নৈশতৃষ্ণা #পর্ব_২ #লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

0
1289

#নৈশতৃষ্ণা
#পর্ব_২
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

-“তুমি কি আমাকে প্রপোজ করতে চাইছ? এনি হাউ পারছ না। হেল্প করব?”

নৈশীর কাশির তেজ বাড়ল। তৃষ্ণা অনিমেষ তাকিয়ে আছে, ভাব-ভঙ্গি বেশ নির্বিকার। মেয়েটির প্রতিক্রিয়া দেখে সে বলল,
-“জাস্ট কিডিং। কথা বলছ না বলে বললাম।”

এবার যেন স্বস্তি পেল সে। ছোট্ট করে দম ফেলে বলল,
-“ও আচ্ছা!”

আবারও সব চুপচাপ। নৈশী কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলে উঠল,
-“এত ভালো বাংলা উচ্চারণ কী করে জানেন?”
-“শিখেছি। বাবা বাঙালি, এজন্য ছোটো থেকেই সব জানি। কিন্তু বলতে পারতাম না। পরে কিছু কোর্স করি, ধীরে ধীরে শিখে যাই।”
-“আমার চেয়েও ভালো বলতে পারেন।”

তৃষ্ণা এদিক-ওদিক তাকিয়ে শুধাল,
-“প্রিয় ফুল কোনটা?”
-“ফুল ভালো লাগে না।”
-“ইন্ট্রেস্টিং!”
-“আপনার?”
-“সেম।”
-“কী ভাল্লাগে?”
-“নিজেকে। আ’ম অবসেসড উইথ মাইসেল্ফ!”
-“আমিও।”

নৈশী তাকিয়ে থাকল তার দিকে। তৃষ্ণা অন্যদিকে চোখ রেখেই বলল,
-“পুরুষ মানুষকে এত দেখতে নেই।”
-“দেখলে কি সৌন্দর্য কমে যাবে?”

হাসি পেল তৃষ্ণার। ঠোঁট কামড়ে নিয়ে বলল,
-“না।”
-“তবে?”
-“জড়িয়ে যাবে, মেয়ে।”
-“কীসে?”
-“মায়ায়। পুরুষ মানুষের প্রতি মায়া হয় ভয়ঙ্কর। সহজে নারীরা পুরুষের মায়ায় আটকায় না। একবার আটকালে, জীবন চলে যায়; সে পুরুষকে ভোলা যায় না।”

নৈশী পিটপিট করে তাকাল। তখনই আয়াত চলে এলো। তৃষ্ণার একটা কল আসায়, সে-ও প্রস্থান ঘটাল। নৈশী সে-বাড়িতে এলো না এরপরের চৌদ্দদিন।

____
পনেরো দিনের মাথায় তার মা রুমে এসে জানায়, তাকে দেখতে আসবে আজ। নৈশী অবাক হলো না। বিয়ের বয়স হয়েছে, অবশ্যই বিয়ে দেবে। তৈরি হয়ে নিল। বরাবরের মতো কানে বাজতে লাগল সে কথাটি—এভাবে ঘুরো না, মেয়ে।
আচ্ছা, তার মনে কি এখনও ঘুরছে সে। কী যেন! কে জানে!
মায়ের কথামতো চটপটে রেডি হয়ে নিল। চাচাতো বোন তার হাতে চা-সন্দেশের ট্রে ধরিয়ে নিয়ে বসার ঘরে এলো। নৈশী চুপচাপ ট্রেটা টেবিলে রেখে নতমুখী হয়ে দাঁড়াল। পাত্রের ছোটো কাকি তাকে সামনে বসার জায়গা করে দিলেন। নৈশী ভদ্র মেয়েলোকের মতো করে বসল; আদতে সে তা নয়।

ভদ্রমহিলা মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
-“আম্মু, কেমন আছ?”

নতমুখী হয়ে মিনমিনে স্বরে বলল,
-“আলহামদুলিল্লাহ ভা..”

কথা থেমে গেল। এতক্ষণে আওয়াজটা চেনা লাগল তার। চকিতে সামনে তাকাল। পাত্রের কাকিবেশে প্রিয় বান্ধবী আয়াতের মা’কে বসে থাকতে দেখে সে যারপরনাই অবাক হলো। অবাকের রেশ কাটছে না। একপাশে গম্ভীরমুখো হয়ে তৃষ্ণা বসে বসে ফোন স্ক্রল করছে।
নৈশীর বিস্মিত নেত্রের সামনেই তার বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে গেল। তৃষ্ণা সবার অগোচরে তার বাবাকে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“একটু আলাদা কথা বলানোর ব্যবস্থা করো।”

আশরাফ সাহেবও ফিসফিসিয়ে বললেন,
-“লাজলজ্জাহীন ছেলে, বাপকে এসব বলে? ওপাশে তোর কাকাতো ভাই আছে। ওকে বল।”
-“ও কি আমার বউয়ের সাথে আমার কথা বলাটা ম্যানেজ করে দিতে পারবে? হেল্প লাগবে বড়োদের। আমি এত দিক ঘুরে কেন বউয়ের কাছে যাব? তাই সোজা তোমাকে বললাম।”

চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললেন আশরাফ সাহেব। নৈশীর আম্মু জিজ্ঞেস করলেন,
-“ভাইয়া, কোনো সমস্যা হচ্ছে?”

কুঁচকানো মুখ শিথিল হলো আশরাফ সাহেবের। হেসে উঠে বললেন,
-“না, না! বলছিলাম—ছেলে-মেয়েরা এখন একটু একান্তে বোঝাপড়া করে নিলে ভালো হয় না?”

প্রস্তাবে ওদিক থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে নৈশীর সাথে তৃষ্ণাকে ছাদে একান্ত আলাপের জন্য পাঠানো হয়। মুখোমুখি দুজন দুটো চেয়ারে বসে আছে। কথা শুরু করল তৃষ্ণা,
-“ভালো লেগেছে?”

কথার একটা তাল প্রয়োজন ছিল, সে-তালেরই অপেক্ষায় ছিল। ও-পাশ থেকে কথা আসতেই, ফুঁসে উঠল নৈশী,
-“কী ভালো লাগবে? এটা কোনো ঘটনা ঘটিয়েছেন!”
-“আমি মাত্র ঘটা কোনো ঘটনাকে কেমন লেগেছে, তা জিজ্ঞেস করিনি। ওটা আমার ভালো লেগেছে, আমার ভালো লেগেছে মানে সব ঠিক আছে। তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি—বর পছন্দ হয়েছে?”
-“বর? কার বর?”
-“তোমার বর।”
-“কে?”
-“আমি। আর কে?”

প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে নৈশী নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে দু’হাত সামনে রেখে বলল,
-“বিয়ে হয়নি, হ্যাঁ?”
-“হয়ে যাবে।”

দায়সারা কথাবার্তা তৃষ্ণার। নৈশী শুধাল,
-“আমরা একে-অপরকে চিনিও না।”
-“চিনে যাব।”
-“হঠাৎ এসব?”
-“লাইফ স্মুদলি চলে না। কিছু সময় ঘটনা এদিক-ওদিক হয়। হঠাৎ হঠাৎই হয়। কেন? আমাকে না তোমার খুব পছন্দ ছিল? ক্রাশড ছিলে!”
-“লাইফে দুই-চারটা ক্রাশ কম-বেশি সবারই থাকে। আপনাকেও ভালো লাগে। ভালো তো ভাই পাকিস্তানি এক্টরদেরও কম লাগে না। তাই বলে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছি? একদমই না।”

-“আচ্ছা।”
-“কী আচ্ছা?”
-“বাবাকে বলব—বিয়ের ডেটটা সামনের মাসের বদলে যেন সামনের সপ্তাহে রাখে। বউটা ঘাড়ত্যাড়ামি করে পালিয়ে যেতেও পারে। আমার বউ বলে কথা। আজগুবি কাজে পারদর্শী অবশ্যই সে হবে।”

পুরোই যা-তা! নৈশীর মুখমণ্ডল এখন সেন্টি ইমোজির মতো, কেবল জন্ডিস হয়নি বলে হলদেটে দেখাচ্ছে না। তৃষ্ণা ফোন বের করে বলল,
-“তোমার কনট্যাক্ট নাম্বারটা দাও তো।”
-“হুঁ?”
-“কনট্যাক্ট নাম্বার!”
-“কেন দেবো?”
-“আচ্ছা, লাগবে না। আমি শাশুড়ি আম্মুর কাছ থেকে ম্যানেজ করে নেব।”

তৃষ্ণা উঠে দাঁড়াল চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। নৈশী হতবিহ্বল নেত্রে সেদিকে তাকাল। বর্ষা ও শরতের একটা সম্মিলিত রূপ। এরূপ আকাশের নিচে একটা ছোট্টো নারী শরীর ভাবুক চোখে তৃষ্ণাকে দেখে যাচ্ছে। তাতে তৃষ্ণা আকস্মিকভাবে ঝুঁকে এসে নৈশীর নাকের ডগায় আলতো করে চুমু খেল। দূরে সরতে সময় নিল অনেকটা। ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

-“তুমি আমার বায়ান্ন তাস, শেষ দানেও আছি,
তোমার নামে ধরেছি আমার সর্বস্ব বাজি।”

নৈশী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে। হুশে আসতে আসতে তৃষ্ণা সেখান থেকে প্রস্থান ঘটাল। কথাগুলো কানে বাজতে লাগল অন্তর্নিহিত কোনো এক সুরের মতো। কী বাজি ধরেছে—কেবল তা-ই বুঝল না।

_____
ইদানিং নৈশীর সাথে কী হচ্ছে, কিছুই সে বুঝতে পারছে না। জীবনটা কীভাবে কীভাবে যেন এগোচ্ছে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। হুট করেই তার এলোমেলো জীবনটা তৃষ্ণার আগমনে বিধ্বংসী আচরণ শুরু করেছে। কখনও উলটোচ্ছে, কখনও বা সব যাচ্ছে যাচ্ছে। এই তো, সামনেই বিয়ে। তাও তৃষ্ণার সাথেই। সে তৃষ্ণাকে পছন্দ করে, কেবল পছন্দই। আর কিছু না। কিন্তু..
যাকে নিয়ে নৈশী চিন্তা-চেতনায় মেতে ছিল, বাস্তবিকপক্ষেই এখন তার কল এলো। নৈশী চিনতে পারল না, রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বলে উঠল,

-“রাত দেড়টা। আর তুমি ঘুমোওনি। আমি কি ধরে নেব—তুমি আমার অপেক্ষায় জেগে ছিলে?”
-“তৃষ্ণা ভাইয়া?”
-“তৃষ্ণা!”
-“নাম্বার পেলেন কোথায়?”
-“শাশুড়ি আম্মু দিয়েছে।”

-“বিয়েটা ক্যান্সেল করে দিন।”
-“ত্রুটি বের করো। আমাকে বিয়ে না করার জাস্ট একটা কারণ দেখাও..”
-“তবে কি বিয়েটা ক্যান্সেল করে দেবেন?”
-“না, আমি সেই কারণটাই মুছে দেবো।”

-“আপনাকে বিয়ে না করার মতো কোনো কারণ নেই। নিঃসন্দেহে আপনি ভীষণ উপযুক্ত কেউ। নয়তো এত জলদি আমার ফ্যামিলি আমাকে বিয়ে দিয়ে দিত না। তবে..”
-“হু-উম?”

-“ভালোলাগা নিয়ে এগোতে চাইছি না।”
-“ভালোবাসাও হয়ে যাবে, নট অ্যা বিগ ডিল।”
-“ভালোবাসা এত সহজ না, এত সহজে হয় না।”
-“ওকে, না হলে না হবে।”

-“আপনি কি সত্যিই বিয়েটা করতে চাইছেন?”
-“চাইছি।”
-“কেন?”
-“যেই মেয়েটা ফুল পছন্দ করে না, আমার সেই মেয়েটাকে ভালো লেগে গেছে। যেই মেয়েটা তীক্ষ্ণ নজরে আমার চোখের নীল তারাতে চোখ রাখতে ভড়কে যায় না, তাকে আমার মনে ধরে গেছে। যেই মেয়েটার দৃষ্টি কৃষ্ণচূড়াকে পাশ কাটিয়ে আঁধার মেঘে গিয়ে থামে, সেই মেয়েটাতে আমার নিঃশ্বাস থমকেছে। আর শেষ-মেষ! মেয়েটা মনের আঙিনায় ধীরপায়েতে ঘোরা শুরু করেছে। তাকে নিজের করে না পেলে বোধহয় লাইফে বড়ো কিছু মিস করে যাব।”

-“আমিই কেন?”
-“কারণ এটা তুমি।”
-“তবে হোক বিয়ে।”
-“তুমি কি খুশি নও?”
-“যদি বলি—না?”
-“আচ্ছা।”
-“কী?”
-“জীবনে যা যা চেয়েছি, সব পেয়েছি। উপোষে হোক কিংবা আপোষে, যা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ ছিল, তা-ও আমি নিজের করে নিয়েছি। আর তুমি তো বড়োই আকাঙ্খিত! পাব না বলছ?”

চলবে..
শব্দসংখ্যা-১৩৪২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here