পদ্মপুকুর পর্ব: ০৮,০৯

0
349

পদ্মপুকুর
পর্ব: ০৮,০৯
লিখা: বর্ণালি সোহানা
পর্ব: ০৮

মাঝরাত হয়ে এসেছে। বৃষ্টি থামার নাম গন্ধ নেই৷ কিন্তু কী আশ্চের্য! এই অঝোর বৃষ্টির মাঝেও আকাশে চাঁদ দেখতে পাচ্ছে তারা মিয়া! মাথায় পলিথিন ব্যাগ বেঁধে বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। বরফ গলা পানিগুলো শরীরে কাঁপন ধরাচ্ছে। এদিকে পুকুরেও হিমশীতল পানি। এক পা নামাতেই গা শিউরে উঠে তার। চট করে পা তুলে নেয়। আজকে যেন পানি একটু বেশিই ঠাণ্ডা। যখন জাল ফেলতে যাবে তখন দেখল, পানিতে বুদবুদ উঠছে। চুলোয় পানি চড়ালে গরম হওয়ার পর যেভাবে বুদবুদ উঠে সেভাবেই বুদবুদ তৈরি হয়েছে ঠিক পুকুরের মাঝখানে। পানির বুদবুদের আওয়াজ ও গতি বাড়তে লাগল। তারা মিয়া ভয়ে ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। তার দৃষ্টি পানির বুদবুদের আকার কীভাবে ছোট থেকে বড় হচ্ছে সেদিকে। মনে হচ্ছে পুকুরের তলদেশ থেকে অজানা কোনো শক্তি উঠে আসছে। কী হতে পারে এটা! বিজলী চমকের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পুকুরের নীল, সবুজ মিশ্রিত জল ধীরে ধীরে লাল রক্তবর্ণ হতে কুচকুচে কালো বর্ণ ধারণ করছে। এ কেমন ভয়াবহ অবস্থা! তারা মিয়ার পা যেন ওখানেই আটকে গেছে। হঠাৎ করেই বৃষ্টি থেমে গেল। এই বৃষ্টি থামাটা সাধারণ নয়। সাধারণত বৃষ্টি যখন থামে তখন অঝোরে বৃষ্টি থেকে ঝিরিঝিরি গতিক বৃষ্টি হয়ে ধীরে ধীরে থামে। কিন্তু এভাবে চট করে বৃষ্টি থামাটা অস্বাভাবিক। যেন অর্ধেক বৃষ্টি ফোঁটা আকাশের নিম্নভাগে এসে থমকে গেছে আর অর্ধেকাংশ মাটিতে লুটিয়েছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! এত বৃষ্টি হলো অথচ কোথাও একটুও কাঁদা নেই। মনে হচ্ছে একটু আগেও প্রখর রোদ ছিল। সূর্য মনে হয় একটু আগেই অস্ত গেল। পুব আকাশে তাকাতেই তারা মিয়ার চোখ অস্বাভাবিক মাত্রায় বড় হয়ে আসে। মধ্য রাতে এই রক্তিম লাল সূর্য উদিত হচ্ছে কেন! হতচকিত হয়ে পশ্চিম আকাশে তাকাতেই চাঁদের উদয় ঘটতে দেখে। একদম রুপালীর থেকেও ধবধবে সাদা গোলাকার পূর্ণ চাঁদ। চাঁদ-সূর্যের একসাথে উদয় কীভাবে সম্ভব! এ কোন মহাপ্রলয় হতে চলেছে! দ্রুত গতিতে সূর্য ও চাঁদ, তারা মিয়ার মাথার উপর এসে একে অপরের সাথে ঘর্ষিত হয়। ঘর্ষণজনিত কারণে এমন এক বিকট শব্দের সৃষ্টি হয় যেন কানের পর্দা ফেটে যাবে। দু’হাতে কান ধরে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে তারা মিয়া। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে চিৎকার বেরিয়ে আসে। কিন্তু আকাশের বিকট শব্দের কাছে তার আওয়াজ চেপে গেছে। এই আওয়াজ কারো কান অবধি পৌঁছাবার নয়। কানের মাঝে বাঁশির মতো “পুঁউ” করে একটা আওয়াজ হচ্ছে। চারদিকের অন্য কোনো শব্দ তারা মিয়ার কানে আসছে না। সবকিছু থমকে গেছে। চোখ খুলে সামনে তাকাতেই দেখে পুকুরের ঠিক মাঝখানে পানির উপর ভাসমান একটা সিন্দুক। কাঁচা হলুদ রঙের গালিচার উপর কৃষ্ণচূড়া রাঙা লাল সিন্দুক। তার মাঝে ঝুলছে বাদশাহী আমলের বড় রুপালী তালা। চোখ ঝাঁজরা হয়ে আসে তারা মিয়ার। তৎক্ষনাৎ আকাশের দিকে তাকাতেই দেখে তার মাথার উপর চক্রাকারে চাঁদ – সূর্য ঘূর্ণায়মান অবস্থায়। হাঁটুর ভাঁজ ভেঙে খানিকটা পেছন দিকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। দু’হাত দিয়ে মাটিতে ভর দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় আছে তারা মিয়া। বাতাসের বেগ এমনভাবে বেড়েছে যেন এখনই তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আশেপাশের সবকিছু উড়ে যাচ্ছে। সিন্দুকটা পুকুরের পানি থেকে আলগা হয়ে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় দেখতে পাচ্ছে। চোখের সামনে কোনো চাবি ছাড়াই তালা খুলে যায়। এসব দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে তার। গলার পানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তৃষ্ণাদগ্ধ মানুষটার এই বুঝি প্রাণ যায় যায় অবস্থা। শত চেষ্টা করেও তার কণ্ঠস্বর দিয়ে একটা ছোট্ট আওয়াজও বেরিয়ে আসে না। মাটিতে হাত-পা দাবড়ানো শুরু করে দেয় তারা মিয়া। পেছন দিকে পালিয়ে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে। আচমকাই সিন্দুকের মুখ খুলে যায়। তখনই একটা অদৃশ্য আওয়াজের আবির্ভাব হয়। হাত-পা দাবড়ানো বন্ধ করে সেই আওয়াজে প্রস্ফুটিত হওয়া কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করে।

“এই সব কিছুই তোর লাইগ্যা। তুই ধনরত্নগুলা নিয়া যা, নূররে দিয়া যা।” ভারী কণ্ঠস্বরে কথাটা ভেসে আসলো

কথাগুলো স্পষ্ট না হলেও কিছুটা এমনই মনে হচ্ছে। সিন্দুক থেকে বিভিন্ন স্বর্ণালংকার, হীরা, মুক্তা, রুপার সামগ্রীসহ কয়েক কলসিভর্তি স্বর্ণের পয়সা শূন্যে ভাসমান হয়ে জ্বলজ্বল করছে। জিনিসপত্রগুলো যেন তাদের নিজস্ব আলো ছড়াচ্ছে। চাঁদ-সূর্যের মাঝেও এতটা মোহময় আলো থাকে না। তারা মিয়া মাটি থেকে উঠে সেই রত্নভান্ডারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ধীর পায়ে। ভয়ে তার হৃদস্পন্দন ঘনঘন ধুকধুক করছে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় হঠাৎ হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করবে সে। থমকে যাবে জীবন ঘড়ি এক নিমিষেই। তারা মিয়ার পা যেন নিজের আয়ত্তে নেই। আপন গতিতে পাড়হীন পদ্মপুকুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পানিতে এক পা ডুবিয়ে দিতেই দূর থেকে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। মুহুর্তেই তারা মিয়ার পা অবশ হয়ে আসলো৷ ধপ করে পুকুরের কিনারায় বসে যায় সে। মাথার উপর চাঁদ-সূর্যের চক্র এক ঝটকায় গায়েব হয়ে যায়। বাতাসের বহমান গতি হুট করেই কমে আসে। চোখের পলকেই শূন্যে ভাসমান ধনরত্নগুলো ঝড়ের গতিতে সিন্দুকের ভেতর প্রবেশ করে। খুলে যাওয়া তালা আচমকা প্রকট হয়ে সিন্ধুকটাকে তালাবদ্ধ করে নেয়। চকচকে হলুদ গালিচার উপর সিন্দুক নেমে আসে। পুকুরে কালো বর্ণের পানি দু’ভাগ হয়ে যায়। সিন্দুকটা ধীরে ধীরে পানির তলে মিলিয়ে যায়। দু’ভাগ হয়ে যাওয়া পানি নিজের অবস্থানে পুনরায় ফিরে আসে। পানি চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে নিজের মতো করেই কালো থেকে লাল আর লাল থেকে নীল ও সবুজ মিশ্রিত রঙ ধারণ করে। আকাশের নিম্নভাগে থমকে থাকা বৃষ্টি ফোঁটা ঝরে পড়ে মাটিতে।

তারা মিয়ার চোখের পলক একবারের জন্যেও পড়ছে না। স্বাভাবিকভাবেই সে মাটি থেকে উঠে মাছের ঝুড়ি ও জাল হাতে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। জাল ঘরের বাইরে রেখে মাছের ঝুড়ি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। রাবিয়া নামাজের সালাম ফিরিয়ে তারা মিয়ার হাত থেকে ঝুড়ি নেয়। মাটিতে ঝুড়ি কাত করতেই হুড়মুড় করে ছোট বড় অনেক ধরনের মাছ বেরিয়ে আসে। সে মাছগুলোকে পরিষ্কার করতে লেগে যায়। তারা মিয়া হাত-মুখ ধুয়ে কোনো কথা না বলে নূরের পাশেই শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ আগে যা হয়ে গেছে কোনো কিছুই যেন তার মাথায় নেই। শরীরটা কেমন দুর্বল হয়ে এসেছে তার। কোনোরকম শুয়ে পড়লেই বাঁচে।

৮.

আব্দুল্লাহ চেয়ারম্যান বাড়িতে এসেছে সেই বেলা সাড়ে সাতটায়। সকালে এক কাপ চা খেয়েই চলে আসে। বেলা আটটা বেজে গেছে এখনও কেউ ঘুম থেকে উঠেনি। এত বেলা অবধি কেবল চেয়ারম্যানের বাড়ির সবাই ঘুমায়। শুধুমাত্র চেয়ারম্যানের মা ছাড়া। সকাল হতেই কত রকমের মানুষ এসে হাজির হয় এই বাড়িতে। আজও অনেকেই বসে আছে শুধু বিচারের জন্য। অথচ এখনও ঘরের দরজা বন্ধ। যে মানুষের কারণে চেয়ারম্যান হয়েছেন মাঝেমধ্যে সেই মানুষগুলো চেয়ারম্যানের কাছে অবহেলিত হোন। তিনি ন্যায় বিচারক এবং কিছুটা উদার হলেও কখনো কখনো মানুষকে দাম দিতে জানেন না। বিষয়টা যদিও কদাচিৎ কোনোদিন ঘটে। সেই সকাল সাতটা থেকে এক মহিলা শুকনো কালো মুখে বসে আছেন। তাকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। আব্দুল্লাহ ঘরের সিঁড়িতে বসেছিল। ভদ্র মহিলা বেশ কয়েকবার এসে তার কাছে জিজ্ঞেস করে গেছেন কখন ঘুম থেকে উঠবেন চেয়ারম্যান। আর কিছুক্ষণ পর উঠে যাবে বলে বসিয়ে রেখেছে সে। কেন জানি আব্দুল্লাহর ওই মহিলার প্রতি একটা কৌতুহল জন্মেছে। জানতে মন চাচ্ছে যে কী হয়েছে তার সাথে।

কৌতুহল মনের ভেতর চেপে না রেখে মহিলাকে দূর থেকেই জিজ্ঞেস করল, “কী হইছে চাচি?”

প্রশ্ন করার সাথে সাথেই মহিলা ডুকরে কেঁদে ওঠেন। হাজারও না বলা কথা তার চোখের জলের সাথে বেরিয়ে যাচ্ছে। একনাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছেন তিনি। আব্দুল্লাহ আর কোনো প্রশ্ন করার আগেই চেয়ারম্যান ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন। অজানা রয়ে গেল মহিলাটার কান্নার কারণ। এমন অনেক জিনিসই আমাদের আশেপাশে ঘটে যায় যা আমাদের চোখে পড়ে কিন্তু মনে ধরে না। আবার কখনো মনে ধরলে তা বুঝে উঠার আগেই চোখের আড়াল হয়ে যায়।

বেলা নয়টা বাজে ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে আসে তারা মিয়া। সূর্যের আজ ভীষণ তেজ। প্রচণ্ড গরম পড়েছে! গা বেয়ে বৃষ্টির পানির মতো ঘাম ঝরছে। এই আবহাওয়ার কোনো কিছুই মাথায় ঢুকে না। এই রোদ, এই বৃষ্টি। রাবিয়া থালাবাসন গুছাচ্ছে।

রান্নাঘর থেকে চড়া গলায় বলল, “কেমন মরার ঘুম ঘুমাইছিলেন আইজকা?”

তারা মিয়া রাবিয়ার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চুলা থেকে কয়লা হাতে নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুরে চলে যায়। নূর উঠানের শেষ মাথায় বসে কাঠি দিয়ে কি সব আঁকিবুঁকি করছে।

রাবিয়া পেছনে বিড়বিড় করতে লাগলো, “মাছগুলান বাজারে বেচতে গেলে টেকা-পয়সা কিছু আইতো। নবাবের ঘুমে টেকা দিবো। মাছ গিইল্যা খাইবো। ঘরে যে মাছ ছাড়াও চাউল, ডাউল, মশলা লাগে হেইদিকে কোনো ধ্যানও নাই।”

নূর মায়ের কথা শুনছে মনোযোগ দিয়ে কিন্তু কিছুই বলছে না। এসব কথা ওর ছোট মাথায় ঢুকে না।

সে একবার তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আব্বা মাছ পুষ্করিণীতে ক্যান থাহে? আসমানে ক্যান থাহে না? মাটিতে ক্যান থাহে না? আমগো ঘরে ক্যান থাহে না?”

তারা মিয়া তখন তাকে কোলে বসিয়ে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বলেছিল, “আব্বা তোমার ছোড মাথায় এইগুলান ঢুকবো না। আগে মাথা বড় হউক তারপর জানবা মাছ ক্যান পুষ্করিণীতে থাহে।”

এর পর থেকেই সে ধারণা করে নিয়েছে এসব বড়দের কথা তার ছোট মাথায় ঢুকবে না। তারা মিয়া পুকুর থেকে এসে রাবিয়াকে খেতে দিতে বলে। বোলের মাঝে কয়েকভাগে মাছ ছড়িয়ে আছে। মাছের উপর মাছি ভনভন শব্দে উড়ে বেড়াচ্ছে। মাছ দেখে অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায় সে। তার মাথায় একটা কথা খটকা লাগে এতগুলো মাছ কোথা থেকে আসলো? সে তো গতকাল রাতে কোনো মাছ ধরেনি।

রাবিয়াকে ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “নূরের মা, এই মাছ কইত্থে আইলো?”

রাগে রাবিয়ার মাথা টনটন করছে। চুলোয় কয়েক টুকরো কাঠ গুঁজে দিয়ে বলল, “ভূতে দিয়া গেছে।”
.
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

❝পদ্মপুকুর❞
পর্ব: ০৯
.
গতকাল রাতে যে সে মাছ ধরতে গিয়েছিল, সেই কথা মাথা থেকেই চলে গেছে। কী হয়েছিল রাতে? তারা মিয়া মনেই করতে পারছে না। বালিশের নিচ থেকে অর্ধেক খাওয়া বিড়ি নিয়ে আসে রান্না ঘরে। ঠোঁটের ফাঁকে বিড়ি গুঁজে চুলো থেকে একটুকরো জ্বলন্ত কাঠ বের করে আগুন নিয়ে ধরায় তাতে। বিড়িতে কয়েকবার ফুঁক দিতেই তার রাতের সেই ভয়ানক ঘটনার কথা আবছা আবছা মনে হতে লাগে। তার মানে সে যা দেখেছে সবই সত্যি ছিল! কোনো স্বপ্ন ছিল না? কিন্তু তার এসব কথা তো কেউ বিশ্বাস করবে না। নূরকে কেন চাইছে সেই অদৃশ্য শক্তি? আর এসব ধনরত্ন তাকেই কেন দিতে চাচ্ছে? কথাটা বারবার মাথায় ঘুরপাক করছে। দরজার পাশে মাটিতে পাতানো পাটির উপর দু’পা ছড়িয়ে বসে আছে চুপচাপ। রাতের হিসেব মেলাতে পারছে না সে। একবারও তো পুকুরে জাল ফেলল না তাহলে এই মাছগুলো কোথায় থেকে আসল?

মনিরের ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে তারা মিয়া। কাজ আছে আজ একটা সেখানে যেতে হবে। লুঙ্গিতে গিট্টু দিতে দিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। আজ আর তার খাওয়া হবে না। ফতুয়াটা গায়ে দিয়ে মনিরের সাথেই বেরিয়ে যায়। বের হওয়ার সময় রাবিয়া একবার খাবে কিনা জিজ্ঞেস করল। তারা মিয়া কিছু না বলেই হনহনিয়ে বাড়ির বাইরে চলে যায়।

রাবিয়া আবার চুলো গুতোগুতি করছে। মাছগুলোকে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে তার। কিন্তু মশলা ছাড়া কী ব্যবস্থাই বা করবে। পাশের বাড়ির ফরিদা চাচির থেকে অনেকবার চেয়ে এনেছে। এখন তো যেতেও লজ্জা লাগে। মানুষের থেকে আর কত চেয়ে নেয়া যায়। তবুও রান্না তো করতেই হবে নাহলে যে পেটে দানা পড়বে না।

ফরিদা বানু হাশিম চেয়ারম্যানের মা৷ বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবার তাদের। শুধু অর্থের দিকে ধনবান নয় মনের দিক দিয়েও অনেক ধনবান তিনি। এলাকার কেউ সাহায্যের জন্য গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসেনি। হাশিম চেয়ারম্যান আবার তাঁর মায়ের কথা খুব শুনেন। সেজন্যে মা যাকে সাহায্য করতে বলেন তিনি তাকে সাহায্য করেন। পাশের বাড়িটাই চেয়ারম্যান বাড়ি।

রাবিয়া ফরিদা বানুর রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে৷ ভেতরে যাবে নাকি যাবে না এমন দ্বিধাদ্বন্দে আছে। সুপারি কাটছিলেন ফরিদা বানু। জানালার দিকে চোখ যেতেই রাবিয়া বেগমকে দেখলেন।

ঠোঁটের কোণে একটা হাসি রেখে বললেন, “আরে নূরের মা না? আয় ঘরে আয়।”

ফরিদা বানুর বয়স প্রায় ষাটোর্ধ হবে। একরঙা শাড়ি পরে আছেন। তাঁর দুই ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলেমেয়ে বিয়ে করিয়ে নাতিপুতির মুখও দেখে ফেলেছেন। জীবনে আর কিছু পাওয়ার নেই। সবকিছুই পেয়ে গেছেন এই ক্ষণিকের জীবনে। কিন্তু আজকাল সব থাকা সত্ত্বেও কথা বলার মানুষের বড্ড বেশি অভাব তাঁর। কেউ এসেছে দেখলে অনেক খুশি হয়ে যান। একটু কথা বলতে একজন মানুষের জন্য তাঁর কত আহাজারি! ছোট ছেলে শহরে চাকুরি করে সেখানেই বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে৷ মেয়েকে পাশের একটা গ্রামেই বিয়ে দিয়েছেন৷ আর বড় ছেলে হাশিম চেয়ারম্যান। তাঁর স্বামীও এই এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন। ছেলের বউ সারাদিন দরজা বন্ধ করে ঘুমায়৷ কাজের মহিলা এসে সকালে একবার কাজ করে দিয়ে যায় আবার বিকেলে একবার আসে। নাতি-নাতনি দুইজন স্কুলে থাকে। সারাদিনে একবারও তাদের দেখা পাওয়া যায় না। সন্ধ্যা হলেই আবার তাদের নিয়ে পড়াতে বসায়। একজন বাইরের মানুষ পেলেই ফরিদা বানু গল্প করার জন্য জেঁকে বসেন। তাঁর এই যারতার সাথে গল্প করাটা ছেলের বউ হালেমার পছন্দ না। তিনি অতিরিক্ত কথা বলেন দেখে অনেকেই চেয়ারম্যান বাড়িতে যায় না। তাছাড়া সম্ভ্রান্ত পরিবার বলে এমনিতেও কেউ প্রয়োজন ছাড়া বাড়িতে পা রাখে না। হালেমার স্বভাব তেমন ভালো না। মানুষ বাড়িতে আসা পছন্দ করে না সে।

ফরিদা বানু দরজা খুলে রাবিয়াকে ভেতরে আসতে দেন৷

“আয় বস,” হাসিমুখে বললেন ফরিদা বানু।

“না চাচি বসুম না। রান্ধন লাগবো।”

ফরিদা বানু রাবিয়ার তাড়া দেখে বুঝলেন সে কোনো প্রয়োজনেই এসেছে। ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু লাগবো? নিতে আইছত কিছু?”

“চাচি একটু…”

কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই চেয়ারম্যানের স্ত্রী হালেমা চলে আসে। ফরিদা বানু আর কোনো কথা বলছেন না। রাবিয়া বেগম হালেমার সামনে চাইতে লজ্জা পায়। না জানি চাইলে মুখের উপর কোনো কিছু বলে দেয়, তখন তো একেবারে সম্মানটাই যাবে।

রাবিয়া হাত কচলাতে কচলাতে বলল, “চাচি আমি যাই৷ পরে একবার আসুম নে একবার।”

কথা শেষ করে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না সে। পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়৷ ফরিদা বানু জানালা ধরে দাঁড়িয়ে রাবিয়ার চলে যাওয়া দেখছেন। দূর থেকেও রাবিয়া চেয়ারম্যানের বউয়ের চিল্লাপাল্লা শুনতে পাচ্ছে৷ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে সে ফরিদা বানুর উপরই চিল্লাপাল্লা করছে।

“আম্মা আপনে যারেতারে ঘরের ভিতর আনেন ক্যান? এইসব ছোডলোক থেইক্যা দূরে থাকা ভালা। আপনেরে আর কত বুঝামু? যদি কিছু চুরি কইরা নিয়া যাইতো?”

“মানুষ তো মানুষের কাছেই আহে রে মা। আর ছোডলোক কইতেছ ক্যান তাগোরে? তারাও তো মানুষ! একসময় তারা মিয়ার বাপেরও সম্পত্তি আছিলো। এখন একটু খারাপ অবস্থায় পইড়া গেছে।”

“হো আমি যাই কই তাই আপনের খারাপ লাগে। আসলে নিজে যেমন তেমন মাইনষের লগেই তো খাতির রাখবেন, তো রাখেন। আপনের লগে আজাইরা প্যাঁচাল পাড়তে ক্যান যে আইলাম!”

আরও নানা কথা বলে হালেমা প্লেটে করে খাবার নিয়ে হনহন করে তার ঘরে চলে যায়। ফরিদা বানু এখনও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। হাসছেন তিনি, যদিও এই হাসিটা অর্থহীন। আশ্চর্য ব্যাপার হলো তিনি তাদের মধ্যে কোনো ব্যবধান খুঁজে পান না। অথচ হালেমা মুহুর্তেই কত পার্থক্য দেখিয়ে দেয়। ফরিদা বানু চুলায় চা চড়াচ্ছেন। সকালে তাঁর এককাপ চা না হলে চলেই না।

এদিকে রাবিয়া রান্নাঘরে এসে চুপচাপ বসে আছে। কী করবে ভেবে পায় না। তার সংসারে তাকে শ্বাশুড়ির কথা শুনতে হয় অন্যদিকে ফরিদা বানুকে তার ছেলের বউয়ের নানা কথা শুনতে হয়। কত অদ্ভুত এই সংসার জীবন! কারো টাকা থেকেও সুখী না, কারো টাকা না থেকেও সুখী না অথচ, দূর থেকে সবাই সুখী। সুখপাখিকে ধরতে পারা এত সহজ নয়। ধরা দিয়েও অধরা থেকে যায় সে।

তারা মিয়া বাজারের থলে হাতে বাড়ির দিকে ফিরছে। মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছে ঘরের খরচাপাতি করার জন্য। নাহলে তার ঘরে চুলা জ্বলবে না আজ। টাকা তো নিয়ে নিয়েছে কিন্তু ভাবছে কীভাবে সে তা পরিশোধ করবে! সুদের টাকা দিনদিন বাড়তেই থাকবে। যত দ্রুত সম্ভব তা পরিশোধ করতে হবে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই তারা মিয়া বাজারের থলে হাতে ফিরে আসে বাড়িতে। নূরের হাতে থলেটা ধরিয়ে দিয়ে আবার কাজে ফিরে যায়। বাবার যাওয়ার পথে বেশ কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। থলে নিয়ে হেঁটে যেতে পারছে না কারণ তার থেকে থলেটার ওজন বেশি। দাঁতে দাঁত চেপে থলে ধরে মায়ের কাছে যাচ্ছে। পায়ের সাথে বারবার লাগছে এসে৷ থলেসহ সে নিজেও পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। রাবিয়া দূর থেকে দেখে এগিয়ে এসে থলেটা নেয়। থলে খুলে দেখল রান্নার কাজে ব্যবহারের নিত্য প্রয়োজনীয় সব মশলাপাতি। তার মাথায় এখন একটাই ভাবনা, মানুষটা কাজেই তো মাত্র গেল এত অল্প সময়ে টাকা কোথায় পেল যে এত বাজার নিয়ে আসলো? মহাজনের থেকে আবার ধার করেনি তো! মাথাটা একদম ফাঁকা হয়ে আছে। নাহ! এই মুহুর্তে এতকিছু ভাবলে চলবে না তার। ভাবতে গেলে রান্না করতে দেরি হয়ে যাবে। পরে আবার আনোয়ারা বিবির নানা কথা শুনতে হবে তাকে।

৯.

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ফরিদা বানু সুপারি কাটতে কাটতে বসার ঘর থেকে বারবার উঁকি দিচ্ছেন। কাপে রাখা চা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। একটা বিস্কুট ডুবিয়ে রাখা আছে কাপে, যা চায়ের পানি খেয়ে একদম ফুলে পুরো কাপ ভরে গেছে। সেদিকে তার কোনো মনোযোগই নেই। সামনে রাখা রেডিওতে ঘোষণাপাঠ চলছে। মাঝেমধ্যে কথা কেটে যাচ্ছে। চায়ের কাপে মুখ দিলে চিন্তা ও ভাবনারা প্রসারিত হয়। ফরিদা বানু এখনও তাতে মুখে দেননি। কিন্তু তবুও এখন চিন্তা হচ্ছে ভিন্ন বিষয় নিয়ে। সেটা হলো, তাঁর নাতি-নাতনি কিছু খেলো কিনা! সেই কখন পড়তে বসছে এখনও শেষ হলো না! দাদী-নানীরা বরাবরই কিছুটা এমন হয়। নিজের ছেলে মেয়েকে নিয়ে যতটা না ভাবেন তার থেকে দ্বিগুণ ভাবেন নাতি-নাতনিদের নিয়ে। ফরিদা বানুর ভাবনাটা নিজের মধ্যেই চাপা দিয়ে দেন। আজকাল সারাক্ষণ একা একা থাকতে আর ভালো লাগে না তাঁর। জীবনটা কেমন পানসে হয়ে এসেছে! মাসুম দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। তার ইচ্ছে করছে দাদির কাছে যেতে কিন্তু হালেমার ধমক খেয়ে আবার পড়তে বসেছে।

ওইদিকে নূরকে পড়াতে বসিয়েছিল রাবিয়া৷ কিছুক্ষণ পড়েই দৌড়ে দাদির কাছে চলে গেছে। কোলে চড়ে বসে আছে গলা জড়িয়ে। সে আজ রাজপুত্রের গল্প শুনবে। আনোয়ারা বিবি গল্প জুড়ে বসেছেন, “এক আছিল রাজা আর এক আছিল রাণী…।”

তারা মিয়া ঘরে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে পাটি বিছিয়ে বসে। রাবিয়া খাবার বেড়ে দেয়। মাছের ঝোল আর লাউ রান্না করেছে। গপাগপ খেয়ে “বাজারে যাচ্ছি” বলেই বেরিয়ে পড়ে তারা মিয়া। কাপড়টাও বদলায় না।

মনির বাইরে বড় আমগাছের গোড়ায় বসে বিড়ি ফুঁকছে আর অপেক্ষা করছে। ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। মনির একাই থাকে। মা-বাবার কোনো পরিচয় নেই। তার বয়স যখন দুই-তিন দিন তখন কেউ একজন রাস্তার মোড়ে একটা পুটলিতে করে ফেলে গিয়েছিল, শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছিল। তারা মিয়ার বাবা জয়নাল মিয়া তাকে কুড়িয়ে আনেন এই বাড়িতে। সেদিন থেকেই সে এই বাড়ির ছেলে। জয়নাল মিয়া মৃত্যুর আগে মনিরকে বাড়ির জায়গায় আলাদা ঘর বানিয়ে দেন। আশা ছিল বেঁচে থাকতেই বিয়ে করাবেন কিন্তু সেই সুযোগ আর হয়ে উঠে না। তারা মিয়াকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ায় মনির। হাতের বিড়িটা মাটিতে ফেলে জুতোর তলা দিয়ে ঘঁষে নিভিয়ে দেয়। ভাইকে যথেষ্ট সম্মান করে সে।

তারা মিয়া এগিয়ে এসে বলল, “হুজুররে পাওন যাইবো তো?”

“হো মাত্র আজান হইলো না? মজ্জিদেই পাওন যাইবো।”

মনিরকে গতকাল রাতে সবকথা খুলে বলার পর সে ফরুক মোল্লার কাছে যাওয়ার কথা বলল। তারা মিয়া তো ভেবেছিল মনির তার কথা বিশ্বাসই করবে না। কিন্তু আজব ব্যাপার হলেও সে সব কথাই বিশ্বাস করল। তার কথা মতেই দু’জনে মিলে মসজিদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ফরুক মোল্লা মাত্র মাগরিবের নামাজ পড়ে বসেছেন। তারা মিয়া মসজিদে না ঢুকে বাইরে থেকেই হুজুর বলে আওয়াজ দেয়। “খুক খুক” করে কেশে তিনি চোখ খানিকটা কুঁচকে বাইরে উঁকি দেন। বয়স কম হয়নি তার। কিন্তু তেমন বেশি বয়স বুঝা যায় না। অনেক বছর ধরেই এই মসজিদে আছেন।

“কিডায় ডাকে?” ফরুক মোল্লা দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

মনির এগিয়ে এসে বলল, “হুজুর আমি মনির, কয়ডা কতা আছিল আপনের লগে।”

“ওহ! মনির মিয়া। কও, কী কতা কবা?”

তারা মিয়া খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে একবার তাকিয়ে আবার হুজুরের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মনির বলল, “মেলা কতা আছে হুজুর। যদি একটু সময় দিতেন।”

“আইচ্ছা খাড়াও আমি দুয়ারডা লাগাই লই। মজ্জিদের ভেতরে বইসা দুনিয়াদারীর কতা কওন যাইবো না। এইডা আল্লার ঘর বুইজ্জ মিয়া? এইহানে খালি আল্লার ইবাদত করতে হয়।” কথা বলতে বলতে পেছনে ফিরে ফরুক মোল্লা মসজিদের দরজা বন্ধ করে বাইরে আসলেন।

বাইরে এসে আবার বললে, “আমার ঘরে আহো, ওইহানে বইয়া কতা কই।”

মনির ফরুক মোল্লার কথায় তারা মিয়াকে নিয়ে তাঁর পিছু পিছু ঘরে গেল। ছোট একটা একচালা ঘর। একাই থাকেন এখানে ফরুক মোল্লা। নিচে পাটিতে ঘুমান তিনি।

ঘরে ঢুকে হারিকেনটা হাত থেকে রেখে পাটিতে বসে বললেন, “বহো মিয়ারা। এইবার কও কী কতা কবা?”

মনির ইশারা দিয়ে তারা মিয়াকে সব বলতে বলল। একে একে সব কথা শুরু থেকে খুলে বলল তারা মিয়া। এসব কথা শুনে ফরুক মোল্লা কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন। চুপ করে চোখ বন্ধ করে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলেন।

খানিকক্ষণ পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ওই পুষ্করিণীতে তো দেও আছে তারা মিয়া।”
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here