পদ্মপুকুর পর্ব: ১৩,১৪

0
469

পদ্মপুকুর
পর্ব: ১৩,১৪
লিখা: বর্ণালি সোহানা
পর্ব: ১৩

১৩.
শেষ বিকেল হয়ে এসেছে প্রায়। কোথাও কোনো বৃষ্টি নেই তবুও আকাশ থেকে থেমে থেমে মেঘের গর্জন শুনা যাচ্ছে। কত মানুষের বাড়ি আজ জ্বলেপুড়ে খাক হচ্ছে কে জানে! আব্দুল্লাহ মাত্র চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে ঘরে ফিরল। বউকে গরম চা বানাতে বলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। বিয়ের দশ বছর হয়ে গেছে তার ঘরে কোনো বাচ্চা নেই। বউ বারবার বলে আরেকটা বিয়ে করতে কিন্তু আব্দুল্লাহ তা করে না। সারাদিন তো চেয়ারম্যানের বাচ্চাদের সাথে কেটে যায় তার। রাতটাতেই বাড়িতে আসে। তখন আর বাচ্চার কথা ভাবার সময় কই তার। তাছাড়া আরেকটা বিয়ে করে খাওয়াবে কী? তেমন ধন-সম্পদও নেই যে বাচ্চাকাচ্চার জন্য রেখে যাবে। তার মতে, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। একবেলা খেয়ে যে মানুষের আরেক বেলা খাবার চিন্তা তার আর বাচ্চা দিয়ে কী হবে? একটা ঘরেই গাদাগাদি করে পরিবার নিয়ে থাকছে। এদিকে সারাদিন মেঘের গর্জনের পর এখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই টানা বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির এমন দিনে খাল-বিলে অনেক ছোট-বড় মাছ পাওয়া যায়। গ্রামের প্রায় সকলেই এমন দিনে মাছ ধরে। আব্দুল্লাহর বাড়ি মসজিদের পেছনেই। নামাজ পড়ে বাড়িতে ফিরছিল তার ছোট ভাই। পদ্মপুকুরে পা ধুতে গিয়ে অনেক বড় মাছ দেখতে পায়। দৌড়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে।

উঠানে এসেই হন্তদন্ত হয়ে বলল, “ভাইজান মজ্জিদের পুষ্করিণীতে মাছ দেহা যাইতাছে, অনেক বড় মাছ।”

নামাজের জামাতের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় আজ আর মসজিদে যাওয়া হয়নি আব্দুল্লাহর। বাসায় নামাজ আদায় করে চা নিয়ে বসেছে মাত্র। ছোট ভাই হেলালের কথা শুনে আব্দুল্লাহ চা খাওয়া রেখে ঘর থেকে কোঁচ নিয়ে পদ্মপুকুরের দিকে দৌড়াচ্ছে। রাস্তাটা পিচ্ছিল কাঁদায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। বৃষ্টির বেগ এখন কমে এসেছে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। রাতের বেলা ভয়ে মাছ ধরতে না গেলেও এখন বিকেল গড়িয়েছে মাত্র তাই ভয়ের কোনো কারণ নেই৷ সবাই আছরের নামাজ শেষ করেছে কেবল। মাগরিবের আজান হতে এখনও অনেক দেরি। কিন্তু মেঘলা দিন হওয়ায় মনে হচ্ছে এখনই সন্ধ্যা নামবে। পদ্মপুকুরের কাছে আসতেই আব্দুল্লাহ দেখল মাছের কালো রঙের পিঠ দেখা যাচ্ছে। দাঁত কিড়মিড় করে সজোরে কোঁচটা মাছের পিঠে বসিয়ে দেয়৷ সাথে সাথে গলগল করে রক্ত বেরুতে থাকে। এত রক্ত দেখে ঘাবড়ে যায় দু’জন। মাছ থেকে তো এভাবে রক্ত বের হওয়ার কথা না! হেলাল পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছটার কাছে এগিয়ে যায়। কোঁচ ধরে টান দিয়ে দেখে এটাতো মাছ নয় একটা বাচ্চা! বাচ্চাটাকে পুকুর থেকে উপরে তুলে আনে। এলোমেলো চুলগুলো পানিতে ভিজে মুখ ঢেকে রেখেছে। হেলাল মুখের উপর থেকে চুল সরাতেই আব্দুল্লাহ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।

এই বাচ্চাটা যে আর কেউ নয় হাশিম চেয়ারম্যানের একমাত্র ছেলে মাসুম! আব্দুল্লাহর অতি আদরের সন্তানতুল্য সেই বাচ্চাটা। সম্পূর্ণ শরীর রক্তে লাল হয়ে আছে মাসুমের। পানি খেয়ে পেট একদম ফুলে গেছে। কান্নাকাটি শুনে মসজিদ থেকে করিম হুজুর দৌড়ে আসেন। আশেপাশের মানুষজন নামাজের জন্য এসেছিল তারাও দৌড়ে আসে। ভিড় ঠেলে চেয়ারম্যান কাছে আসেন। ছেলেকে নিয়ে নামাজ পড়তে এসেছিলেন তিনি। নামাজ শেষ করে গ্রামের লোকেদের সাথে নানা সমস্যা নিয়ে গল্প করতে শুরু করেন। সেই ফাঁকে মাসুম পা ধুতে এসেছিল পুকুরে। পায়ে কাদা লেগে গিয়েছিল তার। কিন্তু অসাবধানতায় পা পিছলে পড়ে যায়। মসজিদে আসা প্রত্যেক মানুষ একটা বিষয় নিয়েই কথা বলছে, মাসুম আসলেই কী কোনো অসাবধানতার কারণে পড়ে গেছে নাকি এর পেছনে সেই অশুভ শক্তির হাত?

এত ছোট বাচ্চা সাঁতারও জানে না, পুকুরেই মরে ভেসে ওঠে। আশ্চর্যজনক বিষয় হল মাসুম নামাজে এসেছিল পাঞ্জাবি পরে অথচ এখন তার খালি গা। তার পরনের সাদা পাঞ্জাবিটা পুকুরের অন্য মাথায় কিছুটা ডুবন্ত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যায়। আব্দুল্লাহকে গ্রেফতার করে৷

হেলাল বারবার কান্না করে বলল, “আমার ভাইজান পোলাডারে মারে নাই৷ ভাইজান তো মাছ মনে করছিল। ভাইজানের কুনু দোষ নাই। তারে ছাইড়া দেন সাহেব।”

হেলালের শত বলার পরেও তার কথা বিশ্বাস করল না পুলিশ কর্মকর্তা। কিন্তু আব্দুল্লাহ একটা শব্দও বের করেনি। যাবার আগে তার চোখে শুধু জল দেখা গিয়েছিল। পুলিশ তাকে ধরে হাজতে নিয়ে গেল। চেয়ারম্যানের স্ত্রী হালেমা ছেলে হারানোর খবর পেয়ে পাগলপ্রায়। তাকে আটকে রাখা যাচ্ছে না। আশেপাশের মহিলারা কোনোরকম আটকে রেখেছে তাকে। ছোট্ট মেয়েটা মায়ের এমন অবস্থা দেখে ভয়ে আরও বেশি কান্না শুরু করে দিয়েছে। এদিকে চেয়ারম্যান বাড়িতে আসার পর থেকে কোনো কথা বলছেন না। একমাত্র ছেলেকে হারিয়েছেন তিনি। মনে হচ্ছে নিজের মায়ের প্রতি করা অন্যায়ের ফল এটা। মায়েরা যদিও কখনও মুখ ফুটে অভিশাপ দেয় না। কিন্তু অভিশাপ দেয় মায়েদের অন্তর। আজ যদি তিনি তার মায়ের সবকিছুর দিকে ঠিকমতো নজর দিতেন তাহলে হয়তো এতকিছু হয়ে যেত না। একদিকে মা হারানোর যন্ত্রণা অন্য দিকে ছেলে হারানোর শোক একসাথে জেঁকে বসেছে তাকে।

চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে টেলিফোন এসেছে ঢাকায়। জেসমিন রান্নাঘরে ছিল। কয়েকবার রিং বাজতেই সে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসে। ব্যস্ত স্বরে কথা বলছে। টেলিফোনের ওপর পাশ থেকে মাসুমের মৃত্যুর খবর এসেছে। তার চোখ থেকে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। ফরিদা বানু পাশেই ছিলেন। অনেক ভেবেও পাচ্ছেন না যে, এমন কী হয়েছে যার কারণে জেসমিন কান্না করছে?

বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর জেসমিন শান্ত গলায় বলল, “আম্মা, আমাদের মাসুম পানিতে ডুবে মারা গেছে।”

ধপ করে সোফায় বসে যান ফরিদা বানু। মাসুম মারা গেছে! চোখের সামনে যেন পৃথিবীটা আঁধার হয়ে এসেছে। কথাটা বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। চিৎকার করে কান্না করছেন। জেসমিন তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে। কারণ এই কষ্টটা কোনো সান্ত্বনায় কমার নয়। আদরের নাতিকে এভাবে হারাবেন কল্পনাও করতে পারেননি তিনি। জেসমিন হারুনকে টেলিফোনে জানায় সব। সে বাড়িতে এসেই তার মাকে সাথে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। নাতিকে শেষ দেখা দেখবেন ফরিদা বানু। বারবার শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন। জন্মের পর থেকে সবসময় নাতিকে চোখেচোখে রাখতেন আর আজ হঠাৎ করেই কী হয়ে গেল! মাসুমের নিষ্পাপ চেহারাটা বারবার তাঁর চোখের সামনে ভাসছে। কলিজায় পুরনো সেই ব্যথা অনুভব করছেন।

আব্দুল্লাহ কোনো অপরাধ না করেও আজ অপরাধী। হাজতে বসে একনাগাড়ে কান্না করছে সে। ছেলে সমতুল্য বাচ্চাটার মৃত্যুর জন্য আজ তাকে দোষারোপ করা হচ্ছে এর থেকে বেশি কষ্ট আর কী হতে পারে! হেলাল একবারের জন্যেও থানা থেকে যায়নি। পুলিশের কাছে কত কাকুতিমিনতি করল কিন্তু অনেক সময় গরীবের আওয়াজ উপর অবধি পৌঁছায় না। তাদের আওয়াজ মুখ থেকে বেরুনোর আগেই সময় চেপে দেওয়া হয়। পুলিশ লাশের ময়নাতদন্ত করে দেখল পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু চেয়ারম্যান তা কিছুতেই মানতে চাচ্ছেন না। তিনি আব্দুল্লাহর নামে কেইস করবেন। সবাই এতকিছু বলছে অথচ সেখানে ফরিদা বানু বিশ্বাস করছেন না যে আব্দুল্লাহ এমন কিছু করবে। নিজ চোখে দেখেছেন সে কত আদর করত মাসুমকে। নিজের ছেলে হাশিমের পাশে বসে বিভিন্নভাবে বুঝাতে থাকেন তিনি।

ফরিদা বানু চোখের জল মুছে বললেন, “দেখ বাজান, আমাগো আব্দুল্লাহ মাসুমরে নিজের পোলার মতোই আদর করত। সে কেমনে নিজের পোলারে মারবো! তুই ভুল বুঝতাছস। ওই পুলিশগোরে কো আব্দুল্লারে ছাইড়া দিতে।”

এসব কথা শুনে হালেমা চিৎকার-চেচামেচি শুরু করে দিয়েছে৷ তার ছেলেকে যেন আব্দুল্লাহ ইচ্ছে করেই মেরেছে। চেয়ারম্যানকে অনেক বোঝানোর পর তিনি কেইস তুলে নিতে রাজী হলেন। একদিকে আব্দুল্লাহকে ছেড়ে দেয়া হল। অন্যদিকে ময়নাতদন্তের পর ছোট বাচ্চার লাশটা চেয়ারম্যান নিজে এসে এম্বুল্যান্সে করে নিয়ে এসেছেন। অশ্রুর ফোয়ারা তৈরি হয়েছে সবার চোখ জুড়ে। এই বয়সে ছেলেকে হারাবেন কে ভেবেছিল! মাসুমের লাশকে বুকে জড়িয়ে ধরে গলা ছেড়ে কান্না করে দেন চেয়ারম্যান। গ্রামবাসী জীবনের প্রথম তাঁকে এভাবে কান্না করতে দেখছে। হালেমা পাগলের মতো প্রলাপ করে কান্না করছে। কত সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে কিন্তু মায়ের মন কী আর তা বুঝে! চোখের জল পড়েই যাচ্ছে অবিরাম। সকালের দিকে মাসুমের জানাজা পড়ানো হয়। আব্দুল্লাহ সেই জানাজায় এসেছিল কিন্তু সবার আড়ালে ছিল সে৷ নিজের কাছে আজ নিজেই অপরাধী।

সেদিনের পর আব্দুল্লাহকে আর চেয়ারম্যান বাড়িতে দেখা যায়নি। জীবনের এই বয়সে এসে বেকার হয়ে ঘরে বসেছে সে। ছোট ভাই হেলাল যতটুকু পারছে পরিবারে আর্থিক সাহায্য করছে। মাসুম মারা গেছে আজ পাঁচ দিন পার হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। হারুন ঢাকা ফিরে যাবে আজ, ফরিদা বানুকেও সাথে নিয়ে যাবে। কাপড়চোপড় গুছিয়ে তারা শহরে ফিরে যাচ্ছে।

চেয়ারম্যান হাশেম অনেকবার বললেন, “আম্মাকে রাইখা যা হারুন।”

কিন্তু হারুন রেখে যায়নি। সে জীবনে প্রথমবার তার ভাইয়ের কথা উপেক্ষা করেছে ৷ মাকে একবার এখানে রেখে যে ভুল করেছে আরেকবার সেই ভুল করবে না৷ অন্তর পুড়ছে ফরিদা বানুরও তবুও তাঁর কিছুই করার নেই। নিশ্বাস কিছুদিন পর তারও থমকে যাবে, থমকে যাবে তাঁর পৃথিবী। কিন্তু ততদিন একটু ভালো থাকতে চান তিনি। আনমনে ছেলের পিছুপিছু হেঁটে যাচ্ছেন বাস স্ট্যান্ডের দিকে। চোখের জল আঁচলের ভাঁজে মুছে ফেলছেন। হারুন মায়ের যন্ত্রণা ভালোই বুঝতে পারছে। চোখের জল দেখেও না দেখার ভান করছে সে। কিছু জিনিস আড়ালে থাকাতে দেওয়া ভালো। সবকিছু দেখতে নেই, সব প্রশ্ন করতে নেই, সব প্রশ্নের উত্তর হয় না শুধু অনুভব করে নিতে হয় কারণ প্রশ্নের উত্তরটা অজানা নয়।
.
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

❝পদ্মপুকুর❞
পর্ব: ১৪

১৪.
দূরে কোথাও করুণ স্বরে ডাকছে শিয়াল। ভয়ে গা ছমছম করছে। চোখ থেকে ঘুম যেন উড়ে গেছে। রাবিয়া ভয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে শক্ত করে। আলতোভাবে মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। তারা মিয়া এখনও বাড়ি ফিরেনি। বড্ড বেশি ভয় জেঁকে বসেছে তার মনে। নূরের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছে।

ছেলেটার পর আর কোনো বাচ্চার মুখ দেখেনি সে। কত হুজুরের কাছে গেল কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। গ্রামে ডাক্তারের চাইতে হুজুরের চিকিৎসা কার্যকর বেশি বলে মনে করা হয়। পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা যেকোনো কিছুতেই হুজুর একটু পানি পড়া বা তেল পড়া দিলেই কাজ হয়ে যায়। সামান্য রোগের জন্য কেউ হাসপাতালে যায় না। পাশের সরকারি হাসপাতাল তো প্রায় সময়ই রোগীহীন হয়ে থাকে। ডাক্তার নার্সরা আরাম করেই মাস শেষে টাকা হাতে গুনছে। মাঝেমধ্যে সকাল বেলা এসে কিছুক্ষণ বসে থেকে আবার চলে যায় তারা। অনেক সময় তো প্রয়োজনে ডাক্তারও মিলে না। হাসপাতালে অনেক ঔষধই পাওয়া যায় না। বাজারের ফার্মেসি থেকে রোগ বলে ঔষধ কিনে আনতে হয়। ছমির ডাক্তার বেশ নামকরা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। হুজুর যে রোগের ঔষধ দিতে পারেন না সে রোগের ঔষধ দেন ছমির ডাক্তার। তার ঔষধে অনেক বড় বড় রোগের রোগীরা আরোগ্য লাভ করেছে। তারা মিয়া রাবিয়ার শেষ চিকিৎসা করতে চায়। একটা বাচ্চার আশা কার না থাকে? রাবিয়াকে নিয়ে এই যাবৎ দুইবার ছমির ডাক্তারের কাছে গিয়েছে সে। সাদা সাদা সাগুদানার মতো বড়ি আর দুই বোতল লাল ও সবুজ রঙের ঔষধ দিয়েছে তাকে। বাকিটা আল্লাহর রহমত হলে বাচ্চা হয়ে যাবে। একনাগাড়ে তিন মাস ঔষধ খেতে হবে রাবিয়ার।

নূর একমাত্র ছেলে তাই সবসময় চোখেচোখে রাখে সবাই৷ দাদির চোখের মণি আর তারা মিয়ার বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র ভরসা। আর রাবিয়ার তো কলিজার টুকরো ছেলে। সবসময় বুকের সাথে আগলে রাখে ছেলেকে। মনে হয় যেন ছাড়লেই কেউ নিয়ে যাবে। নূরও তেমনি শান্তশিষ্ট। অন্যান্য বাচ্চারা যেখানে ধুপধাপ করে এদিকে সেদিকে ছুটে বেড়ায় সেখানে সে মায়ের সাথে সাথেই থাকে। বাবা আসলে তার পাশে গিয়ে কতশত প্রশ্ন জুড়ে বসে।। আর মা যখন কাজে থাকে তখন দাদির কাছে রাজা-রানির গল্প শুনে। আনোয়ারা বিবি কত গল্প জানেন। নূরের কাছে তার দাদির বলা সবচেয়ে মজার গল্প হলো, টোনাটুনির সংসার নিয়ে। ওই যে দুইটা টোনাটুনির পিঠা খাওয়ার গল্পটা। প্রতিদিন একবার সেই গল্প শুনে নূর। রাবিয়া প্রতি রাতে ঘুম পাড়ানোর সময় নূরকে সূরা শেখায়, আজকেও শিখিয়েছে৷ প্রায় অনেকগুলো সূরা নূর শিখে গেছে।

নূরকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে রাবিয়া। ঘেমে একাকার হয়ে গেছে ছেলেটা। আজকে আকাশে মেঘের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। প্রচণ্ড গরম পড়ছে। কয়দিন আগেও তাদের ঘরে বিদ্যুৎ ছিল। তারা মিয়ার চাচাতো ভাইয়ের ঘর থেকে বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগ দিয়েছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ অফিসের লোকজন এসে অবৈধ সংযোগ দেখে কেটে দিয়েছে। ঘরে পঁচিশ পাওয়ারের বাতিটাও এখন আর জ্বলে না। পাখা তো এমনিতেও কিনার সামর্থ্য ছিল না। নূরকে একটু বাতাস করতেই শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। তারা মিয়া বাড়িতে ঢুকছে। টাকার ব্যবস্থা আজও কোথাও হলো না তার। অনেক রাত অবধি একজন থেকে আরেকজনের কাছে গিয়েছে সামান্য কয়টা টাকার জন্য কিন্তু কারও কাছেই পেল না। তারা মিয়া ঘরের কাছে আসতেই দেখল মনির তার ঘরের দরজার পাশে বসে আছে।

দূর থেকেই জিজ্ঞেস করল, “কিরে মনির, খাইছত রাইতে? ঘুমাস না ক্যান? এত রাইতে দুয়ারে বইয়া রইছত যে?”

মনির বিড়ি টানছিল। বড় ভাইকে দেখেই বিড়ির আগুন দরজায় ঘঁষা দিয়ে নিভিয়ে দেয়।

অর্ধেক খাওয়া বিড়িটা বুকপকেটে রেখে বলল, “ভাইজান ঘুম আইতেছিল না। আর তুমিও বাড়ি ফির নাই সবাই ঘরে একলা তাই বইয়া রইছিলাম।”

“আইচ্ছা এহন ঘরে যা, ঘুমা গিয়া। বহুত রাইত হইছে।”

মনির আর কোনো কথা বলে না। রাবিয়া তারা মিয়ার কথা শুনেই দরজা খুলে দিয়েছে। জুতো খুলে বালতির পানি দিয়ে হাত-পা ধুয়ে নেয় সে। রাবিয়া একটা থালায় খাবার বেড়ে দিয়ে নূরের পাশে শুয়ে পড়ে। তারা মিয়া পাটির উপর খেতে বসেছে।

মনির ক্লান্ত চোখে আকাশ দেখছে। আকাশের বিশালতা মাপছে সে। এই বিশালতা মাপার কোনো যন্ত্র এখনও আবিষ্কার হয়নি। সে কাঁদছে, প্রায় মাঝরাতেই তার কান্না পায়। হাজার চেষ্টা করেও তখন চোখের জলকে ধরে রাখা যায় না। এই জীবনে নিজের পরিবারের ভালোবাসা পেল না সে। পরিবার কী সেটাই চিনলো না। জন্মের পরপরই পরিচয়হীন করে দেয় তারই জন্মদাতা মা-বাবা। বিয়ে করে স্ত্রীর ভালোবাসাটাও পেল না। মনির খালি গলায় গান ধরেছে, বিষাদের গান। মাঝেমধ্যে মাঝরাতে এমন গান ধরে। বাঁশি বাজানোর একটা দক্ষতা আছে তার মাঝে। মাঝরাতে যখন বাঁশি বাজায় তখন অনেক রাতজাগা পাখিরা কান পেতে শুনে। শুধু পাখিরা নয়, অনেক মানুষও শুনে। মনের ক্লান্তি দূর করে দেয় সেই সুর। গ্রামের কতশত কিশোরীরা এই বাঁশির সুরে হৃদয় হারাতো। কিন্তু এখন আর আগের মতো হয় না। কারণ তার বাঁশিতে করুণ, হৃদয় ভাঙা সুর খেলা করে। সুখের সুর অনেক আগেই পথ হারিয়েছে। জীবনটা হয়ে গেছে বিষাদময়।

তারা মিয়া শখ করে পাশের গ্রামের মোস্তফা ড্রাইভারের মেয়ে রমিছার সাথে বিয়ে করিয়েছিল। রমিছা দেখতে বেশ রূপবতী ছিল, কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর ছিল তার দীঘল কালো কোমর ছাড়ানো চুল। অষ্টম শ্রেণি পাশ করেছিল আজিমগাঁও বিদ্যালয় থেকে। বিয়ে করেছিল মনির ঠিকই কিন্তু কপালে সুখ সইলো না তার। বউ বিয়ের দুই মাসের মাথায় বাপের বাড়ি গেল আর এলো না। প্রেম ছিল তার চাচাতো ভাইয়ের সাথে। বিয়ের সপ্তাহ খানেকের ভেতরেই মনির টের পায় রমিছা প্রায় গভীর রাতে ঘরের বাইরে গিয়ে কার সাথে যেন দেখা করে। মনির বুঝতে পেরে চুপিসারে বাইরে গিয়ে দেখতে চেষ্টা করে কিন্তু অন্ধকারে শুধু দুইজন মানুষের ছায়া আর কথার ফিসফিস শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। মনির কিছু না বলে ঘরে এসে শুয়ে পড়ে।

একদিন রাতে রমিছাকে জিজ্ঞেস করে মনির, “কার লগে দেহা করো এত রাইত্যের বেলা? কতা কও কার লগে?”

আচমকা এমন কথায় চমকে যায় রমিছা। কিন্তু জবাব তো তাকে দিতেই হবে। সেদিন তার থেকে কিচ্ছু লুকায়নি। সে নিজেই সব সত্যিটা বলে দেয়৷ এই বিয়েতে মত ছিল না তার। চার বছরের সম্পর্ক ছিল তার চাচাতো ভাই শরীফের সাথে। ছেলের পরিবার তাকে মেনে নেয়নি। শরীফ বলেছিল পালিয়ে যাবে দু’জনে। রমিছাও তাই করত কিন্তু মা-বাবা জোর করে বিয়ে দিয়েছেন। মনিরের সাথে সংসার করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না তার। রমিছা চলে যায় স্বেচ্ছায়। সে যাওয়ার পর আর কখনও খোঁজ নেয়নি মনির। হয়তো সুখেই আছে এই কথা ভেবে। জীবন ভালোই চলছে তার। তারা মিয়া আবার বিয়ের কথা বলছে। মনির মন ঠিক করতে পারছে না৷ রাতের আকাশে চাঁদ মেঘে ঢেকে আছে। তারারা খেলা করছে চাঁদের আশেপাশে। রাত বাড়ছে, বাড়ছে মন খারাপের যন্ত্রণা। মন খারাপের যন্ত্রণায় নিশ্বাস ভারী হয়। যন্ত্রণাকে বুকের বাম পাশে পোষণ করে। এই যন্ত্রণাদের কখনও মেয়াদ উত্তীর্ণ হয় না। যন্ত্রণারা যে বুকের ভেতরের স্থায়ী বাসিন্দা।

১৫.

সূর্যটা ধীরে ধীরে মাথার উপরে অবস্থান নিচ্ছে। বেলা তার গতিতে বেড়ে চলেছে। তখনও মনির নদীর পাড়ের রঙিন শৈবালের ওপর বসে আছে আনমনে। পাশে বসে আছে আব্দুল্লাহর ছোট ভাই হেলাল। মনির আর তারা মিয়ার সাথে আব্দুল্লাহর যেমন ভাব তেমনই হেলালের সাথেও বেশ ভাব।

হেলাল মনিরের কাছে রমিছার খবর নিয়ে এসেছে। গতকাল সে পাশের গ্রামে গিয়েছিল একটা কাজে। তখন হঠাৎ করে রমিছাকে দেখেছে। তারপর তার পিছু নিয়ে সামান্য তথ্য নিয়ে এসেছে। রমিছা এখন অন্যের বাড়িতে কাজ করে। যার জন্য সে মনিরের সংসার ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল সেই ছেলেটা রমিছাকে ধোঁকা দিয়ে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করছে। আজ ছেলেটা দুই সন্তানের পিতা আর রমিছা সংসারহীন এক নারী। সে বছরই রমিছার বাবা মারা যান। এমন অবস্থায় সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। সেজন্যে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে শুরু করে সে। বড় একটা ভাই না থাকার দরুন এমন হয়। রমিছার ছোট তিন বোন আর দুই ভাই। সবাইকে সেই দেখে রাখছে। আজকাল প্রতিদিন সেলাই শিখছে সে। সেলাই শেখা শেষ হলে মানুষের বাড়ির কাজ ছেড়ে দেবে। টাকা জমাচ্ছে সেলাই মেশিন কিনার জন্য।

মনির সবকিছু শুনে কেমন যেন দম ধরে বসে আছে। বছর ধরে খোঁজ জানতো না রমিছার। ভেবেছিল সুখেই আছে। অথচ আজ এসব জেনে তার মনের গভীরে কষ্ট হচ্ছে। এই কষ্ট হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু রমিছা কেন তার সাথে যোগাযোগ করল না? হয়তো লজ্জায়, নয়তো সে স্বার্থপর হতে পারেনি। একবার নিজ স্বার্থে মনিরকে ছেড়ে গিয়েছিল। আবার কীভাবে নিজ স্বার্থে তার কাছেই ফিরে আসবে? কিন্তু সে ফিরে আসলে মনির তো তাকে নির্দ্বিধায় মেনে নিত।

মনির আজ যাবে রমিছার সাথে দেখা করতে। তারা মিয়ার সাথে কথা বলতে হবে। হেলালকে সাথে নিয়েই যাবে সেখানে। বাড়িতে ফিরে তারা মিয়ার সাথে কথা বলার পর সে কোনো অমত করেনি। কারণ সংসার করবে মনির। আগের মত আরেকবার জীবন সাজাতে চাচ্ছে সেটাই বড় কথা। এইরকম অগোছালোভাবে তো আর জীবন চলে না। একজন সঙ্গী সবারই চাই। হতে পারে সে জীবনসঙ্গী, বন্ধু বা পরিবারের কেউ। যার সাথে সকল সুখ-দুঃখের অনুভূতিগুলো নির্দ্বিধায় ভাগ করে নেওয়া যায়। যে থাকবে শত ব্যস্ততা জুড়ে, হবে অবসর সময়ের একান্ত আপন। মনের জমানো কথাগুলো বলার মতো কোনো মানুষ না থাকলে কথা জমতে জমতে একটা সময় সেই মানুষ তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, হয়ে যায় উন্মাদ। যখন তখন যাকে তাকে কথা বলার জন্য জেঁকে বসে। কিন্তু কেউ তার কথা শুনতে চায় না। কারণ উন্মাদের প্রলাপ শুনার সময় তখন কারো থাকে না। সেজন্যে খুব দেরি না করে সময় মতো নিজের একজন সঙ্গী তৈরি করা উচিত।
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here