পরী পর্বঃ৪র্থ

0
545

পরী পর্বঃ৪র্থ
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা

.
প্রত্যাশা বিছানা থেকে নামলো। কেমন যেন ভয় ভয় করছে। বাতাসে দরজার পর্দাটা উড়ছে। সায়েমের নাম ধরে কয়েকবার ডেকে উঠল প্রত্যাশা। কোনো সাড়াশব্দ নেই। সব কিছু নিরব হয়ে রয়েছে। শুধু বাহিরে থেকে গাছের ডালপালা বারি খাওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে আর শো শো করছে। প্রত্যাশা ভয়ে ভয়ে পাশের দুটো রুমে গিয়ে চেক করলো। ওখানেও সায়েম নেই । বাথরুমেও নেই। তাহলে গেল কোথায়? এবার সিড়ি দিয়ে এক পা এক পা করে নিচে নামছে। ভয়ে গা ছমছম করছে। নিচে এসে শোফায় ওখানে কাউকে বসে থাকতে দেখলো। রুমটা কেমন যেন থমথমে হয়ে আছে। লাইটের হালকা নীল আলোয় দেখা যাচ্ছে সায়েম শোফায় হেলান দিয়ে হাত দুটো শোফার দুই দিকে দিয়ে মাথাটা শোফার সাথে লাগিয়ে দিয়ে রয়েছে। প্রত্যাশা সায়েমকে দেখে আস্তে করে বলে উঠল, সায়েম?
প্রত্যাশার কথায় সায়েম তার ঘারটা এদিকে ফিরালো। সে এখনো শোফায় হেলান দিয়েই রয়েছে। অদ্ভুত ভাবে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সায়েম। প্রত্যাশা বললো, তুমি এখানে কেন? চলো রুমে চলো।
প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে থেকেই সায়েম এবার শোফা থেকে উঠে দাড়ালো। প্রত্যাশার মনে হলো সায়েমের চোখ দুটো লাল হয়ে রয়েছে। সে এগিয়ে গিয়ে সায়েমের হাত ধরে বলতে থাকে, ঘুমাবে চলো। তোমার শরীরটা ভালো নয়। এখানে এসেছো কেন তুমি।
.
প্রত্যাশার কথায় সায়েম যেন রেগে গেল। সে চোখ মুক্ত শক্ত করতে থাকে। প্রত্যাশার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, তোকে না বলেছি আমার সামনে আসবি না। তোকে আমার সহ্য না। যা এখান থেকে। আমায় একা থাকতে দে।
সায়েমের কথায় প্রত্যাশা অবাক হয়ে বলে উঠল, তোমার কি হয়েছে সায়েম। এমন করছো কেন তুমি?
– তুই আমার সামনে আর আসবি না।
– এসব কি বলছো তুমি!
.
রেগে গিয়ে সায়েম শোফার পাশের ফুলদানিটা হাতে নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারলো। ভয় পেয়ে প্রত্যাশা হাত দুটো কানের কাছে ধরে। সায়েম রুমের আরও জিনিসপত্র হাতে নিয়ে ভাঙতে থাকে। ভয়ে চোখ মুখ শুকিয়ে গেল প্রত্যাশার । এতো রাতে সায়েমের কি হলো। সে কেন কোনো কথাই শুনছে না তার। এখন কি করবে সে। কিভাবে থামাবে তাকে। কার কাছে সাহায্য চাইবে। মাথা কাজ করছে না প্রত্যাশার। সায়েম একের পর এক রুমের জিনিসপত্র ভেঙেই যাচ্ছে।
– সায়েম কি হলো তোমার৷ থামো। এসব কি করছো তুমি?
প্রত্যাশার কোনো কথাই সায়েম কানে নিচ্ছে না। সে ভাঙচুর করেই যাচ্ছে। ভয়ে প্রত্যাশা সিড়ি বেয়ে পেছাতে থাকে। সায়েমকে এমনভাবে রাগ করতে আগে কখনো দেখে নি প্রত্যাশা। উপরে রুমে এসে ডাক্তার অলোক কুমারকে ফোন করলো। কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করতেই প্রত্যাশা বলে উঠল, আই এ্যাম সরি ডক্টর অলোক। এতো রাতে আপনাকে বিরক্ত করতে হলো।
– না না সমস্যা নেই। আপনি বলুন।
– আমার হাজবেন্ড কেমন যেন করছে আর বাড়ির সব জিনিসপত্র ভেঙে ফেলছে। আমার কোনো কথাই ও শুনছে না। মনে হচ্ছে সে নিয়ন্ত্রনের বাহিরে চলে গেছে৷ এই মুহুর্তে বাড়িতে তেমন কেউ নেই। আপনি যদি এখন একবার আসতেন।
– ঠিকাছে ভয় পাবেন না। আমি আসছি আর একটা কথা। উনার কি আগে থেকে মাথায় কোনো সমস্যা আছে?
– আমি তো সেরকম কিছু কখনো দেখি নি। আজই দেখছি ও এমন করছে। বিষয়টা কেমন যেন লাগছে।
– ঠিকাছে আমি আসছি।
.
কলিংবেলের আওয়াজে সায়েম থেমে গেল। হাতের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলো তার হাতে দুটো বই। বই দুটো টেবিলের ওপর রেখে বললো,এতো রাতে কে এলো?
তারপর রুমের চারিদিকে তাকিয়ে রুমের অবস্থা দেখে বলে উঠল, হায় হায় এসব আমি কি করেছি।
আবারো কলিংবেল বাজতে থাকে। রুমের লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলে দিলো। ডাক্তার অলোক কুমার সায়েমকে দেখে হেসে বললেন, আপনিই মিস্টার সায়েম আহমেদ। রাইট?
– জি। মানে আপনি এতো রাতে?
– আপনার স্ত্রী ফোন করেছিলেন।
তখনই প্রত্যাশা নিচে চলে এলো। এদিকে এগিয়ে এসে বললো, আপনি এসে গেছেন। এই দেখুন রুমের অবস্থা। একটু আগেই এসব হয়েছে।
ডাক্তার অলোক কুমার আর সায়েম দুইজনই রুমের চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। সায়েম প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মতো বলতে থাকে, আমি এসব কেন….
তখনই ডাক্তার অলোক কুমার বলে উঠল, তো মিস্টার সায়েম। এখন বলুন আপনার কি সমস্যা? আপনি এভাবে ভাঙচুর করছেন কেন।
সায়েম এবার ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি মানে, আমি এসব কেন করছি আমি জানিনা।
– কেন? আসুন আপনাকে একবার চেপআপ করে নেই।
সায়েমকে দেখার পর অলোক কুমার বললেন, সব তো নরমালই আছে। আপনার কি কি সমস্যা হচ্ছে বলুন তো।
– আমি জানিনা। আমার মাথা কাজ করছে না। কি করছি না করছি আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা।
– হুম। অতিরিক্ত কাজের চাপ। বেশি টেনশন করবেন না। রিলেক্স থাকুন।
.
ডাক্তার অলোক কুমার চলে গেলেন। সায়েম প্র‍ত্যাশার দিকে তাকিয়ে বললো, কি হলো কি ভাবছো।
সায়েমের কথায় প্রত্যাশার ভাবনায় ছেদ পরে। সে সায়েমের দিকে তাকিয়ে বলে ফেললো, তুমি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছো সায়েম।
সায়েম হেসে এগিয়ে এসে প্রত্যাশাকে জরিয়ে ধরলো।
– ম্যাডাম আমি ঠিক আছি। এতো রাতে ডাক্তার নিয়ে এসে দেখালেন। ঠিক না হয়ে পারি। এখন চলেন ঘুমাবেন।
.
সকালবেলা নাস্তা সেরে সায়েম অফিসে চলে গেল। প্রত্যাশা রান্নাঘরে কাজ করছে। রেনু বললো, রাত্রির বেলা ভাইজানের কি হইছিল আফা? ভাইজান জিনিস গুলান ভাঙছে ক্যান?
প্রত্যাশা রেনুর দিকে ফিরে বললো, জানিনা রে। কেমন যেন লাগছে ওকে। কি হয়েছে বুঝতে পারছিনা।
– আমিও দেখছি আফা। ভাইজান এহন কেমন যেন অন্যমনস্ক থাহে।
– কি করবো বুঝতে পারছিনা।
– আমার মনে হয় ভাইজানের ওপর জ্বীন ভূতের আসর পরছে।
– কি বলছিস এসব!
– হ আফা। গেরামে এমন দেখছি। সুন্দর পোলাগো দিকে তাগোর নজর লাগে।
– চুপ কর তুই!
.
প্রত্যাশা রুমে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে বান্ধুবি নীরাকে কল করলো।
– হ্যাঁ বল প্রত্যাশা। কেমন আছিস?
– ভালো না রে। সায়েমকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছি।
– কেন? ওর আবার কি হলো!
– জানিনা রে। বুঝতে পারছিনা৷ কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে ও।
– ওহ হো এসব কি বলিস। বাড়িতে তুই একা থাকিস তাই না?
– হ্যাঁ রে। ও ফিরে সেই রাতের বেলা। সারাদিন আমি একাই থাকি।
– এই জন্যই তোর এমন মনে হচ্ছে। সব সময় উলটাপালটা ভাবিস। সময় কাটানোর জন্য তো তোর কিছু করা উচিত। গ্রেজুয়েশান কমপ্লিট করেছিস। এমনিতেই সময় কাটানোর জন্যও তো কোনো জবে ট্রাই মেরে দেখতে পারিস।
– হুম। তা ভালো বলেছিস।
– সেটাই কর। সময় কাটবে। তা প্রত্যাশা বাচ্চা কাচ্চা কবে নিবি?
– ওসব নিয়ে সায়েমের সাথে কথা হয় নি। এখানে আসার আগে বলেছিলো একটু সময় নিয়ে নিজের ক্যারিয়ারটাকে গুছিয়ে নিতে চায়।
– আচ্ছা। তোর বরের চিন্তা ভাবনা তো খুবই ভালো। দেখতে যেমন হ্যান্ডসাম। আবার কাজের বেলাতেও।
– হুম। আচ্ছা থাক। এখন রাখছি৷
.
ফোন রেখে দিতেই কলিংবেল বাজতে শুরু করে। নিচে গিয়ে প্রত্যাশা দরজা খুলে দিতেই সায়েমকে দেখতে পেল।
– একি তুমি এই সময়? শরীর খারাপ করলো নাকি?
প্রত্যাশা সায়েমের কপালে হাত দিয়ে দেখতে থাকে। সায়েম হেসে বললো,
– কেন আসতে পারি না বুঝি!অফিসে কাজের চাপে সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছিলো। আর মাথাটা কেমন যেন ভার হয়ে আছে। তাই চলে এলাম।
– হুম। ভালো করেছো। তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
– ওই আর কি। এক কাপ কফি হবে প্লিজ?
– হুম অবশ্যই। তুমি রুমে গিয়ে ফ্রেস হও। আমি বানিয়ে আনছি।
.
সায়েম রুমে আসতেই রুমটা হঠাৎ করে গরম হতে থাকে।কেমন যেন থমথমে হয়ে আছে রুমটা। প্রত্যাশা কফি নিয়ে রুমে আসতেই সায়েম ওর দিকে তাকিয়ে রেগে বললো, তোকে না বলেছি আমার সামনে আসবি না। তোকে আমার সহ্য হয় না।
প্রত্যাশা অবাক হয়ে বললো, এসব তুমি কি বলো সায়েম। তোমার কি হয়েছে?
– যা এখান থেকে। আমায় একা থাকতে দে।
.
সায়েম রেগে গিয়ে আবার রুমের জিনিসপত্র ভাঙতে শুরু করলো। ভয় পেয়ে প্রত্যাশা রুমের বাহিরে চলে আসে। ফোনটা হাতে নিয়ে পাশের বাড়ির এক পরিচিত ভাবিকে তারাতারি এই বাড়িতে আসতে বললো। জিনিসপত্র ভাঙার আওয়াজ পেয়ে রেনুও উপরে চলে এলো।
– কি হইছে আফা! ভাইজান এমন করতাছে ক্যান।
সায়েম রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। দরজা লাগানো দেখে প্রত্যাশার আরও ভয় হতে থাকে।
– সায়েম দরজা খোলো। এসব কি করছো তুমি? সায়েম!
.
ভয়ে প্রত্যাশা কান্না করে দিলো। রেনু বললো,আফা কাইদেন না৷ ঠিক হইয়া যাইবো।
প্রত্যাশা কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমার সায়েম এসব কি করছে। ও কি করছে!
.
সায়েমের মাথা ঘুরতে থাকে। বিছানার ওপর ধপাস করে পরে গেল। রুমে এবার কারো অবয়ব ফুটে উঠছে। একটি মেয়ে। সাদা রঙের কাপড় পরা। খোলা চুল। পুরো শরীর আলোয় ঝলমল করছে। বাতাসে তার লম্বা লম্বা চুল গুলো উড়ছে। মুখ মন্ডলটা একদম পুতুলের মতো। পুরোই নিখুঁত সৌন্দর্যের অধিকারী। সে আস্তে আস্তে বিছানার দিকে এগিয়ে এসে বিছানায় পরে থাকা সায়েমের পাশে বসলো। তারপর হাত দিয়ে সায়েমের কপালের ওপর এসে পরা চুল গুলো ঠিক করে দেয়। আর নিচু হয়ে সায়েমের কপালে চুমু দিয়ে দিলো। কেঁপে উঠল সায়েম। কিন্তু চোখ খুললো না। এবার সে সায়েমের এক হাতের ওপর তার হাত রেখে আস্তে আস্তে সায়েমের বুকের ওপর মাথা রাখলো।
.
প্রত্যাশা নিচে এসে অনুপমা ভাবিকে সব খুলে বললো। সব কিছু শুনে তিনিও চিন্তায় পরে গেলেন।
– ভাবি সায়েম দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। এখন কি করবো। ভিতর থেকে কোনো সারা শব্দও নেই।
রেনু বলে উঠল, কইছিলাম না আফা,ভাইজানরে জ্বীন ভূতেই ধরছে। এহনো সময় আছে কোনো হুজুররে ডাইকা দেহান।
– চুপ কর তুই! আমার সায়েমকে কেন এসব ধরতে যাবে।
.
অনুপমা ভাবি বললেন, তোমার সাথে তো ওর কোনো ঝামেলাও হয় নি। তবে এমন করার কারণটা কি! শুনেছি এসব অসাভাবিক আচরণ মানুষ তখনই করে। রাত বিরাতে চলা ফেরা করে। কিছুর আছর তো পারতেই পারে।
প্রত্যাশা কান্না করে দিয়ে বললো, এখন কি হবে ভাবি! আমি কি করবো ওকে নিয়ে।
– শান্ত হও। আমার চেনা একজন ভালো হুজুর আছেন। উনাকে সন্ধ্যা বেলা নিয়ে আসবো। উনি দেখে হয়তো কিছু বুঝতে পারবেন৷
.
বিকাল বেলা সায়েম দরজা খুলে বের হয়ে নিচে আসলো। সায়েমকে দেখা মাত্রই প্রত্যাশা ওদিকে ছুটে গেল। রেনুও অবাক হয়ে সায়েমের দিকে তাকিয়ে আছে। সায়েম বললো,আমার কেমন যেন লাগছে প্রত্যাশা। আমার বোধহয় শরীরটা খুব বেশি খারাপ। প্রত্যাশা সায়েমকে ধরে উপরে নিয়ে গেল। শাওয়ার নিয়ে সায়েম এখন বিছানায় বসে রয়েছে। এখন শরীরটা আস্তে আস্তে একটু সাভাবিক হতে থাকে।
.
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চারিদিকে নিরব নির্জনতায় ভর করেছে। রাস্তার পাশের জঙল থেকে ঝি ঝি পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠায় কেঁপে উঠল প্রত্যাশা। সায়েমের দিকে একবার তাকিয়ে তারপর সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকলো। নিচে আসতেই বিদুৎ চলে গিয়ে পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে যায়। ভয়ে বুকটা ধুকপুক করছে। কোনো রকমে মোমবাতিটা জ্বলিয়ে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
.
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here