নোটবুক❤,পর্ব-১
লেখনীতেঃ কথা চৌধুরী
রাত সাড়ে এগারোটা। চারদিক ছেয়ে আছে নিস্তব্ধতায়। রাতের গভীরতা বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়েই যেন বাড়ছে নিস্তব্ধতা। দুইতলা বাড়িও চুপচাপ কেবল দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সদস্যরা তলিয়ে আছে ঘুমের দেশে। কেবল ছোট্ট একটা রুমে জ্বলছে ক্ষীণ আলো। টিমটিমে আলোকে সঙ্গী করে বেজে চলেছে গান,
“আজ কেন এ মনে ভালোবাসা
উঁকি দেয় লুকোচুরির মতো
যদি থাকো এই আমার কাছে
আমি থেকে যায় অবিরত
সাদা মেঘের বর্ষা তুমি
আমি বৃষ্টি ভেজা রাত।”
গানের সাথে রাতের পরিবেশের কোনো সম্পর্ক নেই আজ। বৃষ্টির পরিবর্তে বরং আকাশে ঝলমল করছে পূর্নিমার চাঁদ। রুমের মধ্যে, ক্ষীণ আলোয় মশারী টানাতে ব্যস্ত দু’টো লতা কোমল হাত। সম্পূর্ণ মনোযোগ গানের সুরে নিমজ্জিত করে বর্ষা নিজের কাজ করে চলেছে।
রাত গভীর থেকে আরও গভীর হচ্ছে। তাই নিদ্রা যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে বর্ষা। মশারী টানানো প্রায় শেষ হতেই ফোনের টুং আওয়াজ কানে এলো তার। খানিকটা চমকে গিয়ে ভাবতে লাগলো, “এতো রাতে আবার কে ম্যাসেজ দিলো?”
মনে জাগ্রত হওয়া প্রশ্নের সন্ধান করতে ফোন হাতে নিলো বর্ষা। দেখলো কেউ একজন জবাব দিয়েছে, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কে আপনি? মানে আপনি কি আমার পরিচিত কেউ?”
গোধূলি লগ্নে একটা জরুরি কাজে বর্ষা সালাম দিয়ে ম্যাসেজ করেছিল একটা ছেলেকে। আর সেই সালামের জবাব ছেলেটা দিলো এতো রাতে।
সচারাচর রাত এগারোটার পর বর্ষা কারো সাথে কথা ফোনে বলে না। কিন্তু জরুরি কাজ আছে বলে ছেলেটাকে জবাব দিলো, “জ্বী, আমার কিছু বলার ছিল। তবে আপনি আমাকে চেনেন না আর আমিও আপনাকে কখনও দেখি নি।”
“দেখেন নি তারপরও কাজ আছে? একটু পরিষ্কার করে বলুন তো ব্যাপারটা কী?”
“আমি আপনার কাজিন তানিশার বান্ধবী। আমরা একই ব্যাচের। আসলে তানিশা বললো, আপনি না-কি ইকোনোমিকসে অর্নাস করেছেন।”
“হ্যাঁ।”
“আমিও করতে চাই কিন্তু তেমন কোনো ধারণা নেই তো তাই তানিশা বললো, আপনার সাথে যোগাযোগ করতে।”
“ওহ আচ্ছা। তুমি তাহলে তানুর ফ্রেন্ড।”
হঠাৎ করে ছেলেটার তুমি সম্বোধনে চমকে গেল বর্ষা কিন্তু সেটার বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো, “জ্বী।”
“তা নাম কী তোমার? ফেইসবুক আইডিতে তো দেখছি নাম দেওয়া ‘সাদা মেঘের বর্ষা’। এটা তো মনে হয় না তোমার নাম।”
“আমার নাম বর্ষা মির্জা।”
“বর্ষা? হুম, কিঞ্চিৎ মিল আছে।”
একটু কৌতূহল নিয়ে, “কার সাথে?”
“আমার সাথে।”
দ্বিগুণ অবাক হয়ে, “আপনার?”
“হুম। আমার নাম আবির মাহমুদ কিন্তু সবাই মেঘ বলে ডাকে। আর বর্ষাকালেই তো মেঘের বিচরণ চলে। তাই বললাম কিঞ্চিৎ মিল আছে। নামটা যদি বৃষ্টি হতো তাহলে পুরোপুরি মিল থাকতো।”
ছেলেটার এমন অকপটে বলা লেখাগুলো দেখে বর্ষা মাঝে কৌতূহলের সৃষ্টি হলো। কিন্তু সমস্ত কৌতূহল পাশে রেখে অতি সংক্ষেপে জবাব দিলো, “ওহ আচ্ছা।”
“তুমি কি চাপা স্বভাবের মেয়ে?”
আচমকা এমন প্রশ্নে মনের অজান্তেই হেসে উঠলো বর্ষা। আলতো হাতে টাইপ করলো, “হুম অনেকটাই।”
“সেজন্যই তো ‘তুমি’ করে সম্বোধন করছি তবুও কিছু বলছো না। আবার বৃষ্টির সাথে মিল হতো বললাম তবুও জানতে চাইলে না।”
মুচকি হেসে, দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে ভাবতে লাগলো। কয়েক সেকেন্ড ভেবে বর্ষা বললো, “না মানে আজকে প্রথম কথা হচ্ছে। আবার আপনার সাথে আলাপ নেই। তাই অহেতুক প্রশ্ন করতে মনে দ্বিধার সৃষ্টি হচ্ছে।”
“আমি একটু বাচাল প্রকৃতির। তাই তো অপরিচিতার সাথেও আলাপ জুড়ে দিয়েছি। যা-ই হোক, তোমাকে সহযোগিতা করতে আমার এমনিতেও কোনো আপত্তি নেই। তানুর ফ্রেন্ড তুমি তাই নিজে থেকেই আরও বেশি তোমার কাজে সহযোগিতা করতে চাই।”
ম্যাসেজটা দেখে বর্ষা মনে মাঝে স্বস্তি বোধ করছে। অপরিচিত একটা ছেলে তাকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিবে সেটাও সে কল্পনা করে। কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে বর্ষা জবাব দিলো, “ভীষণ খুশি হলাম। তাহলে কালকে ভার্সিটিতে দেখা করি। আসলে সরাসরি কথা বললে হয়ত সবচেয়ে বেশি ভালো হয়।”
“ঠিক আছে। ০১*******৫৮ এটা আমার ফোন নাম্বার। কালকে আমি ভার্সিটিতে সকাল দশটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত থাকবো। তোমার যখন সময় হবে আমাকে কল করবে। আমি চলে আসবো।”
“ধন্যবাদ ভাইয়া।”
“ওহে অপরিচিতা,
করো না ভাইয়া সম্বোধন
কারণ থেমে যে যায় হৃদয়ের স্পন্দন।”
ছেলেটার এমন ছন্দে ভরপুর ম্যাসেজে কিঞ্চিৎ জোরেই হেসে উঠলো বর্ষা। হাসিটা থামতেই সে বললো, “ঠিক আছে স্যার।”
“তুমি কি আমার স্টুডেন্ট?”
অবাক হয়ে, “না তো।”
“তাহলে স্যার বললে কেন?”
একটু ভয় নিয়ে, “ভাইয়া বলতে বারণ করেছেন তাই স্যার সম্বোধন করলাম।”
“এসবের দরকার নেই। আমি এমনিতেই ফর্মালিটিস পছন্দ করি না। তুমি আমাকে মেঘ বলে ডাকবে।”
ইতস্তত করে, “আপনি তো আমার সিনিয়র। নাম ধরে সম্বোধন বড্ড বেমানান লাগবে। অন্তত আমাকে দিয়ে হবে না।”
“আচ্ছা বাবা। তোমাকে কিছুই বলতে হবো না। নিজের সমস্যাগুলো জানাবে এতেই হবে।”
“ঠিক আছে। তাহলে কালকে ভার্সিটিতে দেখা হবে ইন শা আল্লাহ। ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।”
“হুম, আল্লাহ হাফেজ আর শুভরাত্রি।”
ম্যাসেজটা কেবল দেখে ফোন টেবিলের উপর রেখে দিলো বর্ষা। কয়েক মিনিট ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে হালকা হেসে বলে উঠলো, “কী অদ্ভুত মানুষ! এমন ভাবে কথা বললেন যেন আমি উনার কত কালের পরিচিত। আবার ভাইয়া ডাকলেও সমস্যা। এটা প্রায় ছেলেদেরই সমস্যা। কিন্তু ভাইয়া ডাকে এতো কীসের সমস্যা হয় ছেলেদের?”
মাথার উপর সূর্য তার সবটা দিয়ে আলো ছড়াচ্ছে এই ভরদুপুরে। আর আলোর প্রখরতা এতোটাই বেশি যে, তৃষ্ণায় গলা বারবার কাঠ হয়ে যাচ্ছে। আর ঘাম তো অবিরাম ঝরছে।
টানা দুটো ক্লাস শেষ করে গ্যালারিতে সদ্য পা রাখলো মেঘ। বসার জন্য ঠিকঠাক একটা জায়গার সন্ধান করতেই গ্যালারি কাঁপিয়ে ফোন বেজে উঠলো তার। পকেটে থেকে ফোন বের করে, নাম্বার ঠিকমতো না দেখেই কল রিসিভ করে বললো, “বলো বর্ষা।”
“আপনি কী করে জানলেন যে আমিই কল করেছি।”
পছন্দমতো একটা জায়গা পেতেই সেখানে বসে পড়লো মেঘ। তারপর বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে জবাব দিলো, “কালকে কথা হয়েছিল, তুমি আজকে দেখা করবে আর এমনিতেও অপরিচিত কোনো নাম্বার থেকে আমার কল আসে না। তাই আন্দাজে একটা ঢিল মারলাম।”
“ওহ আচ্ছা। তা আপনার হাতে এখন সময় হবে?”
“হ্যাঁ, তুমি কোথায় আছো বলো? আমি আসছি।”
“না, না, আমিই আসছি। আপনি আমাকে শুধু আপনার অবস্থানটা বলুন।”
“প্রথম অবস্থায় জুনিয়রকে কষ্ট দিতে চাই না।”
“না মানে…”
“ইতস্তত না করে তাড়াতাড়ি বলে।”
“হুম, আমি ক্যান্টিনে আছি।”
“ঠিক আছে। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।”
“হুম।”
মেঘের পাশ থেকে একজন বলে উঠলো, “কে রে মামা?”
ফোনটা ডান হাতে অনবরত নাড়াচাড়া করতে করতে মেঘ জবাব দিলো, “তানিশার বান্ধবী।”
“মামা, তুই এমন বেইমান হয়েছিস কবে থেকে? প্রেম করিস তবুও জানাস নি৷ ভাবী কি বেশি সুন্দরী না-কি।”
ছেলেটার মাথায় চাটি মেরে মেঘ বললো, “তোর মাথা এতো বেশি ভাবে কেন?”
“তুমি বেশি বেশি প্রেম করবে আর আমার মাথায় ভাবলে দোষ? শোন মামা, আমি হলাম নিলয়। আমাকে ফাঁকি দেওয়া এতো সোজা না।”
“আরে কী শুরু করলি তুই? মেয়েটাকে আমি চিনিও না আর সেও আমাকে কখনও দেখেনি। কালকে রাতে কেবল ইনবক্সে কথা হলো। ইকোনোমিকসে পড়তে চায়। আমার সহযোগিতা প্রয়োজন। ব্যাস! এতটুকুই। আর তুই কোথ থেকে কই নিয়ে গেলি।”
“সরি মামা।”
কপট রাগ নিয়ে, “রাখ তোর সরি। জানিস না, আমি বৃষ্টিকে ভালোবাসি?”
“জানি, কিন্তু বৃষ্টি ভাবী তো তোর উপর ঘাসও ঢালে না।”
নিলয়ের কথা শুনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিলো মেঘ। আর মেঘের চাহনিতে চুপসে গিয়ে বোকা হাসি দিয়ে নিলয় বললো, “মামা, তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোকে না মেয়েটা দেখা করতে বললো?”
বেশ গম্ভীর গলায় জবাব দিলো মেঘ, “হুম।”
চলবে…