পদ্মপুকুর,পর্ব: ০২

0
503

পদ্মপুকুর,পর্ব: ০২

রাতের গভীরতা বেড়েছে। পুকুরের তলদেশ খুব গভীরে। সেই গভীরে অনেক ধনরত্ন পড়ে আছে৷ তারা মিয়া চাইলেই যেন তা নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু ভয় পাচ্ছে এগোতে। কার জিনিস এগুলো? আগে এখানে পাশেই এক মন্দির ছিল। হয়তো ওই পুরনো মন্দিরে কেউ ছিল যার সম্পদ এগুলো। তার এতো ভাবলে চলবে না। ঐ ধনরত্ন তুলে আনতে হবে। পুকুরে নেমে দু’হাতে পদ্মগুলো একপাশে সরিয়ে ডুব দেয় তারা মিয়া। এক ডুবে পুকুরের তল দেখা যায় না। অনেক গভীর পুকুর। ধীরে ধীরে নিচ থেকে নিচের দিকে যাচ্ছে সে। ওইতো স্বর্ণ, মানিক-মুক্তার ঝলকানি দেখতে পাচ্ছে। তারা মিয়ার সাঁতারের গতি আরো বেড়ে যায়। খনির কাছে পৌঁছায় সে। দু’হাতে উঠিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে ছড়িয়ে থাকা স্বর্ণালঙ্কার। সে আনন্দে দিশেহারা প্রায়। ধনরত্ন নিয়ে উপরে উঠতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। সেই বড় সাপটা তার পা পেঁচিয়ে নিল নাতো? না, পদ্মফুলের সাথে পা আটকে গেছে তার। পা ছাড়িয়ে প্রবল শক্তিতে টেনে উপরে উঠে অমূল্য ধনরত্ন নিয়ে বাড়ির দিকে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে তারা মিয়া।

বাড়ির সামনে এসে তার পা থমকে যায়। এত লোক কেন! কীসের এত জটলা! কান্নার রোল পড়ে গেছে। এভাবে হুঁ হুঁ শব্দে কে কান্না করছে! তারা মিয়ার নিশ্বাস চেপে আসে। ফুঁপাতে শুরু করে। হাত-পা এদিক-সেদিক ছুঁড়তে লাগে।

“এই যে হুনতাছেন? কী হইছে আপনের? এমন করতাছেন ক্যান?”

রাবিয়া দু’হাতে তারা মিয়ার গালে আস্তে আস্তে চড় মারতে লাগে। কয়েকটি চড় খেয়ে হুঁশ ফিরে আসে তার। ঘুমের মধ্যে কি সব আবোলতাবোল স্বপ্ন দেখছিল। সম্পূর্ণ শরীর গরম হয়ে গেছে। ঘেমে নেয়ে একাকার। রাবিয়া তার শাড়ির আঁচল দিয়ে শরীর মুছে দিতে থাকে।

পাশের ঘর থেকে শাশুড়ী জিজ্ঞেস করলেন, “আবার কী হইছে রে নূরের মা? তারার শইলডা খারাপ করছেনি?”

রাবিয়া চোখ মুছে উত্তর দিল, “না আম্মা আফনে ঘুমান। উনি ঠিক আছেন।”

আনোয়ারা বিবি আবার ঘুমিয়ে পড়েন। নাক ডাকতে লাগেন মুহুর্তেই। নাকের ভেতর থেকে কেমন গড়গড় করে আওয়াজ বের হচ্ছে। তাঁর ভাষ্যমতে, তিনি নাক ডাকেন না। অথচ এই নাক ডাকার কারণে আশেপাশের সবাই সজাগ হয়ে যায়।

রাত হয়তো তিনটা পেরিয়েছে। ঘড়ি নেই তাই আন্দাজ করেই সময়টা ধরে নিলো রাবিয়া। এই মাঝরাতে মানুষটার কি হলো কে জানে! পাশের হারিকেনের আলোটাকে একটু বাড়িয়ে দেয়। অন্ধকার ঘরে কিছুটা আলো ছড়িয়ে আবছা আলোআঁধারি তৈরি করে। চৌকি থেকে নেমে মাটির কলসি হতে এক মগ পানি নিয়ে দেয় তারা মিয়াকে। গটগট করে পানি খেয়ে পানির মগটা রাবিয়ার হাতে ধরিয়ে বালিশ একটু উঁচু করে মাথাটা ঠেকায় সে। নূর পাশেই গুটিসুটি মেরে গভীর ঘুমের রাজ্যে হারিয়েছে। তার স্বপ্নে হয়তো এখন শতশত প্রজাপতি আর পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। ফরসা গোলগাল মুখখানা চাঁদের মতো লাগছে। তাদের ছেলেটা এ বাড়ির সবার থেকে অন্যরকম। মায়ের থেকেও ফরসা গায়ের রং ছেলের। রাবিয়া ছেলের মাথার নিচের বালিশটা ঠিক করে দেয়। পাশে শুয়ে আলতো করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চুলগুলো কেমন লালচে-ধূসর। একটা চুলের গায়ের সাথে যেন অন্যটা লাগে না। দেখলে মনে হয় বিদেশ থেকে টপকে পড়েছে। তারা মিয়া রাবিয়ার পাশে শুয়ে পড়ে। ঘুম যেন আসতে চাইছে না। এমন ভয়ানক স্বপ্নের পর ঘুম আসতে চাইবেই বা কার! চোখজোড়া সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়।

২.

কুমুদবহুলা গ্রামে ভোর হতেই মানুষের চলাচল শুরু হয়ে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। পুব আকাশে সূর্য মামা এখনও উঁকি দেয়নি। রোদ উঠবে বলে মনে হয় না। আকাশে ভাসমান কালো মেঘের ঘনঘটা। শেষ রাতে বৃষ্টি হয়েছে। পথঘাট স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে৷ আঁকাবাঁকা মেঠোপথটার দু’পাশে অসংখ্য গাছগাছালি ক্লান্ত পথিকদের ছায়া দিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। গাছের পাতাগুলো ঘন সবুজ রঙের হয়ে আছে। অনেক বছরের পুরনো গাছগুলো। বৃষ্টি যেন সবকিছু ধুয়েমুছে একদম স্নিগ্ধ সুষমায় ভরে দিয়ে গেছে।

পরিবেশের থমথমে নিস্তব্ধতা কে হার মানিয়ে মুখরিত করে তুলেছে গ্রামের মানুষের কথার গুঞ্জন। তারা মিয়া এই গ্রামেরই একজন খেটে খাওয়া মানুষ। দিনমজুরি করে জীবনযাপন করে। কাজ না থাকলে বাড়িতে বসে থাকতে হয়। তখন রাতের বেলা লোকচক্ষুর আড়ালে এই পুকুর থেকে ওই পুকুরে মাছ ধরে বেড়ায়। ভয়ও পায় কবে জানি আবার চোর বলে তাকে গণপিটুনি খেতে হয়।

তারা মিয়া বাজারে যাচ্ছে কাজের সন্ধানে। তাদের এখানে আবার ভিন্ন নিয়ম। সব দিনমজুর বাজারে গিয়ে সারি বেঁধে বসে থাকে। সেখানে বিভিন্ন গ্রামের লোকেরা এসে নিজের পছন্দ মতো কাজের লোক বেছে নেয়। মূলত তারা কাজ করার ক্ষমতা অনুমান করে নেয়৷ শরীর দেখলেই বুঝে যায় কে কতটুকু কাজ করতে পারবে। তারা মিয়া বেশ রোগা কিসিমে’র একজন মানুষ। না খেয়ে খেয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে তা নয়। যা তরকারিই হোক না কেন সে প্রচুর খায়। তাকে দেখলে বোঝা যায় না এত খেতে পারে সে। এই শরীর দেখে লোকে কাজেও নিতে চায় না। কিন্তু কেউ জানে না সে প্রচুর কাজ করতে পারে।

বাজারে মানুষের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে৷ সকাল থেকেই মুদি দোকানের সাথে কাঁচা তরকারির বাজার বসে যায় এখানে। জনমানুষের কোলাহলে নিশ্চুপ বসে আছে তারা মিয়া। মনের গভীরে সুপ্ত আশা, আজ হয়তো কাজ পেয়ে যাবে। দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছে মনির কাঁচা তরকারি নিয়ে বসে আছে। মনির তারা মিয়ার ছোট ভাই, সেও দিনমজুরি করে। কিন্তু সবজির মৌসুমে সবজি চাষ করে। বাড়ির পাশেই ছোট একটা ক্ষেত আছে সেখানে মনির নিজ হাতে সবজি চাষ করে। তারপর বাজারে এনে চড়া দামে বিক্রি করে। এই বছর হুট করে অধিক বৃষ্টি হওয়ার কারণে সবজিগুলোও কেমন নেতিয়ে গেছে। এখন তরকারির দাম পাওয়া যাবে না। কোনো রকম বিক্রি করতে পারলেই হলো। এই বছরে কষ্ট হয়ে যাবে সবার।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে এলো। অনেকেই মজুর নিয়ে গেল কিন্তু তারা মিয়া সেখানেই বসে আছে। গ্রামের মানুষজন তাগড়া যুবক ছেলেদের কাজে নেয় বেশি। তারা মিয়ার বয়স হয়েছে চল্লিশের কাছাকাছি। দেখতেও হ্যাংলা, বয়স্ক আর কালো। এমন শরীর দেখে কেউ কাজে নিতে চায় না। বেশ সময় ধরে বসে থাকে কিন্তু আজ আর তার কাজ পাওয়া হলো না। শহীদ মহাজন তার দোকান থেকে উঁকি দিয়ে বারবার তাকাচ্ছে। কেউ কাজের সন্ধান না পেলে মহাজন তাকে টাকা ধার দিয়ে থাকে৷ কেউ না চাইতেও অনেককে টাকা দেওয়ার পেছনে মূল কারণ অধিক পরিমাণে সুদ আদায় করা। টাকা দেওয়ার পরে সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দেনাদারদের গলায় ছুরি বসায়। তারা মিয়া পুটলি হাতে নিয়ে বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখনই মহাজন দোকানের কর্মচারীকে পাঠিয়ে তাকে ডাক দেয়৷ তারা মিয়া মহাজনকে বেশ একটা পছন্দ করে না। শুধু সে নয় গ্রামের কেউই তাকে পছন্দ করে না। শুধু বিপদে কাজে আসে বলেই কেউ তা জাহির করে না। মহাজনের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল তারা মিয়া। তখনই বাজারে হৈচৈ শুনা যায়। তাদের গ্রামের দিঘি থেকে অন্য গ্রামের ছেলেরা মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল রাতে। তখন চেয়ারম্যান বাড়ির কাজের লোক আব্দুল্লাহ আর তার ভাই তাদের দেখে ধরেছে। দুইজন পালিয়ে গেছে আর দুইজন ধরা পড়েছে। এই দিঘির মাছ প্রতিবছর একদিন উৎসবের মতো আয়োজন করে ধরা হয়, তারপর সবাই ভাগ করে নেয়।

চেয়ারম্যান বাড়িতে বিচার বসেছে। সকলে সেদিকেই ছুটে যাচ্ছে। চেয়ারম্যান সবার সাথে ন্যায় বিচার করেন। তবে কিছুটা রগচটা স্বভাবের। মাঝেমধ্যে বিনা কারণেই যে কারো উপর রেগে যান। গ্রামে যেমন কিছু মানুষ আছে একদম তার অন্ধ ভক্ত তেমনই কিছু মানুষ আছে যারা চেয়ারম্যানের সম্পর্কে এমন অনেক কিছুই জানে যা সাধারণ অনেক মানুষই জানে না। সেজন্যে তাকে কেবল অপছন্দ করে না দুশমনও ভাবে। তার বিচারে গ্রামের কিছু মানুষ খুশি হলে কিছু মানুষ নারাজও হয়। চেয়ারম্যান যদি দেখেন তিনি বিচার করলে হবে না তখন পুলিশে সোপর্দ করে দেন। উৎসুক গ্রামবাসী এটাই জানতে যাচ্ছে যে বিচারে অপরাধীদের সাথে কী হয়! অপরাধী দুইজন চেয়ারম্যান বাড়ির উঠানের এক মাথায় বসে আছে। যে দুইজন পালিয়ে গিয়েছিল তাদের নাম জানা যায় এদের কাছ থেকে। পাশের গ্রামের মেম্বার এসেছেন বিচারের জন্য। কিন্তু বাকি দুইজনকে সাথে করে নিয়ে আসেননি। সবাই জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন ওদের নাকি গ্রামেই দেখা যায়নি। হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে। বাকি দুইজনের অনুপস্থিতিতে উপস্থিত দুইজনকে নিয়েই বিচার বসে। বিচারে রায় হয় এরা দুইজন মিলে কান ধরে পুরো গ্রামে এক চক্কর দেবে। সবাই এই বিচারে সহমত প্রকাশ করেন। পাশের গ্রামের মেম্বার এতে ক্রুদ্ধ হলেও কিছু করার থাকে না উনার।
.
.
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here