিভাবে আসবে?
.
নির্ঝরের আলমারি থেকে নিজের সব জিনিসপত্র নামিয়ে এনে একে একে গুছিয়ে নিলাম। আজই শেষ দিন আমার এই বাড়িতে। এখনই চলে যেতে হবে আমার এখান থেকে। ঠিক বলেছে স্নিগ্ধা আজ যদি আমি এ বাড়ি থেকে না যাই তাহলে হয়তো নির্ঝর কখনোই যেতে দেবেন না। নিজের ভালোবাসার জালে আবার আমাকে আটকে ফেলবেন। কিন্তু আমি তো কোন জালে আবদ্ধ হতে চাই না। নির্ঝর সারাজীবন তার পরিবার নিয়ে সুখে থাকবেন এর থেকে সুখের আমার কাছে আর কি হতে পারে। কিছু কিছু ভালোবাসা কখনো পূর্ণতা পায়না। আমার আর নির্ঝরের ভালোবাসা ও তেমন, কখনো পূর্ণতা পাবে না। আমাদের ভালোবাসা কোন সম্পর্কের নাম না পেলেও সবসময় এতটাই গভীর থাকবে। আমি চাই নির্ঝর আমাকে ভুলে যাক কিন্তু আমিতো তাকে কখনো ভুলতে পারবো না।
আমার মনের ভিতরে না হয় আমাদের ভালোবাসা জীবিত থাকুক। আমার স্মৃতিতে আমি আর নির্ঝর একসাথে থাকব। এই দেড়মাসের সম্পর্কের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আমি আমার বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব। আর নির্ঝর স্নিগ্ধার সাথে সুখে থাকবেন তার সন্তান সন্ততি নিয়ে। আমার ভালোবাসা দিয়ে নির্ঝরকে পরিপূর্ণ করে দিয়ে যাব। আমি না হয় অপূর্ণই থেকে গেলাম।
.
.
.
.
.
.
জিনিসপত্র গোছানো হয়ে গেছে। লাগেজটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নামছিলাম,, ঠিক তখন নির্ঝর কোথায় থেকে এসে আমার হাত চেপে ধরলেন। নির্ঝরের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, মুখটা শুকিয়ে গেছে হয়তো সারারাত ঘুমাইনি। উনি এত শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরেছে যে আমার হাতে ব্যথা লাগছে।
চলবে..