নোটবুক❤,পর্ব-২
লেখনীতেঃ কথা চৌধুরী
কন্ঠস্বরে পরিচিত একজন মানুষের সাথে যখন দেখা করার মূহুর্ত আসে, তখন মনের মাঝে অজানা খুশির সাথে অস্থিরতাও বিরাজ করে। মানুষটাকে ঘিরে মন গহীনে চলে হাজারো জল্পনা কল্পনা। কত-শত প্রশ্ন নিজের মাঝে সৃষ্টি হতে শুরু করে আর বলতে থাকে, “কেমন হবে সে?”
প্রায় বিশ পঁচিশ মিনিট ধরে ক্যান্টিনে বসে অপেক্ষা করছে বর্ষা। ভরদুপুরের কাঠফাটা রোদে এমনিতেই মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে ওর, তারউপর কাঙ্ক্ষিত মানুষটার পাত্তা নেই। এভাবে আর কতক্ষণ বসে অপেক্ষা করবে সে? তাই অসহ্য হয়ে কল করলো সে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই বর্ষা জানতে চাইলো, “আপনি কোথায়?”
“আমার একটু জরুরি কাজ আছে তাই দেখা করতে পারলাম না। আর গরিব মানুষ তো ফোনে টাকা নেই বিধায় কলও করতে পারলাম না।”
এতক্ষণ অপেক্ষা করার পর বর্ষা যখন শুনলো দেখা হবে না, তখন নিজের অজান্তেই ওর মন ভার হয়ে এলো। ফোনের ওপাশের মানুষটার উপর অজানা অভিমান অনুভব করছে সে। কিন্তু অপরিচিত কারোর উপর অভিমান করা যায় না, আসলে সেই অধিকারই থাকে না। তাই অভিমানটা চেপে বর্ষা বললো, “ঠিক আছে। সমস্যা নেই।”
“আচ্ছা, আজকে তুমি কোন রঙের ড্রেস পড়েছিলে?”
হুট করে এমন প্রশ্ন বর্ষার মনে কৌতূহলের সৃষ্টি করলেও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সে জবাব দিলো, “হালকা আকাশী রঙের থ্রিপিসের সাথে মেচিং হিজাব।”
“ওহ আচ্ছা। চশমা পড়ো কি?”
“হ্যাঁ, মাথা ব্যথার জন্য।” কারণ বলার প্রয়োজন ছিল না তবুও নিজে থেকে বর্ষা কারণটা জানিয়ে দিলো।
“ঠিক আছে। আমি রাতে তোমার সাথে কথা বলবো। আপত্তি নেই তো?”
বর্ষার কথা বলাটা খুব জরুরি। তাই আপত্তি থাকলেও আপত্তি নেই এমনটা জানিয়ে সে বললো, “নাহ।”
“ঠিক আছে তাহলে আল্লাহ হাফেজ।” বলেই কল কেটে দিলো মেঘ। বর্ষা যে ‘আল্লাহ হাফেজ’ বললো সেটাও হয়ত শুনে নি সে ঠিক করে।
চাপা স্বভাবের মেয়ে হলেও কেউ বর্ষাকে এড়িয়ে চলবে এটা তার মোটেও পছন্দ হয় না। তাই সময় ব্যয় না করে বর্ষা এবার কল করলো তানিশাকে, “হ্যালো তানিশা?”
“বল।”
“তোমার কাজিন তো দেখা করার কথা বলেও দেখা করলো না। তুমি কি উনার সাথে একটু কথা বলবে?”
বর্ষা শুধু চাপা স্বভাবের নয়, যথেষ্ট লাজুকও বটে। তাই তো বান্ধবী হওয়া সত্ত্বেও তানিশাকে ‘তুমি’ করে সম্বোধন করে। প্রথমে তানিশা ঘোর আপত্তি করতো কিন্তু বর্ষাকে বদল করতে না পেরে নিজেই হার স্বীকার করে।
তানিশা অনেকটা সময় বর্ষার কথাগুলো ভেবে জবাব দিলো, “ঠিক আছে। আজকে বিকেলে আমি ভাইকে কল করে বিষয়টা বুঝিয়ে বলবো।”
“ঠিক আছে।”
“হুম।”
দুপুরের কাঠফাটা রোদকে বিদায় জানিয়ে আগমন ঘটলো বৃষ্টির৷ তপ্ত দুপুরে নিমিষেই নামিয়েই দিলো শীতলতা। হিমশীতল বাতাসের সাথে বৃষ্টির টপটপানি শব্দে যেন মুখর হয়ে উঠছে চারপাশ। এই বৃষ্টির প্রতীক্ষায় চাতক পাখি হয়ে থাকে মেঘ। কেন এতো অপেক্ষা তার বৃষ্টির জন্য? ভালোবাসে বলে কি? হয়ত বা খুব করে ভালোবাসে সে আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টিকে।
বারান্দার দরজার সামনে একটা চেয়ার পেতে বসলো মেঘ। আজকে পুরোটা বিকেল সে বৃষ্টির সাথে কাটাতে চায়। বৃষ্টির সাথে কথা বলে সে সন্ধ্যা নামাতে চায়। কিন্তু মানুষের ভালো লাগায় প্রকৃতি সর্বদা সায় দেয় না। তেমনি মেঘের সুন্দর মূহুর্তকে বরবাদ করে দিতে ছন্দহীন সুরে বেজে উঠলো ফোন। একরাশ বিরক্তি নিয়ে চেয়ার ছেড়ে ফোন হাতে নিলো মেঘ। তানিশার নামটা দেখে বিরক্তি ঝেড়ে ফেলে বললো, “কেমন আছিস তানু?”
“এই তো ভাই। তোর কী খবর?”
দরজার সামনে এসে চেয়ার বসলো। হেলান দিয়ে জবাব দিলো, “হুম, বৃষ্টির সাথে সময় কাটাচ্ছিলাম তাহলে তো ভালোই থাকবো।”
“তোর বৃষ্টিবিলাশ আজও চলমান?”
মায়া জড়ানো কন্ঠে, “ভালোবাসি। তাই তো বৃষ্টিকে আগলে রাখি।”
“ভাই প্লিজ। তোর বৃষ্টিবিলাশের পেঁচাল বন্ধ কর। এখন বল, বর্ষার সাথে কেন দেখা করিস নি?”
তানিশার কথা শুনে রহস্যে ভরা হাসিতে মত্ত হলো মেঘ। হাসিতে রহস্য অনুভব করে তানিশা জানতে চাইলো, “কী হলো? হাসছিস কেন?”
“ভালোবাসার মানুষের সামনে দাঁড়ানোর সাহস হয় নি।”
অবাক হয়ে, “মানে?”
“ভালোবাসি আমি বৃষ্টিকে।”
“আমি বর্ষার কথা বলছি ভাই। তুই বৃষ্টি কোথায় পেলি?”
“তোদের জন্য হয়ত বর্ষা কিন্তু আমার জন্য তো বৃষ্টি।”
মেঘের কাব্যিক কথা শুনে তানিশা হয়ত রাগ অনুভব করছে। কিন্তু মেঘ ওর চেয়ে বয়সে বড় বলে সেটা খুব একটা প্রকাশ করতে পারছে না। কোনো মতে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “ভাই, তুই কি পরিষ্কার করে বলবি? কারণ আমি তোর কাব্যিক কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“ঠিক আছে বলছি।”
“হুম।”
“মাসেক খানেক আগে, ভার্সিটিতে আমার একটা জরুরি কাজ ছিল। সেটা শেষ করে বের হতে গিয়ে দেখি, অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। ঐদিনের বৃষ্টিটাকে এতো ভালো লেগেছে যে, বাসায় আসার কথা ভুলে বৃষ্টি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অবশ্য আমার কাছে কোনো ছাতাও ছিল না। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর, আমার ডান দিকে একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, হলুদ রঙের থ্রিপিস আর হিজাব পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসবে আমি একটুও অবাক হই নি। অবাক হয়েছি এই কারণে যে, এমন আধুনিক যুগেও ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ের মুখ মেক-আপ শূন্য দেখে। ভাবলাম হয়ত চোখের ভুল। তাই আমি মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ আমাকে দাঁড়াতে দেখে মেয়েটা চমকে গেল। ও সরে যেতে চাইলো কিন্তু আমি হাত দিয়ে বাঁধা সৃষ্টি করে বললাম, ‘আমার বৃষ্টি হবে?’ আমি নিজেও জানি না হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন করলাম? কিন্তু আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির মতোন ওর মুখখানাও আমার কাছে অপূর্ব লেগেছে৷ সবচেয়ে ভালো লেগেছে লজ্জা আর ভয়ে ওকে চুপসে যেতে দেখে।”
কৌতূহল নিয়ে তানিশা জিজ্ঞেস করলো, “তারপর তারপর?”
“মেয়েটা তো এমনভাবে তাকালো যেন আমাকে নয় কোনো ভূত দেখছে। এদিকে জবাবও দিচ্ছে না। তাই আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘হবে কি আমার বৃষ্টি?’ বিনা উত্তরে ঐ বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মেলে ছুটে পালালো সে। আর আমি ওর এমন কান্ড দেখে হাসতে লাগলাম। এরপর ওর সাথে আর দেখা হয় নি। কিন্তু আজকে যখন বর্ষার সাথে দেখা করতে গেলাম, তখন বৃষ্টিকে দেখলাম। আমার মনে হলো ওর সামনে দাঁড়ানো উচিত হবে না। আর তাই বৃষ্টিকে দেখে বর্ষার সাথে দেখা করলাম না। কিন্তু ভাবতে পারি নি যে, বর্ষাই হলো আমার সেই বৃষ্টি।”
“তাহলে বুঝলি কী করে? বর্ষাকেও তো আগে দেখিস নি।”
“দেখা করতে যাই নি বলে কল করেছিল আমায়, তখন ড্রেস আপের কথা জানতে চেয়েছিলাম এমনিতেই কিন্তু আচমকা সব মিলে গেল।”
“ওহ আচ্ছা। তাহলে এবার আপনি সত্যিকারের বৃষ্টিকে খুঁজে পেয়েছেন?”
“তাই তো মনে হচ্ছে।”
“ভুল।”
অবাক হয়ে, “ভুল কেন?”
“বর্ষা প্রেম করার মতো মেয়ে নয়।”
মৃদু হেসে, “সব মেয়ে প্রথম এমনই ধারণা নিয়ে থাকে যে, কোনো ছেলেকে সে ভালোবাসবে না। কিন্তু পরে ঠিকই সত্যিকারের ভালোবাসার জয় হয়।”
টানা ঝুম বৃষ্টির পর রাত দশটায় এসে বৃষ্টি থেমে গেল। কিন্তু এখনও আকাশে মাঝে মাঝে গর্জে উঠছে বিদ্যুৎ। চারপাশে শীতলতায় তৈরি হচ্ছে অন্য এক মোহ। রাতের খাবার শেষ করে অনেকটা সময় বেলকনিতে, উদাসীন নয়নে তাকিয়ে রইলো বর্ষা। আকাশের সাথে পাল্লা দিয়ে যেন তার মনের আকাশ রঙ বদলায়।
বৃষ্টি নয়, মেঘে মত্ত বর্ষা তাই তো দূরের ঐ মেঘলা আকাশে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো, “সাদা মেঘের বর্ষা তুমি।”
হঠাৎ রুম থেকে ফোনের টোন কানে পৌঁছাতেই রুমের দিকে পা বাড়ালো সে। অতি দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে দেখে মেঘ কল করেছে। আলতো হাতে কল রিসিভ করে বললো, “হ্যালো।”
“ইনবক্সে এসো কথা আছে।”
“ঠিক আছে।”
তড়িঘড়ি করে ইনবক্সে এসে ম্যাসেজ দিলো, “জ্বী বলুন।”
“কালকে আমি দেখা করতে পারবো। আমার কোনো সমস্যা নেই।”
ম্যাসেজটা দেখে বর্ষা চুপ করে আছে। দুই মিনিটের উপর হয়ে গেল কিন্তু বর্ষা কোনো জবাব দিচ্ছে না। তাই মেঘ আবার ম্যাসেজ করলো, “চুপ করে আছো কেন?”
এবারের প্রশ্নের জবাবে বর্ষা পাল্টা প্রশ্ন করলো, “আজকের মতোন করবেন না তো?”
“হা হা হা। অভিমান করেছো কি?”
“অপরিচিত কারোর উপর অভিমান করতে নেই। আর আমি কেবল জানতে চেয়েছি।”
“নাহ, কালকে অবশ্যই আসবো। কারণ কালকে তোমার নোটবুকের মালিকের সন্ধান দিবো।”
অবাক হয়ে, “আমার নোটবুক?”
“হ্যাঁ, তোমার নোটবুক।”
চলবে…