নোটবুক❤,পর্ব-৩ (শেষ পর্ব)
লেখনীতেঃ কথা চৌধুরী
“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“কালকেই না হয় সব বুঝিয়ে বলবো। আর কালকে তুমি নয়, আমি অপেক্ষা করবো। বৃষ্টির অপেক্ষা।”
দোটানায় পড়ে, “আপনার কথাগুলো সত্যিই বুঝতে পারছি না।”
“আজকের জন্য না বুঝেই থাকো। কালকে সকাল দশটায় গ্যালারিতে চলে আসবে। কেমন?”
এই মূহুর্তে বর্ষার মনে উঁকি দিচ্ছে কত-শত প্রশ্নেরা কিন্তু সেসব প্রশ্নের উত্তর বাকি রেখে মেঘ চলে যেতে চাইছে। এবিষয়টা বর্ষার মোটেও ভালো লাগছে না। ভিতরে ভিতরে বড্ড অস্থিরতার সৃষ্টি করছে। তাই তো মনের বিরুদ্ধে সে জবাব দিলো, “ঠিক আছে।”
“হুম, আল্লাহ হাফেজ আর শুভ রাত্রি।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
কালকে অঝোরে বৃষ্টি হওয়ার রেশটা এখনও কাটে নি। আকাশে এখনও ভেসে বেড়াচ্ছে ধূসররঙের মেঘ। বাতাসে রয়েছে শীতলতার সাথে তীব্রতা। আর সূর্যটা যেন কোথায় ফেরারি আসামীর মতো গা ঢাকা দিয়ে আছে।
গ্যালারির পথ ধরে হাঁটতে গিয়ে বারবার আকাশে দৃষ্টি দিচ্ছে বর্ষা। চশমার ফ্রেমে আবদ্ধ তার চোখজোড়া ঐ দূর আকাশে থাকা মেঘের রূপে হয়ে উঠছে চঞ্চল। ঠোঁটের কোণেও মাঝে মাঝে ফুটে উঠছে হাসির রেখা কিন্তু মনের ঘরে বিরাজমান অস্থিরতা। মেঘের বাকি রাখা প্রশ্নের উত্তর জানতেই এতো অস্থিরতা চলছে তার মাঝে।
সময় মতোই পৌঁছে গেছে সে গ্যালারিতে কিন্তু হঠাৎ মনে পড়লো সে তো মেঘকে চেনে না, তাহলে এতো ছেলের মাঝে কী করে ঠাওর করবে যে, এটাই মেঘ। আচমকা ফোনের ব্যাপারটা মাথায় আসতেই চটপট কল করলো সে মেঘকে, “হ্যালো।”
“এসেছো কি?”
“হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে চিনবো কী করে?”
“আমি হোয়াইট টিশার্ট আর ব্লু জিন্স পড়েছি। তুমি?”
“ব্ল্যাক ড্রেস আর সেইম রঙের হিজাব।”
“হুম, পেয়েছি তোমায়। পিছনে তাকাও।”
পিছনে তাকানোর কথা বলতেই অনেকটা ঘাবড়ে গেল বর্ষা। ফোন কানে রেখেই পিছনে ঘুরে তাকালো সে। মেঘের বর্ণনা অনুযায়ী একটা হাসোজ্জ্বল ছেলেকে ফোন কানে ধরে অন্য হাতে তার দিকে হাত নাড়িয়ে ইশারা করছে। কিন্তু ছেলেটাকে দেখার সাথে সাথে বর্ষা ৪২০ ভোল্টের শখ খেলো। সে ভাবতেই পারছে না সেদিনের ছেলেটাই হলো মেঘ।
ছেলেটার ওর যত কাছাকাছি আসছে, তত ওর হৃদয়ের ধুকপুকানি বাড়ছে। কিন্তু এতো অস্থিরতাও সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ছেলেটার দিকে।
কাছাকাছি এসে মেঘ মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি বর্ষা?”
বর্ষা বিনা উত্তরে কেবল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘ তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, “আমি মেঘ, ভূত নই যে এভাবে তাকিয়ে আছো।”
মেঘের কথায় এবার বর্ষার মাঝে লজ্জার সৃষ্টি হলো। তাই অতি দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। মেঘ আবার জানতে চাইলো, “তুমি কি বর্ষা? আসলে আমি শিওর ছিলাম না যে, আমার বৃষ্টিই হলো বর্ষা।”
লজ্জা কাটিয়ে বর্ষা কাঁপা গলায় জবাব দিলো, “আমি বর্ষা। বৃষ্টি নই।”
“সবার জন্য হয়ত বর্ষা কিন্তু আমার জন্য কেবল বৃষ্টি। আকাশে ঘনায়মান মেঘ থেকে সৃষ্ট বৃষ্টি।”
লজ্জায় ধরে আসা গলায় বর্ষা প্রশ্ন রাখলো মেঘের কাছে, “আমরা কি দরকারী কথা বলতে পারি?”
“এসব তো অদরকারী নয়।”
“কিন্তু আমার দরকারীও মনে হচ্ছে না।”
“তাহলে নোটবুক আগলে রাখাটা বুঝি দরকারী।”
হঠাৎ নোটবুকের কথা বলতেই বর্ষার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলো, “কীসের নোটবুক?”
“ঐ যে, ক্যান্টিন থেকে পাওয়া একটা নোটবুক। যেটা কি-না তোমার হৃদয় দখল করে বসে আছে।”
“এসব আপনাকে কে বললো?”
দায়সারা ভাব নিয়ে, “আর কে? তানিশা বলেছে।… এখন বলো তো নোটবুকের মালিককে পছন্দ না-কি যিনি নোটবুকে লিখেছেন তাকে।”
“মানে?”
“মানে হচ্ছে নোটবুকের মালিক হলো মিরাজ রাজ। কিন্তু নোটবুকে থাকা লেখাগুলো আমার।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছে আমি প্রুফ দিচ্ছি। নোটবুকের প্রথম পৃষ্ঠার লেখাটা হচ্ছে ‘সাদা মেঘের বর্ষা তুমি, আমি বৃষ্টি ভেজা রাত।’ আর কিছু কবিতাও লিখেছি। শেষে একটা লেখা ছিল,’বৃষ্টি আমার চোখের পাতা নয়, হৃদয়কে ছুঁয়ে দাও।’ আসলে আমি একজন বৃষ্টিপ্রেমী। তাই যখন বৃষ্টি হয়, তখন সব ভুলে বৃষ্টি আঁকড়ে বসে থাকি। কিন্তু বাস্তবে কারোর মাঝে বৃষ্টির ছায়া পাবো ভাবতে পারি নি। তোমাকে আর আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টিকে কেন যেন এক লাগে। তাই তো নিজের অজান্তেই সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, হবে কি আমার বৃষ্টি?”
মেঘের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো বর্ষা। তারপর ব্যাগ থেকে নোটবুকটা বের করে সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো, “আমি মেঘ পছন্দ করি, বৃষ্টি নয়।”
নোটবুকটা দেখে মেঘ করুণ গলায় বললো, “তাহলে নোটবুকের লেখাগুলো তোমার হৃদয় দখল করে নি? ভালোবাসো নি কি তুমি লেখনীর মালিককে?”
নোটবুকটা নিজের কাছে নিয়ে নিরবতা আঁকড়ে ধরলো বর্ষা। মেঘ শান্ত গলায় আবার বলতে শুরু করলো, “বর্ষা, আমি বাচ্চা ছেলে নই। আবেগ আর বাস্তবতার তফাৎ আমি বুঝি। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না কারণ বাস্তবতা বড্ড কঠিন। আর আমি এমন কোনো সম্পর্কের দাবী রাখছি না যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমি তোমাকে বর্ষা হিসেবে নয়, বৃষ্টি হিসেবে আমার জীবন সঙ্গী করতে চাই। তাও আমাদের পরিবারের পূর্ণ সম্মতিতে। প্রেম, প্রেম নাটক দ্বারা আমি বৃষ্টিকে অসম্মান করতে চাই না। কারণ সেই ছোট্ট বেলা থেকে বৃষ্টিকে ভালোবাসি। এতো বছর পর আল্লাহ আমাকে এমন একজনের সাক্ষাৎ পাইয়ে দিয়েছেন, যার মাঝে আমি বৃষ্টিকে খুঁজে পাই।”
মাথা নত করে সবটা শুনে বর্ষা নিঃশব্দে মেঘের নোটবুকটা তার ধরিয়ে দিয়ে বললো, “আমি মেঘ পছন্দ করি, বৃষ্টি নয়।” বলেই পিছনে ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো সে। আর বর্ষার থেকে কাঙ্ক্ষিত উত্তর না পেয়ে থ মেরে রইলো মেঘ।
নোটবুকটার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো, “এতোদিন পর বৃষ্টির খোঁজ পেয়েও হাতছাড়া হয়ে গেল। সত্যিই, বৃষ্টি অস্থায়ী। তাই তো সে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।”
ঘরময় অন্ধকার করে, পরিশ্রান্ত মনে, কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে মেঘ। মনের আকাশে আজ বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু সেটা সুখ না দিয়ে মেঘকে জ্বালা দিচ্ছে। বুকটা কীসের আর্তনাদে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেটার প্রকাশে কেবল মুখটা হতাশায় ছেয়েমআছে।
বালিশের পাশে রাখা ফোনটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো বর্ষার ম্যাসেজ। ধুরমুর করে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। মনে জাগা হাজারো প্রশ্নকে পুঁটলি করে ম্যাসেজটা পড়তে শুরু করলো, “আমার শেষ কথাটা হয়ত আপনি বুঝতে পারেন নি। আমি বলেছিলাম, মেঘকে পছন্দ করি– এটা কি আরও ভেঙে বলতে হবে আপনাকে? জানেন না? মেয়েরা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। আর নোটবুকের মালিক না-কি লেখনীর মালিক? এটার উত্তর আমার জানা নেই। আমি কেবল জানি, নোটবুক জুড়ে থাকা মেঘ নামক শব্দগুলো আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। এমন যুগেও আপনার প্রশস্ত চিন্তাভাবনা দেখে আমি বিমোহিত হয়েছি। দুই পরিবারের সম্মতি থাকলে মেঘ আর বৃষ্টিকে একত্রিত করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।”
বর্ষার এমন ম্যাসেজে মেঘ খুশিতে আত্মহারা হারা হয়ে উঠলে। তার খুশি যেন আজ বাঁধ ভেঙেছে। এতো খুশি সে রাখবে কোথায়?
অতি খুশিতে সে অনুভব করলো তার চোখের কোণে জল হাতছানি দিচ্ছে, কিন্তু সেটাকে পাত্তা না দিয়ে বর্ষাকে জবাব দিলো, “মুখ ফুটে বলতে না পেরেও তো কতকিছু বলে দিলে। ভেবেছিলাম, হয়ত হারিয়ে ফেলবো তোমায় কিন্তু উল্টো চমকে দিলে আমায়।”
“আমার কিন্তু বৃষ্টি পছন্দ নয়।”
“কিন্তু আমার তো পছন্দ। খুব করে মত্ত আমি বৃষ্টিতে। তাই তো তোমায় বৃষ্টি বলে ডাকবো। আমি ভালোবাসবো বৃষ্টিকে আর তুমি ভালোবাসবে মেঘকে। কি বাসবে না ভালো?”
“জানি না।”
হালকা হেসে মেঘ ময়াসেজ করলো, “কিন্তু আমি তো জেনে গেলাম ভালোবাসো তুমি আমায় বৃষ্টি।”
“নোটবুকটা আপনার না হলেও আপনি কেন তাতে লিখতেন?”
“মিরাজ আমার কলেজ পড়ুয়া ভাই। বাসায় বেড়াতে এসে নোটবুকটা ফেলে রেখে গেছে। নোটবুকটা দেখতে সুন্দর বলে এতে আমিই লিখতে শুরু করি। সেদিনও ক্যান্টিনে বসে লিখছিলাম কিন্তু ভুলে ফেলে রেখে এসেছিলাম।”
“ওহ।”
“হুম, আর নোটবুকের জন্যই সত্যিকারের বৃষ্টিকে নিজের করে পেলাম।”
“আপনি সবসময়ই কি বেশি কথা বলেন?”
“হ্যাঁ, কেন খারাপ লাগে শুনতে?”
“আসলে আমার কথা বলার চেয়ে শুনতে বেশি ভালো লাগে।”
মৃদু হেসে বললো, “ভালোই তো হলো আমি বলবো আর তুমি শুনবে। একটা গান আছে না কী যেন? হ্যাঁ, মনে পড়েছে,
” সন্ধ্যাবেলায়,
তুমি আমি বসে আছি দু’জনে
তুমি বলবে, আমি শুনবো।
তুমি বলবে, আমি শুনবো।”
“আপনি বেশ কাব্যিক বলে বোধ হচ্ছে।”
“তা নয়, আর হলেও দোষ কী বলো?… আচ্ছা, মেঘ পছন্দ বলেই তোমার আইডির নাম ‘সাদা মেঘের বর্ষা’ কি?”
“হুম, অনেক পছন্দ।”
“তাহলে ভালোবাসো কি আমায়?”
“উহুম।”
অবাক হয়ে, “তাহলে মেঘকে?”
“হুম।”
জোরে হেসে, “আমিও তোমাকে নয়, বৃষ্টিকে ভালোবাসি।”
“পাগল আপনি।”
“হুম, অনেক পাগল আমি বৃষ্টি আর তুমি নামক বৃষ্টির জন্য।”
“আকাশে ঘনীভূত হওয়া ধূসর মেঘে
খুঁজে পাই না কো আমি কিছু।
কিন্তু মেঘ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টিকে
ভালোবেসে নিয়েছি যে আমি পিছু।”
_____________ সমাপ্ত _______________