পর্ব:৩০(দ্বিতীয়াংশ),৩০(শেষাংশ ও শেষ পর্ব)

0
1290

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:৩০(দ্বিতীয়াংশ),৩০(শেষাংশ ও শেষ পর্ব)
লেখনীতে:তাজরিয়ান খান তানভি
পর্ব:৩০(দ্বিতীয়াংশ)

শৈবাল নিরুদ্বেগ গলায় আবার বলল—

“আমি তোমাকে কীভাবে খুঁজে পেয়েছি জানো? তন্দ্রাকে মনে আছে তোমার? ওই যে, হসপিটালে যার সাথে তুমি দেখা করেছে। ও অমিতের গার্লফ্রেন্ড। শিমুল আমাকে বলেছে। আমি ওর কাছে গিয়েছিলাম। তন্দ্রাকে অমিতই আমার পেছনে লাগিয়েছিল। অমিতের নাম্বার ট্র্যাক করেই আমি এখানে এসেছি।”

শৈবাল থামল। পরিবেশে নীরব হলেও মৃদু গোঙানি অমিতের। বাতাস ভার হচ্ছে তার মন্থর আর্তনাদে। শৈবাল অপরাধী গলায় বলল—

“তোমার আমাকে ঘৃণা হয় তাই না? আমার ছোঁয়াকে? কী করব বলো, দিনশেষে আমিও তো পুরুষ! তোমাকে যেমন না ছুঁয়ে থাকতে পারলাম না, ঠিক তেমন ভালো না বেসেও থাকতে পারলাম না।”

অরুনিকা অনুদ্বেগ, ভাবনাহীন, নিস্তরঙ্গ চোখে তাকিয়ে আছে। শৈবাল মুচকি হেসে আবার বলল—

“আমাদের বিয়ের রাতের কথা মনে আছে তোমার? সারারাত তোমাকে ঘুমাতে দেয়নি আমি। কী কাণ্ডটাই না করেছিলাম বলো! আমি তোমার চলে যাওয়া একদম মানতে পারছিলাম না। তারপর….তারপর….ধীরে ধীরে আমি তোমায় ভালোবেসে ফেললাম। আমার বিন্দু বিন্দু ভালোবাসার কখন যে মহাসাগরে রূপ নিয়েছে, আমি নিজেও জানি না অরু। আমি তোমাকে আমার কাছ থেকে একটুও দূরে সহ্য করতে পারছিলাম না। যেদিন আমাকে না বলে তুমি বাইরে চলে গিয়েছিলে, বিশ্বাস করো, আমি নিজেকে অনেক বোঝাতে চেয়েছি। কিন্তু পারিনি। অরুমিতা আমাকে ধোঁকা দেবে আমি কখনো ভাবিনি। তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে তো আমি ম*রেই যেতাম! তাই সেদিন আমি নিজেকে আ*ঘাত করেছি। তুমি খেয়াল করেছ তো, এর আগে শুধু আমি জিনিসপত্রই ভাঙচুর করেছি, কখনো নিজেকে আ*ঘাত করিনি! সেদিনের ওই ঘটনার পর তুমি যখন আবার আমার কাছে ফিরে এলে, আমি নিশ্চিত হয়েছি তুমি আমাকে ভালোবাসো। আর তাই….।”

গা দুলিয়ে হেসে উঠল শৈবাল। কিয়ৎক্ষণ হেসে পূনরায় চুপ হয়ে গেল। মাথানত করে কিছু একটা ভাবছে সে। পরমুহূর্তে মাথা তুলল। অরুনিকা দেখল, শৈবালের চোখের কোল ভেজা। সে আহত সুরে বলল—

“আমি যদি জানতাম, তখন তুমি আমাদের ভালোবাসাকে নিজের গর্ভে ধারণ করছ, আমি কখনো এমন করতাম না অরু, কখনো না।”

শৈবাল অধর ছড়িয়ে শ্বাস ফেলল। অরুনিকা ভালো করে খেয়াল করে দেখল, শৈবালে দুই হাত কাঁপছে। সে হাত বাড়িয়ে শৈবালকে ছুঁতে গেলে হাত সরিয়ে বলে উঠে শৈবাল—

“ছুঁয়ে না আমাকে। আমি অভিনয় করছি না এখন। তোমাকে হারানোর কথা মনে হলেই আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না।”

অরুনিকা অনুরক্তির সুরে বলল—

“আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না শৈবাল।”

শৈবাল আবিষ্ট চোখে তাকিয়ে বলল—

“যেতে তো তোমাকে হবে অরু। আমার মতো অসুস্থ মানুষের সাথে তুমি থাকতে পারবে না। আমার কাছে থাকলে আমি তোমাকে নিঃশ্বাসও নিতে দেবো না। তোমার চোখের পলকও আমায় তোমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। আমি তোমাকে আমাতেই আবদ্ধ করে রাখব। আমার গণ্ডিতে। যার শুরুও আমি, শেষ সীমানাও আমি। যার শুরু হয়েছিল ভালোবাসার লাল রঙে, তার শেষও হবে সেই রঙে। আমি তোমাকে আমার করে রাখব। আমার সেই ‘ভালোবাসার লাল বৃত্তে’। যেখান থেকে তুমি আর বেরোতে পারবে না। এমন একটা মানুষের সাথে অবশ্যই তুমি থাকতে চাইবে না?”

অরুনিকা হতভম্ব দৃষ্টিতে চাইল। সন্ধ্যা নেমেছে আরও আগেই। বাইরের অন্ধকার ছাপিয়ে জ্বলছে এই অসমাপ্ত ঘরের উজ্জ্বল বাতি। কেমন অস্থিরতা বাতাস জুড়ে, গহন আর্তনাদ, অনুভূতির শিহরন। অরুনিকা কোনো কথা বলল না। যেন কথা ফুড়িয়ে গেছে তার। সে চেয়ে আছে অনিমেষ। শৈবাল গাঢ় স্বরে বলে উঠল—

“আমি দোষী, শিমুল,অমিত, অরুমিতা আমরা সবাই দোষী। সেই দোষীদের একে অন্যের সাথে জুড়ে দিলে তুমি। যেখানে তোমার কোনো দোষ নেই। তবুও সবচেয়ে বেশি ভুগেছ তুমি? আর এই সবকিছুর জন্য আমি দায়ী। আমার জন্য তুমি আর অরুমিতা দুইজনই কষ্ট পেয়েছ। অমিত ভালোই করেছে তোমাকে তুলে এনে। নাহলে আমি কখনো অরুমিতার আসল দোষীদের খুঁজে পেতাম না।”

“আমার কী সত্যিই চলে যাওয়া উচিত?”

অরুনিকার এই প্রশ্নে তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দিলো না শৈবাল। সে চাহনি দৃঢ় করে অরুমিতার দিকে চাইল। ধীরগতিতে অরুমিতার হাত নিয়ে উলটো পিঠে চুমু খেল। অরুনিকার হাত ধরেই আরেকটু কাছে এগিয়ে গেল তার। তারপর, অরুনিকার সেই হাত বুকে চেপে ধরে বলল—

“আমি নিজেকে বদলাতে পারব না অরু। তোমাকে আমার কাছে এভাবেই থাকতে হবে। তুমি নিশ্চয় এই আবদ্ধ ভূমিতে থাকতে চাও না। তাই, তুমি চলে যাও। তোমার সব দায়িত্ব আব্বা নেবেন। তোমার জন্য ভালো ছেলে যোগাড় করে দেবেন। তোমার জন্য ছেলের অভাব হবে না অরু।”

“আপনি সহ্য করতে পারবেন আমাকে অন্য কারো সাথে?”

“পারব না। একদম পারব। খু*ন করে ফেলতে ইচ্ছে হবে আমার। কিন্তু তখন তো আমি থাকব না।”

অরুনিকা পলেই হকচকিয়ে বলল—

“কোথায় যাবেন আপনি?”

শৈবাল চোখে হেসে অচক্রী গলায় বলল—

“শিমুলকে আমি ওর সাজা দিয়েছি। অমিতের বাকি। ওকে খু*ন করে আমি জেলে যাব। সেখানে আমার যা হওয়ার হোক। হয় ফাঁসি না হয় যাবজ্জীবন। মরে মরে বেঁচে থাকব হয়তো আমি। কিন্তু এখানে থাকলে তোমাকে আমার চাই, আর চাইই।”

“তাহলে এসব কেন বলছেন?”

শৈবাল গালভরতি হেসে ফেলল। তার চোখ জোড়া অদ্ভুত ভঙ্গিতে বুজে এলো। সে স্থির, নিরানন্দ গলায় বলল—

“তুমি আমার সাথে থাকলে ওকে আমি পুলিশে দেবো। কারণ, আমি আমার জীবনের বাকি রাস্তাটুকু তোমার সাথে যেতে চাই। আর যদি তুমি চলে যাও, তাহলে ওকে খু*ন করে আমিও এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেব।”

“ওকে পুলিশে দিয়ে দিন।”

এক লহমায় স্বীকারোক্তি দিলো অরুনিকা। শৈবাল শুধু অবাক হয়নি। চূড়ান্তরূপে অবাক হয়ে সে তাকাল। অরুনিকা গরগর করে বলল—

“আবদ্ধ করে নিন আমাকে আপনার ভালোবাসার লাল বৃত্তে। সেখানে আপনি ছাড়া আর কারো ছায়াও যেন আমার ওপর না পড়ে। ”

শৈবাল দম বন্ধ করে চেয়ে আছে। ঠিক তখনই পেছন দিক থেকে তার গলা পেঁচিয়ে ধরে অমিত। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে যায় শৈবাল। সাথে অমিতও। আকস্মিক ঘটনায় হতচকিত অরুনিকা। দেয়াল ধরে ধীরগতিতে দাঁড়ায় সে। অমিত শৈবালকে নিয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায়। দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল—-

“তোর নিজে ম*রতে হবে না। আমিই তোর সেই ইচ্ছে পূরণ করে দিচ্ছি।”

অরুনিকা অসহনীয় গলায় চিৎকার করে উঠে—

“শৈবালকে ছাড়ো অমিত ভাইয়া, তাকে ছাড়ো।”

“তুই বললেই কী আমি ছেড়ে দেবো?”

শৈবাল দাঁত দাঁত চেপে হাত উলটো করে অমিতের চুল চেপে ধরে তাকে সামনের দিকে আনার চেষ্টা করল। এবং সফলও হলো। তবে অমিত তখন দুই হাতে শৈবালের গলা চেপে ধরেছে। নিজেকে ধাতস্থ করে অমিতকে আ*ঘাত করতে গেলে অরুনিকা তটস্থ হয়ে ছুটে এসে ধাক্কা বসাতে থাকে অমিতের পিঠে। ঠিক তখন চতুর অমিতের পায়ের ক্ষ*ত জায়গায় হাঁটু দিয়ে আ*ঘাত করতে চায় শৈবাল। কিন্তু তার পূর্বেই শৈবালকে ছেড়ে অরুনিকাকে ধরে ফেলে অমিত। অরুনিকার গলার কাছে লোহার ছোটো একটি দণ্ড গেঁথে দেওয়ার ভঙিতে ধরে রেখে বলল—

“থাম, নাহলে কিন্তু…।”

অমিত একটু এগিয়ে নেয় লোহার দণ্ডটি অরুনিকার গলার আরেকটু কাছে। তাতেই আঁতকে উঠে চিৎকার করে শৈবাল।

“না…..। অরুর গায়ে একটা আঁচড়ও দিবি না। তোর শত্রুতা আমার সাথে।”

দাঁত কেলিয়ে হাসল অমিত। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল—-

“শ*ত্রু তো ও আমার। ও তোকে বিয়ে না করলে আমাকে এতকিছু করতেই হতো না। ওর জায়গা অন্য মেয়ে হলে, আমি নিজ হাতে আরও আগেই মে*রে দিতাম।”

শৈবাল খলবলিয়ে উঠে তেড়ে আসতেই অমিত বলল–

“সামনে আগাবি না। তাহলে কিন্তু সেকেণ্ডও সময় লাগবে না আমার।”

অরুনিকার বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে। চোখে ভীষণ ভয়। যেন মৃ*ত্যু দূত তাকে হাতছানি দিচ্ছে! কপালে, নাকের ডগায়, চিবুকে জমেছে ঘাম। নোনতা নহর স্মিত ধারা নামছে কানের পাশের চুল গলিয়ে। সে অসহায়, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শৈবালের দিকে।

চলবে,,,

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:৩০(শেষাংশ)
লেখনীতে:তাজরিয়ান খান তানভি

অরুনিকার গায়ের সাথে লেপ্টে আছে অমিত। তার ভয়াল নিঃশ্বাস অরুনিকার কানে বিঁধে যাচ্ছে। শৈবাল অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার পুরো শরীর সহসা কাঁপতে শুরু করল। অরুনিকা বুঝতে পারছে শৈবালের মনস্থিতি। তার প্যানিক অ্যাটাক করেছে। একটু পরেই মাথায় যন্ত্রণা শুরু হবে। অরুনিকা কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল—

“শৈবাল!”

শৈবাল কম্পিত গলায় বলল—

“ওকে ছেড়ে দে অমিত। আমাকে মা*র। তোর বদলা তুই আমার কাছ থেকে নে।”

অমিত তার আ*ঘাতপ্রাপ্ত পা খানিকটা ভেঙে রেখেছে। অন্যপায়ে মোটামুটি শরীরের সকল ভর ঢেলে দাঁড়িয়েছে। অমিত শ্লেষাত্মক হেসে বলল—

“ধুর! তোকে মারলে তো অনেক আগেই মা*রতে পারতাম। উহু, তুই নিজে ম*রবি।”

অরুনিকার চোখ বিদ্ধ হয়ে আছে তার গলার কাছে ধরে রাখা এবড়ো থেবড়ো কা*টা লোহার দণ্ডটির দিকে। অমিত অতি সাবধানে তার অন্য হাত দিতে পকেট থেকে একটা পাতলা চা*কু বের করে শৈবালের দিকে ছুড়ে মারে। কেঁপে ওঠে অরুনিকা। অমিতে তখন সেই হাত দিয়ে অরুনিকার বাজু ভালো করে চেপে ধরে। খরখরে গলায় বলল—

“একটু আগে বললি না, অরুনিকাকে ছাড়া বাঁচতে পারবি না! তাহলে নে এখন। তুই নিজেই নিজেকে শেষ করবি। ব্যস, অরুনিকা মুক্ত।”

অরুনিকা আর্ত গলায় বলে উঠে—

“নাহ্…!”

“শিষ! সোনাপাখি! চিল্লায় না। কেন এমন কান্নাকাটি করছিস তুই? তুই চিন্তা করিস না। আমি তোকে বিয়ে করব। তোর সব ইচ্ছে পূরণ করব।”

“আমি ম*রে গেলেও তোমাকে বিয়ে করব না।”

“তাহলে ম*রে যা!”

অমিত পুরো লাগিয়ে ফেলে লোহার দণ্ডটি অরুনিকার গলদেশের পাতলা আবরণের সাথে। শৈবাল তার পুরুষালী কণ্ঠ ভেদ করে আওয়াজ তোলে—-

“নাহ…। তুই যা বলবি তাই হবে। ওর কোনো ক্ষতি করবি না।”

শৈবাল কথা বলতে পারছে না। তার হা-পা কাঁপছে। কম্পনরত অবস্থায় ঝুঁকে সে চা*কুটি হাতে নিল। অমিত উচ্ছ্বাসিত হেসে বলল—

“নে, এবার তোর হাতে চালা। তোর দেহ থেকে যত দ্রুত প্রাণ বের হবে, তোর অরু ততটাই নিরাপদে থাকবে। শুরু কর।”

শৈবাল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকাল অরুনিকার দিকে। অরুনিকার গাল বেয়ে নামছে উষ্ণ জলের প্রস্রবণ। তার চোখে আকুতি। শৈবালের নিরুপায় চাহনি। সে কাতর স্বরে বলল—

“আই এম সরি, আই এম রিয়েলী সরি অরু!”

অরুনিকার শুষ্ক গলা। তার শ্বাস বারবার গলার কাছে আটকে যাচ্ছে। দীর্ঘ ক্ষীণ শ্বাসের সাথে তার বুক উঠছে আর নামছে। চোখের পলক পড়ছে না। শৈবাল আলতো হাসল। অরুনিকার দিকে তাকিয়ে ডান হাতে রাখা চা*কু বাম হাতের কব্জির ওপর ধরল। অরুনিকা নিঃস্ব গলায় বলল—

“এমন করবেন না শৈবাল।”

তৎক্ষণাৎ তার কর্ণকুহরে ফিসফিসিয়ে বলল অমিত—

“তুই চিন্তা করিস না। শৈবালের চেয়ে বেশি আদর করব তোকে আমি, ভালোবাসব।”

“আমাকে যেতে দাও অমিত।”

“বাহ্! নাম ধরেও বলছিস! চমৎকার !”

“যেতে দাও আমাকে।”

“যদি না দেই?”

তদ্দণ্ডে এক সাহসী কাজ করে ওঠে অরুনিকা। অমিতের পায়ের ওপর একটা দানব মার্কা পাড়া দিতেই অমিতের হাতের বাঁধন হালকা হয়। অরুনিকা দ্রুত সরে আসতে গেলে এলোমেলো অমিত খপ করে অরুনিকার শাড়ির আঁচল ধরে ফেলে। কাঁধ থেকে আঁচল খসে পড়ে অরুনিকার। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেও আঁচল ছাড়েনি অমিত। শক্ত টানে অরুনিকার কয়েকটা কুচিও খুলে যায়। সে টালমাটাল হয়ে পড়তে গেলে বুক পেতে দেয় শৈবাল। শৈবালের বুকের কাছে খামচে ধরে স্থির হয় অরুনিকা। একহাতে অরুনিকাকে বুকের সাথে চেপে ধরে অন্যহাতের চা*কু ফেলে অমিতের হাতে থাকা শাড়িতে টান মারে শৈবাল।

কিন্তু তাতে লাভ হলো না। তার পূর্বেই এক হ্যাচকা টানে অরুনিকার শাড়ির অর্ধেক কুচি খুলে অমিতের হাতে চলে যায়। আর মুখ থুবড়ে পড়ে যায় অরুনিকা অমিতের সামনে। মেঝেতে পড়া মাত্রই দাঁতের ঘর্ষণে ঠোঁট কে*টে র*ক্ত ঝরতে থাকে। শৈবাল কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে অরুনিকাকে রেখে তড়িৎ গতিতে গিয়ে অমিতের বুকে থাবা বসায়। শাড়ির আঁচল খসে পড়ে অমিতের হাত থেকে। অরুনিকা ব্যথায় মূহ্যমান। কোনোমতে কাতরাতে কাতরাতে নিজের দিকে তাকায়। তার বুকে কাপড় নেই। লজ্জায় কুকুড়ে যায় সে। ধাতস্থ হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ি টেনে শুধু বুকের কাছটায় আড়াআড়ি টেনে নেয়।

সামনে তাকাতেই তার পিলে চমকে ওঠে। যেই লোহার দণ্ড তার গলায় বিঁধে যাওয়ার কথা ছিল তা এখন অমিত শৈবালের চোখের কাছে ধরে রেখেছে। শৈবাল প্রাণপনে অমিতের সেই হাত নিজের চোখের কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে। হিম হয়ে এসেছে অরুনিকার লহু। তার দেহ থরথর করে কাঁপছে। ওই মুহূর্তে আর কিছু মাথায় এলো না অরুনিকার। সে ছুটে গিয়ে প্রথমে শৈবালকে ধাক্কা মা*রল। আচানক ধাক্কায় শৈবাল মেঝেতে ধপাস করে পড়ে যায়। তারপর শরীরের সমস্ত শক্তির সাথে আক্রোশ মিশিয়ে ধাক্কা বসায় অমিতের বুকে। অতর্কিত ধাক্কায় চোখের পলকে দেয়ালের ওপর গিয়ে পড়ে অমিত। সাথে সাথে ইটের সাথে লেগে যায় অমিতের মাথা। তবে সে আর নড়ল না। দেয়ালের ফাঁকের জায়গায় ইট রাখা ছিল। যার বাড়তি অংশটুকু সামনের দিকে ভাঙাচোরা। তাই গেঁথে যায় অমিতের মাথার পেছনের দিকটায়।

নিজেকে সামলে অমিতের দিকে তাকাল শৈবাল। তার চোখ স্থির হয়ে রইল। চোখ মেলে চেয়ে আছে অমিত। ধীরে ধীরে চোখ-মুখ কুঁচকে মাথার পেছনে হাত দিয়ে সে অরুনিকার দিকে তাকাল। তারপর কিয়ৎপলেই ঢলে পড়ল মেঝেতে। অরুনিকা আড়ষ্ট নজরে তাকিয়ে আছে। শৈবাল চাহনি ঘুরিয়ে তাকাল অরুনিকার দিকে। অরুনিকার বক্ষদেশে শাড়ি নেই। সমানতালে বিধ্বংসী শ্বাসের সাথে তূরন্ত কম্পন। শৈবাল ঝট করে উঠেই অরুনিকাকে বুকে জড়িয়ে ধরল জোরালো হাতের বাঁধনে। মেঘ ভাঙা বর্ষণের মতো রোদনে আচ্ছন্ন হয়ে বলে উঠল অরুনিকা—

“আমি অমিতকে মে*রে ফেললাম শৈবাল, আমি অমিতকে মে*রে ফেললাম।”

হাউমাউ করে শৈবালকে দুই হাতে খামচে ধরে অরুনিকা। বাচ্চাদের মতো গা ঝাঁকিয়ে বলতে থাকে—

“আমি খু*ন করেছি শৈবাল, আমি খু*ন করেছি! মে*রে ফেললাম আমি অমিতকে, মে*রে ফেললাম!”

শৈবাল পিষে ধরল নিজের বক্ষ পাটাতনে অরুনিকাকে। আশ্বস্ত গলায় বলল—

“কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু না। শান্ত হও তুমি। ”

“আমি খু*ন করেছি শৈবাল, খু*ন করেছি।”

“ইট ওয়াজ এন অ্যাকসিডেন্ট। ইটস নট ইউর ফল্ট। প্লিজ কাম ডাউন।”

“না, না, নাআআআআআ।”
,
,
,

ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসল অরুনিকা। তার কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বিউটিবোনের সন্ধিস্থল ডেবে যাচ্ছে। মৃদু কম্পন সাথে মস্তিষ্কে অসহনীয় যন্ত্রণা। তার চিৎকারে ডিভান থেকে ছুটে এলো শৈবাল। শৈবালের সান্নিধ্য পেতেই ঝড়ে উপড়ে যাওয়া গাছের শেষ আশ্রয়ের মতো তাকে আঁকড়ে ধরল অরুনিকা। স্বামীর বুকে মাথা গুঁজে আচ্ছন্ন গলায় বলল—

“সবাইকে মে*রে ফেললাম আমি, সবাইকে। আমি আমার সন্তানকেও বাঁচাতে পারিনি। অমিত ভাইয়াকে মে*রে ফেললাম। আমার জন্য খালা মা*রা গেল। আমি সব শেষ করে দিলাম, সব।”

শৈবাল আলগোছে বুকে জড়িয়ে রাখল অরুনিকাকে। তার পিঠে হাত বোলাতে লাগল পরম আবেশে। কোমল গলায় বলল—-

“শান্ত হও। তোমার কোনো দোষ নেই। ভাগ্যবিধাতার সংবিধান কেউ বদলাতে পারে না। মানুষের ভাগ্যে তাই হয় যা তিঁনি নির্ধারণ করেছেন। এতে মাটির তৈরি মানুষের কোনো হাত নেই।”

“কিন্তু শৈবাল…..।”

অরুনিকাকে আর বলতে দিলো না শৈবাল। এখনো মাঝে মাঝে অমিতের সেই রক্তাক্ত মৃ*ত মুখটা ভেসে ওঠে অরুনিকার অবচেতন মনের স্বপ্নে। তখন সে নিজেকে আ*ঘাত করার চেষ্টা করে। ছেলের মৃ*ত্যু শোক সামলাতে পারেনি অরুনিকার খালা। কিছুদিন পরে তিনিও ইন্তেকাল করেন। অরুনিকা পুরোদস্তুর এলোমেলো হয়ে যায় পরপর তিনজন মানুষকে হারিয়ে। কোথাও না কোথাও সে নিজেকেই দায়ী করে তাদের প্রথম সন্তানের, অমিতের আর নিজের খালার মৃ*ত্যুর জন্য।

পুলিশকে সামলে নেয় জাফর আর শৈবাল। এছাড়াও অমিতের রক্তে ড্রাগসের নমুনা পাওয়া গেছে। এমনকি সে ড্রাগস ড্রিলারদের সাথেও জড়িত ছিল। তাই কেস ঘুরাতে বেশি বেগ পেতে হয়নি শৈবালকে।

“মামা, মামা!”

রিম, ঝিমের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস। শৈবাল তাকাতেই দেখল, ঝিম পেটের সাথে তার ছোট্ট ভাইটিকে চেপে ধরে খুব কষ্টে হেঁটে আসছে। শৈবাল তৎক্ষণাৎ অরুনিকাকে রেখে ছুটে যায় ঝিমের কাছে। ছোট্ট জীবন্ত দলাটিকে কোলে নিয়ে সোজা হয়। কপট রাগি গলায় বলল—

“ওকে নিয়ে এসেছ কেন?”

রিম প্রাণবন্ত হেসে বলল—

“আম্মু বলেছে মামিমা কাঁদলেই বাবুকে নিয়ে আসতে। মামিমা তো কাঁদছে!”

শৈবাল গ্রীবাভঙ্গি বদলে অরুনিকার দিকে তাকাল। অরুনিকার চোখের স্রোত থেমে গেছে। শৈবাল বাচ্চাটিকে নিয়ে অরুনিকার কোলে দিলো। অরুনিকা টপটপ করে কয়েকটা চুমু খেল মৃন্ময়ের চোখে -মুখে। বাচ্চাটি লাল ঠোঁট ফাঁক করে শব্দহীন হাসল। ছোটো ছোটো হাতে অরুনিকা নাক খাবলে ধরল। চোখে হাসল শৈবাল। মৃন্ময়ের এই একান্ত ছোঁয়াতেই অরুনিকার অপ্রকৃতিস্থ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। মৃন্ময়কে আদরে ভাসাতে থাকে অরুনিকা। বিছানায় উঠে তার দুই কাঁধে হাত রেখে ঝুঁকে ভাইকে আদর করা দেখেছে রিম আর ঝিম। বিছানার পাশের টেবিল থেকে ঔষধের বাক্স হাতে নিল শৈবাল। অরুনিকার দিকে তাকিয়ে বাক্স খুলে নির্দিষ্ট পাতা হতে ঔষধ নিল। অরুনিকার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা বড্ড মায়াবী! মৃন্ময়কে কোলে নিলেই যেন অরুনিকার বুকটা ভরে ওঠে। শৈবাল পানি ঢেলে নিল জগ থেকে গ্লাসে। ঔষধ এগিয়ে দিলো অরুনিকাকে। অরুনিকা হঠাৎ থমকে গিয়ে তাকাল। তারপর বিনা বাক্য ব্যয়ে ঔষধ খেয়ে নিল। হালকা রাগের আভাস ঝড়িয়ে বলে উঠে শৈবাল—

“রিম, ঝিম পড়তে যাও। মামা আসছি।”

রিম আবদার করে বলল—

“বাবুকে আরেকটু দেখি মামা?”

“না, যাও। হোমওয়ার্কের খাতা বের কোরো। মামা এক্ষুনি আসছি।”

দুই বোন মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিয়ে বিছানা থেকে নামলো। গুটগুট করে চলে গেল। রুমকি এখন এখানেই থাকে। অরুনিকা স্বাভাবিক হওয়ার আগ পর্যন্ত সে এখানে থাকবে বলে জানিয়ে দেয় জাফরকে। শিমুল এখন একটু সুস্থ। তার ডানপায়ের হাঁটুর নিচ থেকে বাকিটুকুর হাড় ভেঙে দিয়েছিল শৈবাল। অপারেশনের পর এখন একটু হাঁটতে পারলেও একা কোথাও যাওয়ার সাধ্য নেই তার।

“শুয়ে পড়ো অরু। একটু পর খেয়ে বাকি ঔষধ খেতে হবে।”

“আপনার আমাকে ভালো লাগে না তাই না?”

শৈবাল বিনা শব্দে বিছানায় বসল। আবিষ্ট গলায় বলল—

“এ কথা কেন বলছ?”

“এখন আর আপনি আমার কাছে আসেন না। সব সময় দূরে দূরে থাকেন। আমি তো পঁচে গেছি।”

“ছিঃ! এভাবে কেন বলছ? তুমি অসুস্থ অরু।”

অরুনিকার চোখের টলটলে জল টুপ করে মৃন্ময়ের ফুলকো গালের ওপর পড়ল। টুকটুক করে হেসে উঠল মৃন্ময়। অরুনিকা প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—

“আজ আপনি আমার কাছে থাকবেন?”

“আমি তো তোমার কাছেই থাকি।”

“উহু! আমার হয়ে থাকবেন।”

শৈবাল মাথাটা এগিয়ে নিল অরুনিকার কাছে। অরুনিকার গালে ঘ্রাণেন্দ্রিয় ঠেকিয়ে বলল—

“থাকব।”

আপ্লুত হলো অরুনিকার অন্তঃকরণ। তার চাতক হৃদয়ের তৃষ্ণা যেন হুরহুর করে বিস্তৃত হলো। সে বলল—

“বাবু আজ আমাদের কাছে থাকুক।”

শৈবাল একচোট হেসে বলল—

“তাহলে যে আমার অসুবিধা হবে!”

“তাহলে দিয়ে আসুন বাবুকে।”

“এখন থাক। তুমি রেস্ট নাও। বাবু বোধহয় ঘুমাবে।”

অরুনিকাকে শুইয়ে দিলো শৈবাল। অরুনিকার পাশেই জায়গা হলো ছোট্ট তুলতুলে দলাটির। মৃন্ময়কে আরও কয়েকটা চুমু দিলো অরুনিকা। অরুনিকার মাথায় হাত বোলাতে থাকে শৈবাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ বুঝে নেয় অরুনিকা। মৃন্ময় ঘুমো ঘুমো চোখে মামাকে দেখে।

অরুনিকার ঘুম গাঢ় হতেই উঠে দাঁড়াল শৈবাল। অধর বিস্তৃত করল। তার বুক ফুড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। মেয়েটা হাসে না, অপ্রকৃতিস্থের মতো চেয়ে থাকে জানালার গ্রিল গলিয়ে, তারপর আচমকা কেঁদে ওঠে। কখনো কখনো ভয়ানক স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে, তখন সামলানো যায় না। নিজের নখের আঁচড় নিজেকেই ক্ষত-বিক্ষত করে। শৈবাল বেশিরভাগ সময় বাসায় থাকে। অরুনিকার দিকে তার সতর্ক দৃষ্টি। অরুনিকা আবার মা হতে চায়। খুব করে কাছে চায় স্বামীকে। কিন্তু শৈবাল খুব বেশি প্রয়োজন না হলে দূরত্ব বজায় রাখে। অরুনিকার পরিস্থিতি বিবেচনা করে সাইক্রিয়াটিস্ট এখনই বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে ঋণাত্মক অভিমত দিয়েছেন। অরুনিকার মতে, তাদের প্রথম সন্তান তার অসতর্কতা, অবহেলাতেই প্রাণ হারায়। তাই দ্বিতীয়বারও যদি একই ঘটনা ঘটে, তাহলে অরুনিকার মানসিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে।

ভাবনার সুতো কাটল শৈবাল। অরুনিকা নড়ে উঠেছে। মৃন্ময়ের মাথার ওপর তার হাত। শৈবাল এগিয়ে এলো। মৃন্ময়ের মাথার ওপর থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে অরুনিকার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। শৈবাল হাসল। গাঢ় রহস্যময় হাসি। স্বগতোক্তি করে বলল—

“আমাকে ঘিরেই তুমি। আমার আমিতেই তুমি। তোমাতেই পূর্ণ আমার আমি।”

শৈবাল উঠে দাঁড়াল। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল—

“সরি অরু। আমি তোমাকে কোনো কিছুর বিনিময়ে হারাতে পারব না। তাই আমাকে এমন করতেই হলো। অমিতের বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। ও বেঁচে থাকলে অরুমিতার আত্মা কখনো শান্তি পেত না। তুমি না হয় অরুমিতার হয়ে অরুর দায়িত্ব পালন করলে!
সদা সত্য তোমার আলাপন, শুধু মিথ্যে ক্ষণিকের দর্পণ,
রয়ে যায় স্মৃতির আখরে, তোমার আলিঙ্গন।
তোমাকে আমার হয়েই থাকতে হবে অরু। তোমার নিঃশ্বাসের পরিধি আমি। আমার ভালোবাসার লাল বৃত্তে আবদ্ধ তুমি। সেখানে আর কালো ছায়াও তোমার ওপর পড়বে না। আই প্রমিস ইউ, মাই লাভ।”

——————সমাপ্ত————-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here