পরী পর্বঃ৮ম
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা
.
গাছের ডালপালা গুলো বাতাসে দুলে উঠছে। মাথার উপর এক ফালি বাঁকা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। পরিবেশটা খুবই ঠান্ডা। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর সায়েম বাহিরে এসে গায়ে একটু হাওয়া লাগাচ্ছে। প্রত্যাশা ঘুমিয়ে পরেছে। সারাদিন জার্নি করার পর সে ক্লান্ত হয়ে পরেছে। বাড়িতে সায়েমের বাবা মা, ভাই ভাবি সবাই যে যার ঘরে ঘুমিয়ে গেছে। সায়েমের ঘুম আসছিলো না। রুমে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। তাই বাড়ির সামনে বাগান বাড়িটায় এসে বসে রয়েছে। আশেপাশে লেবু গাছ থাকায় সেটার গন্ধ নাকে এসে লাগছে। বাগানটায় আরও আছে আম কাঁঠালের অনেক গাছ। ফুলের গাছও রয়েছে। এখানে বসার জন্য সিমেন্ট দিয়ে বেঞ্চ বানানো হয়েছে। সায়েম উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
দূর থেকে একটি ছায়া আস্তে আস্তে সায়েমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই ছায়াটি একটি মেয়ের অবয়বে রুপ নিলো। পাশ ফিরে তাকাতেই সায়েম তাকে দেখে চমকে ওঠে। ভয়ে ঘামতে শুরু করে দেয়। বুকে হাত দিয়ে ঘন ঘন দম নিতে থাকে। সে কি চোখে কোনো ভূল দেখছে!চোখটা ডোলে ডোলে বন্ধ করে আবারো তাকিয়ে দেখলো সে ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেক অবাক হয়ে সায়েম তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো।
– মিস অরি আপনি এখানে! আপনি এখানে কিভাবে এলেন?
চাঁদের আলো আর তার শরীরের আলোয় স্পষ্ট তার মুখ দেখা যাচ্ছে। অরি বলে উঠল, আমাকে তো আসতেই হবে। তুমি আমাকে কেন দূরে ঠেলে দিচ্ছো সায়েম!
-আগে বলুন আপনি এতো রাতে এখানে কিভাবে এলেন!
– কারণ আমি মানুষ নই। আমি অনায়াসে যেকোনো জায়গায় চলে যেতে পারি।
অরির কথা শুনে সায়েমের মাথায় বাজ পরতে শুরু করলো। ভয়ে শরীর জমে যাচ্ছে। অরিকে এখন অন্যরকম দেখাচ্ছে। পরনে সাদা রঙের কাপড়। মাথার চুল গুলো খোলা। শরীরে বিভিন্ন অলংকার জড়ানো। অরির শরীর থেকে এক ধরনের উজ্জ্বল আলো বের হচ্ছে।
সায়েম বললো, তুমি মানুষ নও মানে!
– আমি তো শুধুমাত্র তোমার কাছাকাছি থাকতেই তোমার কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে দূরে রাখতে বাড়িতে হুজুর ডেকে নিলে। হাতে তাবিজ বেধে নিলে। আমাকে দূরে সরিয়ে দিলে!
– কেন এসেছো ! কি চাও তুমি!
-তোমাকে চাই। আমরা বিয়ে করবো। এক সাথে থাকবো। তুমি যা চাও আমি তোমাকে সব দিতে পারবো। তুমি অনেক ভালো থাকবে। চলো সায়েম। আমার সাথে চলো!
– আমার কিচ্ছু চাই না। আমার স্ত্রী আছে। তাকে নিয়ে আমি অনেক ভালো আছি৷
– আমি তোমাকে ভালোবাসি! হতে পারি আমি জ্বীন। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি।
.
অরির মুখে তার চোখের পানি গাল বেয়ে বেয়ে পরতে শুরু করলো। সেখানটায় আলো পরে চোখের সেই পানিটা চিক চিক করছে। অরির মায়াবি মুখটা দেখে সায়েমের ভয় কিছুটা কেটে যায়।
– আমাকে তাড়িয়ে দিয়ো না। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। তোমার হাতের তাবিজটা খুলে ফেলো। আমি তোমাকে নিয়ে যাব৷
.
সায়েমকে রুমে না পেয়ে বাহিরে খুঁজতে চলে এসেছেন সায়েমের মা। উনি প্রত্যাশার মুখে সায়েমের ওপর জ্বীন পরীর আছোর লাগার কথা পুরোটা শুনেছেন। তাই আসার পর থেকেই ছেলের দিকে নজর রাখছেন। খুঁজতে বের হয়ে বাগান বাড়ির এখানে এসে দেখলেন সায়েম একা একা কারো সাথে কথা বলছে। সায়েমের নাম ধরে ডাকতেই সে এদিকে ফিরে তাকালো।
– বাবা তুমি এখানে কি করছো! চলো ঘরে চলো।
.
সায়েম সামনে তাকিয়ে অরিকে আর দেখতে পেলো না। সায়েমের মা সায়েমকে ঘরে নিয়ে আসলেন। প্রত্যাশার শরীরটা ভালো না। শাশুড়ির ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেছে৷ এখন গা গুলাচ্ছে আর দুইবার বমিও করেছে। সায়েম রুমে আসার সাথেই প্রত্যাশা বলে উঠল, কোথায় গিয়েছিলে? মা তোমার কাছে এসেছিলেন।
– হুম। ওইতো একটু বাহিরে।
তখনই সায়েমের মা রুমে প্রবেশ করলেন আর বললেন, আমার ছেলের কোনো খেয়ালই তো রাখো না। বউ কি জন্য হয়েছো বুঝি না আমি! তোমার জন্যই ছেলেটার আজ আমার এই দশা।
সায়েম মাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, মা কি বলছো তুমি! ওর কি দোষ। তুমি যাও গিয়ে শুয়ে পরো। অনেক রাত হয়েছে।
সায়েমের মা চলে যাওয়ার পর প্রত্যাশা মন খারাপ করে বিছানায় বসে আছে। সায়েম এগিয়ে এসে বললো, জান তুমি মায়ের ওসব কথা ধরে বসে থেকো না।জানোই তো মা আমাকে নিয়ে সব সময় একটু বেশিই চিন্তা করে। চলো ঘুমাবে এসো।
সায়েম প্রত্যাশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিজেও ওর সাথে ঘুমিয়ে যায়।
.
মাঝরাতে ডাইনিং রুমের জিনিসপত্র ফ্লোরে পরে ভাঙার আওয়াজ পেয়ে সায়েমের মা উঠে এলেন। উঠে এসে লাইট জ্বালিয়ে দেখলেন রুমের ভিতর থাকা প্লেট বাটি এবং কাঁচের জিনিসপত্র এমনি এমনি পরে ভেঙে যাচ্ছে। বাতাসে রুমের ভিতর ঝড় ওঠার মতো হয়ে গেছে। ভয় পেয়ে চিৎকার দিলেন সায়েমের মা। জিনিসপত্র ভাঙার আওয়াজে সায়েমের বাবা, বড় ভাই আর ভাবিও এসে গেলেন। জানালা খোলা। জানালা দিয়ে প্রচুর বাতাস আসছে। সায়েমের ভাই গিয়ে জানালা লাগানোর চেষ্টা করতেই রুমের ভিতর থাকা ঝড়টা আরও বেড়ে গেল। ভয়ে সেও ওখান থেকে সরে আসে। ডাইনিং রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে সবাই জড়সড় হয়ে হয়ে এসব দেখছে। সায়েমও রুম থেকে বেড়িয়ে এলো।
.
সায়েম এখানে আসতেই বাতাসের গতি বেড়ে অনান্য রুমে চলে গিয়ে সেখানেও ঝড় উঠার হয়ে গেল আর রুমের জিনিসপত্র পরে ভাঙতে লাগলো। ভয়ে সবাই জমে যাচ্ছে। বাড়ির কাজের মহিলাটা বলে উঠল,আম্মাজান মনে হয় এগুলান জ্বীন ভূতেই করতাছে!
কথা শুনে সায়েমের মা এগিয়ে এসে সায়েমকে ধরে রইলেন। কেউ বুঝতে পারছেনা এসব কি হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সব কিছু থেমে গেল। সবার ধারণা রুমের ভিতর অদৃশ্য কিছু রয়েছে। নিজের চোখকে তো আর ফাকি দেয়া যায় না। চোখের সামনে সবাই এতক্ষণ যা দেখলো তা তো আর লোকমুখে শোনা নয়। সচোখে দেখেছে সবাই।
.
এসব দেখে সায়েমের মেজাজটা খুবই বিগড়ে যায়। তাকে বিরক্ত করার সাথে সাথে তার পরিবারকেও বিরক্ত করছে সে। সায়েম দরজা খুলে বাহিরে বেড়িয়ে গেল। সায়েমের বাবা সায়েমকে ডেকেই যাচ্ছে তবুও সায়েম কারো কথাই শুনলো না। প্রত্যাশাও বিছানা ছেড়ে উঠে এসে এসব দেখে ভয় পেয়ে যায়।
.
বাহিরে এসে সায়েম হাটতে শুরু করলো। কোথায় যাচ্ছে জানে না। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। হাটতে হাটতে হঠাৎ করেই সামনে অরি এসে হাজির হয়।থেমে গেল সায়েম। রাগে অরির চোখ মুখ জ্বলছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলে উঠল, তুমি বাবা হতে যাচ্ছো সায়েম! তাই সেটা আমার সহ্য হচ্ছে না। তুমি তোমার বউ নিয়ে সুখে থাকবে আর আমার মন এভাবেই জ্বলতে পুড়তে থাকবে। আমি সহ্য করতে পারছিনা।
অরির কথা শুনে সায়েম বড় ধরনের ঢাক্কা খেল। প্রত্যাশা প্রেগন্যান্ট? সেটা অরি কিভাবে জানলো।
সায়েম নিজের অজান্তেই বলে ফেললো,কিহ! তুমি কিভাবে জানলে?
– আমি সব বুঝতে পারি । আমার সহ্য হচ্ছে না।
.
অরির কথা শুনে সায়েম বাড়ির দিকে দৌড় দিলো। এক্ষুণি তাকে প্রত্যাশার কাছে যেতে হবে।
.
চলবে….