পতিতা পল্লী
১৪তম পর্ব/শেষ পর্ব
মাবিহা অরণ্যের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে অরণ্যের হাতটা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল
—আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না?একটা শেষ সুযোগ কি দেওয়া যায় না?।আমি যে অণুতপ্তের আগুনে পুড়তে পুড়তে ছাই হয়ে গেছি।আমাকে মাফ করে দাও।আমাকে তোমার করে নাও।আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ আমার চোখে কোন ছলনা নেই।আমায় মাফ করে দাও অরণ্য।
অরণ্য মাবিহার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল মাবিহাকে বেশ নিষ্পাপ লাগছে।আজকে মাবিহার চোখে অরণ্য কোন ছলনার ছাপ দেখতে পারছে না।আজকে মাবিহাকে অনেক পবিত্র লাগছে।আর সত্যিই তো মাবিহা একটা ভুল করেছে তাকে তো সে ভুল শুধরানোর সুযোগ দেওয়া উচিত।মাবিহার প্রতি হঠাৎ একটা মায়া জন্মালো অরণ্যের।এ মায়ার জাল ছিড়ে যেন অরণ্য বের হতে পারছিল না।তাই অরণ্য মাবিহাকে জড়িয়ে ধরে বলল
—আমার এ ছন্নছাড়া জীবনে কেন জড়াতে চাও।তুমি যে কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবা।
মাবিহাও কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল
—তুমি আমাকে যত পার কষ্ট দাও তবুও আমাকে ফিরিয়ে দিও না।
পাশ থেকে রহমত চাচা বলে উঠল
—অরণ্য বাবা মাবিহা মা যেহুত ভুল বুঝতে পেরেছে তাকে ক্ষমা করে দাও।তাকে আর কষ্ট দিও না।তাকে শুধরানোর একটা সুযোগ দাও।তোমরা আজকেই বিয়ে নাও।
অরণ্য, মাবিহার কথা ভেবে রহমত চাচার কথা ফেলতে পারল না।অতঃপর তারা বিয়ে করে নিল।মাবিহাও আগের থেকে বদলে গেল।মাবিহা ডাক্তারি করা ছেড়ে দিয়েছিল আরও আগেই।অরণ্য চাই না মাবিহা জব করুক।আর মাবিহাও অরণ্যের বউ বলে পরিচয় দিতেই বেশি ভালো বোধ করত।মাবিহা বেশ মানিয়ে নিল অরণ্যের সাথে।মাবিহাকে পেয়ে অরণ্যও বেশ খুশি ছিল।একমাস পর মাবিহা অরণ্যকে বলল
–একটা কথা বলার ছিল
অরন্য মাবিহার কোমরে হাত দিয়ে কানে কানে বলল
—কি কথা?
মাবিহা অরণ্যের দিকে ফিরে অরণ্যের কানে একটা চুমু দিয়ে বলল
—তুমি বাবা হতে চলেছ। আমাদের পরিবারে নতুন অতিথি আসতে শুরু করেছে।
অরণ্য মাবিহার কথা শোনে খুশিতে আত্নহারা হয়ে গেল।মাবিহাকে কোলে নিয়ে ঘুরাতে লাগল।মাবিহা বলল
—আরে আস্তে আস্তে।বাবু ব্যাথা পাবে যে।
অরণ্য জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল
—ওহ সরি। আজকে থেকে তোমার বাড়ির সব কাজ করা বন্ধ।আজকে থেকে শুধু রেস্ট নিবা।আমি চায় না বাবু আর বাবুর মায়ের কোন ক্ষতি হোক।
মাবিহাও সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।অরণ্য আর মাবিহার জীবন বেশ ভালোয় কাটতে লাগল।তারা বেশ ভালোই সময় কাটাতে লাগল।অরণ্য মাবিহার একটা বিষয়ে প্রথমে আপত্তি করলেও অরণ্য পরে আর এ বিষয় নিয়ে আপত্তি করে নি।কারন মাবিহা প্রতিমাসে ১৫ হাজার টাকা আলাদা করে কি করত সেটা অরণ্যকে বলত না।প্রথম প্রথম অরণ্য জানতে চাইলেও পরে ভাবল হয়ত সংসারের কোন কাজের জন্য রেখেছে তাই পরে আর এটা নিয়া মাবিহাকে কিছু বলে নি। আস্তে আস্তে মাবিহার ডেলিভারীর সময় আসল।একদিন হঠাৎ মাবিহা ব্যাথায় চিল্লাতে লাগল।অরণ্য মাবিহাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল।ডাক্তার মাবিহাকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে গেল তাড়াতাড়ি ।আর বের হয়ে বলল
—অরণ্য সাহেব আমরা আপনার স্ত্রী কে বাঁচাতে পারি নি সরি।আপনার সন্তান ভালো আছে।আর আপনার কন্যা সন্তান হয়েছে।
অরণ্যের ভিতরা টা যেন একথা শোনে দুমরে মুচরে গেল।অরণ্য দৌঁড়ে মাবিহার কাছে গিয়ে দেখল মাবিহার নিথর দেহটা পড়ে আছে।মাবিহাকে জড়িয়ে ধরে অরণ্য চিল্লায়ে কাঁদতে লাগল।হঠাৎ অরণ্য খেয়াল করল কেউ একজন তার কাঁধে হাত রেখেছে।অরণ্য পিছন ফিরে যা দেখল নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না।খেয়াল করল ডালিয়া দাঁড়ানো।অরণ্য ডালিয়াকে দেখে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল
—ডালিয়া তুমি এখানে?তুমি এতদিন কোথায় ছিলে।দেখ মাবিহা মরে গেছে।
—হুম জানি অরণ্য মাবিহা মরে গেছে।আর এটাই যে হওয়ার ছিল
—মানে?
—তাহলে শোন। সেদিন আমি রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম।হঠাৎ খেয়াল করলাম মাবিহা ডাক্তারের কাছে গেছে আর বেশ আচ্ছন্ন মনে ছিল। মাবিহার চেহারাটা দেখে কেন জানি না আমার মনে হচ্ছিল কিছু একটা হয়েছে।আমি দৌঁড়ে মাবিহা যেখানে ডাক্তার দেখিয়েছিল সেখানে গেলাম।সেখানে গিয়ে যা শোনলাম নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।কারন জানতে পারলাম মাবিহার বড় একটা রোগ ধরা পড়েছে আর মাবিহা বাঁচবে মাত্র ২ থেকে ৩ বছর।একথা শোনে আমি বেশ চমকে গেলাম।পরদিন মাবিহার সাথে যোগাযোগ করলাম।মাবিহা বেশ কষ্ট পাচ্ছিল।নিজের এ রোগের জন্য বারবার নিজেকে দায়ী করছিল।ভাবছিল যে, তোমাকে কষ্ট দিয়েছে তাই তার এমন হয়েছে।কিন্তু তার খুব শখ ছিল তোমার ভালোবাসা নিয়ে মারার।আমি মাবিহাকে অনেক করে বললাম তুমি অরণ্যকে বিয়ে কর আমি অরণ্যের জীবন থেকে চলে যাব। মাবিহা রাজি হল না।কিন্তু এদিকে আমি জানতে পারলাম আমি কখনও মা হতে পারব না।তাই মাবিহাকে বললাম
—মাবিহা আমি অরণ্যকে কখনও বাচ্চা দিতে পারব না।তুমি ওকে বিয়ে কর আর একটা বাচ্চা নাও।তারপর তোমার কিছু হলে আমি তোমার বাচ্চার দায়ভার নিব।আমি চাই তুমি অরণ্যের ভালোবাসা পাও।প্লিজ না কর না।
মাবিহা হতাশ কন্ঠে বলল
—কিন্তু সে তো আমায় ভালোবাসে না ডালিয়া।সে তো তোমাকে ভালোবাসে।আমি চাই না তোমাদের মাঝে আসতে।
—আমাদের মাঝে তুমি আস নি বরং তোমাদের মাঝেই আমি এসে পড়েছি।অরণ্য তোমাকে ভালোবেসেই বিয়ে করবে।শুধু আমার কথাটা শোনে যেও।
সেদিন আমার জোরাজোরি তে মাবিহা রাজি না হয়ে পারল না।সে রাজি হল।সে ডাক্তারে কাছে জানতে পারল এসময় সে বাচ্চা নিতে পারবে কিনা।ডাক্তার তাকে বলল বাচ্চা নেওয়া যাবে।তবে এতে ঝুঁকি বেশি হয়ত ডেলিভারীর সময় মমত্যু ঘটবে।মাবিহা এটাই স্থির করল সে তোমাকে বিয়ে করে বাচ্চা নিবে।কিন্তু আমি তোমার জীবনে থাকলে মাবিহা কখনও তোমাকে পেত না তাই এত বড় নাটক করেছি।আর আমি যদি তোমাকে এ ঘটনা বলতাম তাহলে তোমার মাবিহার প্রতি শুধু দয়া আসত ভালোবাসা না।
“আমি চেয়েছি মাবিহাকে তুমি ভালোবাস।চেয়েছি সে তোমার ভালোবাসা পেয়ে মরুক।মাবিহা নিজের ভুল শুধরে নিয়েছিল।আমি চেয়েছি সে তার ভুল শুধরানোর পুরুষ্কার পাক।”
তার জন্যই এত বড় নাটক করা।আর মাবিহা ১৫ হাজার টাকা নিয়ে আমাকে পাঠাত আমার খাওয়া খরচের জন্য।তুমি হাজারবার জানতে চাইলেও সে বলে নি।আর আমাকেও সে একলা ছাড়ে নি।তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে।প্রতিদিন কথা হত আমাদের।আর আজকে যখন মাবিহার পেইন উঠল আমাকেই প্রথম ফোন দিয়েছিল।মাবিহা ডাক্তারকে আগেই বলে দিয়েছিল তোমাকে যেন না জানানো হয়।ডাক্তার তাই করল।এবার তুমি যা শাস্তি দিবে আমি মেনে নেব।যদি মনে কর আমি আর মাবিহা তোমাকে ঠকিয়েছি তাহলে তুমি যা শাস্তি দিবে তাই মেনে নিব।
ডালিয়ার কথা শোনে অরণ্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল।কারন মাবিহা এত বড় একটা রোগ নিয়ে ছিল কত যন্ত্রণায় না তাকে সহ্য করতে হয়েছে।কিন্তু অরণ্যকে বুঝতে দেয় নি।হাসি মুখে সবসময় কথা বলেছে।আর ডালিয়া নিজের ভালোবাসাকে অন্যের হাতে তুলে দিল সেটাও কাউকে বুজতে দিল না।বরং আরও নিজেকে ছলনাময়ী প্রমান করে গেল।
“সত্যিই মেয়েরা ছলনাময়ী এ ছলনা কিছু কিছু মানুষের জীবনে সুখ এনে দেয় আাবার কিছু কিছু মানুষের জীবন শেষ করে দেয়।”
অরণ্য যেদিন প্রথম ছলনার শিকার হয়েছিল তখন তার জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আর ২য় ছলনা তো অরণ্যের জীবন পাল্টে দিল।
“মেয়েরা যেমন ছলনাময়ী বিষাক্ত জাল তেমনি ছলনাময়ী মায়ার বাধন।”
এ বাধন ছিড়ে যাওয়ার ক্ষমতা কারও নেই।মাবিহার লাশটা অরণ্য জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল
—একটা বার তো বলতে পারতা।দুজনে কষ্টটা ভাগ করে নিতাম।তাহলে না বলে কেন চলে গেলে।না বলে কেন ধোকা দিলে।এ কোন ছলনার মায়ায় আমায় ফেলে গেলে যেখান থেকে বের হতে পারছি না।দেখ তো একবার আমাদের কন্যা সন্তান হয়েছে।তুমি আরেক মায়ার ছলনা রেখে গেলে মাবিহা।মাবিহা দেখ ডালিয়া এসেছে।তুমি তো তাকে কিছু বল।এ মেয়েটা যে তোমাকে অনেক ভালোবাসে।
এদিকে ডালিয়াও কাঁদতে লাগল।ডালিয়া মাবিহার বাচ্চাটা কুলে জড়াইয়া নিয়ে বলতে লাগল
—তোর এক মা চলে গিয়েছে তো কি হয়েছে আমি আছি তো।তোর মায়েরা যে কষ্ট গুলো পেয়েছে তোকে সে সব কষ্ট থেকে আগলে রাখব মা।তোর কাছে কোন কষ্ট আসতে দিবনা।আর অরণ্যকে বলল-তোমার বাচ্চার মা হিসেবে কি আমাকে গ্রহন করবে।
অরণ্য ডালিয়ার কাছে এসে বলল
—তুমি ছাড়া আমার মেয়েকে কে দেখবে বল।মাবিহা তো আমার মেয়ের ভার আগেই তোমাকে দিয়ে গেছে।এত বড় ছলনায় করেছ যে এ ছলনার মায়া থেকে বের হতে পারব না।
ডালিয়া আর অরণ্য কাঁদতে লাগল।মাবিহাকে তারা কবর দিল।কিছুদিন পর অরণ্য ডালিয়াকে বিয়ে করে নিল।আর ডালিয়াও তার ভালোবাসা ফিরে পেল।অরণ্য আর ডালিয়া সুখে সংসার করতে লাগল।
সেদিনের ঘটনার পর ডালু আর অরুর জীবন পাল্টে গেল।ডালিয়া এখন সুবিধাবঞ্চিত নারীদের নিয়ে একটা সংগঠন খুলেছে।সেখানে সুবিধাবঞ্চিত বিভিন্ন নারীদের কাজের ব্যাবস্থা করে দিয়েছে।
আর #পতিতা পল্লীর যেসব মেয়েদের জোর করে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল তাদেরকেও উদ্ধার করে কাজের ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। ডালিয়ার বেশ সময় পার হয়ে যায়,বাচ্চা,সংসার আর এসব সামাজিক কাজ করে।আর ডালিয়া আর অরণ্যের মেয়ের নাম রেখেছে “মালিয়া” মাবিহা নামের প্রথম অক্ষর মা আর ডালিয়ার নামের শেষ অক্ষর লিয়ার সম্বনয়ে।মাবিহায় এ নাম টা ডালিয়াকে বলে গিয়েছিল।বলেছিল যদি তাদের মেয়ে হয় এ নাম যেন রাখা হয়।।অরণ্য ডালিয়ার মোড় পাল্টে গিয়ে তারা সুখে সংসার করতে লাগল।
#পতিতা পল্লীর নাম শুনলেই আমরা সভ্য সমাজের লোকরা তাদের প্রতি একটা ঘৃনার চাদর মুড়ে দিয়ে কথা বলি।কিন্তু তাদের এ পথে আসার আগের গল্পটা আমরা কখনও শুনি না।কখনও এটা জানতে চায় না তারা কেন এখানে কেন এসেছে।তাদের এখানে আাসার আগে যে হাজারটা কারন,হাজারটা গল্প আর কাহিনী থাকে তা আমারা না জেনেই তাদের নিকৃষ্ট বলতে আমাদের সভ্য সমাজের মুখে আটকায়।
একটু সহানুভূতি আর ভলোবাসা পেলে যে তারাও কারও কারও জীবনের মোড় বদলাতে পারে তা আমরা বুঝি না।গল্পের ডালিয়ার মত হাজারটা নয়িকা সমাজে থাকলেও অরণ্যের মত নায়কের বেশ অভাব
(আশা করি ইন্ডিং টায় সবাই খুশি।আমি জানতাম সবাই ভাববে ডালিয়া অসুস্থ তাই এমন করেছিল তাই একটু ভিন্ন ভাবে ইন্ডিং দিলাম।আশা করি এমন কেউ সহজে ভাবতে পারি নি।কারন পাঠকের মনে ভাব পাঠক পড়ার আগেই আমি বুঝতে পারি।আাশা করি গল্পটা ভালো লেগেছে।পরের গল্প এর থেকে ভালো হবে ইনশাআল্লাহ)
লেখিকা-#শারমিন আঁচল নিপা