পদ্মপুকুর,পর্ব: ০১

0
1255

পদ্মপুকুর,পর্ব: ০১
ধরণ: অতিপ্রাকৃত
লিখা: বর্ণালি সোহানা

১.
গভীর রাত নেমেছে। পানির ঝুপঝাপ আর বাতাসের শনশন আওয়াজ একত্রিত হয়ে চারপাশের প্রকৃতি এক বিকট রূপ ধারণ করেছে। বাতাসের তীব্র ঝাপটায় যেন মানুষ উড়ে যাবে। আকাশে মেঘের সাথে মেঘের ঘর্ষণে গুড়গুড় আওয়াজ করে থেকে থেকে বাজ পড়ছে। পানিতে ভাসমান সাপটা তেড়ে আসছে তারা মিয়ার দিকে। তারা মিয়া সাঁতার কেটে উপরে উঠতে চাইছে কিন্তু কোনো কূল কিনারা পাচ্ছে না। কতক শুভ্র পদ্মের সাথে বারবার হাত, পা আটকে যাচ্ছে। এদিক-সেদিক প্রাণপণে সাঁতরে চলেছে। সে যত দ্রুত সাঁতরাচ্ছে সাপটা ততই দ্রুত তার পেছন পেছন আসছে। এত বড় সাপ জীবনেও দেখেনি তারা মিয়া। হুট করে মনে হলো কেউ তার পা চেপে ধরেছে। যত সামনে এগোতে চাইছে তত পেছন থেকে কিছু একটা টেনে ধরছে তাকে। নাকে, মুখে পানি ঢুকে যাচ্ছে। নিশ্বাস নিতে পারছে না। দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। গায়ের সব শক্তি যেন লোপ পেয়েছে। পানির মধ্যে এমনিতেই গায়ে শক্তি কম অনুভূত হয়। তখনই তার সম্মুখে সবুজ রঙের একটা সাপ কয়েক ইঞ্চি চ্যাপ্টা ফণা তোলে৷ তারা মিয়া সাপটাকে দেখে উল্টো ঘুরে বারংবার চেষ্টা করেই যাচ্ছে পুকুর থেকে উঠে আসার। আচমকা সামনে অদূরে কিছুটা আলো দেখতে পায়। সম্বিত ফিরে আসে তার। পাড় থেকে খানিকটা দূরে মৃদু হারিকেনের আলো দেখতে পাচ্ছে। তারা মিয়ার কলিজায় তেজ আসে। অনেকটাই প্রাণ ফিরে পাওয়ার মতো। হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটতে লাগে সে। ওইতো কিনারা দেখা যাচ্ছে। কিনারায় গিয়েই তারা মিয়া নিজের দেহটার ভার ছেড়ে দেয়।

ফরুক মোল্লা সামনে কিছুর আওয়াজ পেয়ে হারিকেন হাতে দৌড়ে আসে। গ্রামের মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন তিনি। গ্রামের সবাই মিলে তাঁকে বেতনভুক্ত করে রেখেছে৷ তিনবেলার খাবারটাও গ্রামের লোকেরা দেয়। খাবার একদিন খাঁ বাড়ি থেকে আসে তো অন্যদিন চৌধুরী বাড়ি থেকে। কয়েকটা সম্ভ্রান্ত পরিবার তাঁর খাবারের দ্বায়িত্ব নিয়েছে।

দূর থেকেই ফরুক মোল্লা হাঁক ছাড়েন, “কিডায়? কিডায় ওইহানে?”

“হুজুর, হুজুর”

তারা মিয়া গুঙিয়ে গুঙিয়ে তাঁকে ডাকছে। ফরুক মোল্লা হারিকেন হাতেই ছুটে এসে দেখেন মাটিতে পড়ে আছে তারা মিয়া। কালো, লম্বাটে মুখখানা ঠাণ্ডায় আরও কালো হয়ে গেছে। চামড়া যেন কুঁচকে গেছে।
পাশেই মাটিতে হারিকেন রেখে তারা মিয়ার মাথা ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “আরে তারা মিয়া না! কী হইছে তোমার? এইহানে এই রাত্তিরে কী করো?”

তারা মিয়া আমতা আমতা করে কিছু বলতে গিয়ে জ্ঞান হারায়৷ পাশেই তার মাছের ঝুড়ি রাখা। ফরুক মোল্লা মাছের ঝুড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে নেন একবার৷ তারা মিয়ার কাপড় ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। ফতুয়া ও লুঙ্গী কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। ফরুক মোল্লা তার পেটে এক হাতের উপর অন্য হাত রেখে চাপ দিতে লাগলেন৷ কয়েকবার চাপ দেওয়ার পর তারা মিয়ার মুখ দিয়ে গলগল করে পানি বেরিয়ে আসে। খুক খুক করে কাশতে লাগে সে। দ্রুত নিশ্বাস ফেলছে।

রাবিয়া বেগম গভীর ঘুমে নিমগ্ন। সারাদিন কাজ করে শরীরটা আর মানে না। বিছানায় শুতেই ঘুম নেমে আসে চোখ জুড়ে। পাশের ঘরেই শুয়ে আছেন তারা মিয়ার মা আনোয়ারা বিবি। বয়স হয়েছে ষাটোর্ধ। এই বয়সে ঘুম কম হয়। হালকা কিছুর নড়চড় পেলেও ঘুম ভেঙে যায়। হাতের তসবিহখানা এখনও আঙুলের ফাঁকে রয়েছে। ঘুমের ভেতরেও তসবিহ পড়েন। ফরুক মোল্লা তারা মিয়াকে ধরে নিয়ে বাড়িতে আসেন।

বাইরে থেকে বার কয়েক আওয়াজ দেন, “নূরের মা, ও নূরের মা! দুয়ারডা খুলো।”

রাবিয়াকে এতবার ডাকার পরেও কোনো সাড়াশব্দ নেই। আনোয়ারা বিবি ঘুম থেকে উঠে রাবিয়াকে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগলেন, “এই নূরের মা, নূরের মা, উঠোস না ক্যান? মইরা গেছতনি? এই উঠ।”

রাবিয়া ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। চোখ কচলে উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হইছে আম্মা? কী হইছে?”

“মরার মরা, তোরে বাইর থেইক্যা ডাকতেছে। উঠ কিডায় আইছে দেখ।”

রাবিয়া চোখ কচলে বিছানা থেকে উঠে হারিকেনের মৃদু আলোটা বাড়িয়ে দেয়। হারিকেন হাতে নিয়ে ধীর পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে চেষ্টা করছে বাইরে কে আছে। কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।

ভেতর থেকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিডায় বাইরে?”

“আমি ফরুক মোল্লা। দুয়ারডা খুলো! তারা মিয়ার শইলডা খারাপ করছে। আমি তারে লইয়া আইছি।”

কথাটা শুনে যেন নিশ্বাস আটকে যায় রাবিয়ার। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায় মুহুর্তেই। তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে দেয়। স্বামীকে এমন অবস্থায় দেখে শরীর যেন থরথর করে কাঁপছে তার। তারা মিয়াকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফরুক মোল্লা বাইরে বের হয়ে আসেন। রাত তিনটা বাজতে চলল। তাহাজ্জুদ নামাজের সময় চলে যাবে তাই দ্রুত পায়ে মসজিদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

ছেলের এই অবস্থা দেখে আনোয়ারা বিবি কান্না জুড়ে বসেছেন।

“ওরে আমার পোলাডার কী হইলো রে? আমার একডা মাত্র পোলা। আল্লাহ তুমি আমার পোলাডারে ভালা কইরা দেও। মরা, তোর লাইগ্যা আইজ আমার পোলার এই অবস্থা।”

আনোয়ারা বিবি রাবিয়াকে যা-তা বলেই যাচ্ছেন। স্বামীর এই অবস্থার জন্যেও না-কি সেই দায়ী। রাবিয়া কিছু বলে না। চুপচাপ সব শুনতে থাকে। আগে কথায় কথায় জবাব দিত। যার কারণে প্রায়শই ঝগড়া লেগে থাকতো। স্বামী যখন বলল তার মা কিছু বললে সে যেন চুপ করে থাকে। তখন থেকে সে কখনোই কোনো কিছু বলে না। আনোয়ারা বিবি চোখে জল নিয়েই নিজের শোবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েন। মাটির দেয়াল আর টিনের ছাউনির ছোট ঘরটা বাড়ির ঠিক পশ্চিম দিকে। মাঝখানে উঠান আর পূর্ব দিকে রান্নাঘর। দক্ষিণ পাশে শৌচাগার। উত্তর পাশে তারা মিয়ার দুই চাচাতো ভাইয়ের দালান ঘর। ওই দুই ঘরের পরেই মনিরের ছোট একটা ঘর। ঘরের পূর্ব দিকে রান্নাঘর আর গোয়ালঘরও আছে। তারা মিয়ার ঘরটায় দুইটা শোবার ঘর। একটাতে রাবিয়া তার ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে থাকে। অন্যটাতে শাশুড়ী থাকেন।

রাবিয়া বেগম তারা মিয়ার মাথার পাশে বসে আছে। স্বামীর এমন অবস্থা দেখে একদম ভয়ে চুপসে আছে। তালি দেয়া সুতি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছে কিছুক্ষণ পরপর। গোলগাল, ফরসা মুখে চিন্তায় যেন অমাবস্যা নেমে এসেছে৷ উষ্কখুষ্ক লম্বা চুলগুলো খোঁপা করে রাখে। অতিকষ্টে তারা মিয়ার কাপড় বদলে আবার বিছানায় শুইয়ে দেয়। মাথার পাশে বসে হাত পাখার বাতাস করতে থাকে চুপ করে। দ্রুত নিশ্বাস ফেলছে তারা মিয়া। ঘুমিয়ে গেছে এতক্ষণে ।

আব্দুল্লাহ তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য মসজিদে যাচ্ছে। পুরো বছর সে মসজিদে নামাজ পড়ে। তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামাজ পড়ে রোজকার মতোই চেয়ারম্যান বাড়িতে যাবে। চেয়ারম্যান বাড়ির সব কাজ তারই করতে হয়। গ্রামের পুরনো দিঘির পাশ কাটিয়ে যেতে হয় মসজিদে। বহু বছরের পুরনো এই দিঘি। চেয়ারম্যান গ্রামের লোকদের জন্য মাছ ফেলেন প্রতি বছর। হেলালও তার ভাইয়ের সাথেই নামাজে যাচ্ছে। হাতের হারিকেনে নিভুনিভু আলো জ্বলছে। তাহাজ্জুদ নামাজের ওয়াক্ত হলেই ডাকাডাকি শুরু হয়ে যায় আব্দুল্লাহর। বাড়িতে সবার ঘরের দরজায় গিয়ে কড়া নেড়ে ডেকে দেয় নামাজ পড়ার জন্য। যতক্ষণ না ভেতর থেকে কেউ জবাব দিচ্ছে ততক্ষণ ডাকতেই থাকে। অনেকে তার এসব কাজে বিরক্তও হয়। কিন্তু বাড়ির বড় ছেলে হওয়ায় কেউ কিছু বলে না। না চাইতেও চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে মসজিদে যেতে হয় হেলালের। আকাশের অবস্থা ভালো না। কিছুক্ষণ আগে ঠিক যেন এক পশলা কালবৈশাখী ঝড় হয়ে গেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে এখনও। তবুও নামাজ বাদ যাবে না আব্দুল্লাহর। হঠাৎ করেই হেলালের চোখ পড়ল দিঘিতে। কারা যেন জাল ফেলছে।

আচমকা আব্দুল্লাহর বাহুতে হাত দিয়ে বলল, “ভাইজান আমগো দিঘিতে এই রাত্তিরে কিডায় মাছ মারে!”

আব্দুল্লাহ তাকিয়ে দেখে আসলেই দিঘির ওই পাড়ে কারা জাল ফেলছে। হাতের হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দু’জনে দুইদিক দিয়ে দৌড় দেয়। একদিকে গেলে চোর পালিয়ে যাবে। ততক্ষণে চোরগুলো মানুষের উপস্থিতির টের পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে যায়। দুইজন সবকিছু ফেলেই দৌড় দেয়। ধস্তাধস্তি করে বাকি দুইজনকে ধরে ফেলে। আজকে আর নামাজে যাওয়া হলো না তাদের। চোর দুইজনকে নিয়ে চেয়ারম্যান বাড়িতে যেতে হবে। বিচার হবে সেখানে।
.
.
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here