পতিতা পল্লী ৬ষ্ঠ পর্ব
—তাহলে শোন।মা,বাবা নিয়ে আমাদের ছোট্র সংসার ছিল।তখন এত বড়লোক ছিলাম না।বাবার এত টাকাও ছিল না।বাবা ছোটখাট একটা সরকারী করত।ভালোভাবেই দিন কাটতেছিল আমাদের।আমি তখন ক্লাস টু তে পড়ি।কিন্তু “মা” বাবার প্রতি মোটেও সন্তুষ্ট ছিল না।বাবাকে সবসময় “মা” বলত
—তোমার সংসারে থেকে আমি কিছুই পাই নি।তোমার পোস্টে থেকে অন্যরা ঠিকেই অনেক টাকার মালিক হয়েছে আর তুমি কিছুই করতে পারলে না।শাদাফের মা কে শাদাফের বাবা হীরার আংটি, নেকলেস কিনে দিয়েছে আর তুমি আমাকে হীরে তো দূরে থাক স্বর্ণ ও কিনে দিতে পারনি।
—ওদের মত অসৎ উপায়ে টাকা ইনকাম করি না।আর এসব টাকাই শান্তি নাই অরণ্যের মা।শুধু শুধু তুৃমি লোভ কর না।আমরা শান্তিতে আছি এটাই অনেক।
—হ্যা এখন তো বলবাই আমি লোভ করি।তুমি যদি আমাকে এসব না এনে দিতে পার আমি তোমাকে তালাক দিব বলে দিলাম।দুনিয়ায় এত ভালোভাবে চললে হয় না।
বাবা দিনের পর দিন মায়ের এমন উস্কানিমূলক কথা শোনত।এসব শোনতে শোনতে বাবা অতিষ্ট হয়ে যেত।এদিকে মা ও বাবার প্রতি ক্ষেপে তালাক দিতে চাইল।মাকে কাছে রাখতে আর আমার জন্য বাবা ঘুষ খাওয়া শুরু করে।একের পর এক ঘুষ খেত আর অনেক টাকা ইনকাম করত।অল্পদিনেই বাবা অনেক টাকার মালিক হয়ে গেল।বাবার বাড়ি গাড়ি সব হয়ে গেল।কিন্তু এতেও মায়ের শান্তি ছিল না দিন দিন মায়ের লোভ বাড়তে থাকল।মায়ের লোভের জোগান দিতে গিয়ে বিভিন্ন অন্যায় কাজ করে টাকা কামাতে লাগল।আর একদিন ঘুষ খাওয়ার অপরাধে চাকুরীচ্যুত হল।সেদিন বাবা ঘরে এসে চুপ করে বসে ছিল।বুঝতে পেরেছিলাম বাবা সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিল।যে বাবা সবসময় সততার বাণী দিত আজ সে বাবাই ঘুষের জন্য চাকুরী চ্যুত হল।বাবা এক জায়গায় চুপ করে বসে নীরব হয়ে ছিল।বাবাকে দেখে আমি বাবার কাছে যায় বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে সেদিন চুপ করে ছিল।আর মা শাত্ননার পরিবর্তে বলেছিল
—হয়েছে হয়েছে এসব নিয়ে মন খারাপ করতে হবে না।আমাদের ৭,৮ ফ্যাক্টরি আছে ঐগুলা সামলাও।এরকম ঘুষ খেয়ে অনেকেই চাকুরীচ্যুত হয়।এমন মন খারাপ হয়ে বসে থাকলে চলবে না।ব্যাবস্যা বাড়াও।
বাবা শুধু নীরবে কথাগুলা শোনে গিয়েছিল।আর মায়ের সুখের জন্য সব ভুলে আগের মত মন দিয়ে ব্যাবসা করতে লাগল।আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়তাম মাকে সবসময় কাছে পেতাম না।মা ক্লাব নিয়েই পড়ে থাকত। টাকার পাহাড়ে মা যেন আর মা ছিল না।প্রয়োজনেও মা আমার খবর নিত না।আমার সব দায়িত্ব পালন করত রহমত চাচা।মাকে প্রায়ই খেয়াল করতাম একটা লোকের সাথে ঘোরাফেরা করত।মাঝে মাঝে বাসায় নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিত।বুঝতে পারি নি মা কি করছে তবে বুঝতে পারতাম মা যা করছে খারাপ করছে।মায়ের এরকম কর্মকান্ড চলতেই থাকল।আমি তখন ক্লাস সিক্স এ উঠি একদিন ক্লাস শেষ করে এসে দেখি মা,আর বাবার মাঝে তুমুল জগড়া।মা বাবাকে রেখে সেদিন সে পরপুরুষের হাত ধরে চলে গিয়েছিল।আর বাবা মাকে আটকানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু মা কথা শোনে নি।বাবাকে ছাড়ার একটা কারণেই ছিল ঐ লোকটার টাকা পয়সা বাবার থেকে বেশি ছিল।সেদিন মা আমার দিকেও তাকায় নি।আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিল।মা চলে যাওয়ার পর বাবা অনেকটা চুপ হয়ে গিয়েছিল।বাবাকে সবসময় দেখতাম অস্থির থাকত।একটা বছর বাবা পাগলের মত করেছে।হঠাৎ একদিন বাবা আমার রুমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল
—বাবা আমি চলে গেলেও তুই ভালো থাকিস।আর এটা মনে রাখিস মেয়ে মানুষ ছলনাময়ী হয়।ওদের সব দিলেও ওদের মন পাওয়া যায় না রে।
—বাবা তুমি এভাবে কষ্ট পেও না আমার ভালো লাগে না।
—না রে বাবা আর কষ্ট পাব না কষ্টটারে যে ছুটি দিয়ে দিব।
বাবা সেদিন কি বুঝাতে চেয়েছিল জানি না।সপ্তম শ্রেনীতে পড়তাম তখন।আবার এত বড় কথার মানে বুঝে নি তখন।সকালে উঠে দেখলাম বাবার রুমের দরজা আটকানো।রহমত চাচা আর আমি অনেক ডাক দিলাম বাবা উঠল না।শেষ মেষ দরজা ভেঙ্গে ঢুকে দেখলাম আমার বাবা ঝুলতেছে।বাবাকে দেখে বুকের ভিতরে হাহাকার শুরু হল।পাশে একটা চিঠি ছিল আর সেটাতে লিখা ছিল”মেয়ে মানুষ মেয়ে না ছলনাময়ী এক বিষাক্ত জাল।”
বাবার লাশ টা পুলিশে নিয়ে গেল ময়না তদন্ত করে ফেরত দিল।বাবাকে দাফন করে রুমে ঢুকলাম খেয়াল করলাম বাবার উকিল দাঁড়িয়ে আছে।ওনি বলল সম্পত্তির অর্ধেক আর ব্যাংকের টাকা লিখে দিয়ে গেছে আমার নামে।আমি প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর সেগুলা পাব আর সে পর্যন্ত আমার দায়িত্ব নিবে রহমত চাচা আর সব সামলাবে রহমত চাচা।আর বাকি অংশ লিখে গেছে আশালতা মানে আমার মায়ের নামে।সেদিন খুব অবাক হয়েছিলাম এটা ভেবে বাবাকে এত কষ্ট দেওয়ার পর ও মাকে সম্পত্তি লিখে দিছে এজন্য।মা ঠিকেই বাবার সম্পত্তি নিতে এসেছিল কিন্তু আমার দিকে ফিরেও তাকায় নি।কতটা স্বার্থপর হলে এমন করতে পারে সেদিন আমি বুঝেছিলাম
বাবার খুব শখ ছিল আমি ডাক্তার হই।তাই আমি পড়াশোনায় অনেক মনযোগ দেই।আর এদিকে রহমত চাচা সব সুন্দর ভাবে সামলানো শুরু করে।রহমত চাচায় ছিল আমার বাবা আর মা।আমিও মেডিকেলে চান্স পাই।মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর হঠাৎ ক্লাসে একটা মেয়ের উপর চোখ গেল খেয়াল করলাম মেয়টার চোখ গুলা বেশ সুন্দর আর টানা টানা।মেয়েটাকে দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিল। খোজ নিয়ে জানতে পারি মেয়েটার নাম মাবিহা।মাবিহাকে দেখেই আমি হারিয়ে যেতাম স্বপ্নের রাজ্যে।মাবিহা লুকিয়ে ফলো করতাম।খুব ইনট্রোভার্ট হওয়ার কারনে মাবিহাকে তেমন কিছু বলতে পারতাম না খালি তাকিয়ে থাকতাম।একদিন কলেজ ফাংশনে খেয়াল করলাম মাবিহা নীল শাড়ি পরেছে কপালে নীল টিপ আর ঠোঁটে গাড় লাল টুকটুকে লিপস্টিক।মাবিহাকে দেখেই হা করে তাকিয়ে ছিলাম।খেয়াল করলাম মাবিহা আমার দিকেই আসছে। মাবিহা যতই আমার কাছে আসছিল ততই হার্টবিটটা যেন বেড়ে যাচ্ছিল।হঠাৎ মাবিহা আমার কাছে এসে বলল
—মনে হচ্ছে ইদানিং তোমার সাথে আমার দেখাটা অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে।আচ্ছা ফলোটা কি তুমি আমাকে বেশি করছ নাকি আমি তোমাকে?
আমি ভিতরে ভিতরে একরাশ হাসি দিয়ে শান্ত গলায় বললাম
—মনে হয় আমিই করেছি।আমি কোন ভুল করে থাকলে সরি।
—আরে বোকা ভুল কেন করবা কেন।আমার তো বেশ ভালোই লাগে।আচ্ছা তোমার নাম যেন কি?
—অরণ্য।
—বাহ খুব সুন্দর নাম তো।আমার নাম কি জান নাকি খোজ নিয়ে জেনে ফলেছ?
—নাহ মানে জানি।তোমার নাম মাবিহা।
—আরে এত লজ্জা পাচ্ছ কেন?লজ্জা পেলে তোমাকে খুব কিউট লাগে।আচ্ছা তোমার নাম্বারটা কি বলতো।
মাবিহা আমার নাম্বার চাচ্ছে মনে হচ্ছে কোন স্বপ্ন দেখছিলাম।আমার হার্টভিট টা যেন আরও বেড়ে চলল।মনে যে কত কিছু ঘুরতে লাগল।আনন্দের চুটে নাম্বারটাও মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না।তবুও নিজেকে সামলিয়ে মাবিহাকে নাম্বার দিলাম।কিন্তু মাবিহার নাম্বার নেওয়ার সাহস হলনা।কলেজ ফাংশন থেকে এসে শুধু মাবিহার কথায় ভাবতে লাগলাম।হঠাৎ একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসল।অনেকটা আগ্রহ নিয়ে কলটা ধরলাম বাবলাম হয়ত মাবিহা কল দিয়েছে।নাহ কলটা কাস্টমার সার্ভিস থেকে ছিল।এরপর আাবার কল আসল একটা নাম্বার থেকে আমি ধরলাম এবার ফোনের ওপাশ থেকে একটা সুরেলে কন্ঠ বলে উঠল
—অরণ্য আমি মাবিহা।কেমন আছ?
—হুম ভালো আছি তুমি?
—ভালো আছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মাবিহার সাথে আমার কথা বেশ জমে গেল।অল্প সময়েই মাবিহা বেশ আপন করে নিল।মাবিহার সাথে একের পর এক কথা হতে লাগল।আমাদের বন্ধুত্ব টাও বেশ জমে গেল।হঠাৎ একদিন মাবিহা রাত ১২ টায় ফোন দিয়ে বলল
—অরণ্য এখনি আমার হোস্টেলের নীচে আস তো।
—কিন্তু মাবিহা মেয়ে হোস্টলে ঢুকব কিভাবে?
—আরে হোস্টেলের সামনে আস, আমি বের হচ্ছি।
—কেন তোমার কি কিছু হয়েছে।তোমার কি কোন সমস্যা হয়েছে নাকি।
—আরে তুমি একটু বেশিই ভাবছ আস তো আগে।
বুঝতে পারলাম না মাবিহা কেন ডাকছে।কোনরকমে রেডি হয়ে মাবিহার হোস্টেলের সামনে গেলাম।গিয়ে মাবিহাকে কল দিলাম।নাম্বারটা বন্ধ দেখাচ্ছে।আমি চিন্তায় অস্থির হয়ে ঘামতে লাগলাম।হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন আমার চোখ চেপে ধরল।আমি বুঝতে পারলাম না কে আমার চোখটা চেপে ধরল।চোখ ধরে বলল
—বলতো আমি কে?
কন্ঠটা শোনে বুঝতে পেরেছিলাম এটা মবিহা ছাড়া আর কেউ না।আমি বললাম
—কে আর হবে তোরা নামে কোন একটা মেয়ে।
মাবিহা এবার চোখটা খুলে বেশ রেগে গেল আর বলল
—তোরাটা কে শোনি।আমাকে রেখে এখন তোরাকে মিস করা হচ্ছে।
—আরে ধুর কি যে বলনা।তোমাকে রাগানোর জন্য বললাম।তা বল কেন ডেকেছ?
মাবিহা এবার আমার হাতে এক গুচ্ছ রজনী গন্ধা ধরিয়ে দিয়ে বলল
—মনের কথা আর কত চেপে রাখবা প্রপোজটা কি তুমি করবা নাকি আমি
আমি এবার বেশ লজ্জায় পাচ্ছিলাম।মাবিহার হাত থেকে রজনী গন্ধাটা নিয়ে মাবিহাকে বলে উঠলাম
— মাবিহা আই লাভ ইউ।
তখনি খেয়াল করলাম আশেপাশে সবাই এসে হাজির আর ট্রিট এর জন্য বায়না ধরল।আমিও সবাইকে পরদিন ট্রিট দিলাম।আস্তে আস্তে আমাদের প্রেমটা বেশ জমে গেল।মাবিহাকে সবসময় খুশি করার চেষ্টা করতাম।মাবিহা রাগ করলে ওর রাগ ভাঙ্গানোর জন্য কত কিনাই করতাম।ভালোই জমে গেল আমাদের প্রেম টা।
এর মধ্যে মেডিকেল পড়া শেষ করলাম ডাক্তার হলাম।অল্প দিনের মধ্যেই আমি বেশ পরিচিতি পেয়ে গেলাম।অল্পদিনে এত ভালো পরিচিতি দেখে অনেকে আমাকে হিংসাও শুরু করতে লাগল।এবার মাবিহাকে বিয়ে করার পালা।মাবিহাকে বললাম।মাবিহা লাজুক স্বরে উত্তর দিল
—চাচাকে পাঠাও আমি রাজি।
চাচা মাবিহার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেল আর মাবিহার মা, বাবাও মেনে নিল।খুব ধূমধামে আমাদের বিয়েটা হল।একমাস পরেই মাবিহার জন্মদিন ছিল।আমি মাবিহা কি উপহার দিলে খুশি হবে বুঝতে পারছিলাম না।অবশেষে মাবিহার জন্য ছোট ছোট জিনিস দিয়ে একটা ঘর সাজালাম।মাবিহাকে রাত ১২ টায় চোখ বন্ধ করে ঐ রুমে নিয়ে গেলাম।মাবিহার চোখ খোলে এসব দেখে বেশ খুশি হল।আমাকে জড়িয়ে ধরে সেদিন বলল
—আমি অনেক খুশি হয়েছি।কিন্তু আমি চায় তুমি আমাকে তোমার থেকে ২ টা বাড়ি লিখে দাও যাতে আমি গর্ব করে বলতে পারি আমার স্বামী আমাকে বার্থ ডে তে বাড়ি গিফট করেছে।
মাবিহার কথাটা শোনে কোনরূপ সন্দেহ ছাড়াই আমি ওকে বাড়ি লিখে দেয়।এর ঠিক এক মাস পরেই মাবিহা আমাকে বলল
—অরণ্য এই নাও ডিভোর্স পেপার সাইন দিয়ে দাও।আর আমার কাবিনের সব টাকা আমাকে দিয়ে দাও।
মাবিহার কথা শোনে আমার যেন মাথায় আাকাশ ভেঙ্গে পড়ল।মাবিহা হঠাৎ কি বলছে এসব।হয়ত মজা করছে
—মাবিহা মজা কর না তো।এসব মজা আমার পছন্দ না তুমি জান তো।তাহলে মজা করছ কেন।
—অরণ্য আমি সিরিয়াস।আমাকে ডিভোর্স দাও।
—মাবিহা এসব বলার মানে কি।কিজন্য তুমি আমাকে ডিভোর্স দিবা।কি কমতি রেখেছি তোমার।তুমি যা চেয়েছ দিয়েছি।তাহলে কেন?তোমাকে কি দেয় নি বল?
—আমি জানি তুৃমি আমাকে পাগলের মত ভালোবাস।জানি আমার জন্য তুমি অনেক করেছ।কিন্তু এছাড়া আমার কোন উপায় নাই।আমাকে ভালোবাসলে আমাকে ডিভোর্স দাও।
—কিন্তু কেন?
তারপর মাবিহা যা বলেছিল আমি আমার কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।কারন ময়ে মানুষ এতটা স্বার্থপর ও হতে পারে জানা ছিল না।মাবিহা বলেছিল…..
লেখিকা-#শারমিন আঁচল নিপা
(অরণ্য নামটা নিয়া অনেকের একঘেয়েমি আসতে পারে।তাদেরকে বলছি এ নামটা ছাড়া গল্প লিখলে আমি ভালো লিখতে পারি না।আর এ নাম দিয়া গল্প লিখার কারন “বাস্তবের অরণ্যকে কল্পনার চরিত্রে পবার ক্ষু্দ্র প্রয়াস মাত্র” )