পরী পর্বঃ৫ম

0
915

পরী পর্বঃ৫ম
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা

.
প্রত্যাশা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। অনুপমা ভাবি আর একজন টুপি পরা দাড়ি ওয়ালা লোক দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পরনে তার সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি। হতে তসবি। অনুপমা ভাবি বললেন, উনি মাওলানা শাহ মুসাফির।
-আসসালামু আলাইকুম। ভিতরে আসুন।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। ঘরের ভিতরে কেমন গুমোট ভাব। কিছু যে আছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। তা তোমার স্বামী কোন ঘরে মা?
– উপরের ঘরে রয়েছে। আসুন।
বিদুৎ চলে এলো। অনুপমা ভাবি আর হুজুর সাহেব উপরের বেড রুমে চলে এলেন৷ সায়েম উনাদের দেখে অবাক হয়ে বললো, আপনারা? প্রত্যাশা বললো, উনি তোমাকে দেখতে এসেছেন।
– মানে কি?
– সেটা তুমি পরে বুঝতে পারবে সায়েম।
.
হুজুর সাহেব বিছানায় বসে বিভিন্ন দোয়া দরূদ পড়তে আরম্ভ করলেন। রুমের মধ্য হঠাৎ বাতাস বইতে লাগলো। বাতাসে রুমের জিনিস পত্র গুলো নড়ছে। সায়েমের মাথা ঘুরছে। চোখ বন্ধ করে ফেললো সায়েম। প্রত্যাশা আর অনুপমা ভাবি রুমের একদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রেনু দরজা থেকে দাঁড়িয়ে ভয়ে জরসর হয়ে এসব দেখছে। রুমের ভিতর হঠাৎ বাতাসের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ঝড় ওঠার মতো হয়ে গেল। জিনিসপত্র গুলো বারি খেয়ে শব্দ হতে লাগলো।
.
হুজুর সাহেব দোয়া পড়তেই লাগলেন৷ আস্তে আস্তে বাতাসের গতি কিছুটা কমে গেল।
তারপরই রুমের মধ্য একটি মেয়ের কন্ঠস্বর শোনা যায়। সে বললো,— তুমি কেন এখানে এসেছো? আর আমার সাথে কেন কথা বলতে চাইছো?
হুজুর সাহেব বলেন, তার আগে বল তুই কে? আর কেন এদের বিরক্ত করছিস?
—আমি জ্বীন বংশোদ্ভূত।
প্রত্যাশা আর অনুপমা ভাবি ভয়ে ঘাবড়ে গেলেন। তারপরও অনুপমা ভাবি প্রত্যাশার মনে সাহস জোগাচ্ছেন। রুমের ভিতর এভাবে অদৃশ্য কারো কথা শুনে যে কেউ ভয়ে জমে যাবে ।
হুজুর সাহেব বললেন, এখানে এসে কেন এদের বিরক্ত করছিস?
— আমি আলিসাই আলিয়া। এই ইনসান পুত্রকে আমার ভালো লেগে গেছে। আমি তাকে বিবাহ করতে চাই।
.
এসব শুনে প্রত্যাশার অচেতন হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। অনুপমা ভাবি তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। প্রত্যাশা ঢকঢক করে পানি টুকু খেয়ে নিয়ে ভয়ে জরসর হয়ে অনুপমা ভাবির গায়ের সাথে লেপটে রইলো।
হুজুর সাহেব বললেন, সে বিবাহিত। তার স্ত্রী আছে। তুই এদের অযথা বিরক্ত না করে তোর জায়গায় চলে যা।
— না। আমি তাকে চাই। সে আমার। শুধু আমার।
– তুই এখানে আসলি করে?
— আমি ওই রাতে আমার লম্বা চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে গাছের তলায় বাসে ছিলাম। তার সে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আমার চুলের ওপর পা দেয়। আর তাতে আমার প্রচন্ড রাগ হয়। আর আমি ওর পিছু নেই।
– ইনসান কি করে জানবে তুই ওখানে চুল ছেড়ে দিয়ে বসে আছিস। তোকে তো সে দেখে নি। তুই ওকে ক্ষমা করে দে। আর এখান থেকে চলে যা।
—-ক্ষমা করে দিয়েছি। আর তাই তো রাগের বসে আমার প্রিয়তম এর পা দুটোর যেখানে ক্ষত করে দিয়েছিলাম সেখানটায় আমিই সারিয়ে দিয়েছি৷ ওর সাথে এখানে এসে ওকে দেখে আমার ভালো লেগে যায়। এমন সুন্দর ইনসান আমি আগে কখনো দেখি নি। আমার ওকে খুব পছন্দ হয়েছে। আমি তাকে বিবাহ করতে চাই। আমি এখনো কুমারী আর সে আমার প্রথম পছন্দের পুরুষ।
.
প্রত্যাশা আর সহ্য করতে পারলো না। এসব শুনে সে এবার অচেতন হয়ে গেল। অনুপমা ভাবি তাকে ধরে রুমের চেয়ারটায় বসিয়ে দিলেন৷ হুজুর সাহেব এবার রেগে গিয়ে বলেন, ইনসানকে বিয়ে করতে চাস তুই! ভালোয় ভালোয় এখান থেকে চলে যা।
— আমি তাকে আমার করে নেব।
হুজুর সাহেব এবার দোয়া পড়ে রুমের মধ্য পানি ছেটাতে লাগলেন৷ সাথে সাথে তার চিৎকার শোনা যায়।
—- উফফ, থামো। থামো বলছি। গা জ্বলে যাচ্ছে আমার।
– এখান থেকে চলে যা। ইনসানদের আর বিরক্ত করিস না। না হলে আরও কষ্ট পাবি।
—- আমি এখন যাচ্ছি। তবে আমি আবার আসবো। আমার প্রিয়তমকে আমি আমার করেই নেব।
.
রুমের মধ্য আবারো ঝড় উঠল। কিছুক্ষণ থাকার পর আবার সব শান্ত হয়ে গেল। এখন থমথমে ভাবটাও আর নেই। প্রত্যাশার চেতনা ফিরে আসে।
হুজুর সাহেব বলেন, সে চলে গেছে। তবে এখন একটু সাবধানে থাকতে হবে। আর সময় করে একদিন পুরো বাড়ি ঝেড়ে দিতে হবে।
সায়েমকে চোখ খুলতে দেখে প্রত্যাশা এগিয়ে গিয়ে সায়েমের পাশে বসলো।
-তুমি ঠিক আছো তো সায়েম?
– হুম। মাথাটা কেমন যেন ঘুরছিল আমার। কি হয়েছিল?
.
হুজুর সাহেব বললেন, আমি এখন আসি। আবার কোনো সমস্যা হলে খবর পাঠালেই আমি চলে আসবো।
– আপনি নাস্তা করে যাবেন না?
– আজ থাক। অন্য একদিন এসে খেয়ে যাব। এখন তোমার স্বামীর একটু খেয়াল রাখো মা।
.
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সায়েমের ফোনে ওর মায়ের কল এলো। সায়েম কলটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই অপর পাশ থেকে কড়কড়ে মেজাজ শোনা যায়, কোথায় থাকিস বাবা? ফোন ধরতে এতো সময় লাগে কেন?
– ওইতো একটু…
– হয়েছে থাক। মাকে আর মিথ্যা কথা বলতে হবে না।
– আসলে মা শরীরটা ভালো নেই।
– কেন বাবা কি হয়েছে? বৌমা তো আমায় কিছু জানায় নি।
– ওইতো কাজের একটু চাপ আরকি। তেমন কিছু না।
– নিশ্চয়ই ওই বউ তোর ঠিকমত খেয়াল রাখতে পারছে না। তাই আমার ছেলেটা দিন দিন দুর্বল হয়ে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। জানতাম আমি এমন কিছুই হবে। যবে থেকে ওই বউ তোর জীবনে এসেছে তবে থেকে তুই মায়ের একটা কথাও শুনিস না। নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ওকে বিয়ে করলি। কেমন মেয়ে সে স্বামীর দিকে কোনো খেয়ালই নেই! আমার ছেলেটাকে একদম শেষ করে দিল।
– আহা মা। কি শুরু করলে। ওর কোনো দোষ নেই। আমারই একটু কাজের চাপ বেশি।
– হয়েছে আর বউয়ের হয়ে কথা বলতে হবে না। তুই ছুটি নিয়ে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি চলে আয় তো বাবা। মায়ের আদর যত্ন ছাড়া কি আর ছেলে সুস্থ হয়।
– মা এখন আসতে পারবো না। সামনে অনেক কাজ। অফিসের গুরুত্বপূর্ন মিটিং গুলোও সারতে হবে ।
– তাহলে নিজের একটু যত্ন নিস বাবা। দেখেশুনে থাকিস। তোকে নিয়েই আমার যত চিন্তা।
– ঠিকাছে মা। তুমি চিন্তা করো না। এখন রাখি৷
.
প্রত্যাশা রুমে আসতেই সায়েম খেয়াল করলো মেয়েটা কিছু একটা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবছে। অন্যমনস্ক হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুলো আঁচড়াতে থাকলো।
– কি হলো কি ভাবছো?
সায়েমের কথায় প্রত্যাশা চিরুনিটা রেখে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। সায়েম প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রত্যাশা সায়েমের চোখে চোখ রেখে বললো, তুমি আমায় ছেড়ে কখনো যাবে না তো সায়েম!
সায়েম খেয়াল করলো প্রত্যাশার চোখে পানি চিকচিক করছে। সায়েম প্রত্যাশার দুইবাহুতে হাত রেখে বললো, না রে পাগলী। এসব কেন বলছো। আমার মাথা ঠিক ছিল না তাই কি বলতে কি বলেছি আমি নিজেও জানিনা৷ ওসব ভেবে তুমি কষ্ট পেয়ো না।
– না। সে তোমায় বিয়ে করবে বলেছে।
– আরে কে বিয়ে করবে আমায়? আমি তো বিয়ে করেই নিয়েছি তোমায়।
– ওই জ্বীনপরী টা?
– আরে ধুর। তাই কখনো হয় নাকি৷ এসো তো কাছে এসো।
সায়েম প্রত্যাশাকে টেনে কাছে নিয়ে আসে তারপর কপালে চুমু একেঁ দিয়ে কোলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো।
.
সকালবেলা অফিসে আসতেই সায়েম খেয়াল করলো সবাই এক এক জায়গায় জড়ো হয়ে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। সায়েম বলে উঠল, কি হয়েছে, আপনারা সবাই এভাবে কাজ ফেলে গল্প করছেন কেন?
ম্যানেজার রোহান এদিকে ফিরে বলে উঠলেন, স্যার নতুন একজন মহিলা কলিগ এসেছে।
– তো? এটা আবার নতুন কি। অফিসে লোক আসবে যাবে এটাই নিয়ম।
– আহা স্যার আপনি বুঝতে পারছেন না। উনি মারাত্মক লেভেলের সুন্দরী!একবার দেখলে তাকায় থাকতেই ইচ্ছা করে। চোখ ফেরানো যায় না। পুরাই পরীর মতো দেখতে।
– আপনারা তাহলে এখন কাজ ফেলে মেয়ে দেখছেন। চরিত্রের কি ছিড়ি!
পাশে থেকে নীলয় চৌধুরী বলে উঠল, মিস্টার সায়েম আহমেদ আপনি ভুল ভাবছেন, সুন্দরী নতুন কলিগের রুপের ঝলক অফিসের পরিবেশটাই পাল্টে দিয়েছে। আপনি নিজের চোখে না দেখলে তা বুঝতেই পারবেন না। কি ফিগার মাইরি!
– সরি। আই হ্যাভ নো ইন্টারেস্ট এ্যাবাউট হার! এখন যান। যে যার জায়গায় গিয়ে কাজ করুন।
.
ম্যানেজার রোহান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মুখটা একটু বিকৃত করে নিজের ডেক্সের কাছে চলে গেলেন। সায়েম নিজের চেম্বারে এসে ফাইল গুলো ঘাটছিলো। হঠাৎ ফোন আসে অন্য একটা কম্পানির সাথে আজ বেলা ১২ টা নাগাধ একটা মিটিং হবে। তারপর সেখানেই লাঞ্চের অফার করা হয়েছে। সায়েম সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য অফিস থেকে বের হয়ে বাইকে উঠে বসলো।
.
বাইক নিয়ে দ্রুত বেগে চলছে সায়েম। চোখে দেওয়ার সানগ্লাসটি শার্টের সামনের পকেটে আটকে রেখেছে। জঙ্গলের রাস্তাটা দিনের বেলায় খুব সুন্দর দেখায়। আঁকাবাকা পথ আর তার দুইপাশে সবুজ গাছপালা। যদিও দিনের বেলাতেও খুব একটা জ্যাম নেই এই রাস্তায়। গাড়ি খুব কম চলে। তাই ফাকা রাস্তাতে খুব স্প্রিডে বাইক চালানো যায়। হাই স্প্রিডে বাইক চালানোই পছন্দ সায়েমের। হঠাৎ দেখলো রাস্তার বাম পাশে লাল ড্রেস পরা একটি মেয়ে হাত উচিয়ে তার দিকে ইশারা করছে। বাইক তার কাছাকাছি পৌঁছাতেই সে হাত দিয়ে থামার ইশারা করলো। সায়েম বাইক নিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায়। মেয়েটি এগিয়ে আসতেই সায়েম তার মাথা থেকে হেলমেট খুলে তার দিকে তাকায়৷ মেয়েটির দিকে তাকাতেই সায়েমের মাথা চক্রর দিয়ে উঠল। মেয়ে তো নয় যেন আগুন!
সায়েম হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একি কি সত্যিই মানবী নাকি অন্যকিছু। চোখ যেন ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। কেউ এতো সুন্দর কি করে হতে পারে! মনে হচ্ছে স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো অপ্সরী।
সায়েম তার ঘোর কাটানোর জন্য মাথাটা একবার ঝাকিয়ে নিয়ে আবার তার দিকে তাকালো৷ না সে ঠিকই দেখছে তার সামনে অপ্সরীর মতোই দেখতে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি কিছু একটা বলতে যাবে তখনই সায়েম বলে উঠল, আপনি?
মেয়েটি এবার হেসে সায়েমের দিকে তাকায়। তার চোখ দুটি যেন সায়েমের দিকে ড্যাব ড্যাবিয়ে চেয়ে আছে। সায়েম তার সৌন্দর্য দেখে আটকে যাচ্ছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে নিজেকে সামলে সায়েম এবার বলে উঠল, কে আপনি?
.
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here