পদ্মপুকুর পর্ব: ০৬,০৭

0
512

পদ্মপুকুর
পর্ব: ০৬,০৭
লিখা: বর্ণালি সোহানা
পর্ব: ০৬

আজ রাতের আকাশটা অনেক সুন্দর। জোছনা যেন আকাশ থেকে উপচে পড়ছে। গোল রুটির মতো সাদা ধবধবে চাঁদ। মনে হচ্ছে এখনই কেউ রুটি বানিয়ে রেখেছে। কতদিন রুটি খাওয়া হয় না। খাবে কীভাবে আটার রুটি গরীবের পাতে জুটে না। কিন্তু এই চাঁদকে দেখে ইচ্ছে করছে হা করে খেয়ে নিতে। রুটি হলে খেয়েই নিত। মাছের ঝুড়ি আর জাল কাঁধ থেকে নামিয়ে পুকুরের পাশে রাখে তারা মিয়া। লুঙ্গিটা খানিকটা তুলে কোমরে বেঁধে নেয়। প্রথমবার জালে তেমন কোনো মাছ আসেনা। কয়েকবার ফেলার পর ছোট ছোট কিছু মাছ উঠে আসে।

হঠাৎ যেন পদ্মপুকুরের ওপারে শ্মশানের দিকে কোনো কিছুর আলো দেখতে পেল। কিছু মানুষের আবছা আবছা শব্দ শুনা যাচ্ছে। তারা মিয়া একবার ভাবলো এগিয়ে দেখবে কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আর কোনো শব্দ শুনতে পায় না। ভাবলো হয়তো কোনো প্রাণী হবে। এসব ছেড়ে নিজের কাজে মনোযোগ দেয় সে। শেষবার যখন জাল ফেলে অনেক ওজন লাগে। মনে হয় বড় কোনো মাছ লেগেছে জালে। যা ভেবেছিল তাই। জাল তোলার পর একহাত লম্বা দুইটা মাছ উঠে আসে। তারা মিয়ার মুখে প্রশস্ত হাসি। তার মাছ ধরতে আসাটা আজ সফল হয়েছে। যদি রাবিয়ার কথা শুনে না আসত তাহলে এত বড় মাছ পাওয়া যেত না৷ মাছের লোভে আরো কয়েকবার জাল ফেলে তারা মিয়া কিন্তু তেমন কোনো লাভ হয় না। মাছগুলো নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। দরজায় “ঠকঠক” শব্দ শুনে রাবিয়া চোখ কচলে হাই তুলতে তুলতে এসে দরজা খুলে দেয়।

“তুই না কইছিলি মাছ ধরতে না যাইতে? দেখ এহন কত্ত বড় বড় মাছ পাইছি আইজকা।” কথাটা বেশ উৎকণ্ঠিত গলায় বলল তারা মিয়া।

রাবিয়া তার কথা শুনে মাছের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। সবাই বলে এই পুকুরটাতে দেও আছে। অদৃশ্য কোনো শক্তির ছায়া আছে ওটাতে। কিন্তু তারা মিয়া তা বিশ্বাস করে না। তার মাছ ধরতেই হবে। আর এত বড়সড় মাছ পদ্মপুকুর ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়ার নয়। কেউ এখানে ভয়ে মাছ ধরতে আসেনা। তারা মিয়া কিছু একটা বিড়বিড় করতে করতে কাপড় বদলে শুয়ে পড়ে। সকাল হতেই সে মাছ বাজারে বিক্রি করতে নিবে। এখানকার বাজার আবার সকাল বেলায় জমে। সকাল হতেই বাজারে মানুষের ঢল নামে। কেউ যায় কাজের সন্ধানে, কেউ বা ব্যবসার জন্য তো কেউ যায় বাজার করার জন্য। বাজারটা বেশ বড়ও নয় আবার বেশ ছোটও নয়। কিন্তু এটাই গ্রামের লোকেদের একমাত্র বাজার।

৬.
দুঃস্বপ্নটা প্রায় প্রতিরাতই নিয়ম করে দেখতে লাগে তারা মিয়া। প্রতিটা স্বপ্নের মাঝেও ভিন্নতা রয়েছে। দিন হলে অনেক কথাই ভুলে যায় সে। কিন্তু একটা কথা মনে রয়ে যায়। কেন, তা সে নিজেও জানে না।

সব স্বপ্নে অদৃশ্য আওয়াজটা একই কথা বলে, “নূররে দিয়া যা, ধনরত্ন নিয়া যা।”

গতকাল আবারও একটা ভিন্ন স্বপ্ন দেখেছে। সম্পূর্ণ কথাগুলো মনে না থাকলেও আবছা আবছা মনে আছে। স্বপ্ন দেখার সাথে সাথেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। পদ্মপুকুরের ওপর পাশের শেষ মাথায় ঠিক ডানদিকে একটা রুপার হাঁড়ির মাঝে অনেক ধনরত্ন রাখা আছে। ওখান থেকেই তুলে আনতে বলছিল। কিন্তু তারা মিয়া কোন কিছু বোঝার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নটা ঠিক মাঝরাত থেকে শেষ রাতেই দেখে সে। ঘনঘন একই স্বপ্ন দেখায় এই স্বপ্নের সত্যতা কতটুকু তা জানতে প্রবল ইচ্ছে করছে তার মনের মাঝে। কিন্তু এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটা কাজ। এই কাজ করলে যদি পরে নূরের কিছু হয়ে যায়! এই ভাবনাও তার মাথায় আসে। এ কথা ভেবেই তারা মিয়া চুপচাপ থাকে।

সেদিন রাবিয়া বারবার প্রশ্ন করছিল, “কী এমন স্বপন দেখেন আপনে? যা দেইখ্যা এক্কেবারে ডরাইয়া ঘাইমা যান, একেবারে কাঁপতে লাগেন।”

সেদিন কোনো উপায় না দেখে রাবিয়াকে সবকিছু খুলে বলল তারা মিয়া। রাবিয়াকে বলার পর থেকে এখন রাবিয়াও ভয় পায়। নূরকে সবসময় চোখে চোখে রাখে। তারা মিয়াকে ওই পুকুরের ধারে কাছেও যেতে নিষেধ করেছে। কিন্তু সে শুনার মত ব্যক্তি নয়৷ তারা মিয়া অনেকদিন কোনো কাজ করে না। কাজ করে না বললে ভুল হবে, আসলে কাজ নেই এখন। আজকাল মানুষ সারা বছরের জন্য কাজের মানুষ রেখে দেয়৷ আর তারা মিয়া দিন হিসাবে কাজ করে, বছর বা মাস হিসাবে ধরা কাজে তার মন বসে না।

আজ কাজের জন্য বাইরে যাবে। ঘরে চাল-ডাল ফুরিয়েছে, এসব ছাড়াও অনেক মশলাপাতি লাগবে। কাজ না করলে কেউ দুই টাকাও দেবে না। দিনমজুরি করেছে এর আগে অনেক। মাছ ধরার নেশায় দিনমজুরি কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার কাজে লেগে যেতে হবে।

নূর উঠানে বসে একা একাই খেলছে। বাড়িতে রুমেল, সবুজ, পলি কেউ নেই যে সে খেলবে। সবাই এই মুহুর্তে স্কুলে আছে তাই নূর আজ একা। এই সময়টা তার মোটেও পছন্দ না। সে যে কবে স্কুলে যাবে সেই অপেক্ষাতে আছে। বাবা বলেছে এই মাসেই তাকে স্কুলে ভর্তি করাবে। সেজন্যে খুশির কোনো শেষ নেই তার। কতশত স্বপ্ন স্কুল যাওয়া নিয়ে।

নূরের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তারা মিয়া। গতকাল রাতে মনির বলেছিল, নতুন একটা কাজের সন্ধান পেয়েছে। কাজটা পাশের হাজিপুর গ্রামের মাস্টারের বাড়িতে। সে ভোর হতেই কাজে চলে গেছে। তারা মিয়া এখন বের হবে। অপেক্ষা করছে রাবিয়ার জন্য। খাবারের পুটলি নিয়ে আসতেও এত সময় লাগছে কেন ভেবে পায় না সে। হঠাৎ করে পায়ের মাঝে ঠাণ্ডা কিছু অনুভব করে তারা মিয়া। মনে হচ্ছে তার পা বেয়ে ঠাণ্ডা পিচ্ছিল জাতীয় কিছু একটা উঠছে। নূর ওখানে বসে চুপচাপ তাকিয়ে আছে। ভয়ে একদম জমে গেছে। কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু ঠোঁটজোড়া যেন চেপে ধরে রেখেছে অজানা কোনো শক্তি। রাবিয়া পুটলি হাতে ঘর থেকে বের হয়ে তারা মিয়ার হাতে পুটলিটা দিতে যাবে এমন সময় হাত থেকে ধপ করে পড়ে যায় সেটা। আসমান-জমিন সমান চিৎকার দিয়ে উঠে সে।

তারা মিয়ার দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে একটা মোটা কালো রঙের ডোরাকাটা সাপ উঠে আসছে। এই দিন দুপুরে সাপ আসলো কোথা থেকে! তারা মিয়ার ঘাড়ের পাশ বেয়ে ঘাম ঝরছে। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। সাপটা ধীরে ধীরে তারা মিয়ার দু’পা জড়িয়ে নেয়। এত বড় মানুষটাও সাপের বাঁধনের জন্য নড়তে চড়তে পারছে না। তারা মিয়া হতভম্ব হয়ে গেছে। সাপ অনেক জোরে জোরে “ফোঁসফোঁস” শব্দ করছে। মনে হচ্ছে অনেক বেশি ক্রুদ্ধ হয়ে আছে। আজ তারা মিয়ার রক্ষা নেই। হয়তো তার প্রাণ কেড়ে নিতে আজরাইল সাপের বেশেই হাজির হয়েছে। এই মুহুর্তে কী করবে না করবে ভেবেও পাচ্ছে না৷ রাবিয়া একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়েছে৷ বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই এই সময়। সবাই যার যার কাজে। সাপটাও ধীরে ধীরে পা প্যাঁচিয়ে উপরে উঠছে। কোমর ছুঁইছুঁই অবস্থা। ভয়ে মাথা ঘুরতে লাগে তারা মিয়ার। হাতেই পুটলি বাঁধার একটা লাঠি ছিল। কোনোকিছু না ভেবেই ওই লাঠি তুলে প্রাণপণ জোর দিয়ে “আল্লাহু-আকবার” বলে সাপের মাথায় বাড়ি দেয়। সাপের মাথায় আঘাত লাগায় সে কিছুটা দুর্বল হয়ে আসে। তারা মিয়া যেন তার সাহস ফিরে পায়। এভাবেই বারকয়েক আঘাত করে সাপের মাথায়। মাথায় বারবার আঘাত পেয়ে সাপের প্যাঁচ ধীরে ধীরে খুলতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে প্যাঁচ খুলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আরো বারকয়েক বাড়ি মারার পর সাপ নিজের সম্পূর্ণ শক্তি হারায়। খানিকক্ষণ পর আর কোনো নড়চড় দেখতে পায় না। শক্তিহীন সাপের উপর সে আরো কয়েকটি বাড়ি মারে। অল্প সময় মাটির উপর গা ঝাঁপটানোর পর সাপ উল্টে যায়। সাপের উল্টে যাওয়া মানে, তার মৃত্যু হয়েছে।
.
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

❝পদ্মপুকুর❞
পর্ব: ০৭
.
এতক্ষণ একা দাঁড়িয়ে ছিল নূর। হাতের খেলনাটা ওখানে ফেলেই দৌড়ে গিয়ে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে দাঁড়ায়। রাবিয়া ছেলের মাথায় হাত রেখে তারা মিয়ার দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায়। মনের ভেতরের ভয়টা যদিও কেটে গেছে কিন্তু একটু আগেও সে ভেবেছিল হয়তোবা আজই তার প্রিয়তম স্বামীকে হারিয়ে বিধবার বেশ বরণ করতে হবে। ছেলেটাকে হতে হবে বাপহারা। আল্লাহ সহায় ছিলেন তাই এই বিপদ থেকে উঠে আসতে পারলো তারা মিয়া। হাতের লাঠি দিয়ে সাপটাকে টেনে সোজা করে। প্রায় চার’হাত লম্বা সাপ। এত বড় সাপ স্বচক্ষে কখনই দেখা হয়নি। হাজার ভেবেও একটা কথার উত্তর পাওয়া যায় না যে, এই দিনের বেলায় এত বড় সাপ এলো কীভাবে?

তারা মিয়ার মাথা ভনভন করছে। মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে অনেকক্ষণ দম ধরে বসে রইল। আকাশে একটু আগেও প্রখর রোদ ছিল। মুহুর্তেই কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। খুব জোর বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। এ কেমন আবহাওয়া! এটা কী কোন বিপদের পূর্বাভাস? রাবিয়া কাপড় তুলতে শুরু করল। আশেপাশের মানুষ একসাথে জড় হয়েছে সাপ দেখতে।

সবার মুখে এখন একটাই কথা, “তারা মিয়ার বাড়িতে সাপ ধরা পড়ছে।”

বাচ্চা থেকে শুরু করে বুড়ো পর্যন্ত সাপ দেখতে আসছে। মানুষের বিশাল ভিড় জমে গেছে চারদিক।
ঘরের পেছনে একটা গর্ত তৈরী হচ্ছে। গর্ত তো নয় যেন কবর, সাপের কবর। অনেকটা ঠিক মানুষের কবরের মতোই। কবর খোঁড়ার পর লাঠি দিয়ে সাপটাকে তুলে ভেতরে ঢুকিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। তারা মিয়ার বাড়ির পেছনে কিছুটা দূরেই সাপটাকে কবর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভয়টা এখনও যায়নি। প্রতিক্ষণ মনে হয় এই বুঝি সাপ আসলো। নূর তো সেদিন থেকে আর ঘরের পেছনে যায়ই না। ভয় যেন তার বুকের ভেতর পাখির মতো বাসা বেঁধে নিয়েছে।

ঘরের পেছন থেকে “ছপছপ” শব্দ পাচ্ছে রাবিয়া। এ যেন মানুষ চলার শব্দ। তারা মিয়া কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে। এই অবেলায় কে হতে পারে! রাবিয়া বেগম কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ সাহসী বলা যায়। সত্যি বলতে, গ্রামের মানুষ যতটা সহজ সরল হয় ততটাই সাহসী হয়। আর তা কেবল পুরুষরা নয় মহিলারাও অনেক সাহসী হয়। কারো সাথে যদি ঝগড়া বাধে তাহলে একদম চুল ছেঁড়াছিঁড়ি অবস্থা হয়ে যায়। এদিক দিয়ে রাবিয়া বেগম যথেষ্ট ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। কিন্তু সাহসীকতায় তার তুলনা নেই। তাছাড়া এখন মাত্র শেষ বিকেল। এই বেলায় ভয় পাওয়ারও কোনো কারণ নেই। রাবিয়া বটি-দা নিয়ে ধীর পায়ে ঘরের পেছনে যায়৷ কলা গাছে এক ছড়ি কলা ধরেছিল। রাবিয়া অপেক্ষায় ছিল, পাঁকতে শুরু করলেই কেটে ঘরে আনবে। কিন্তু পাঁকার আগেই চোর চুরি করতে শুরু করেছে। এই চোর অন্য কেউ নয় সে হলো লেবু খান। কুটকুট করে চিবিয়ে কাঁচা কলা খাচ্ছে। রাবিয়া কিছুটা ভয় পায় তাকে দেখে। কিন্তু তার মতে, ভয়কে কখনও অন্যের সামনে জাহির করতে নেই। জাহির করলেই অপরপক্ষ তোমাকে দুর্বল ভাববে এবং আঘাত করে বসবে। কয়েকবার লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ভয়টাকে বুকের ভেতর চেপে দেয় সে।

খালি গলায় ঢোঁক গিলে বলল, “চাচা খাইবেননি ভাত চাইরডা?”

লেবু খান ঘাড় বাঁকা করে তাকায়। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “হুঁ! ভাত, ভাত। দে খামু।”

“সামন দিকে আহো। আমি দিতাছি।”

হাতের অর্ধেক কলা মাটিতে ছুঁড়ে মারে লেবু খান। মুখে থাকা কিছুটা কলা থু থু দিয়ে ফেলতে থাকে। হাত দু’খানা পাঞ্জাবিতে মুছে বারান্দার এসে বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসল। রাবিয়া এক টুকরো কলা পাতা ছিঁড়ে ধুয়ে তার সামনে দেয়। থালায় অল্প কিছু ভাত আর এক টুকরো মাছের সাথে খানিকটা ঝোল বেড়ে এনে কলা পাতার উপর ঢেলে দেয়। লেবু খান গপাগপ খেতে লাগে৷

খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বিড়বিড় করে বলছে, “তোরা বড়লোকের বাড়িত গেলে আমগোরে কুত্তার লাহান তাড়াই দেস। তোগোর এই বড়লোকি থাকবো না। ইন্দুরে খাইবো সব, ইন্দুরে খাইবো।”

রাবিয়া কথাটা বেশ মনোযোগ দিয়েই শুনলো। হয়তো লেবু খান কোনো বড়লোকের বাড়িতে গিয়েছিল কিন্তু কেউ তাকে খাবার দেয়নি বরং বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এমন কাহিনী অনেক ভিক্ষুকদের কাছ থেকে শুনেছে সে। আসলে যাদের অনেক থাকে তারা দিতে চায় না। কিন্তু যাদের নেই তাদের দেওয়ার মতো মন-মানসিকতা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় দেওয়া হয়ে উঠে না। আজ লেবু খানের ভাগ্য ভালো থাকায় সে এখানে খেতে পেল। নাহলে হয়তো অন্য কোথাও খেতে পারত আবার হয়তো কেউ তাকে খেতেই দিত না। ক্ষুধার্ত হয়ে পথে পথে ঘুরতে হতো তাকে।

নূর আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে লেবু খানের খাওয়া দেখছে। কেমন মুখের আশেপাশে লাগিয়ে খাচ্ছে। সে যখন মুখের আশেপাশে লাগিয়ে খায় মা তখন তাকে ধমক দেয়। কিন্তু এই লোকটাকে মা ধমক দিচ্ছে না কেন সেটাই বসে ভাবছে সে। খাওয়া শেষ করে মগ থেকে ঢকঢক করে পানি গিলে শেষ করে ফেলে লেবু খান। শব্দ করে ঢেঁকুর তুলে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুখ মুছে নেয়। খুব তৃপ্তি নিয়ে পেটপুরে খেয়েছে। খাওয়া শেষে আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে সোজা পথ ধরে হাঁটা শুরু করে সে। হাঁটবে আর একা একাই কথা বলবে, এটাই তার স্বভাব। রাস্তা থেকে কিছু একটা কুড়িয়ে বুক পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। মনে হচ্ছে যেন অমূল্য কোনো ধন।

৭.

মনির প্রায় রাতেই দুয়ারে বসে বিড়ি ফুঁকে, আজও তার ব্যতিক্রম নয়। একা মানুষ দিনে কাজ করে আর রাতের বেলা বিড়ির আগুনে কষ্টের পাহাড় জ্বালিয়ে শেষ করে দিতে চায়। কিন্তু বিড়ির সেই বিষাক্ত নিকোটিন কষ্ট সাময়িক কমালেও দীর্ঘমেয়াদি সুখ দিতে পারে না। রমিছাকে আজ বেশ মনে পড়ছে। লোকে ঠিকই বলে, যারা আমাদের আঘাত দিয়ে যায় আমরা তাদেরকেই বেশি মনে রাখি। আর যারা ভালোবেসে পাশে থাকে তাদেরকে গুরুত্বই দিই না। রমিছা মনিরকে আঘাত দিয়ে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু তার পাশে কেউ নেই যে, এই আঘাতের ক্ষতগুলোকে পূর্ণ করে দিবে। বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই হাতের জ্বলন্ত বিড়িটা নিভে যায়। মনির দুয়ার থেকে সরে ঘরে ঢুকে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রয়। এখন আর বাইরে বসে থাকা যাবে না। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। এই দীর্ঘশ্বাসের সাথেই তার দুঃখগুলো পোহায়। ঘুম আসুক আর নাই আসুক এখন তাকে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে হবে। দু’চোখের পাতা এক করে শুয়ে থাকতে হবে রাত ফুরাবার অপেক্ষায়।

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। মেঘের সাথে মেঘের ঘর্ষণে বিজলী চমকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর গুড়গুড় আওয়াজ করে উঠছে। সম্পূর্ণ ঘর যেন থেমে থেমে কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি বাজ পড়ল! রাবিয়া যতদূর জানে ঘরের ভেতর বাজ কম পড়ে। কিন্তু এটা তারা মিয়াকে কে বুঝাবে? এত রাতে মাছ ধরতে যাবে বলে তৈরী হচ্ছে। নূর শান্ত হয়ে হাত-পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে আছে চৌকিতে। রাবিয়ার মুখ এই অন্ধকারের থেকেও কালো হয়ে আছে। বাতাসের তীব্রতায় মনে হচ্ছে ঘরের ছাউনি উড়িয়ে নিয়ে যাবে। “শো-শো” শব্দ আর বৃষ্টির “ঝুমঝুম” আওয়াজ শুনে বুকে কাঁপুন ধরাচ্ছে। রাবিয়া কিছু একটা বলছে যা তারা মিয়ার কান অবধি পৌঁছাতে পারছে না। বৃষ্টির শব্দে মানুষের মুখের শব্দগুলো চেপে যায়। কথা শুনতে ও বুঝতে হলে একটু জোরে কথা বলতে হয়। এটা কেবলমাত্র টিনের চালের ঘরেই হয়। এতেও একটা আনন্দ আছে। যে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনে ঘুমায়নি সে এখনও সবচেয়ে আরামের ঘুম উপভোগ করতে পারেনি।

মাছের ঝুড়ি আর জাল নিয়ে তারা মিয়া বেরিয়ে যাবে তখনই নূর সাপ সাপ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। রাবিয়া ছেলেকে বুকের সাথে আগলে ধরে। টাকা-পয়সা না থাকলেও অনেক শান্তি আছে গরীবের কুটিরে। বড়লোক বাবা-মায়ের সন্তানদের আলাদা শোবার ঘরে থাকতে দেওয়া হয়। এরা মা-বাবার আদর পায় না। রাতে ভয়ে কান্না করলে অনেক সময়ই মা কাছে থাকে না, ভালোবেসে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর জন্য। তারা প্রত্যেকে নিজেতেই ব্যস্ত থাকে। কিন্তু এই জিনিসটা তারা মিয়ার মতো পরিবারে দেখা যায় না। কেননা তাদের থাকার জায়গা খুবই সীমিত। রাতে মা তার বাচ্চাকে বুকের সাথে আগলে ধরে ঘুমায়। যেমনটা এখন রাবিয়া তার ছেলেকে ধরেছে। তারা মিয়া জাল ও মাছের ঝুড়ি ওখানেই রেখে ছেলের পাশে এসে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগে।

“আমার আব্বা কি ডরাইছে? এই দেহো আব্বা সাপ নাই তো। সাপরে না মাইরা দিলাম। সাপ নাই আব্বা।” শান্ত গলায় বলল তারা মিয়া।

নূর বাবার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকায়। কোলে উঠে বসে গলা জড়িয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়ে । নূরকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে তারা মিয়া মাছ ধরার উদ্দেশ্যে পদ্মপুকুরের দিকে বেরিয়ে যায়। রাবিয়া উঠে আলতো করে দরজাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে।
.
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here