পরী পর্বঃ১০ম (শেষ পর্ব)
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা
.
সন্ধ্যা বেলা চা নাস্তা খেয়ে প্রত্যাশা বিছানায় বসে ছোট বাচ্চাদের কিছু ছবি দেখছিলো। কতো গুলো কিউট বেবি । দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। মায়া জন্মে। হঠাৎ করেই জানালার পাল্লা দুটো বারি খাওয়ার শব্দ শোনা যেতেই প্রত্যাশা সেদিকে তাকায়। বাহিরে প্রচুর বাতাস উঠেছে। আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। আজ বড় ধরনের ঝড় আসবে বোধহয়। বাড়ির সকলে বাহিরে থাকা জিনিসপত্র গুলো ওঠানোর জন্য ছুটোছুটি করতে ব্যস্ত। ধুলোবালি উড়ছে। জানালা দিয়ে সেগুলো বাতাসের সাথে রুমের ভিতরে এসে পরছে। প্রত্যাশা সেদিকে তাকিয়ে দ্রুত বিছানা থেকে উঠে এগিয়ে যেতেই বিদুৎ চলে গিয়ে পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল। আর তাড়াহুড়ো করে আসায় পা স্লিপ করে পরে যেতে ধরলো। তখনই হঠাৎ করে গরম কিছু প্রত্যাশার গায়ের সাথে এসে লাগে। মনে হলো কেউ তাকে আটকে ধরেছে। পরে যাওয়া থেকে বেঁচে গেল প্রত্যাশা কিন্তু প্রচন্ড ভয় পেয়ে জোরে একটা চিৎকার দেয়। চিৎকার শুনে সায়েমের মা আর চাচি আলো নিয়ে এই ঘরে ছুটে আসলো। প্রত্যাশা ভয়ের চাপ সামলাতে না পেরে এখনো চিৎকার দিয়েই যাচ্ছে। সায়েমের মা বলে উঠলেন, কি হয়েছে বৌমা ভয় পেয়েছো?
– এই ঘরে কিছু আছে! কিছু আছে!
সায়েমের চাচী আলো নিয়ে চারপাশে দেখতে দেখতে বলতে থাকে, কই কিছু নেই তো!
প্রত্যাশা ভয়ে এখনো হাপাচ্ছে। সায়েমের মা বললেন, ঝড় আসছে। আর হঠাৎ কারেন্ট চলে গেছে তো তাই ভয় পেয়েছো। চলো আমার রুমে চলো এখানে একা থেকে কাজ নেই৷
.
শাশুড়ির ঘরে এসে প্রত্যাশা তখনকার পরে যাওয়ার ঘটনাটা বললো। এটা শুনে উনিও ঘাবড়ে গেলেন।
– এখন একটু দেখে শুনে চলবে তো। বড় বাঁচা বেঁচে গেছো। আজ যদি কোনো অঘটন ঘটে যেতো। ছেলেটাও বাড়ি নেই। কি জবাব দিতাম আমি!
.
ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। বিদুৎ আসার কোনো নাম নেই। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সায়েমের ফোন এলো। সায়েম পৌঁছে ফোন করেছে। তখন সায়েমের মা প্রত্যাশার পরে যাওয়ার ঘটনাটা সায়েমকে বললো। সব শুনে সায়েম তখনই বাড়ি চলে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। প্রত্যাশা সায়েমকে বলে, আহা আমার কিছু হয় নি! আমি ঠিক আছি। শুধু পরে যাবার সময় মনে হলো কিসে যেন আমায় ধরেছিলো।
– কিসে ধরেছিল মানে!
– ওসব কিছু না। তুমি চিন্তা করো না।
– এ্যাই খুব সাবধানে থাকবে কিন্তু বলে দিলাম। আমি না আসা পর্যন্ত বাবুকে দেখে রেখো।
– আচ্ছা। তুমিও সাবধানে থেকো।
.
সায়েমের মা প্রত্যাশার জন্য বিছানা রেডি করছিলেন। তখনই প্রত্যাশা এগিয়ে এসে বলে,
– আপনি শুয়ে পরুন মা। আমি ঘরে যাচ্ছি।
– বৌমা আজ একা না থাকলে হয় না। আবার যদি কোনো ভয় পাও। তুমি বরং এখানেই থাকো। নাহলে চিন্তায় আমার সারারাত ঘুমই হবে না৷
– না মা এখন কোনো সমস্যা নেই। আর ভয় পেলে আমি আপনাদের ডেকে নেব।
.
এখনো হালকা বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে৷ প্রত্যাশা ঘরে এসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। হঠাৎ ফোনের রিংটন বেজে ওঠায় চমকে উঠে ধরফরিয়ে উঠে বসলো। সায়েম ফোন করেছে। হাফ ছেড়ে বেঁচে কলটা রিসিভ করে সায়েমের সাথে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে গেল।
.
পরদিন বিকেলবেলা সায়েম বাড়ি ফিরলো। প্রত্যাশাকে একা রেখে তার মন টিকছিলো না। তাই জরুরি কাজ গুলো সেরেই ফেরার জন্য রওনা হয়ে গেছে। কাল রাতের ঘটনার কোনো ব্যখ্যা খুঁজে পাচ্ছে না সায়েম। প্রত্যাশা অনুভব করেছে কিছু একটা তাকে আটকে ধরেছিল। আর তাতেই সে পরে যাওয়া থেকে বেঁচে যায়৷ কিন্তু কি সেটা? সায়েম ভাবছে এমন কাজ কে করতে পারে,অরি? কিন্তু তাকে তো ওই দিনের পর আর কোথাও দেখতেই পায় নি । নাহ! আর ভাবতে পারছে না। কিসে কি হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। প্রত্যাশাকে খুব সাবধানে রাখতে হবে।
.
সায়েমের চাকুরীটা হয়ে গেছে। অনেক ভালো একটা পোস্টে। গত মাসে জয়েন করার কথা। কিন্তু এখানে প্রত্যাশাকে একা রেখে যাবার কথা কিছুতেই ভাবতে পারছে না সায়েম। তাই শহরেই অফিসের কাছাকাছি একটা ফ্লাট নিয়ে প্রত্যাশাকে সেখানে নিয়ে গেল। বাড়িতে যেন এখন একদমি একা না থাকে সেই জন্য মা বাবা ভাই ভাবিকেও সাথে নিয়ে যায়। সময় পেরিয়ে আস্তে আস্তে প্রত্যাশার এখন ডেলিভারির সময় চলে এসেছে। এক সন্ধ্যায় অসুস্থ হয়ে পরলে সায়েম তাকে হসপিটালে নিয়ে যায়।
.
অপেক্ষা আর চিন্তার মধ্যে দিয়ে দিনটি পার করার পর প্রত্যাশার একটি মেয়ে হলো। হসপিটালে তাকে দেখার জন্য আত্মীয় স্বজনেরা ভিড় জমিয়েছে।বেডের ওপর শুয়ে থেকে সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটি হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে। সায়েম বাবুকে কোলে তুলে নিলো। এক অদ্ভুত মায়া বাবুর মুখে৷ টলটলে চোখ দুটি বাবার দিকে চেয়ে আছে। সায়েম বাবুর গালে চুমু দিলো। বাবু আলতো ভাবে তার হাতটা সায়েমের গালে ছুঁয়ে দেয়। বাবুকে কোলে নিয়ে সায়েম প্রত্যাশার পাশে বসে আবেগে প্রত্যাশাকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে চুমু দিলো। আজ সায়েম অনেক খুশি। নিজেকে একজন পরিপূর্ণ সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে। প্রথমবার বাবুর হাতের ছোঁয়া পেয়ে সায়েম বাবুর নাম রেখেই দিল ছোঁয়া! ছোঁয়া আহমেদ।
.
বাবুর বয়স দুই মাস। এই কয়েকদিনে কোনো অদ্ভুত ঘটনা না ঘটলেও আজ দুপুরে প্রত্যাশা যখন রান্নাঘরে রান্না করছিলো তখন বেডরুমে হঠাৎ কোথা থেকে যেন প্রচুর বাতাস এসে রুমে ঝড় ওঠার মতো হয়ে গেল। রুমের জিনিসপত্র পরে ভাঙতে লাগলো। বাবু ওই রুমে বেডের ওপর শুয়ে ছিল। জিনিসপত্র ভাঙা আর বাবুর কান্নার আওয়াজ পেয়ে প্রত্যাশা রান্নাঘর থেকে ছুটে বেড রুমে চলে আসে। রুমের মধ্য প্রচুর ভাঙচুর আর ঝড় দেখে প্রত্যাশা ভয় পেয়ে শিউরে উঠল। বাবু কাঁদছে। প্রত্যাশা দৌড়ে গিয়ে বাবুকে কোলে তুলে নিয়ে ওখান থেকে বের হয়ে আসে। রুমের মধ্য আপনাআপনি জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি হচ্ছে। শব্দ পেয়ে সায়েমের মা পাশের রুম থেকে দৌড়ে এলেন।
– একি বৌমা! এগুলো কি হচ্ছে!
– জানিনা মা, তাড়াতাড়ি সরে আসুন এখান থেকে।
ভয়ে সবাই জড়সড় হয়ে ড্রইংরুমের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে। সায়েম অফিসে। প্রত্যাশা ফোন করে সায়েমকে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসতে বললো। হুজুর কেও এই বাসার ঠিকানা দিয়ে আসতে বলে।
.
কি হচ্ছে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না৷ কিছুক্ষণ পর পর বাসার ভিতর এখানে সেখানে ভাঙচুর হচ্ছে। অদৃশ্য কোনো কিছুই এসব করছে। ভয় পেয়ে এবার বাসার সবাই বাহিরে এসে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালো। সায়েম চলে এসেছে। আর বাসার ভিতরে পা দিয়ে দেখলো এখন কোনো ভাংচুরের আওয়াজ নেই তবে কেমন যেন থমথমে পরিবেশ।
.
ভয়ে সবাই সায়েমের পিছু পিছু এসে ড্রইংরুমে বসলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর হুজুর সাহেব চলে আসলেন। উনি উনার সঙ্গীকেও সাথে করে এনেছেন। বাসার অবস্থা দেখে উনারা বেডরুমের কাছে চলে গেলেন। রুমটা খুবই গরম হয়ে আছে। বাকিরাও পিছু পিছু আসলো। সায়েম বললো, কিছু কি বুঝতে পারছেন, সে কি আবার এসেছে?
– হুম। এখানে শুধু একজন নয়। অনেকজন রয়েছে।
হুজুরের কথা সবাই ভয়ে শিউরে উঠল। বাবুকে কোলে নিয়ে প্রত্যাশা সায়েমের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
হুজুর সাহেব দোয়া পড়তে শুরু করলেন৷ আর রুমের মধ্য পানি ছেটাতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর অনেকজনের আওয়াজ পাওয়া যায়। হঠাৎ করে অরি ওরফে জ্বীন পরি আলিসাই আলিয়া বলে ওঠে
—-থামাও এসব…. আমি চলে যাচ্ছি। আমার পরিবার আমাকে নিতে এসেছে।
হুজুর সাহেব রেগে বললেন,তুই যে চলে যাবি তার প্রমাণ কি! বার বার এসে ইনসানদের কেন বিরক্ত করছিস! তোকে আজকে বন্দী করার উপায় আমি নিয়ে এসেছি।
—– আমি বিরক্ত করতে চাই নি। শুধু সায়েমের ওই বাচ্চাটার ওপর নজর রেখে ওকে সবসময় সুরক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। কারণ ওই বাচ্চাই আমার সায়েমের হাসির কারণ। বাবা হবে জেনে আনন্দে ভরা সায়েমের হাসি মুখটা যেদিন দেখলাম তখন থেকে ওকে আমি আর বিরক্ত করিনি। শুধু ওর বাচ্চার সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলাম।
.
সায়েম আর প্রত্যাশার ধোয়াশা গুলো এবার পরিষ্কার হয়ে গেল যে সেদিন অরিই প্রত্যাশাকে পরে যাওয়া থেকে বাঁচায়। হুজুর সাহেব আবারও রেগে বলছেন,চুপ! ইনসানদের এভাবে বিরক্তকরার শাস্তি তোকে পেতেই হবে। আজই তোকে বন্দী করবো৷
তখনই অন্য জ্বীনদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠল, —-ওকে ছেড়ে দাও,আমরা ওকে নিতে এসেছি।
আরেকজনও সাথে সাথে বলে উঠল,
—– ও চলে যাবে, আমাদের সাথে চলে যাবে। ওকে ছেড়ে দাও।
এবার অরি বললো,
—– সায়েমকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা আমি ভাবতে পারিনি। ওকে নাইবা পেলাম তবুও তো চোখের দেখা টুকু তো দেখতে পেতাম৷ ওর হাসিমুখটা দেখেই আমার শান্তি ছিল। তাই আমার পরিবার এসে আমাকে যাওয়ার কথা বলাতে প্রথমে রাজি হইনি। কিন্তু এখন আমাকে যেতেই হবে। আমার জন্য আমার পরিবার আর জ্বীনকূলের শান্তি বিনষ্ট হোক আমি তা তাইনা।
.
হুজুর সাহেব বললেন,হুম আর ইনসানের মধ্য থাকলেও তাদের শান্তি বিনষ্ট করলে তারাও তোমাদের ছেড়ে দেবে না। তোমরা তোমাদের যায়গায় চলে যাও।
—–আলিসাই আলিয়া কোনো ওয়াদা করলে সেই ওয়াদা ভঙ্গ করে না। বিদায়… আসলামু আলাইকুম।
.
রুমের মধ্য আবারো বাতাসের প্রভাব বাড়তে থাকে আর আগুনের ফুলকির মত করে সেগুলো জানালা দিয়ে রুমের বাহিরে বের হয়ে যেতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর সব সাভাবিক হয়ে গেল। হুজুর সাহেবও উনার সঙ্গীকে নিয়ে এবার বিদায় নিলেন। এখন নিশ্চিন্ত হলো সবাই। জ্বীন পরী নামক অধ্যায় সায়েমের জীবন থেকে চলে গেছে। প্রত্যাশা সায়েমকে জরিয়ে ধরলো।
.
পরদিন সায়েমের পরিবারের সদস্যরা বাড়ি ফিরে গেলে সায়েম প্রত্যাশা আর বাবুকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে বের হয়। ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যা নামার আগে গোধূলী লগ্নে যখন সূর্য প্রায় অস্ত যাচ্ছে তখন পার্ক থেকে প্রত্যাশাকে নিয়ে চলে আসছিল সায়েম। ছোঁয়া বাবু সায়েমের কোলেই ছিল। ওই সময়ই সাঁই করে একটা বাতাস সায়েমের ডান পাশ দিয়ে চলে গেল। আর বামপাশে ছিল প্রত্যাশা। বাতাসটা যেতে যেতে সায়েমের কানের কাছে ভেসে এলো— আমি চলে যাচ্ছি সায়েম। তোমাকে আমি কোনোদিনো ভূলবো না। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তুমি অনেক ভালো থেকো সুখে থেকো। বিদায় প্রিয়।
.
সায়েম খেয়াল করলো বিদুৎগতিতে দ্রুত বেগে আগুনের গোলার মত কিছু একটা পশ্চিম আকাশের দিকে চলে যাচ্ছে। যেতে যেতে সেটা অনেক দূর গিয়ে গোধূলীর লাল আকাশটার সাথে মিলিয়ে গেল। পাশে থেকে হঠাৎ প্রত্যাশা বলে উঠল, কি গো ওইদিকে তাকিয়ে একমনে কি দেখছো!
প্রত্যাশার কথায় সায়েম হেসে ওর দিকে তাকায়। তারপর বললো, আমাদের বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে।
প্রত্যাশাও হেসে বললো,চলো জান।
সায়েমের জীবনের আসল পরী তো প্রত্যাশা। আর এখন ছোট্ট পরীও এসে গেছে৷ সায়েম বাবুকে কোলে রেখেই অন্য হাত দিয়ে প্রত্যাশার হাতটা ধরে পার্কের রাস্তাটা দিয়ে হেটে যাচ্ছে।
.
<<<সমাপ্ত>>>