পর্ব ১৩+১৪ বধুয়া

0
2002

পর্ব ১৩+১৪

বধুয়া পর্ব-১৩

দুই- তিনবার কলিং বেল বাজার পর আনিসের স্ত্রী দরজা খুলে।
– আপনি? আমার বাসা পর্যন্ত চলে আসছেন?
– আমি আনিস সাহেবের সাথে কথা বলতে চাই।
– আনিস নেই এখানে।
– প্লিজ, আমি জেনে গেছি আনিস সাহেব মাহিরের বন্ধু।উনি কেন বিয়ের নামে চিট করতে চেয়েছিলেন সেটাই জিজ্ঞেস করতে চাই।আর আমি আপনাদের পেছনে পেছনে এসেছি, উনি বাসায়ই আছেন।।
আমাকে ঢুকতে দিন।
অনেকটা জোর করেই বাসায় ঢুকে যাই।
– আপনি?
আনিস আমাকে দেখে চমকে উঠে।
– জি। চিনতে পেরেছেন তাহলে! আপনার কাছে একটা প্রশ্ন করতে চাই।কেন আপনি এমন করলেন? মাহির আর আপনি মিলে আমার পরিবার, সবাইকে ঠকিয়েছেন।চিট করেছেন!
আপনার স্ত্রী আমাকে চিনতে পেরেও মিথ্যা বলেছে!
আনিসের স্ত্রী সামনে এসে বললো -থামুন আপনি! অনেক তো বললেন – আমার স্বামী চিট করেছে! আপনার স্বামীর অনুরোধে করেছে। মাহির ভাইয়ের অনুরোধ ফেললতে পারেনি তাই।
-রাইসা চুপ করো তুমি। আনিস সাহেব উনার স্ত্রীকে থামাতে চাইলেন।
– কেন চুপ করবো? উনার তো জানা প্রয়োজন, না হলে শুধু তোমাকে আর মাহির ভাইকে দোষারোপ করবেন উনি।
শুনোন আপনার পরিবারের সাথে কেউ চিট করেনি।আপনার পরিবার সবাই জানতো শুধু আপনি ছাড়া! পরিবারের কথা না শুনলে এমনটাই হয়!
এ কথা শুনে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়।সবাই আমাকে ধোঁকা দিয়েছে!
কোনো রকমে টলতে টলতে আনিসের বাসা থেকে বের হয়ে আসি।
আমার আব্বু – আম্মু, মামণি, মাহির সবাই ঠকিয়েছে আমাকে!.
আনিস, রাইসা ভাবি অনেক ডাকলেন বাসায় নিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু উনাদের সাথে কথা বলতে চাইনি। সাড়া দেইনি

বিয়ে! গন্ডগোল! আনিসের ছুটে আসা, আটকে রাখার নাটক! মাহিরের নাটক করে নিয়ে আসা, আব্বু – আম্মুর, মামা – ফুপ্পির সব সাজানো ছিলো? চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ভেবেছিলাম আমাদের সম্পর্কটা একদিন ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না সেটা আর কখনও সম্ভব না। যখন নিজের পরিবার ধোঁকা দেয়, কিছু বলার থাকে না।
এমন সময় মাহিরের ফোন আসে। নিশ্চয়ই আনিস সাথে সাথেই মাহিরকে সব জানিয়ে দিয়েছে।
ফোন রিসিভ করার প্রয়োজন মনে করলাম না।

হেঁটেই চলছি। কোথা থেকে কোথায় আসছি নিজেও জানিনা।চোখের পানি তো বাঁধ মানেনি, এখনো ঝরছে।কাঁদতে চাইছিনা কিন্তু তবুও পানি ঝরছে কেন!!
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে । ক্লান্তিতে এখন হাত পা ভেঙে আসছে। হাঁটতে পারছিনা আর। এতো সময় বুঝতে পারিনি,কিন্তু এখন ক্লান্তি চেপে বসেছে। কি করবো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কি করা উচিত আমার?
মাহিরের বাসায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।আমাদের বাসায় তো যাবোই না! কোথায় যাবো? যে বাবা – মা এতো নাটক করতে পারে মেয়ের জীবন নিয়ে তাদের কাছে কিছুতেই যাবো না।

মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি ৩০০ মিসড কল!
ফোনের চার্জ ১৫% চলে আসছে। মাহির,আব্বু- আম্মু, মামণি, নীরা,ফুপ্পি, তানহা… একজনের পর একজন কল করেই গেছে!
অনেক গুলো মেসেজ মাহিরের নাম্বার থেকে। মেলেজগুলো পড়তে ইচ্ছে করছে না।
মেসেঞ্জারে নীরা, তানহার কল,মেসেজ।
আবার মাহির ফোন দিলো। রিসিভ করিনি কাটতেও ইচ্ছে করছে না, এটাও মিসড কল হলো।
ফেসবুক আইডিটা ডিএক্টিভেট করে মেসেঞ্জারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সব আনইন্সটল করে দিলাম।
একটা ফোন করে মোবাইলটা অফ করে একটা গাড়ি ঠিক করলাম স্টেশন পর্যন্ত।

ঘন্টা তিনেক পরে স্টেশনে এসে পৌছালাম। যেহেতু আগে টিকিট কাটিনি তাই অনেক রিকুয়েষ্ট করে দ্বিগুণ টাকায় ‘উপবন এক্সপ্রেস’ এর একটা টিকিট কিনলাম। এতোক্ষনে পেটে খিদে জানান দিচ্ছে। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। এক বোতল পানি কিনে পুরোটা খেয়ে ফেলি।
তারপর আরও এক বোতল পানি কিনে স্টেশনে অপেক্ষা করি।
ট্রেন ছাড়ার কথা ৯ঃ৫০ এ কিন্ত সাড়ে ১০ টায় ট্রেন স্টেশন ছাড়ে।
ঢাকা টু সিলেট। ট্রেনে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারিনা।ক্লান্তিতে চোখ এমনিতেই বন্ধ আসলো। ঘুম ভাঙলো সাড়ে তিনটার দিকে। আর ঘুম আসছেনা। আমাকে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না।
প্রায় ভোর ছয়টায় এসে সিলেট পৌছাই।ট্রেন থেকে নেমে দেখি সুমন ভাই দাঁড়িয়ে আছেন।
সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময়ের পর বললাম – এতো সকালে আপনি কেন কষ্ট করে এলেন? আমি নিজেই চলে যেতে পারতাম।
– এটা একটা কথা বললে? আমি থাকতে তুমি একা যাবে? তাহলে যে আমার ঘরে ভাত জুটবে না! হাহাহা..
উনার কথায় আমিও মুচকি হাসলাম।
স্টেশন থেকে ঘন্টাখানেক লাগলো উনাদের বাংলোয় যেতে।
আমাকে দেখে তরী দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে।

তরী আমার স্কুললাইফের বেস্ট ফ্রেন্ড। ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত এক সাথে পড়েছি।কি গভীর বন্ধুত্ব ছিলো। S.S.C পরিক্ষার পর থেকে দুজন আলাদা হয়ে যাই।তরীর বাবা মারা যান তখন, তারপর তারা দেশের বাড়ি রংপুরে চলে যায়। তবে দেখা না হলেও মাঝেমধ্যে যোগাযোগ হতো। তরীর বিয়ে হয়েছে বছর চারেক আগে। সুমন ভাই, তরীর হাজবেন্ড খুবই মিশুক মানুষ। অনেক বার ফোনে কথা হয়েছে। ছবিতে দেখলেও আজ প্রথম সামনাসামনি দেখা।সুমন ভাই সিলেটের একটা চা বাগানের ম্যানেজার।
আমি কোথায় যাবো কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। যেখানেই যাই তারা আমার খোঁজ পেয়ে যাবে। তখন তরীর কথা মনে পড়লো। দীর্ঘদিন দেখা হয়না। তরীর কাছে আসতে পারি সেটা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। তাছাড়া তরী কোথায় আছে সেটাও তারা জানে না। তাই কাল তরীকে ফোন দিয়েই মোবাইল অফ করে দিয়েছি।
তরী এতো বছর পর আমাকে পেয়ে খুশিতে কান্না শুরু করে!

– তোর এই ছিচকাঁদুনে স্বভাব আর গেলো না!
– এবার বুঝো কুহু কিভাবে সংসার করছি।চোখের পানিতে আমার সংসার অর্ধেক ভেসে যায়!
সুমন ভাইয়ের কথা শুনে বেশ মজা পেলাম। উনি আসলেই আমুদে লোক!
তরী চোখ মুছে আমাকে ভেতরে নিয়ে যায়!
– সাথে জামা-কাপড় কিছুই আনিস নি?!!
আমি কিছু বলার আগেই কি ভেবে তরী বললো -সমস্যা নেই,আমার শাড়ি পড়বি।
ফ্রেশ হয়ে তরীর শাড়ি পড়েছি।তারপর সবাই এক সাথে নাস্তা করতে বসলাম।
– নাস্তা করে তুই কিছুক্ষণ রেস্ট নে।সারারাত নিশ্চয়ই ঘুম হয়নি,জার্নিতে কি অবস্থা হয়েছে।
নাস্তা করে বিছানায় পিঠ লাগাতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাই। আড়াইটায় দিকে তরী ডেকে ঘুম ভাঙায় লাঞ্চ করার জন্য। লাঞ্চ করে আরও ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নিলাম।
ঘুম থেকে উঠে বিকাকবেলা। এখন মাথা ধরা অনেকটা কমেছে।

বিকেলে বাংলো আর তার আশপাশটা তরী ঘুরিয়ে দেখালো।সত্যিই চমৎকার যায়গা! এতো শান্ত! সবুজ পরিবেশ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। চা বাগানটা যেন সবুজ কার্পেট বিছানো। জায়গাটা অসম্ভব ভালো লেগেছে আমার। কাল থেকে যা ধকল গেছে তাতে মনে হচ্ছে এখন একটু বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। বাসায় কে কি করছে কে জানে! নিশ্চয়ই আমাকে অনেক খুঁজাখুঁজি করছে সবাই।
মাহির! এবার বুঝবে মাহির। এতো দিন খুব জ্বালিয়েছে।সব সহ্য করেছি কিন্তু সবাই মিলে যে কাজ টা করলো তা সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে।
এতো বড় ধোঁকা! সবাই জানতো অথচ আমার সাথে কি নিখুঁত অভিনয় করে গেছে!
বিয়ের ৭-৮ মাস হয়ে গেছে অথচ কাল যদি আনিসের সাথে দেখা না হতো তাহলে সারাজীবন এই মিথ্যেটাকেই বিশ্বাস করে যেতাম।।

– কিরে কোথায় ডুবে আছিস?
তরীর কথায় আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো।
– কোথাও না।তোদের কি খবর বল।
– আমরা ভালোই আছি। তুই এসেছিস খুব ভালো হয়েছে। সামনের সপ্তাহে কেয়া আসবে ওর কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। কয়েকদিন থাকবে, সিলেট ঘুরে দেখবে। সবাই মিলে অনেক মজা হবে।
– কেয়া এখন কি করে?
– ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ৩য় বর্ষ, ঢাকা ভার্সিটিতে।
– বাহ! খুব ভালো।
আমরা আরও কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে বাংলোয় ফিরে আসি।
রাতে আমার ঘুম আসছে না। কি করা যায় তা-ই ভাবছি। তরীদের এখানে কিছুদিন না হয় থাকবো,কিন্ত পরে কোথায় যাবো? এভাবে বসে থাকলে তো চলবে না। একটা জব খুঁজতে হবে। ঢাকার বাইরে, সিলেটে হলে আরও ভালো।
মোবাইল টা হাতে নিয়ে ফাইলগুলো চেক করে দেখলাম সিভিসহ সব কিছুর কপি আছে।
অনলাইনে কতগুলো পার্ট-টাইম চাকরিসহ অনেক গুলো এপ্লাই করে ফেললাম।যা কিছু একটা জব খুব তাড়াতাড়ি দরকার। এখানে বেশি থাকাও ভালো দেখায় না।
চলবে..

#বধুয়া
# পর্ব-১৪

চা বাগানে খুব সুন্দর জায়গা তবুও আমার মনে যে ঝড় বইছে সেটা সব কিছুকেই মলিন করে দিচ্ছে। তরী আর সুমন ভাই দুজনেই বুদ্ধিমান মানুষ। তারা আমাকে বাসার কথা তেমন কিছুই জিজ্ঞেস করেনি।কারণ তারা অনুমান প্রথমেই করেছিলো যে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে, তাই এভাবে এখানে এসেছি। কিছু জিজ্ঞেস করে বিব্রত করেনি আমাকে।
৪-৫ দিন পরে তরী আমায় জিজ্ঞেস করে –
কুহু তোর কি হয়েছে বলতো?তুই ভালো নেই সেটা বুঝতে কাউকে তোর জীবনী পড়তে হবে না, মুখ দেখেই বলে দিবে। আমি তো তোর প্রাণের বান্ধবী ছিলাম আমাকে খুলে বল কি হয়েছে। তুই যে এখানে সেটা তোর বাসায় যে কেউ জানে না সেটা বুঝেছি।
আমি তরীকে সব খুলে বললাম। তরী বললো – দেখ নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে এমনটা করার।
কারণ যাইহোক তোর কি মনে হয় না তুই নিজের জেদ কে বড় করে দেখেছিস? মাহির ভাই যদি কোনো অন্যায় করেও থাকে সেটার জন্য তার শাস্তি তুই অনেক বেশিই দিয়েছিস।
– আমি শেষ পর্যন্ত সব মানিয়ে নিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সবাই যা করলো সেটা মানা সম্ভব না।
– আচ্ছা, বাদ দে।যা হবার হবে। এখন এখানে এসে মন খারাপ করে থাকা চলবে না।বুঝছিস?

পরদিন তরীর বোন কেয়া ৬-৭ জন বন্ধু- বান্ধব নিয়ে আসে।আমাকে দেখে কেয়ার আনন্দ আরও বেড়ে গেছে। কেয়ার বন্ধুরাও ভীষণ মিশুক। দুদিনেই যেন কত আপন আপন হয়ে গেছে। দুই- তিন দিন অনেক ঘুরাঘুরি করলো। আমাকেও অনেক জোর করে যাবার জন্য। বেশি দূরে কোথাও হলে নানা অযুহাত দেখিয়ে যাইনি।দূরত্ব কম হলে ২-১ বার ঘুরতে গিয়েছি।
একদিন সকালে তারা ঠিক করে আজ নাকি কোথাও যাবে না। শুধু বাগানে ঘুরবে আর রেস্ট নিবে। আমি এখানে আসার পর থেকে প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হই। আমাকে বের হতে দেখে তারাও যোগ দিলো আমার সাথে। সবাই মিলে ঘুরতে ভালোই লেগেছে।

বাংলোয় ফিরে দেখি তরী ব্যস্ত। একজন গেস্ট আসছে তাকে নাকি বিশেষ আপ্যায়ন করতে হবে!
– তোর গেস্ট কি ভি. আই.পি নাকি?
– ভি.আই.পি তো বটেই!
– তা গেস্ট টা কে?
– সুমনের এক বন্ধু! আজই প্রথম এখানে এসেছে। কি একটা বিশেষ কাজে।
– অহহ! তাই বল।আমি আরও ভাবলাম কোন মন্ত্রী – মিনিস্টার!
– আয় আমার সঙ্গে।
তরীর সাথে গেলাম।ড্রয়িং রুমে সুমন ভাই আর উনার বন্ধু বসে আছেন। কেয়ার বন্ধুরা সবাই বাংলোর বাইরে ছায়ায় আড্ডা দিচ্ছে।
সুমন ভাই আমাকে দেখেই বললেন আসো আসো।আমার বন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।

সুমন ভাইয়ের বন্ধুকে সালাম দিয়ে সামনে গেলাম।উনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এই দুনিয়ায় কি এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আমি দু-দন্ড শান্তিতে থাকতে পারবো!?
– কুহু?
– তুমি?
– ওকে তুমি চেনো নাকি? সুমন ভাই জিজ্ঞেস করলেন।
– তরী! শেষ পর্যন্ত তুই ও নাটক করলি আমার সাথে?
– কি বলছিস এসব? কিসের নাটক করলাম?
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
– তরী, উনি হচ্ছে মাহির ভাই আর কুহু, তরী আমাকে সব বলেছে।তবে উনি যে আসবে তরী সত্যিই জানে না।
– মাহির ভাই, আপনাকে আমি চিনতে পারিনি।সেই কত বছর আগে দেখেছিলাম স্কুলে পড়ার সময় তাই, চিনতে পারিনি।কিছু মনে করবেন না।
– আরে ব্যপার না! এতো বছরে কি আর আগের মতো আছি? তুমিও কত বদলে গেছো।চেনার কথাও নয়।
আমি চলে যাচ্ছিলাম, তরী আমার হাত ধরে ফেলে- কোথাও যাবি না,বস এখানে।
জোর করে বসিয়ে দেয় নিজেও বসে।
– শুনো কুহু, তোমাদের মধ্যে যাই ঘটুক, এখন যেহেতু মাহির ভাই এসেছেন আর কেয়ার বন্ধুরাও আছে তাই বলছিলাম যে, ওদের সামনে এমন ভাবে থেকো না যাতে ওরাও বুঝতে পারে তোমাদের মধ্যে ঝামেলা চলছে।ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সামনে এটা ভালো দেখাবে না।
– সুমন ঠিক কথাই বলেছে। শুধু শুধু ওদেরকে এসব বুঝতে দেয়ার দরকার নেই। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নিজেদের মধ্যেই রাখা ভালো।
তরীও সুর মেলালো।

আমি আর কোনো কথাই বললাম না। কোথাও গিয়েও শান্তি নেই? এখানেও উনাকে হাজির হতে হবে? রাগে দুঃখে দুচোখ যেদিকে যায় চলে যেতে ইচ্ছে করছে। তরীকে জানানোই ঠিক হয়নি।
আমি আমার রুমে চলে আসি।একটু পরে মাহির ও আসলো।
কি অবস্থা হয়েছিলো চোখমুখের! এই সাতদিনে মনে হয় আরও শুকিয়ে গেছে। মলিন হয়ে গেছে চেহারা। হোক! আমি এতো কিছু দেখি না!
আমার কি?
– তুই এভাবে চলে আসলি? একটা বার ভাবলিনা তোর জন্য প্রতিটি মানুষের খাওয়াদাওয়া,ঘুম হারাম হয়ে যাবে। এতো রাগ তোর? সব রাগ আমার উপরেই ঝাড়িস এবারো ঝাড়তে পারতি।
সব কিছুর জন্যেই তো আমি দায়ী।
– কেন এসেছো এখানে? তুমি আসলেই আমি ফিরে যাবো ভাবলে কি করে?
– যাবি না?
– না।কোথায় যাবো? যেখানে প্রত্যেকটা মানুষ আমাকে ঠকিয়েছে?
– আচ্ছা ঠিক আছে। তোকে যেতে হবে না। তুই এখানে আছিস এটা তো জানতে পারলাম এতেই চলবে। আমিও তো চলে আসছি,আমিও কোথাও
যাচ্ছি না।
– শান্তিতে মরতেও দিবে না? অসহ্য লোক একটা!
আমি হনহন করে বেরিয়ে আসি।।

এদিকে কেয়া আর তার বন্ধুরা মাহিরকে পেয়ে যেন আরও জমে উঠেছে! মাহিরও বেশ আমুদে আছে। সারাদিন বাগানে ঘুরাঘুরি করলো। সবকটা মাহিরের ভক্ত হয়ে গেছে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই।
কেয়া এসে বললো – কুহু আপু, আজকে ভাইয়ার অনারে একটা পার্টি হবে সন্ধ্যায়।
তরীকে বললো – আপু তোর রান্না করতে হবে না রাতে। সব কিছু আমরাই করবো।
তরী বললো -যাক! আজকে রান্নার ভেজাল থেকে মুক্তি পেলাম!
সন্ধ্যায় তো বিশাল আয়োজন করে ফেলে। সবাই মিলে হৈচৈ করে রান্না করলো।
তারপর বারান্দায় বসে সবাই ডিনার করলাম। ডিনারের পর বাংলোর বাইরে আড্ডা। মাহির বলে উঠলো
– জমছে না!
– কি জমছে না?তরী জিজ্ঞেস করলো।
– চা বাগানে এসে রাতে খাবার পর এককাপ চা না খেলে জমবে কিভাবে? তার উপর এতো সুন্দর জোছনা!
মাহির এ কথা বলার পর সুমন ভাই বললেন – একদম পারফেক্ট হবে যদি এক কাপ চা মিলে যায় তবে।
আমি আর তরী চা করতে যাচ্ছি।
কেয়া বললো – আমিও খাবো।
কেয়ার বান্ধবী দোলন বললো – আমিও
তখন সবাই বলছে – আমিও খাবো, আমিও
– আচ্ছা, আচ্ছা সবার জন্য নিয়ে আসবো।

আমি আর তরী চা করে নিয়ে গেলাম। ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলতে চেয়েছিলো কিন্তু এই সুন্দর পরিবেশের সাথে অন্য কিছু ডিজার্ভ করছে। তাই ঠিক হলো গানের কলি খেলবে।
কিছু সময় খেলা চলে। মাহিরও কয়েক কলি গাইলো তারপর সবাই মাহিরকে ধরে গান শুনাতে। মাহির অনেক সুন্দর গান করে।সবার অনুরোধে মাহির গান ধরলো।

“বেদনার কলি তুমি দাও ভালবেসে বধু।
ফুল ফোটানোর ছলে আমি ভরে দেবো মধু
সারা মন কেন তুমি চোখে সাজালে
কত কি রয়েছে লেখা কাজলে কাজলে।।

জনম সফল হবে বধুয়ার ঘরে আজ
শরমেরও আড়ালেতে দেখা যাবে ফুলসাজ
নিশিরাতে বিরহেরও বাঁশি ওরে কে বাজায়
ভালবেসে কেন বধু আজ শুধু কেঁদে যায়
সেধে সেধে কেন তুমি মরণও নিলে
কত কি রয়েছে লেখা কাজলে কাজলে।।
নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে
কত কি রয়েছে লেখা কাজলে কাজলে।”

মাহিরের গানে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে গেছে আমার। আমি বারান্দায় বসেছিলাম,সেখানে আর বসে থাকতে পারিনি, চলে আসি। মাহিরের প্রতি জমে থাকা একটা অভিমান ধীরে ধীরে ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। ও কি কখন বুঝেনি আমাকে? নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছি সবসময়। যত কাছে আসতে চেয়েছে আমি ততটা বিরক্ত হয়েছি।
আমার শৈশব, কৈশোর সবটা জুড়ে একমাত্র মাহির ছিলো। সে আমাকে জ্বালাতন করতো,আমি বিরক্ত হতাম। কিন্তু না করলে হাজার গুণ বেশি কষ্ট পেতাম। কৈশোরে প্রথম যার প্রেমে পড়েছিলাম সে- মাহিরই।
সেই আমি কেন নিজেই এক দেয়াল তৈরি করে রেখেছি তা কি মাহিরের অজানা?.
.. না অজানা নয়!
সে ভুলের জন্য অনেক বার ক্ষমা চেয়েছে কিন্তু আমি জেদ পুষে গেছি।

চলবে…

আজকের মধ্যে বাকি কয়েকটা পার্ট দিতে চাইছি।
ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে পরে পোস্ট করতে সমস্যা হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here