#পদ্মফুল
#পর্ব_১
#নাজমুন_বৃষ্টি
-‘আমি ডিভোর্স চাই পদ্ম।’
স্বামীর এই একটা কথায় যেন পদ্ম থমকে গেল। এইতো মাত্রই তো ভীষণ খুশি হয়ে এসেছিলো রাহানের সাথে গল্পঃ করবে বলে! কিন্তু এটা কী বললো সে! পদ্ম হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলো। তার স্বামী রাহানের এই একটা বাজে অভ্যাস আছে। যখন তখন সিরিয়াস কথা নিয়ে মজা করবে। তারপর কিছুক্ষন পর এসে পদ্মর সামনে কানে ধরে বাচ্চামো-ধরণের মুখ করে কাঁদো কাঁদো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। যতক্ষণ না পদ্মর রাগ কমে যাচ্ছে ততক্ষন ঐভাবেই দাঁড়িয়ে রইবে। পদ্ম তার স্বামীর এমন কার্য-কলাপ দেখে আর রাগ করে থাকতে পারে না। ভেতরে ভেতরে যতই বলুক, আজ আর রাহানের সাথে আর কথা বলবে না কিন্তু ঠিকই রাহানের কাজ দেখে হেসে ফেলে। মুখটাকে বেশিক্ষন গম্ভীর ভাবে রাখতে পারে না। আর রাহান তার প্রিয়তমার হাসি দেখে সুযোগ বুঝেই প্রিয়তমাকে এসে জড়িয়ে ধরে ফেলে। এতে পদ্মর রাগ মুহূর্তের মধ্যে উবে যায়।
পদ্ম হেসে হেসে রাহানের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
-‘তোমার মজা করার স্বভাবটা আর গেল না!’
পদ্ম উত্তর শুনে রাহান আবারও বলে উঠল,
-‘আমি মজা করছি না।’
-‘তুমি তো প্রত্যেকবারই মজা করার পরও বলো, তুমি মজা করছো না। একদম সিরিয়াস মুখ করে। আজকে কিন্তু কিছুক্ষন পরে এসে কানে ধরে দুনিয়া উল্টাই ফেললেও আমি ক্ষমা করবো না, বলে দিলাম।’
-‘সবসময় তোমার এই বেশি বাড়াবাড়ি আমাকে বিরক্ত করে। আমাদের মনের মিল হচ্ছে না। ঠিকমত বুঝা-পারা হচ্ছে না। এভাবে সংসার করা যায় না। সংসার করতে হলে ঠিকমতো বুঝা-পারার দরকার আছে। সারাদিন অফিস করে এসে তোমার এই নেক্যামো কথা-বার্তা গুলো আমাকে বিরক্ত করে তুলে। আগের কথাগুলো নিয়ে এখনো পড়ে আছো। সেই অনেক আগে আমি তোমার সাথে মজা করতাম কিন্তু ইদানিং আর দেখেছো? কোথ থেকে বলো! এমন আজে-বাজে কথা। আমি আর পারছি না। তাই আমি নিজেকে মুক্তি দিতে চাচ্ছি নিহিলা আর সাথে তোমাকেও।’
ধমকে কথাগুলো বলে রাহান বেরিয়ে যেতে নিতেই দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পেছনে না তাকিয়েই বলে উঠল,
-‘ডিভোর্স লেটার খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবে। ততদিন চাইলে, এখানেও থাকতে পারো আর নয়তো তোমার বাসায় চলে যেতে পারো।’ বলেই হনহন পায়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল রাহান।
রাহান পেছনে তাকালে হয়ত দেখতে পেতো, একজন কঠোর মানবিনীর সিক্ত আঁখিজোড়া। যে মানবিনীর আঁখিতে এই তিনবছর কোনো অশ্রু ছিল না। হয়ত এমন চোখ দেখে রাহানের হৃদয়ও কেঁপে উঠতো কিন্তু হায় আফসোস! রাহান আজ দেখলো না।
পদ্মর এতো কিছুর পরেও তার ইচ্ছে করছিলো মানুষটাকে পেছন থেকে ডেকে বলতে,
‘শোনো তোমার পছন্দের রান্না করেছি আজ। আমি নিয়ে আসি। যাওয়ার আগে খেয়ে যাও।’
কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারলো না। কোথায় যেন একটা বাধা কাজ করছে। কী জানি! হয়ত আজ রাহান এই কথাগুলো বলার পর বাস্তবতা উপলব্ধিতে এসেছে।
————-
রাত বাড়ছে কিন্তু রাহানের কোনো খবর নেই। পদ্ম চুপচাপ টেবিল ক্লিন করে ঘর ঝাড়ু দিয়ে দিল। এই সংসারটা না-কি আর তার থাকবে না! হয়ত অন্য কোনো নারীর সংসার হবে। এটা ভাবতে গেলেই কোথাও যেন কিছু আটকে আছে মনে হচ্ছে।
নিহিলা তার মলিন হাত দিয়ে সংসারের সব জিনিসগুলো আলতো হাতে ছুঁয়ে দিল। মনে হচ্ছে যেন আজ সবকিছুতে মায়া জন্মে আছে।
ভেতর রুম থেকে শাশুড়ির আওয়াজ আসছে।
পদ্ম দ্রুত পানির জগ ভর্তি করে টেবিলে রেখে রান্নাঘরে যেতে যেতে ‘আসছি মা’ বলে শাশুড়ি মায়ের প্রতিত্তর করলো।
সে দেয়ালে থাকা ঘড়িটার দিকে এক নজর চোখ বুলালো। ‘সাড়ে আটটা’ বাজতে চলল কিন্তু ওই মানুষটার আসার কোনো নাম-গন্ধ নেই। পদ্ম শান্ত-দৃষ্টিতে মেইন দরজার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে মলিন শ্বাস ফেলল।
এরপর খাবারের প্লেট নিয়ে শাশুড়ি মায়ের রুমের দিকে অগ্রসর হলো।
-‘মা? আপনার খাবার এনেছি। খেয়ে নিন।’
রাহানের মা ওই পাশ ফিরে শুয়ে ছিল। পদ্মর কণ্ঠস্বর শুনে শোয়া থেকে পাশ ফিরে উঠে বসল।
পদ্ম খাবারের প্লেটটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে শাশুড়ি মাকে ধরে খাটে বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে উঠিয়ে বসালো।
এরপর খাবারের প্লেটটা শাশুড়ির দিকে এগিয়ে ধরলো। তিনি হাত থেকে প্লেট নিতে নিতে পদ্মর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
-‘তুমি খাইবা না? নেও, মায়ের থেইকা একসাথে খাইয়া নাও।’
-‘আমি পরে খেয়ে নিব মা। আপনি খেয়ে নিন। আপনার ওষুধ আছে। খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে।’
পদ্ম এটা বলেই মাথা নিচু করে প্লেটে চোখ দিতেই হেঁচকির আওয়াজে চমকে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল।
শাশুড়ি- মা কাঁদছে কিন্তু কেন!
পদ্ম বিস্মিত নয়নে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। তার এখনো বোধগম্য হলো না যে কেন কাঁদছেন তিনি। কিছু বুঝে উঠে আসতেই সে বসা থেকে উঠে শাশুড়ি মায়ের হাতে-পিঠে মালিশ করতে লেগে গেল।
-‘মা, আপনি কাঁদছেন! কী হয়ছে! কোথায় ব্যথা হচ্ছে, বলুন।’ বলতে বলতে পদ্ম অস্তিরচিত্তে শাশুড়ির হাতে-পিঠে দেখতে লাগল। তার বিয়ের এতো বছরের জীবনে এই মানুষটার চোখে ভুল-ক্রমেও কোনো পানি দেখেনি কিন্তু আজ কী হলো! উনার টান বেড়ে যায় নি তো!
পদ্মর এমন অস্তিরতার আওয়াজে বুলি দৌড়ে এলো। বুলি হলো এই বাড়িতে থাকে। ছোটবেলায় ওর মা এই বাড়িতে কাজ করতো। বুলি মায়ের সাথে চলে এসে মায়ের কাজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেক কাজ শিখে গিয়েছিল। মা মারা যাওয়ার পর থেকে রাহানের মা বুলিকে একেবারের জন্য রেখে দিয়েছে। সেই থেকে বুলির একমাত্র আস্তানা এই বাড়ি। হাতে হাতে বিভিন্ন কাজ করে।
বুলিও এসে অবাক হয়ে তার রহিমা বানুর দিকে তাকিয়ে আছে।
রহিমা বানু পদ্মর এমন অস্তিরতা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে মায়া-বরা কণ্ঠে বলে উঠলো,
-‘এতো মায়া কেন করছিস মা! ঠিকই তো দুইদিন পর ছেড়ে যাবি। আমার পোলাটা হিরে চিনতে ভুল করেছে।’
পদ্ম শাশুড়ি মায়ের মুখপানে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যায় রাহানের কথাগুলো শুনে তার ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু উপরে উপরে শক্ত থেকে নিজেকে যথা-সম্ভব স্বাভাবিক রেখেছিল শাশুড়ি-মায়ের জন্য। শাশুড়ি মা এমনি নরম মনের, তার উপর ছেলের এসব শুনলে হয়ত মনে মনে অনেক ভেঙে পড়বেন তাই এসবকিছু শাশুড়ি থেকে লুকিয়ে স্বাভাবিক রইল। ভেবেছিল, কাল বাপের বাড়ি চলে যাবে কাউকে না জানিয়ে। এতে অন্তত তিনি ছেলেকে ভুল বুঝবেন না। পদ্ম সবকিছুর পরেও চায়, রাহান যেন সে যাওয়ার পরেও ভালো থাকে। অন্তত যেন মাকে নিয়ে ভালো থাকে।
-‘আজ সন্ধ্যায় রাহানের লগে কথা বলতে ওই রুমে গিয়ে ওর সব কথা হুনছি। আমার ভাবতে কষ্ট লাগতাছে যে এমন পোলা আমি নিজের গর্ভে নিছিলাম। ওরে আমি মানুষ করতে পারি নাই রে মা। ভেবেছিলাম, তুই আসার পর একটা মেয়ের শখ পূরণ হয়ছিল কিন্তু এটার শেষ পরিণতি এমন হবে ভাবিনি রে মা।’
পদ্মর ভেতর ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিন্তু সে মোটেও শাশুড়ির সামনে চোখের পানি দেখাতে চায় না। এরকম হলে তিনি তার ছেলেকে ভর করবেন। এটা পদ্ম চায় না। সে স্বাভাবিক নরম কণ্ঠে বলে উঠল,
-‘এমন ভাবে বলিয়েন না আম্মা। আপনার ছেলে আগে আগে বলে দিয়ে ভালোই করেছে। হয়ত ওর মনে আর আমি নেই। আমি আপনার মেয়ে হিসেবে সারাজীবন কাছে থাকতে পারি নি তো কী হয়েছে। আমি যাওয়ার পর আপনার ছেলে হয়ত আরেকটা মেয়ে আনবে। তাকে সারাজীবনের জন্য কাছে টেনে নিয়েন, যেরকম আমাকে নিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, আপনার ছেলে মেয়ে চিনতে ভুল করবেন না।’
-‘আমার ছেলে লাইগবো না। আমার মেয়ে লাইগবো। আর সেই মেয়ে হচ্ছিস তুই। তরেই মেয়ে হিসেবে লাইগবো আমার। তুই আমারে ছাইড়া যাইস না, আমার মেয়ে হিসেবেই থাক আর নয়তো আমারেই নিয়ে যা তোর লগে। এমন পোলার লগে থাকা লাইগবো না আমার।’ বলতে বলতেই রহিমা বানু পদ্মকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন।
-‘আমার জন্য ওকে আপনি ভর করিয়েন না। সহ্য করতে পারবে না। জানেনই তো, ও অনেক নরম মনের মানুষ। ও আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, মা।’ বলতেই বলতেই কান্নারা যেন দলা ফেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। কান্না লুকাতে বৃথা চেষ্টা চালিয়ে শাশুরিকে শুয়ে পড়তে বলে বেরিয়ে আসতে নিতেই দরজার কাছে বুলিকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল।
বুলি চোখ-মুখ ফুলে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝাই যাচ্ছে, ওদের কথা শুনে কেঁদে-কেটে অবস্থা এককার। মেয়েটার মন অনেক নরম।
পদ্ম তার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো। বুলির মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিল।
-‘আম্মার আর উনার খেয়াল রাখিস। নিজেরও যত্ন নিস্।’
বলেই রুম থেকে প্রস্থান করলো। পেছন থেকে রহিমা বানু এক নাগাড়ে ডেকে চলেছে কিন্তু পদ্ম সাড়া দিল না কারণ এই মুহূর্তে সাড়া দিলে শাশুড়ি তার চোখ-ভর্তি পানি দেখে ফেলবে। এতে তিনি ছেলের সাথে রাগ করে আর কথা বলবে না কিন্তু পদ্ম এটা চায় না। সে চাই, তার অনুপস্থিতিতে সব যেন আগের মতোই থাকে। তার প্রিয় মানুষটা যেন খুশি থাকে।
চলবে