পদ্মপুকুর,পর্ব: ০৩,০৪
লিখা: বর্ণালি সোহানা
পর্ব: ০৩
চোর দুইজন কান ধরে সম্পূর্ণ গ্রামে ঘুরছে। গ্রামের বাচ্চারা তাদের পিছুপিছু দৌড়াচ্ছে। নূর হৈচৈ শুনে বাড়ির রাস্তায় বের হয়। রাস্তায় এসে দেখলো তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে দুইজন লোক কান ধরে যাচ্ছে। পরনে তাদের গেঞ্জি আর লুঙ্গি। গায়ে কাঁদামাটি লেগে আছে তাদের। কাঁদা শুকিয়ে গেছে। বাচ্চাদের মতো কান ধরে হেঁটে যাচ্ছে দুইজন। তারা মিয়াও তাদের পিছু হয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। নূরকে রাস্তায় দেখে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়। বাবার সাথে হাঁটছে আর পেছন ফিরে তাকাচ্ছে।
চোরগুলো দৃষ্টির আড়াল হতেই জিজ্ঞেস করল, “আব্বা এরা কান ধইরা যাইতাছে ক্যান?”
তারা মিয়া ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বলল, “বাজান এরা দুইজন চুরি করছে। তাই চিয়ারম্যান তাগোরে শাস্তি দিছে।”
“চুরি কী আব্বা?”
উচ্চতায় বাবার হাঁটু পার করেছে নূর। এটুকু বয়সী বাচ্চাদের যেকোনো জিনিস জানার আগ্রহ থাকে অনেক বেশি। নিষ্পাপ মনে অনেক প্রশ্ন থাকে তাদের। তখন যে শিক্ষাই দেয়া হয় সেই শিক্ষাই গ্রহণ করে।
তারা মিয়া ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “কারও জিনিস না বইলা নিয়া নিলে ওইটারে চুরি কয় বাজান। আর এই দুইজন রাইতের বেলা আমাগো গেরামের দিঘি থেইক্যা মাছ চুরি করতে আইছিল।”
নূর বাবার দিকে অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। প্রায় রাতেই তারা মিয়া ঘরে থাকে না। ভোরের দিকে অনেকগুলো মাছ নিয়ে বাড়িতে ফিরে। সকালে সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে। নূর এটা প্রায় সময়ই দেখেছে। তাহলে কি তার বাবাও চুরি করে? তারা মিয়া পরনের ফতোয়া খুলছিল।
নূর তার সামনে গিয়ে বলল, “আব্বা, তুমিও তাগোর লাহান মাছ চুরি করো?”
নূরের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তারা মিয়া। রাবিয়া দরজায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। ঘরের ভেতর এসে বলল, “নূর খেলতে যা বাজান। আইজকা শুক্কুরবার কেউ ইশকুলে যায় নাই। যা, খেলতে যা।”
মায়ের কথাটা শুনা মাত্রই নূর ভোঁদৌড় দেয়। সবাই হয়তো তাকে রেখেই খেলা শুরু করে দিয়েছে। ঘর থেকে বের হয়ে উঠানের এই মাথা থেকেই দেখতে পাচ্ছে সবাই পুকুরের ধার ঘেঁষে বিস্তীর্ণ খালি জায়গাটাকে খেলার জন্য ঠিক করছে। তা দেখেই নূরের মুখে রাজ্যের হাসি ফুটে ওঠে।
৩.
গ্রামের লোকজন রাত দশটা বাজার আগেই ঘুমায় আবার ভোর ছয়টার দিকেই ঘুম থেকে উঠে যায়। ভোর হতেই দিনের সকল কাজ শুরু হয় সবার। কেউ যায় মাঠে গরু চড়াতে, কেউ যায় ফসল দেখতে, কেউ বা যায় বাজারের থলে নিয়ে। সারাদিন কাজের ব্যস্ততা তাদেরও থাকে। ভোরে ঘুম থেকে উঠার মাঝেও একটা রসদ খুঁজে পাওয়া যায়। সূর্যের প্রথম কিরণ চোখের তৃষ্ণা মেটায়। ভোরের মিষ্টি রোদ দেহকে সতেজ, নির্মল করে তোলে। শান্ত পরিবেশের স্নিগ্ধতায় মন ও মস্তিষ্কের শান্তি খুঁজে পাওয়া যায়। বুক ভরে যখন নিশ্বাস নেয়া হয় তার মাঝে একটা মিষ্টি সুগন্ধি মিশে থাকে।
প্রতিদিনের মতো আজও খুব ভোরেই পাখির মিষ্টি কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙে নূরের। ঘুম ভাঙলে কখনোই আর বিছানায় থাকে না সে। কিন্তু আজ বিছানা থেকে উঠার সময় দেখলো তার বিছানা ভেজা। ভয়ে ভয়ে প্যান্টে হাত দিয়ে দেখে প্যান্টটাও ভেজা। কেমন বিশ্রী একটা গন্ধ আসছে! গতকাল রাতে যে স্বপ্ন দেখেছিল সে কথা মনে হয় তার।
পুকুর ঘাটে খেলছে সে। কেউ পুতুল সাজাচ্ছে তো কেউ বিভিন্ন গাছের পাতা, ফুল, বালু ও ইটের গুড়া দিয়ে রান্নার কাজে ব্যস্ত। নূরের তখন ভীষণ প্রস্রাবের চাপ এসেছে। পেছনেই বাঁশঝাড়। নূর সেদিকে এগিয়ে যায়। “সুই” শব্দ করে প্রস্রাব করে দেয়। স্বপ্নের ভেতর যখন সে বাঁশঝাড়ের তলায় প্রস্রাব করছিল তখন আসলে সে বিছানা ভেজাচ্ছিল। এখন টের পেয়েছে সব। দম ধরে বসে আছে ভেজা বিছানায়। মা দেখলে কী বলবে সেই চিন্তা জেঁকে বসেছে তার মাথায়, ভয় পাচ্ছে ভীষণ।
ঘরের মধ্যে সবার আগে ঘুম থেকে উঠেন আনোয়ারা বিবি। বারান্দার একটা কোণা তার সারাদিনের বসার জায়গা। আনোয়ারা বিবি পাটি বিছিয়ে বারান্দায় বসে একটা একটা করে নারকেলের পাতা থেকে কাঠি বের করছেন। এগুলো দিয়ে ঝাড়ু বানানো হয়। রাবিয়া প্রতিদিন উঠে সামনের উঠান ও ঘর ঝাড়ু দেয়। নূর মায়ের পিছু পিছু হাঁটে। রাবিয়া নূরের অবস্থা দেখে কখনও বিরক্ত হয় তো কখনও হাসে৷ তারা মিয়া রাত জেগে মাছ ধরে আর সকাল দশ-এগারোটা বাজিয়ে ঘুম থেকে উঠে। নূর প্যান্ট বদলে বাইরে আসে। ভেজা প্যান্টটা বিছানার কোণায় লুকিয়ে রাখে। প্রতিদিনের মতো আজও মায়ের পিছু পিছু হাঁটছে৷ কীভাবে এই কথা বলবে সেটাই ভাবছে। ভেতরে ভেতরে কান্না পাচ্ছে তার। মাঝেমধ্যে ঠোঁট উল্টে যাচ্ছে কিন্তু আবার কান্নাটা বেরিয়ে না এসে ভেতরেই চেপে যাচ্ছে।
নূরের এসব কাজে রাবিয়া বিরক্ত হয়ে বলল, “এক জাগায় বইলেও তো পারোস৷ পিছে পিছে আইতাছস ক্যান?”
বেচারা মায়ের ধমক খেয়ে ওখানেই থমকে দাঁড়ায়। আনোয়ারা বিবি খালি মুখেই ঠোঁটের ভাঁজে পাতা বিড়ি পুরে দিচ্ছেন। বিড়ি খাওয়া তার একটা নেশা বলা যায়। গ্রামের প্রায় বয়স্ক মহিলারা পাতা বিড়ি খায়। সবার সামনেই খায় তারা, এতে বিন্দুমাত্র লজ্জা কাজ করে না তাদের। তারা মিয়া মায়ের জন্য নিজেই বিড়ি এনে দেয়। কখনও কখনও মায়ের থেকে নিয়ে সেও দু’এক টান বিড়ি ফুঁকে নেয়।
নাকে মুখে ধূলো ঢুকে যাচ্ছে নূরের। মুখে দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মা একবার বলেছিল ধূলা যেন নাকে-মুখে না ঢুকে। এতে বিভিন্ন ধরনের অসুখ-বিসুখ হয়। সেই থেকেই এটা শিখেছে সে। ঝাড়ু দেয়া শেষে নূরের হাতে একটা কয়লা ধরিয়ে দিয়ে থালাবাসন ধুতে পুকুরে যায় রাবিয়া। নূর পিছু পিছু যায়। ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে রাবিয়ার পাশে বসে আছে। ঘাসগুলো কত মসৃণ। কিছু কিছু ঘাস ধূসর রঙের তো কিছু ঘাস গাঢ় সবুজ রঙের। এই সময় হলুদ, সাদা, বেগুনি রঙের ঘাসফুলও ফুটেছে। শিশির বিন্দু জমে আছে ঘাসের উপর। নূর ঘাসের উপর বসাতে প্যান্ট ভিজে গেছে, তবুও বসে থাকে সেখানে। ঘাসগুলো মাটি থেকে উপড়ে ফেলছে। এটা এক দারুণ মজার খেলা মনে হচ্ছে তার কাছে। ঘাসের যেন কোনো নিজস্ব শক্তি নেই। তারা মাটির উপর নির্ভরশীল, সর্বস্ব মাটির মাঝেই সমাহিত। ঘাস আর মানুষের মাঝে একটা জায়গায় মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তারা কিছু মানুষের মতোই পরনির্ভর, স্বনির্ভর নয়। তাই তো নূর টান দিলেই উপড়ে আসছে একদম মূলসহ। ঘাস তুলে পুকুরে ছুঁড়ে মারছে সে। পানিতে না ডুবে ঘাসগুলো ভেসে থাকছে।
একে একে থালাবাসন ধুয়ে ঝুঁড়িতে তুলে রাখছে রাবিয়া। পুকুরের পানিটা অস্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছ হয়ে আসছে। এখন প্রায় বৃষ্টি হচ্ছে সেজন্যেই। কিছুদিন আগেও পুকুরে পানি ছিল হাঁটু সমান। খরায় পুকুরের পানি একদম শুকিয়ে যায়। তখন তলদেশ স্পষ্ট দেখা যায় অথচ এখন বৃষ্টির জন্য পুকুরে অনেক পানি জমে গেছে। এই পুকুরটা তাদের না। চেয়ারম্যান বাড়ির পুকুর। ঘর থেকে খানিকটা দূরে, ঠিক বাড়ির দক্ষিণ পাশে। পুকুরের ওপর পাশে চেয়ারম্যানের ঘর। সম্পূর্ণ বাড়ি দেয়াল দেওয়া, এপাশ হতেই দেখা যায়। অনেক বেশি জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আনোয়ারা বিবির চিল্লাপাল্লা শুরু হয়ে গেছে। প্রতিদিন ছেলের বউয়ের সাথে খিটমিট করতেই থাকেন। সকাল থেকেই তার শুরু হয় আর রাতে ঘুমানোর সময় শান্ত হোন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও অনেকসময় বিড়বিড় করে অভিশাপ দিতে থাকেন।
নারকেলের একটা পাতা থেকে কাঠি বের করতে করতে বললেন, “কি গো নবাবজাদী, খাওন-দাওন কি আইজ জুটবো না পেডে? বাসন মাইজতে একদিন লাগাই দিলি। রান্ধন লাগবো না কিস্যু? ওই নূরের মা মইরা গেছত?”
সকালে পেটে কিছু না গেলে আনোয়ারা বিবির মুখ আরও তেঁতো হয়ে যায়। তখন শুধু কর্কশ শব্দই বের হয়। নূর পেছনে তাকিয়ে দাদির কথা শুনছে। রাবিয়া এসব কথা এখন আর কানে নেয় না। প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো। কিন্তু এখন শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে তার। বিয়ের পর থেকেই এসব চলে আসছে। শাশুড়ির সুখ তার কপালে কখনও ছিল না। বেঁচে থাকতে আর হবেও না।
বাসন পরিষ্কার করে কয়লা দিয়ে নূরের দাঁত মেজে মুখ ধুইয়ে দিল। দাঁতের ফাঁকে কয়লার টুকরো আটকে গেছে। নখ দিয়ে বের করার চেষ্টা করছে নূর। রাবিয়া নিজেও হাতমুখ ধুয়ে বাসনগুলো নিয়ে রান্নাঘরে চলে আসে। চুলায় রং চা তুলে দেয়। খালি চা তো খাওয়াও যাবে না তাই কয়টা সিদ্ধ চাল ভেজে গুঁড়ো করে নেয়। ঘরে চিনিও ফুরিয়ে এসেছে। বাটিতে একটু চিনি দিয়ে লবণ ছিটিয়ে চায়ের পানি ঢেলে দেয়। ঘরে চায়ের কোনো কাপ নেই। যে বাটিতে তরকারি ঢালে সেই বাটিতেই চা খায়৷ এটা হচ্ছে তাদের সকালের খাবার, ভাত দুপুরে আর রাতে খায়। তিনবেলা ভাত খেলে চলে না। রাজার ভাণ্ডার নেই যে তিনবেলা বসে বসে খাবে।
চায়ের উপরে চালের গুঁড়ো দিয়ে নূরের হাতে বাটি ধরিয়ে বলল, “যা, তোর দাদিরে দিয়া আয়।”
“আমারডা কই?”
“তোরডা আছে। যা, আগে তোর দাদিরে দিয়া আয়।” নূর বাটি খুব সতর্কভাবে ধরে দাদির কাছে নিয়ে যায়৷ পাটিতে রেখে দৌড়ে আসতে চাইলেই আনোয়ারা বিবি বললেন, “তোরডা কই নূর?”
“আম্মায় বানাই দিতাছে।”
দৌড়ে মায়ের কাছে এসে শিশিরে আধো ভেজা প্যান্ট নিয়েই পিঁড়ির ওপর বসে পড়ে। প্যান্টের নিচ দিকে কিছুটা ছিঁড়ে গেছে। রাবিয়া সেলাই করে দিয়েছিল কিন্তু এখন আবারও সেই একই জায়গায় ছিঁড়ে গেছে।
.
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা
❝পদ্মপুকুর❞
পর্ব: ০৪
.
নূর গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা করছে। মা কখন চা দেয় তাকে। নূরকে এক বাটিতে চা দিয়ে নিজেও খেতে লাগে রাবিয়া। তারা মিয়া এখনও ঘুম থেকে উঠেনি। চা খাওয়া শেষ করে নূর বাটি ধুতে চলে যায় পুকুরে, দাদির বাটিও সাথে নিয়ে যায়। এসব কাজ করতে তার বেশ আনন্দ লাগে। কাজ করলে নিজেকে আর ছোট মনে হয় না তার। মায়ের কাজে সাহায্য করে সবসময়। বাটি ধুয়ে রান্নাঘরে রেখে দেয়।
“তোর বাপ উঠছে নাকি দেইখ্যা আয় যা।” রাবিয়া আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে কথাটা বলল।
নূর দৌড় দিয়ে শোবার ঘরে যায়। তারা মিয়া এখনও নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ছোট ছোট হাত দিয়ে তারা মিয়াকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে ডাকলো, “আব্বা! আব্বা! ও আব্বা!”
বারকয়েক ডাকে কিন্তু কোনো সাড়া পায় না। এখন আর উঠান পাড়ি দিয়ে মায়ের কাছে যেতে মন চাইছে না তার। বাবার পাশে সেও শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আঙুল দিয়ে বাবার পায়ের আঙুল মাপতে চেষ্টা করছে। একেকটা আঙুল একেক রকম। নখের কোণায় কত ময়লা জমে আছে। নূর নিজের পায়ের দিকেও তাকায়, তার আঙুলের কোণায় ময়লা জমে নেই। রাবিয়া প্রতি সপ্তাহে জুম্মার আগেই তার নখ কেটে দেয়। কারণ জুম্মার নামাজের আগে নখ কাটা সুন্নত। শুক্রবারে সে আবার মসজিদে যায় জুম্মার নামাজ পড়তে। শুক্রবারের জন্য তার অপেক্ষার শেষ নেই। শনিবার থেকে দিন গুনতে শুরু করে আবার কবে শুক্রবার আসবে।
মাছ ধরতে গিয়ে তারা মিয়ার জাল এক কোণে ছিঁড়ে গেছে। উঠানে সুঁই, সুতা নিয়ে বসেছে সেলাই করার জন্য। সুঁইয়ের ভেতর সুতা ঢুকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। ঘরে ঢুকতেই বিশ্রী গন্ধটা রাবিয়ার নাকে এসে লাগে। নিশ্চয়ই ছেলেটা বিছানায় প্রস্রাব করেছে। আরেকটা কাজ বেড়ে গেছে তার।
“নূর, নূর, ওই নূর”
গলা ছেড়ে ডাকছে রাবিয়া কিন্তু কোনো জবাব পায় না। ভয়ে ঘরের কোণে লুকিয়ে আছে। রাবিয়া কাঁথা, বিছানার চাদর নিয়ে পুকুর ঘাটে যায়৷ সবকিছু ধুয়ে দিতে হবে। দরজার পেছনে লুকিয়ে রাখা প্যান্ট হাতে নিয়ে নূরও পুকুরে যায়। ভেবেছিল মায়ের হাতের মার একটাও মাটিতে পড়বে না, সব তার ঘাড়েই পড়বে। অথচ একটা বকাও শুনে না। নূর ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে, এত বড় ছেলে হয়ে বিছানায় প্রস্রাব করেছে লজ্জা পাওয়ারই কথা। আশেপাশে কেউ জানলে কারো সামনে যেতে পারবে না সে। সবাই তাকে নিয়ে মজা করবে। মা আবার গল্পের আসর বসলে সবাইকে সব কিছু বলে দেয়। তখন তাকে নিয়ে সবাই মজা নেয়। এর আগেও তার সাথে এমন হয়েছে।
৪.
বেশ কয়েকবার বলার পরেও কথাটা অস্পষ্ট লাগছে তারা মিয়ার কাছে। ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসে তার। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়েছে।
অস্পষ্টভাবে একটা কথাই শুনতে পাচ্ছে, “নূররে আমায় দিয়া দে। নূরের বদলে তুই যতটুকু ধনরত্ন চাইবি নিয়া যা, শুধু নূররে দিয়া দে।”
কথাটা তারা মিয়ার কানে বারবার বাজছে। একই কথা পুকুরের চারপাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তারা মিয়ার সামনে রুপার হাড়ি-পাতিল ভর্তি অসংখ্য স্বর্ণের টুকরো, হীরা, মুক্তা পড়ে আছে। সে যা ইচ্ছে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে শুধু তার পরিবর্তে নূরকে দিয়ে যেতে হবে। ছেলে নাকি হাড়ি-পাতিল ভর্তি ধনরত্ন? তাকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটা মাত্র ছেলে তার। এই ছেলের পরিবর্তে এত ধনরত্ন দিয়ে কী হবে? কিন্তু ছেলে তো পরেও হয়ে যাবে। ধনরত্ন কী হাতছাড়া করা উচিৎ? এমন অনেক প্রশ্ন তারা মিয়ার মাথায় ঘুরপাক করছে। ছেলেটা একমনে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো তার বাবার জবাবের আশায়।
“আব্বা, আমারে এইহানে রাইখা যাইবা? কও না আব্বা, রাইখা যাইবা?”
নূর তার ছোট ছোট দু’হাতে তারা মিয়ার হাত দু’টো জড়িয়ে ধরে হাত ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করছে বারবার। তারা মিয়ার শরীর ঘামতে শুরু করল। পা দু’টো থরথর করে কাঁপছে। আবারও সেই আওয়াজের প্রতিধ্বনি শুনছে।
“বল নূররে চাই না ধনরত্ন চাই তোর?”
নূর করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাবাকে বলল, “আব্বা! আমারে দিও না, আম্মায় কানবো। আমারে বাড়িত নিয়া যাও।”
“নূররে না দিলে সম্পদ পাবি না।”
“আব্বা আমারে নিয়া যাও।”
“নুররে রাইখা যা তারা, ধনরত্ন নিয়া যা।”
একদিকে ওই অদৃশ্য আওয়াজের প্রতিধ্বনি অন্য দিকে ছেলের আকুতি। মাথাটা ঝিমিয়ে আসছে তারা মিয়ার, চোখে ঝাপসা দেখছে। বিড়বিড় করে কি বলছে রাবিয়া ঠিক বুঝতে পারছে না। মুখের কাছে কান নিয়ে শুনার চেষ্টা করেও বুঝল না। “নূরের বাপ” বলে ডাকতে লাগল, তবুও তার বিড়বিড় থামছে না। গা ধরে কয়েকবার ধাক্কা দিল জোরে জোরে। ঘুম থেকে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল তারা মিয়া। প্রচন্ডভাবে ঘামছে সে। এসব কি স্বপ্ন দেখতে লাগল সে!
“কী হইছে? কী দুঃস্বপ্ন দেখছেন?” রাবিয়া বারবার জিজ্ঞেস করল।
কিন্তু তারা মিয়া কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে ঘাম মুছছে। কী জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছে না সে! নাহ! রাবিয়াকে কোনো কিছু বলা যাবে না, শুধু শুধু চিন্তা করবে। আর এসব বললেই সে পদ্মপুকুরের দোষের কথা বলবে। সবসময়ই তাকে মাছ ধরতে মানা করে রাবিয়া। কিন্তু তারা মিয়া তার কথা শুনেই না। কোনো কথা না বলেই তারা মিয়া উঠে বাইরে চলে যায়।
রাতের আকাশে থালার মতো চাঁদ উঁকি দিয়েছে৷ আকাশ জুড়ে তারাদের এক বিশাল মেলা। প্রকৃতি জুড়ে চাপা নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে। রাবিয়া নূরের গায় কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে এসে তারা মিয়ার গা ঘেঁষে বসে।
“কী হইছে আপনের? কিছু কন না ক্যান?” কোমল সুরে বলল রাবিয়া।
একটা মায়া মায়া দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। তারা মিয়া আকাশ পানে তাকিয়ে ছিল, রাবিয়ার কথায় পাশ ফিরে তাকায়। একহাতে তাকে পরম যত্নে জড়িয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে। রাবিয়া অনেকদিন পর পরম শান্তিতে তার বুকে মাথা রাখে৷ সংসারে অর্থের অভাব থাকলেও ভালোবাসার অভাব কোনোদিনও করেনি রাবিয়া।
কোনো কথা বলছে না কেউ, খানিকক্ষণ এভাবেই বসে থাকে দু’জন। রাতের গভীরতা বেড়ে চলেছে…। আর বাইরে থাকা যাবে না। রাবিয়ার চোখ লেগে এসেছে। বেশিক্ষণ দেরি না করে দু’জনে এসে পাশাপাশি শুয়ে পড়ে। তারা মিয়া এপাশ ওপাশ করতে থাকে রাতভর কিন্তু চোখ জোড়ায় ঘুম আসে না। রাতটা এভাবেই ফুরিয়ে যায়। দিনের শুরুতে চারদিকে সূর্যের রক্তিম আলো ছড়িয়ে পড়েছে।
আজকে কী বার সেই হিসাব করছে নূর৷ বেশ কয়েকবার হিসাব নিকাশের পর আবিষ্কার করল আজ বৃহস্পতিবার। এই বারটা তার খুব ভালো লাগে। সপ্তাহের সাত দিনের নাম মায়ের কাছ থেকে মুখস্ত করেছে সে। স্কুলে ভর্তি করলে যাতে সবকিছু ঝটপট উত্তর দিতে পারে। প্রতি বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকেই রুমেল, সবুজ আর পলি স্কুল থেকে ফিরে আসে। ওরা সম্পর্কে নূরের চাচাতো ভাই-বোন হয়। শুক্রবার সারা বিকেল একসাথে খেলতে পারে সবাই মিলে। জুম্মার আগে তো নূরকে চোখের দেখাও দেখা যায় না। আবার দুপুরে খেয়েই তাদের সাথে গায়েব। উঠানের শেষ মাথায় বসে খেলে সবাই মিলে। এইতো শেষ বিকেলে সবাই মিলে খেলছে। এটা তাদের নিত্যদিনের খেলা। পলি স্কুল থেকে শিখেছে খেলাটা। স্কুলে বান্ধবীরা মিলে এই খেলা খেলে।
রুমেল আর সবুজ মুখোমুখি বসে দুই পায়ের গোড়ালি দিয়ে উঁচু করে সামনের দিকে ছড়িয়ে দেয়। পায়ের উপর দিয়ে নূর আর পলি লাফ দিয়ে অতিক্রম করতে করে। একবার অতিক্রম করার পর তারা এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে দিয়ে উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়। এরপর পায়ের ওপর প্রসারিত হাতের আঙুল স্থাপন করে উচ্চতা বাড়িয়ে তুলে ধীরে ধীরে।
এই পায়ে ঘেরা স্থানটি পা তুলে লাফ দিয়ে তিনবার অতিক্রম করছে আর বিড়বিড় করে বলছে,
“ইচিং বিচিং চিচিং চা
প্রজাপতি উড়ে যা।
এএল তে লন্টন
বাবুর মাঝে বন্টন
বাবু তুই খাবি খা
আমার বাড়ি যাবি যা।
তোর বাড়ি যাব না
আমি কিছু খাব না
তোর সাথে আড়ি
যাচ্ছি আমার বাড়ি।”
ছড়াটি বারংবার বলছে আর লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছে সবাই৷ নূর আর পলি হেরে গেলে তারা দু’জন পা ছড়িয়ে বসবে। তখন রুমেল আর সবুজ পায়ের উপর দিয়ে লাফ দিবে। গ্রামের সব বাচ্চারা বসে মজাদার খেলাটা খেলে। কখনো কখনো মাঠে ক্রিকেটও খেলে। কিন্তু ক্রিকেট খেলায় কেউ নূরকে নেয় না। কারণ সবাই বলে সে নাকি ছোট। খেলায় নিলেও সে থাকে দুধভাত। কোনো এক দল নেয় না তাকে। সে দুই দলেরই হয়ে থাকে। সবাই যখন ব্যাটিং করে তখন তাকে দৌড়ে গিয়ে বল খুঁজে আনতে হয়। সেজন্য সে ক্রিকেট খেলা পছন্দ করে না। কারও সাথে খেলতে যায় না। বড় হলে যেদিন ব্যাটিং করতে দিবে সেদিনই সে খেলবে। কিন্তু তার মা বলে, বড় তখনই হবে যখন তাকে স্কুলে ভর্তি করা হবে। সেটা শুনে বাবার কাছে কতবার জেদ করেছে স্কুলে ভর্তি করার জন্য। ছোট বলে এতদিন এড়িয়ে গেলেও এখন বলেছে, তাকে আগামী মাসের প্রথম দিনেই স্কুলে ভর্তি করে দিবে। পড়ালেখা করে এই গ্রামের স্কুলের মাস্টার হবে সে।
.
চলবে…