[প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত]
-“আমার বয়ফ্রেন্ড আমার সাথে ব্রেকআপ করে নিয়েছে, কারণ আমি ওর জন্য কাপড় খুলতে পারিনি, ওর সাথে শুতে পারিনি, ওর নোংরা সব কথা কিংবা চাহিদার সাথে তাল মেলাতে পারিনি। ওর ভাষ্যমতে আমি নাকি বরফ; অথচ বরফের মতন আচরণ করিনি। খুলে বলতে গেলে—আমি কেন তার অশ্লীলতায় লজ্জা পাইনি, ছুঁতে গেলে গলে পড়িনি।”
একাধারে এতগুলো কথা বলে থামল নৈশী। গভীর শ্বাস ফেলে উলটো দিকে বড়ো-বড়ো চোখে তাকিয়ে থাকা আয়াতকে একবার দেখল। আয়াত শুকনো ঢোক গিলে বলল,
-“এবারও? আচ্ছা, এরপর?”
নৈশী ঠোঁট উলটে বলল,
-“অতঃপর আমার তৃতীয় ব্রেকআপ। আচ্ছা আয়াত, ওদের এত ডিমান্ড কেন?”
-“থাক নিশু, বাদ দে। শোন, তৃষ ভাইয়া আসবে আজ।”
-“কে যেন?”
-“আমার বিদেশিনী কাকির ছেলে।”
সরু চোখে তাকিয়ে নৈশী বলল,
-“কোনটা?”
আয়াতের রাগ লাগল। কোলের ওপরের কুশনটা নৈশীর মুখের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল,
-“বাল, বুঝোস না? ঢং মারাস?”
-“চেতিস কেন? সত্যিই মনে করতে পারছি না। দিন গেলে নিজের নামই ভুলে যাই, আর ওটা তো কবে না কবেকার খাওয়া একটা ক্রাশ।”
-“হুহ! ক’বছর আগে যার চোখ দেখে ফিদা হয়ে অবশেষে তোর সিঙ্গেলশিপের খ্যাতা পুড়িয়ে প্রথমবারের মতো রিলেশনশিপে গেলি, সেই কিউট পোলাটা আমার তৃষ ভাইয়া।”
চোখ বড়ো বড়ো করে সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নৈশী। হাতের পপকর্নসহ কুশন—দুটোই নিচে পড়ে গেছে। আয়াত চোখ-মুখ কুঁচকে বিরক্তিসূচক ‘চ’ শব্দ করল। নৈশী বলে উঠল,
-“সিরিয়াসলি?”
-“নাহ। আমি হুদাই বলছি। মজা করে। মজা পাইছিস?”
নৈশী বসে পড়ে বলল,
-“একটুও পাইনি। তবে এক্সাইটেড হয়েছিলাম খুব।”
-“কেন? এবার এলে কী প্রপোজ করে বসবি?”
-“না, বাপ! এদেশের ছেলেরাই যে এডভান্স! রিলেশনে যেতে না যেতেই লিটনের ফ্ল্যাটে ডাকে, ফোনসে*-এর জন্য ইনসিস্ট করে। এদের সাথেই রিলেশনে যাওয়া যায় না! আর তোর ভাই তো ফোরেইনার। কলিজায় এত জোর নেই ভাই আমার।”
-“এ রে! তোর না ক্রাশ ছিল?”
-“ছিল, আছে। ক্রাশ যে কেউ হতে পারে। আমি তো তিন বাচ্চার বাপ শাহরুখ খানের ওপরও ক্রাশড; ব্যাটায় বিয়াত্যা, আবার আমার বাপের বয়সী। তাই বলে কি তাকে বিয়ে করব? ব্যাপারটা তা নয়। ভালো লাগে, লাগতেই পারে।”
-“তোর ভালো লাগার মাইরি বাপ, বা..”
-“দেখ, আয়াত! আবার মুখ খারাপ করবি না।”
-“করব। তোর কী?”
-“করবি না বললাম।”
-“করতেছি দেখ।”
-“একদম না।”
আয়াত জোরালো আওয়াজে বলে উঠল,
-“বাআআআআআল।”
-“ছি! অশ্লীল!”
মুখ কুঁচকে ফেলল নৈশী। ফিক করে হেসে দিয়ে আয়াত বলল,
-“হ্যাঁ, শোন। তৃষ ভাইয়া এবার সত্যি সত্যিই আসবে।”
-“হঠাৎ?”
-“দাদুমণি অসুস্থ না? কাকাই-কাকিমণির সাথেই আসবে।”
-“আচ্ছা, বুঝলাম। আসার পর বলিস, একবার ক্রাশকে দেখে দু’চোখ ধন্য করে আসবনি। এবার মুভি দেখ, আমিও দেখি। কতটা মিস করে গেলাম!”
____
তাজওয়ার তৃষ্ণা সরকার। জন্ম, বেড়ে ওঠা, বড়ো হওয়া—সবটা বিদেশের মাটিতে হলেও, প্রতি বছরের সবচেয়ে বড়ো ছুটিটা সে কাটায় দেশমায়ের কোলে। ডাক্তারি পড়েছে। তার মতে—উন্নত রাষ্ট্রে তার চেয়েও বেটার অনেক মানুষ আছে, সেখানে সে পর্যাপ্ত দাম পাবে না কিংবা তার শিক্ষাকে উপযুক্ত কাজে লাগাতে পারবে না।
তাই অনেকটা সময় সে এদেশে কাটিয়েছে; দেশকে কাছ থেকে দেখেছে, জেনেছে, বুঝেছে। এবার খুব জলদি এখানে স্থায়ী হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা। নিজের জ্ঞানকে সে এদেশের কাজে লাগাবে।
তৃষ্ণার ব্যাপারটা নৈশীকে জানানোর পর এগারোটা দিন কেটেছে। তৃষ্ণা বাড়ি ফিরেছে আজ সকালেই। তার আগমনের কথাটা আয়াত নৈশীকে জানায়নি। বরাবরের মতো বিকেল হতেই এ বাড়িতে চলে এলো নৈশী। বাড়ির সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত। সে হেলে-দুলে আয়াতের রুমে চলে গেল। আয়াত ফোনে কথা বলছিল। নৈশী পিছে থেকে হুট করেই বলে উঠল,
-“কী রে? কে রে?”
আয়াত থতমত খেয়ে গেল। ফোনটা পড়ে যেতে নিয়েও গেল না, সামলে নিয়ে বলল,
-“তোর দুলাব্রো লাগে। কথা বলবি?”
মাছি তাড়ানোর মতো করে মুখের সামনে হাত নাড়ায় নৈশী, চোখ-মুখ কুঁচকানো। বিরক্তি নিয়ে বলল,
-“ছি! আর কয়টাকে আমার দুলাভাই বানাবি। থাক তুই, বারান্দায় গেলাম আমি।”
আয়াত ফের কথা বলা শুরু করল। নৈশী বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ভীষণ বাতাস, সাথে কদমের ঘ্রাণ। আকাশে ছিমছাম মেঘ। ওদিকে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ; পুরোটা সবুজ, কেবল মাথার ওপরের দিকে কিছু লাল পাপড়ি। কী সুন্দর লাগছে তার! তার চেয়েও সুন্দর লাগছে ঠিক ওপরের ভাসমান কালচে মেঘগুলোকে। ক্ষণে ক্ষণে ডেকে উঠছে। নৈশী গায়ের ওড়না ভালোমতো পেঁচিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরল।
তখনই কানে শুদ্ধ বাংলা অ্যাকসেন্টে কিছু শব্দগুচ্ছ এসে বাড়ি খেল,
-“এভাবে ঘুরো না, মেয়ে।”
নৈশীর কানে কথাগুলো ঘুরতে লাগল খালি বাড়িতে ফেলে দেওয়া একটা ছোট্টো ঝুমুরের ঝুনঝুন আওয়াজের মতো। এভাবে ঘুরো না! কেন ঘুরবে না? কোথায় ঘুরবে না? যুবতী মেয়েটা কি কারো মনে এক্কাদোক্কা খেলছে নাকি? ঘুরতে মানা করল কেন? নাকি অন্য কিছু? এই এতটুকু কথা দ্বারা কত কিছু বোঝায়! কত কিছু!
আওয়াজটা আবারও এলো,
-“ওপাশে ভাঙা কাঁচ আছে।”
বোঝাবুঝির গান শেষ হতেই নৈশীর কল্প-মস্তিষ্ক ঘুমে গেল, বাস্তবিক অর্থেই সে জেগে উঠল। সরু চোখে ও-পাশের বারান্দায় তাকাল। বর্ষার ঝড়োয়া হাওয়া, কদমের ঘ্রাণ, আর মন মাতাল করে দেওয়া সেই নীলাভ দৃষ্টিতে হাসি দেখে নৈশীর মনে শুরু হয়ে গেল আদিম খেলা; কী খেলা—তা বলা বাহুল্য নয়। লোকটা কফিমগে চুমুক দিয়ে পেছনের চুলে ব্যাকব্রাশ করতে করতে রুমের ভেতর ঢুকে গেল। তার আগে একটা কথা বলল আবছা ঠোঁট নেড়ে; আওয়াজ হলো না।
ঠোঁটের ক্ষণিকের খেলায় নৈশীর বুঝতে সময় লাগল। বুঝে আসতেই গা শিরশির করা লজ্জায় সে নুইয়ে পড়ল। কান হয়ে সোজা বুকে লাগল কথাটা। প্রতিটা স্পন্দনের সাথে সমান তালে প্রতিফলিত হচ্ছে ভদ্রলোকের আওয়াজবিহীন বাক্যটা—হাসিটা ভয়ঙ্কর।
নৈশীর মনের অভ্যন্তরে কিছু একটা ঘটল; অজানা কিছু, অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু। মনের অতি গোপনের প্রেমসায়রে খেলে গেল জলতরঙ্গ। কানে বাজতে লাগল রঞ্জয় ভট্টাচার্যের লেখা সেই গান—প্রেমে পড়া বারণ, কারণে অ-কারণ…
সময় এগোচ্ছে, দৌড়াচ্ছে। কথা শেষে আয়াত বারান্দায় এসে নৈশীকে মুগ্ধ হয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভীষণ রকমের অবাক হলো। ক্ষণমাত্র আগে প্রেমিকের মুখে বলা কথাটা মনে পড়ল, এ-ই ছিল—প্রেমের রঙ লাল; প্রেমে পড়া মানুষের জন্য কৃষ্ণচূড়াতে মুগ্ধতা খোঁজা অতি আবশ্যক ব্যাপার। অথচ আয়াত খেয়াল করল না—নৈশীর দৃষ্টি অন্যত্র।
বিস্মিত আওয়াজে আয়াত বলে উঠল,
-“নিশু, কী হলো?”
-“তুই বলিসনি আমায়—আজ বাড়িতে কেউ এসেছে।”
আয়াত লক্ষ করল নৈশীর অন্যমনস্কতা। শুধাল,
-“হ্যাঁ, এসেছে। তাই কী হয়েছে?”
-“মরন হয়েছে। বুঝবি না। বাড়ি যাব।”
-“তুই কি তৃষ ভাইয়াকে দেখেছিস?”
-“দেখেছি।”
-“কোথায়?”
-“বারান্দায়।”
-“কথা হয়েছে?”
-“না।”
-“আয়, কথা বলিয়ে দিচ্ছি।”
তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল নৈশী, গম্ভীরমুখে বলল,
-“ইচ্ছে করছে না। বাড়ি যাব।”
-“হঠাৎ কী হলো?”
-“কিচ্ছু হয়নি।”
দরজায় করাঘাতে দুজনেই সচকিত হলো। আয়াত গিয়ে দ্রুতপায়ে দরজা খুলল। ওপাশে তৃষ্ণা দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করল,
-“কী করছ?”
আয়াত হেসে বলল,
-“এমনিই গল্প করছিলাম, ভাইয়া। তুমিও আমাদের জয়েন করো।”
নৈশীও রুমের ভেতরে এলো। তৃষ্ণা এগিয়ে গিয়ে তার দিকে তাকাল। থেমে থেমে শুধাল,
-“না–ম?”
নৈশী একবার তৃষ্ণার দিকে তাকাল, এরপরে নতমুখী হয়ে জবাবে বলল,
-“নিশীতা রহমান নৈশী।”
-“ভালো।”
যখন নৈশী প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে প্রতিমুখে দণ্ডায়মান পুরুষের চোখের নীলতারায় দৃষ্টি গোপন রেখে তাকাচ্ছিল, আয়াত অতি আবেগে বিবেকহীনতা প্রকাশ করল ঠিক তখনই,
-“ভাইয়া, নিশু তোমাকে পছন্দ করে। লাস্ট টাইম যখন বিডিতে এলে, তখন ক্রাশ খেয়েছিল। একটু আলাপ করো ওর সাথে। ওর খুব ভালো লাগবে। আমি তিনকাপ কফি নিয়ে আসি। থাকো।”
তৎক্ষনাৎ তৃষ্ণা নৈশীর দিকে তাকাল আর নৈশী তৃষ্ণার সহাস্য চোখপানে। থতমত খেয়ে যাওয়া মেয়েটির দিকে তাকিয়েই তৃষ্ণা বলল,
-“দু-কাপ। আমার জন্য এনো না, আমি খেয়েছি সবে।”
____
বারান্দায় দক্ষিণমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তৃষ্ণা আর নৈশী। কেউ কোনো কথা বলছে না। নৈশীর খুব অস্বস্তি লাগছে। সরে যেতে চাইছে, কিন্তু সে হচ্ছে ভদ্র-সদ্র বাচ্চা; এভাবে সরে পড়া যায় না।
জড়তা নিয়ে নৈশী দু’হাত একটি-অপরটির সাথে খানিকটা ডলল। সামান্য কেশেও উঠল। তৃষ্ণা তখন অবিলম্বে বড্ড দৃঢ় গলায় বলে উঠল,
-“তুমি কি আমাকে প্রপোজ করতে চাইছ? এনি হাউ পারছ না। হেল্প করব?”
#নৈশতৃষ্ণা
#পর্ব_১
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
শব্দসংখ্যা-১৩৩৯
চলবে?
[সবাই মন্তব্য করবেন❤️]
আজ থেকে ঠিক এক বছর আগেই তৃষ্ণা চরিত্রের জন্ম হয়েছিল। ওকে নিয়ে লেখার প্ল্যান পুরো বছর ঘুরে এই আজকেই এলো। ছোটো একটা গল্প হবে। ভালোবাসা নেবেন!