পদ্মপুকুর পর্ব: ০৫

0
392

পদ্মপুকুর
পর্ব: ০৫

চেয়ারম্যানের ছেলে মাসুম জানালা দিয়ে তাকিয়ে নূরদের এই মজার খেলা দেখছে। তারও ইচ্ছে করে খেলতে। কিন্তু মা বাইরে যেতে দেয় না। বোন আরিফার সাথে সে খেলে না। মেয়েলি খেলা আবার ছেলেরা খেলে নাকি! কখনো খেলতে গেলেও আরিফা তার সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়। একে অপরের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলে কতগুলো। একা একাই উঠানে ক্রিকেট খেলে সেজন্যে। কিন্তু আব্দুল্লাহ থাকলে তার খেলার জন্য আর ভাবতেই হয় না। আব্দুল্লাহ বল মারে আর মাসুম ব্যাটিং করে। দু’জনের মাঝে বেশ ভাব। কাকা বলে ডাকে তাকে। আব্দুল্লাহর কোনো ছেলেপুলে নেই বলে তাকে অনেক আদর করে। নূরের সাথে মাঝেমধ্যে চোখাচোখি হয় মাসুমের। নূর যখন পুকুর পাড়ে সবার সাথে খেলে মাসুম তখন জানালা ধরে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে তাদের খেলা। একজন পুকুরের এপাশ থেকে হাসি বিনিময় করে আর অন্যজন জানালার ওপাশ থেকে। প্রায় প্রতি জুম্মায় মসজিদে যাওয়ার সময় দু’জনের দেখা হয়। তখন একটু-আধটু কথা হয় তাদের মধ্যে। নামাজের সময় এক জায়গাতেই বসে দু’জন। শুধু তারা দু’জন নয় নামাজের কাতারে ধনী-গরিব সবাই একসাথে দাঁড়ায়। তখন চেয়ারম্যানের জন্য আলাদা জায়গা আর দিনমজুরের জন্য আলাদা জায়গা ঠিক করা হয় না। মসজিদের ভেতর সবাই সমান। এখানে এসে সবাই এক। কোনো ব্যবধান বা পার্থক্য নেই কারো মাঝে। নূর আর মাসুমেরও ঠিক এখানেই মেলবন্ধন। এটুকুই তাদের বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্বে নেই কোনো ঝগড়া, নেই কোনো মান-অভিমান।

৫.

আজ নূর খুব খুশি। গোসল করেই গতবারের ঈদের পাঞ্জাবী আর টুপিটা পরে বসে আছে। বারবার নিজের দিকে তাকাচ্ছে। সেই কতক্ষণ ধরে বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। শুক্রবার এলেই নূর বাবার সাথে মসজিদে যায়। এখনও নামাজ পড়া শিখেনি সে। তার মসজিদে যাওয়ার উদ্দেশ্য নামাজ পড়াও নয়, শুধু শিরনী খাওয়ার লোভেই যায় সে। প্রতিদিন আর কত শাকসবজি খাবে! শুক্রবার ভালো কিছু খেতে পারে। প্রায়শই মুরগী বা গরুর গোশত দিয়ে বিরিয়ানি করে দেয় কেউ না কেউ। কিন্তু আজকে জিলাপি দিয়েছে, এটাও তার খুব পছন্দ।

নামাজ শেষে জিলাপি বিতরণ করা হয়। জিলাপি খেয়ে হাত ধুতে পুকুরে চলে যায় নূর। এই পুকুরটা পদ্মপুকুর নামে পরিচিত। আজ থেকে বহু বছর আগে একবার বর্ষা বিদায়ের পর শরতের আগমনে অগণিত পদ্মফুল ফুটেছিল এই পুকুরে। মানুষ খেয়ে আর বিক্রি করে অনেক অর্থ উপার্জন করেছিল। তখন থেকেই নাম হয় পদ্মপুকুর। সে বছরের মত এখন আর পদ্ম হয় না। তবে পুকুর জুড়ে অনেক পদ্মফুলই ফুটে৷ আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো সবগুলো পদ্মফুলের রঙ ধবধবে সাদা। কিন্তু রাতের অন্ধকারে তারা রং বদলায়। যা নীল কম অনেকটা কালচে রঙের দেখা যায়। নূর পানিতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে। পানি নাড়া দিতেই ছবিটা মিলিয়ে গেল। এই ব্যাপারটা বেশ মজা লাগছিল তার। কয়েকবার এমন করার পর পুকুরে হাত নামাতেই কেউ যেন হাত টেনে ধরল। হাত ছাড়ানোর যথেষ্ট চেষ্টা করছে সে। ভয়ে ঘামতে শুরু করেছে। চোখগুলো যেন কোঠর থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। নূরের গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। সর্বশক্তি দিয়ে বারবার “আব্বা” বলে ডাকতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। হাত টেনে ক্রমশই নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

“নূর তুই এইহানে? আর আমি তোরে পুরা মজ্জিদ খুঁজি পাই না।” তারা মিয়া অনেক ধমকের স্বরে কথাটা বলল৷

নূর ছিটকে পেছনে পড়ে যায় তখনই। তার হাত যেন ছেড়ে দিয়েছে সেই অজানা শক্তি৷ দৌড়ে পুকুর থেকে উঠে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। চোখজোড়া কুচকে বন্ধ করে আছে। বুকটা দুরুদুরু করছে তার, অতি ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। তারা মিয়া নূরের মুখে হাত দিয়ে দেখে গাল বেয়ে জল পড়ছে। কান্না করছে নূর! ভয় পেয়েছে ছেলেটা। তারা মিয়া ভাবে, শুধু শুধু না বকলেও হতো।

“আইচ্ছা চল বাড়িত যাই। তোর মায় আইজ মাছ রানবো। তোর পছন্দের বড়ো মাছ। আর এই নে হুজুর তোরে আরও দুইটা জিলাবি দিছে।” ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি রেখে বলল তারা মিয়া।

নূরের এক হাতে জিলাপি ধরিয়ে দিয়ে অন্য হাত ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে দু’জন৷ হাতে জিলাপি কিন্তু সে খাচ্ছে না নূর৷ বারকয়েক পেছন ফিরে পুকুরের দিকে তাকালো। “শাঁ, শাঁ” শব্দে এক শীতল হাওয়া বয়ে গেছে, যে হাওয়া তপ্ত দুপুরেও এক মুহুর্তের জন্য শরীরে কাঁপুন ধরিয়েছে।

দুপুরে মাছ রান্না হয়েছে অথচ নূর পেট ভরে খেতে পারেনি। ভয়ে চুপসে গেছে সে। রাবিয়া পুকুর ঘাটে বসে বাসন মাজছে। পাশের বাড়ির মায়া বেগমও পুকুরে এসেছেন রান্নার চাল ধোয়ার জন্য। দু’জনের মধ্যে ওখানেই গল্পের আসর জমে উঠেছে। মহিলা দুইজন একসাথে হলেই হলো। জায়গা যেখানেই হোক না কেন সেখানেই গল্প জুড়ে বসেন তারা। অন্যদিকে উঠানে বসে খেলছিল সবাই। নূরের আজ খেলায় তেমন মন ছিল না কিন্তু সবুজ তাকে খেলার জন্য ধরে এনেছে। খেলতে গিয়ে সবকথা মনের আড়াল হয়ে যায় নূরের। খেলার এক পর্যায়ে রাস্তায় চোখ পড়তেই পলি, রুমেল আর সবুজ রাস্তার দিকে এক দৌড় দেয়। এই দৌড়ের কারণ লেবু খান। লেবু খান যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। পরনে তার ছেঁড়া, মলিন সাদা রঙের একটা পায়জামা আর পাঞ্জাবি তার উপর কালো রঙের কোট। চুরি করার একটা বদ অভ্যাস আছে তার। তবে কোনোদিন দামী কোনো জিনিস চুরি করেনি। সবসময় শুধু খাবারই চুরি করে। আগেপাছে তার কেউ নেই যে তাকে খাওয়াবে। ক্ষুধার জ্বালা মেটাতেই চুরি করে। লেবু খানের মাথায় কিঞ্চিৎ সমস্যা আছে। পোলাপান সেই সমস্যার ফায়দা নেয়। লেবু খান যখনই রাস্তা দিয়ে যায় তখনই গ্রামের সব বাচ্চারা তার পিছু নেয়।

পিছন পিছন হাঁটবে আর বলবে, “এক গোটা লেবু, চিনি দিয়া গুইল্যা, খামু গিইল্যা। ও লেবু তোর দাম কত?”

লেবু খান পেছন ফিরেই সব বাচ্চাদের দৌড়ানি দেয়। বিসমিল্লাহ ছাড়া একনাগাড়ে গালাগাল শুরু করে।

“খাটাশের দল তোগোর বাপের লেবু, তোর মায়েরে নিয়া খাওয়া খবিশের দল।” পায়ের একটা জুতা হাতে নিয়ে বলে লেবু খান।

গ্রামের এমন কোনো বাচ্চা নেই যে লেবু খানকে দেখলে এসব কথা বলে না, শুধু নূর ছাড়া। নূর বাড়ি থেকেই বের হয় না। চুপচাপ লক্ষ্মী স্বভাবের ছেলেটা। সবাই যখন লেবু খানের পেছনে দৌড়াচ্ছিল তখন সে সুপারি গাছের আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

লেবু খানের পাল্টা দৌড়ানিতে ভয় পেয়ে সব বাচ্চারা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। নূর ওখানেই দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকে। আশ্চর্য ব্যাপার সে তাকে কোনো কিছুই বলে না। চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে হাতে রাখা পায়ের জুতোটা পরে আবার সরু পথটা ধরে চলে যায়। এটা তার প্রতিদিনের গন্তব্যহীন এক পথচলা।

নূর খেলার ছলে দিনের কথাটা ভুলেই গিয়েছিল। রাতে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই মনে পড়ে যায় পুকুরের সেই কথা। মায়ের পাশে শুয়ে ধীর কণ্ঠে বলল, “আম্মা আইজকা যহন আমি মজ্জিদের পুষ্করিণীতে হাত ধুইতে গেছিলাম, তহন আমার হাতডা না কেউ টাইনা ধরছিল।”

নূর প্রায়ই এমন উদ্ভট কথাবার্তা বলে। যা রাবিয়া বেগমের চুপ করে শুনতে হয়। বাচ্চারা তাদের মনের ভেতর ভিন্ন একটা রাজ্য তৈরি করে। তারা হয় সে রাজ্যের রাজপুত্র। সেখানে নিজে নিজেই কত কাহিনী বানায়। কখনও হরিণ শিকার করে তো আবার কখনও বাঘকে হত্যা করে একাই।

রাবিয়া স্মিত হেসে বলল, “তুমি গেছিলা ক্যান বাবা? আর যাইবা না। ওইহানে দেও আছে।”

নূর আর কিছু বলে না। দেও মানে যে খারাপ শক্তি সে এটা বুঝে। কারণ সেই শুরু থেকেই প্রতি রাতে ঘুমের সময় মায়ের মুখে দেও-এর কাহিনী শুনে আসছে সে। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখজোড়ায় ঘুম নেমে আসে তার। মায়ের বুকে মুখ লুকায়। মুহুর্তেই ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়। বাচ্চাদের কোন দুশ্চিন্তা থাকে না। বালিশে মাথা দিলেই তাদের দু’চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে। ঘুম তো ঠিকমতো হয় না বড়দের৷ কারও ঘুম হয় না দুশ্চিন্তায় তো কারও রাত জাগতে জাগতে অভ্যাস হয়ে যায় না ঘুমিয়ে থাকার। কেউ আবার সারা রাত জাগে আর সারাদিন পড়ে ঘুমায়। যেমন ফরুক মোল্লা সারারাত জেগে আল্লাহর ইবাদত করে আর ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমায়, একেবারে যোহরের নামাজের সময় উঠে। তারা মিয়াও এমন। তবে তার রাত জাগার কারণ ভিন্ন। সে সারারাত জেগে মাছ ধরবে। মাছ না ধরলে খাবে কি! মাছ বিক্রি করেই তো তার সংসার চলে। রাবিয়া বেগম কত করেই তারা মিয়াকে বলল, এই রাতের বেলা মাছ ধরতে যেন না যায়৷ কিন্তু তারা মিয়ারও তো কোন উপায় নেই। এই রাতের বেলাতেই মাছ পাওয়া যায়। গভীর জল থেকে মাছ উপরে ভেসে বেড়ায়। দিনে তো মাছের টিকিটিও দেখা যায় না। সংসার চালানোর একমাত্র মাধ্যম এই মাছ বিক্রি করা।
.
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here