পদ্মপুকুর পর্ব: ১৫,১৬

0
1110

পদ্মপুকুর
পর্ব: ১৫,১৬
লিখা: বর্ণালি সোহানা
পর্ব: ১৫

মনির হেলালের সাথে আজ পাশের গ্রামে যাচ্ছে। গ্রামের নাম কাইতকোণা। রমিছাকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে। এতদিন তার সম্পর্কে কিছুই জানতো না, তাই রমিছার সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি। কিন্তু এখন যখন জেনেছে তখন আর এভাবে দূরে রাখবে না। রিকশা করে রমিছাদের বাড়িতে পৌঁছে যায় তারা। বাড়িটা একদম অচেনা লাগছে। যখন নতুন বিয়ে হয় তখন এত গাছগাছালি ছিল না। এখন ছোট-বড় অনেক গাছগাছালিরা বাসা বেঁধেছে। মনির প্রচণ্ড ঘামছে, ঘেমে বগলের নিচের দিকে শার্ট ভিজে গেছে খানিকটা। মহাজনের থেকে টাকা ধার করে এক কেজি মিষ্টি আর বিস্কুট নিয়ে এসেছে। আগামী কাল সবজি বিক্রি হলেই টাকা ফেরত দেবে। ঘরের সামনে এসে “রমিছা” বলে ডাক দেয় মনির।

ঘরের ভেতর থেকে একজন বৃদ্ধার কণ্ঠ ভেসে আসে, “কেডা? ঘরে আহো। রমিছা তো বাড়িত নাই।”

মনির হেলালকে নিয়ে ঘরে ঢুকে। তখনই রমিছা ছোট বোন রুমানা এগিয়ে আসে। দুলাভাইকে দেখে খুশি হওয়ার সাথে অনেকটা অবাক হয়। সে জানতো তার দুলাভাই একদিন আসবে। কিন্তু এত দেরি করবে সেটা ভাবেনি। রুমানা তাদের ঘরের ভেতর নিয়ে চৌকিতে বসায়।

মনির বসতেই জিজ্ঞেস করল, “হেনা, হাসনা, বেলাল আর হাবিব কই? তাগোরে দেখি না যে? আম্মা কই? ডাক দেও আম্মারে।”

রুমানা হেসে বলল, “ওরা ইশকুলে গেছে দুলাভাই। আপনারা বহেন ওরা আইয়া পড়বো। আর বুজান সেলাই শিখবার লাইগা গেছে। এহনি আইবো।”

মাকে ডাকতে যাবে তখনই গুলজান বানু মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে দিয়ে ঘরে আসেন। মনির তার পা ধরে সালাম করে। দু’জনের সাথে কুশল বিনিময় করে চেয়ার টেনে বসেন গুলজান বানু। গুলজান বানু যেন এতদিন মেয়ের জামাইর অপেক্ষাতেই ছিলেন। মৃত্যু তার দরজাতেও কড়া নাড়ছে। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন। কিন্তু সন্তানদের এমন বেহাল অবস্থায় রেখে মারা গেলে তার আত্মারও শান্তি হবে না। কবরে গিয়েও জ্বলবেন। আজ তার অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে মনে হচ্ছে। একজন পুরুষ মানুষের ছায়া প্রত্যেক সংসারেই প্রয়োজন। পুরুষ মানুষ ছাড়া সংসার যেন পাতাহীন গাছ। যে গাছের ডালপালা তো অনেক থাকে কিন্তু তার নিচে ছায়া থাকে না। কারণ ডালপালারা কখনও ছায়া দিতে পারে না। ছায়া তো পাতারা দেয়। মাথার উপর থেকে ছায়া সরে গেলে এই নিষ্ঠুর প্রকৃতিতে বেঁচে থাকা নিদারুণ কষ্ট হয়ে পড়ে।

গুলজান বানু বেশ হাসিখুশি আজ। এবার হয়তো তার মেয়ের একটা গতি হবে। রমিছা মাকে ডাকতে ডাকতে ঘরের ভেতরে ঢুকে। চৌকিতে মনিরকে দেখে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খায় সে। আচমকা এমন কিছু হবে ভাবনার বাহিরে ছিল। রমিছার ভাবনারা যেন থমকে গেছে মুহুর্তেই। মনির খেয়াল করল রমিছার ফরসা মুখখানি মলিন হয়ে গেছে। এই মলিনতা সংসারের চাপে এসেছে। রমিছা নিশ্চুপ ঘরের ভেতরে চলে যায়।

মনির শাশুড়ীকে বলল, “আম্মা আমি রমিছারে নিতে আইছি৷ সংসারডা আরেকবার জোড়া লাগাইতে চাই।”

“কুনু মা কী চায় বাজান তার মাইয়া সংসার না করুক! আমিও তো তাই চাই। কিন্তু আমার মাইয়াডারে বুঝাইতে বুঝাইতে আর পারি না।” কথাটা বলেই কেঁদে দেন গুলজান বানু।

হতাশার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। চেয়ার ছেড়ে উঠে রমিছার কাছে গিয়ে কথা বললেন। রমিছা যেতে রাজী নয়। সব জায়গায় স্বার্থপর হওয়া যায় না। কিন্তু সে আরও একবার স্বার্থপর হচ্ছে। পরিবার ছেড়ে যেতে পারবে না। পরিবারের মাথা গোঁজার জায়গা ঠিকই আছে কিন্তু এই জায়গায় খালি পেটে ঘুম আসবে না। নিজের কথা ভেবে সুখের সংসার হয়তো সাজাতে পারবে। বাইরের লোকেরা দেখবে কত সুখ! কিন্তু পেট খালি থাকলে তা কেউ দেখবে না৷ ক্ষুধার অসুখ সবার চোখে পড়ে না। যখন ক্ষুধার্ত পেট থেকে গুড়গুড় করে আওয়াজ আসে তখন কেবল ক্ষুধার্ত ব্যক্তিই তা উপলব্ধি করতে পারে৷ আর পারে তার খুব কাছের মানুষ। রমিছা তার পরিবারকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় রেখে নিজে পেট পুরে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারবে না। সংসার তার পক্ষে আর করা সম্ভব নয়।

গুলজান বানু হতাশ হয়ে মনিরের কাছে ফিরে আসেন। তার শুকনো চেহারাই বলে দিচ্ছে উত্তর সন্তোষজনক নয়। মনির বুঝতে পারে রমিছার এই না করার কারণ৷

মাথাটা নিচু করে সে গুলজান বানুকে বলল, “আম্মা, আমি রমিছারে নিয়া সংসার করতে চাই। সেই সংসার যদি এইহানেও হয় তাইলেও আমি করতে রাজি। আমি এইহানে আমু-যামু। আমি বুঝবার পারছি রমিছা আপনেগো থুইয়া এইহান থেইক্যা যাইবো না। কিন্তু যদি সে যাইবার চায় আম্মা আমি আপনেরে কথা দিতাছি তার মাইনষের বাড়িতে কাম করতে হইবো না। আমি তারে সেলাই মেশিন কিইন্যা দিমু। প্রতি হপ্তায় আইসা বাজার কইরা দিয়া যামু আপনেগো। তারে ভাবতে কইয়েন আম্মা। সে যদি আমার লগে যায় তাইলে একডা খবর দিয়া জানাই দিয়েন। আমি আইসা নিয়া যামু তারে। আর যদি সে না যায় তাইলে,

মনির কিছুটা থমকে আবার বলল, “তাইলে, আমি এইহানে আসুম। এক্কেবারে গেরাম, বাড়ি-ঘর ছাইড়া তো চইলা আসা সম্ভব না কিন্তু পত্যেক হপ্তায় একদিন আসুম।”

রমিছা পাশের ঘর থেকে সব কথা শুনছে। নিঃশব্দে কাঁদছে সে। এই কান্নার নিজস্ব কোনো আওয়াজ নেই। অশ্রু নিশ্চুপে গাল পার করে। শব্দ হয় তো শুধুই নাক টানার। ব্যথা যদিও রমিছার বুকে করছে। এত ভালো একটা মানুষকে ছেড়ে আসার ব্যথা।

মনির হাসিমুখে বাড়ি ফিরছে। রমিছা সেলাই শিখার পড়েই বাড়ি ফিরবে। গুলজান বানু কথা দিয়েছেন তাকে। রমিছা হ্যাঁ বা না কোনো কিছুই বলেনি। এতেই বোঝা গেল যে তার কোনো অমত নেই। রমিছার মনে হচ্ছে এইবারও সে স্বার্থপরের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। পরিবারের সুখ আর নিজের শান্তির আশ্রয়ের জন্য স্বার্থপর হচ্ছে সে। প্রতিটি মানুষের করা প্রতিটা কাজেই স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। সব স্বার্থ অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা বা অন্যকিছুর হয় না। কিছু স্বার্থ হয় শারিরীক তৃষ্ণা মেটানোর আবার কিছু স্বার্থ মানসিক প্রশান্তিরও হয়। এখানে মনিরও স্বার্থপর, তার স্বার্থ মানসিক প্রশান্তি।

চেয়ারম্যান বাচ্চার কবরের পাশে বসে আছেন। প্রতি শুক্রবার এসে জিয়ারত করে ঘন্টাখানেক পাশে চুপচাপ বসে থাকেন তিনি। এখানে বসলে যেন ছেলের শরীরের ঘ্রান পান। হালেমা দূরে দাঁড়িয়ে সদ্য কবরটা দেখছে। ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে সে। এখন মনে হয় এসব তার পাপেরই ফল। একজন মায়ের কাছ থেকে সে ছেলে কেড়ে নিয়েছিল আজ তার কলিজার টুকরোকে উপরওয়ালা কেড়ে নিলেন। মাসুমের ছোট্ট বোনটা মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বড্ড একা হয়ে গেছে সেও। খেলার জন্য কতবার ভাইকে খুঁজে কিন্তু পায় না। ভাই তার আকাশের তারা হয়ে গিয়েছে। তপ্ত দুপুরের রোদ মাথার উপর খেলা করছে। ঘাম ঝরছে শরীর বেয়ে। গরমে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। হালেমা মেয়ের হাত ধরে চোখের জল মুছে বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছে। হাশিম চেয়ারম্যানও উঠে দাঁড়িয়েছেন। যারা পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় কেউ তাদের ধরে রেখে বাঁচা ভুলে যায় না। একটা সময় জীবিত মানুষগুলো তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকেও ভুলে যায় কারণ সে মৃত। কোনো অবসরে কেবল তাদের স্মৃতিরা সাথে থাকে।

১৬.

ওই তো আবারও সেই অদৃশ্য আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে তারা মিয়া। এই আওয়াজ তাকে কিছু একটা বলছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে তা শুনতে চেষ্টা করছে। “শা, শা” বাতাসের সাথে আওয়াজটা ভেসে আসছে।

“নূররে লাগবো না, এগুলো তোর সম্পদ। তুই আইসা নিয়া যা। পুকুরের ওপারে ডান দিকটায় নামলেই সিন্দুকটা পেয়ে যাবি। তুই শুধু আইসা নিয়া যা।”

বারকয়েক এই আওয়াজ আসে। ঝুপঝাপ শব্দে আওয়াজটা আবারো বাতাসের সাথে মিলিয়ে যায়। তারা মিয়া চৌকি ছেড়ে উঠে বসে। দ্রুত নিশ্বাস নিচ্ছে। সে আবারও স্বপ্ন দেখছিল। সেই ভয়ানক স্বপ্ন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো এবারের স্বপ্নে অদৃশ্য শক্তিটা নূরকে কেন চাইল না! শুধু সিন্দুকটাকে নিয়ে আসতে বলল কেন? নূরকে কী এখন আর আসলেই চায় না?

পরপর কয়েকদিন তারা মিয়া সেই একই স্বপ্ন দেখল। আগের দেখা স্বপ্নে নূরকে চাইতো আর এখন শুধু সিন্দুকটা নিয়ে আসতে বলে। স্বপ্নের মাঝেও সিন্দুকটা জ্বলজ্বল করছিল। কতশত ধনরত্নে ভরপুর। এই সিন্দুকটা যদি সত্যি সত্যি তারা মিয়া পেয়ে যায় তাহলে তো তার আর কোনো অভাব থাকবে না। সংসারে লেগে থাকবে না কোনো টানাপোড়ন। নূরকে বড় হয়ে তার মতো অন্যের কাজ করতে হবে না। বড় স্কুলে লেখাপড়া করাতে পারবে।

তারা মিয়া কাজে যায় ঠিকই কিন্তু তার ধ্যান থাকে না। সেদিনের পর থেকে আর মাছ ধরতে যায়নি। ছোটখাটো যাই কাজ পায় তাই করে। অনেক টাকা ঋণও করে ফেলেছে৷ এসব ঋণ কীভাবে শোধ করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। প্রতিদিন শহীদ মহাজনের দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়া-আসার সময় লুকিয়ে যায় আসে। মহাজন দেখলেই তাকে টাকার জন্য কথা শুনায়। মহাজনের সামনে পড়ে না তারা মিয়া। দেখলেই টাকা চায়। কাজ না থাকায় এই পর্যন্ত অনেক টাকা ধার করেছে মহাজনের থেকে। আজকে বাজারে যেতেই মহাজনের সামনে পড়ে যায় তারা মিয়া৷ মহাজন চোখের চশমাটা নাকের ডগায় রেখে তারা মিয়াকে দোকানে আসতে বলল৷

“চোখ-মুখ এমন বানাই রাখছো ক্যান মিয়া? টেকা নেয়ার সময় তো মিয়া পত্যেকদিন তিনবার আইতা আমার দোকানে। আর এহন তো দেহাই যায় না। টেকা দিতে পারতেছো না এর লাইগা আহো না?” মুখের ভেতর পান গুঁজে বলল মহাজন।
.
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

❝পদ্মপুকুর❞
পর্ব: ১৬

তারা মিয়া মাথা নিচু করে বসে আছে। মলিন কাপড় আর ক্ষুধার্ত চেহারাটা যেন কষ্টের কাহিনী বয়ান করছে। দোকানের কর্মচারী ছেলেটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। পাশে বসেই ধীরে ধীরে আধশোয়া মহাজনের পা টিপছে। মহাজন আরেকটা পানের খিলি মুখে পুরে নিয়ে তারা মিয়ার দিকে একটা পান আগাই দেয়। নাম শহীদ হলেও মহাজন মরে শহীদ হবে না। মানুষের শরীর থেকে রক্ত কীভাবে আলাদা করতে হয় তা কেবল শহীদ মহাজনই ভালো জানে৷ টাকা দেয়ার সময় ঠিকই দেবে আবার উশুল করার সময় একদম নাড়িভুঁড়ি টেনে বের করবে। গ্রামের প্রত্যেক মানুষ তার সম্পর্কে জানে। মেয়ে মানুষ দেখলে তো আর কথাই নেই। একদম হাত চলে সেদিকে। টাকা দেওয়ার কথা বলে শরীরের এখানে ওখানে হাত দেবে। কতজন মহিলাকে টাকা দিতে না পারার জন্য নষ্ট করেছে সে হিসেব নেই। আর ঘরের লক্ষ্মীরা সংসার বাঁচাতে চুপচাপ বলি হয়।

বাঁকা দৃষ্টিতে তারা মিয়ার দিকে তাকিয়ে শহীদ মহাজন বলল, “কী মিয়া? কতা কও না ক্যান? টেকা কবে দিবা?”

“মহাজন চাচা, কাম-কাজ না থাকলে টেকা আইবো কেমনে? একটা লম্বা কাম পাইয়া লই সবার আগে তোমার টেকা দিমু।”

“টেকা দিতে না পারলে কী হইবো জানো তো?”

তারা মিয়ার কানের কাছে মুখ এনে মহাজনে ফিসফিস করে বলল, “বউডারে কিন্তু এক রাইতের লাইগা দিয়া যাওন লাগবো।”

সামনে থেকে পানের খিলির বাক্সটা ফেলে দিয়ে মহাজনের গলা চেপে ধরে তারা মিয়া। তার বউ সম্পর্কে এমন কথা সে কখনোই মেনে নিবে না। মহাজনের দম বন্ধ হয়ে আসছে। মুখ থেকে জিভ বেরিয়ে গেছে। তারা মিয়ার চোখ লাল হয়ে এসেছে।

“জবান টাইনা ছিঁইড়া ফালামু মহাজন। জবান সামলাইয়া কতা কইতি। সবার মতো কী আমারেও পাইছত?”

দোকানের কর্মচারীসহ আশেপাশের মানুষ দৌড়ে এসে তাকে ধরে আটকায়। শহীদ মহাজন গলা ধরে খুক খুক কাশতে লাগে। আর কিছুক্ষণ এভাবে ধরে রাখলে জান বেরিয়ে যেত। সবাই তারা মিয়াকে ধরে রেখেছে। শহীদ মহাজন উঠেই তার গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয়।

শার্টের কলার ধরে টেনে বলল, “শালা! তুই তো আমার বিলাই। আমার খাইয়া, আমার পইরা, আমারেই কছ মিউ?”

“মহাজন যা টেকা দিছ তার সুদও নিতাছো মাগনা দিতাছো না। জবান সামলাই কতা কও। ছাড়ো আমারে৷ অপরাধ করছে ওই মহাজন। আমার বউ তুইল্যা খারাপ কতা কইছে। আর তোমরা সবাই আমারেই ধইরা রাখছো। ছাড়ো কইতাছি।” তারা মিয়া বেশ চিৎকার করে বলল।

সবাই তাকে ছেড়ে দেয়। মহাজন যে খারাপ তা সকলেই জানে। সবার দৃষ্টি এখন মহাজনের দিকে।

মহাজন আমতা আমতা করে বলল, “এই হপ্তায় ভালা মতন আমার সব টেকা সুদে-আসলে দিয়া দিবি। নাইলে তোর ওই জমিডা আমার নামে লেইখ্যা দিবি।”

তারা মিয়ার গলার পানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। দোকান থেকে বের হয়ে হনহনিয়ে বাড়িতে চলে আসে। যেভাবেই হোক কাজের সন্ধান করতে হবে। টাকা শোধ করতে না পারলে ওই একমাত্র সম্পদ জমিটা হারাতে হবে তাকে। হয় টাকা দিতে হবে নয়তো কবে এসে চাষের জমিটা দখল করে নিবে। অনেক রাত জেগে চিন্তা ভাবনা করে তারা মিয়া। তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। এর আগে মনিরের সাথে একবার দেখা করতে হবে। সব কথা বলে গুছিয়ে নিতে হবে। ওই এক টুকরো জমি সে হারাতে পারবে না।

১৭.

আজ বাজার থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে তারা মিয়ার। অবশ্য সে একা না সাথে মনিরও আছে। দুইজন গল্পগুজব করতে করতে বাড়িতে ফিরছে। তাদের গল্পে রাস্তা দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। অথচ একা হাঁটলে মনে হয় যেন রাস্তা শেষ হতেই চায় না। মাঝপথে আসতেই পদ্মপুকুরের দিকে চোখ যায় তারা মিয়ার। সেদিনও সে এই পুকুরে মাছ ধরেছে অথচ আজ কয়দিন ধরে আর পদ্মপুকুরে মাছ ধরতে যাওয়া হয়ে উঠে না তার। ছেলে হারানোর ভয়টা প্রবলভাবে জেঁকে বসেছে তাকে। হঠাৎ করেই ঝোপ থেকে হেলাল দৌড়ে বেরিয়ে আসে। হাঁটুর উপর দু’হাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না।

তারা মিয়া উৎকণ্ঠিত গলায় হেলালকে জিজ্ঞেস করল, “ কী হইছে রে হেলাল? এইভাবে হাঁপাইতেছস ক্যান? কিছু দেখছত? কোনো জানোয়ার আছেনি?”

হেলাল কিছুটা শান্ত হয়ে বলল, “ভাইজান আমি বাজার থেইক্যা ফিরতেছিলাম তখন দেখলাম কারা যেন শ্মশান পার হইয়া জঙ্গলের ভিতরে যাইতেছে। আমিও তাগো পেছনে গেছিলাম গিয়া যা দেখলাম তা দেইখাই আমি দৌড়াই পলাই আসছি।”

মনির হেলালকে ধরে জিজ্ঞেস করল, “কী দেখছত রে তুই?”

হেলাল কোনো কিছু না বলে হাঁপাতে হাঁপাতে ওইদিকে ইশারা করে দেখায়। তারা মিয়া থমকে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকায়।

মনির অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হইছে ভাইজান?”

সে কোনো কথা না বলে ইশারা দেয় তাদের চুপ করার জন্য। পদ্মপুকুরের ওপারে শ্মশানে মানুষের কথার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। কেউ তো আজ মারা যায়নি। আর মারা গেলেও এই মধ্যরাতে কে আসবে শ্মশানে! তারা মিয়া বরাবরই অনেক সাহসী। হাতের হারিকেনের আলো বাড়িয়ে শ্মশানের দিকে এগিয়ে যায়। মনির আর হেলালও তার পেছনে যাচ্ছে। গাছের আড়াল থেকে দেখল একটা গাড়িতে গাছ তোলা হচ্ছে। শ্মশানের পেছনে যে জঙ্গল আছে সেখানেরই গাছ হবে। কিন্তু এসব তো সরকারের জিনিস। না বলে এই রাতের বেলায় গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে কেন! নিশ্চয়ই চুরি করছে। তারা মিয়া মনিরকে ইশারা দিয়ে বলল দ্রুত পুলিশকে ডেকে আনতে। সে সোজা থানার দিকে দৌড়াতে শুরু করে। এখান থেকে কাছেই থানা। পুলিশকে খবর দিয়ে সাথে করেই ফিরে আসে। পুলিশ ভ্যানের শব্দ শুনেই যারা গাড়িতে গাছ তুলছিল সেখানেই ফেলে এদিক-সেদিক দৌড়াতে শুরু করে। কিন্তু বেশিদূর পালাতে পারে না। পুলিশ কয়েকজনকে ধরে ফেলে। গাড়িসহ তাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

সকাল বেলা মনির, হেলাল আর তারা মিয়াকে থানায় ডাকা হয়েছে। সাথে ডাকা হয়েছে চেয়ারম্যানকেও। ছেলের মৃত্যু হয়েছে মাত্র। এক কেইস বন্ধ হয়নি অথচ নতুন আরেক কেইস এসে পড়েছে। যাদের গতকাল রাতে ধরা হয়েছে তারা জবানবন্দি দিয়েছে। পদ্মপুকুরের আড়ালে কেউ একজন তার অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল দিনের পর দিন। পুকুরে দেও আছে বলে গুজব ছড়িয়ে দিয়েছিল যাতে রাতের বেলা ওইদিকে কেউ না যায়৷ কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি যে সত্য চাপা থাকে না। সে তার সামনে আসার পথ নিজেই বানিয়ে নেয়। আর এই সবকিছুর পেছনে ছিলেন হাশিম চেয়ারম্যান। এসব শুনে সবাই অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছে। ভাবতেও পারেনি চেয়ারম্যানের মতো লোক এসব কাজে জড়িত থাকতে পারে। তাদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ছেড়ে দেয় পুলিশ। বাইরে এসে তারা মিয়া খুব ভাবছে। তার মাথায় একটা জিনিস বেশ খটকা লাগলো। চেয়ারম্যান পদ্মপুকুরের আড়ালে তার অনৈতিক কাজ চালিয়েছে সে না হয় সত্যি কিন্তু সেখানে যে দেও নেই সেই কথাটা আসলে কতটুকু সত্যি!

তবে এই কেইসটা বেশিদিন চলবে না। কারণ চেয়ারম্যানের টাকা আছে সে টাকা দিয়েই ধামাচাপা দিয়ে দিবে। আর হলোও তাই। কোনো কেইস ফাইল হয়নি। দুইদিন পর যে যার মতো চলতে শুরু করল। চেয়ারম্যানকে যারা পছন্দ করত তারাও এখন বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করেছে। কিন্তু কারো মুখ ফুটে বলার সাহস নেই। কারণ এলাকায় একমাত্র তার ক্ষমতা চলে।

১৮.

তারা মিয়া কয়দিন ধরে অনেক ভেবেছে। পদ্মপুকুরে কী আসলেই দেও আছে নাকি নেই সেটা সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। মনের মধ্যে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব খেলা করছে। মহাজন নামের তলোয়ার গলার সামনে ঝুলছে। এই সপ্তাহে টাকা দিতে না পারলে রাবিয়াকে সে কী জবাব দেবে? নাহ এমন কোনো কিছুই সে হতে দিবে না। সন্ধ্যার পর মনিরের সাথে সব আলাপ শেষ করে নেয়। রাত দুইটার দিকে বের হবে তারা মিয়া। মনির তার সাথেই থাকবে। পদ্মপুকুরের সেই ধনরত্ন আনতে যাবে। যদি সত্যিই ধনরত্ন থাকে তাহলে তার অভাব দূর করার একমাত্র মাধ্যম এই ধনরত্ন। একা এতবড় সিন্দুক নিয়ে ফেরা সম্ভব নয়। সিন্দুকটা মনিরের ঘরে রাখবে বলে ঠিক করে নেয়।

তারা মিয়া বাড়ি ফিরে এসেছে। নূরকে নিয়ে পড়তে বসায়। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বরবর্ণ লিখাচ্ছে তাকে। চটপট সব বর্ণ লিখে নেয়, হাতের লেখাও দারুণ। ছেলেকে নিয়ে তার কতশত স্বপ্ন। অনেক দূর পড়িয়ে মাস্টার বানাতে চায়। একদম হাজিপুর স্কুলের মাস্টার সাহেবের মত।

রাত দুইটা বাজে চৌকি ছেড়ে উঠে তারা মিয়া। সারারাত জেগেছিল। ঘুমালে হয়তো আজকের রাত পার হয়ে যাবে সেই ভয়ে। তারা মিয়া উঠতেই রাবিয়া জেগে যায়।

চোখ কচলে জিজ্ঞেস করল, “আপনে আবার কই যাইতাছেন?”

তারা মিয়া কোনো জবাব দেয় না। ফতোয়া পরতে লেগে যায়।

রাবিয়া আবার বলল, “আপনে আবার মাছ ধরতে শুরু করতাছেন না? দেহেন আমার পোলাডার যদি কিছু হইবো তাইলে কিন্তু আমি আপনেরে ছাড়ুম না।”

রাবিয়ার কথার তোয়াক্কা না করে তারা মিয়া বের হয়ে যায়। জাল আর মাছের ঝুড়ি সাথে নিতে চায়নি কিন্তু রাবিয়া সন্দেহ করবে বলে সাথে নেয়। মনিরের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিতেই মনির বেরিয়ে আসে। সে যেন অপেক্ষায় ছিল কখন তারা মিয়া এসে তাকে ডাকবে। মনিরের ঠোঁটে, মুখে হাসির সাথে প্রচণ্ড ভয় মিশে আছে। জীবনের প্রথম কোনো খনির সন্ধান পেয়েছে। এতে তারও স্বার্থ লুকিয়ে আছে। যদি ধনরত্ন পেয়ে যায় তাহলে সে রমিছাকে সেলাই মেশিন কিনে দিবে। সংসারটা আবার শুরু করবে সুন্দরভাবে। কিন্তু ভয় হচ্ছে, না জানি কী আছে কপালে! আল্লাহর নাম নিয়ে দু’জন বেরিয়ে পড়ে, গন্তব্য পদ্মপুকুর।
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here