#পাথরের_মৃত্যু
পর্ব-১
লেখক ইকরাম চৌধুরী মারা গেল সকালবেলা। কেন যেন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার। ভেবেছিল উঠে একটু জলদি লিখতে বসবেন৷ কিছুক্ষণ বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করি ডাইনিং এর দিকে গেলেন পানি খেতে। হঠাৎ মনে হলো সে ছাড়াও বাড়িতে অন্য কেউ আছে। অথচ অন্য কেউ থাকার কথা নয়৷
বড় বাড়িটাতে সে প্রায় বছরখানেক হলো একা থাকে। কখনো ভয়টয় পায়নি। এই মাত্র কিছুদিন হলো অদ্ভূত কিছু অভিজ্ঞতা হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে বাড়িতে সে ছাড়াও অন্য কেউ আছে। বাথরুমে ঢুকলে মনে হয় সদ্য কেউ গোসল করে গেছে। তার মৃতা স্ত্রী কথার গায়ের গন্ধ ছড়িয়ে থাকে ঘরময়। বিছানায় শুলে মনে হয় কথা তার পাশে শুয়ে আছে৷ মাঝেমধ্যে গভীর রাতে ডাইনিং এ কারো হাঁটার শব্দ শোনা যায়। এক রাতে তো স্পষ্ট শুনল, কেউ একজন জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালছে!
ভূতে বিশ্বাস কোনো কালেই ছিল না ইকারামের। তাই সে এসব লক্ষণ দেখে প্রথমেই যায় সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে৷ সাইকিয়াট্রিস্টটা ভালো। যে ডাক্তারের কাছে সে সবসময় যায় তিনিই এনার ঠিকানা দিয়েছেন৷
সাইকিয়াট্রিস্টকে সব খুলে বলার পর তিনি বলেছেন, এসবই হচ্ছে একা থাকার ফলে। তার উচিত আরেকটা বিয়ে করা।
আরেকটা বিয়ের কথা কয়েকদিন থেকে ইকরাম নিজেও ভাবছিল। কিন্তু মনমতো মেয়ে পাওয়াও একটা ঝক্কি।
ডাক্তার কিছু ঔষধ দিয়েছিলেন, সেসব খেয়ে কয়েকদিন কিছু দেখছে না সে৷ ঘুমও হচ্ছে বেশ ভালো। কিন্তু আজ এই দিনের আলোতে আবার কারো উপস্থিতি অস্থির করে তুলল তাকে।
জোর গলায় ডাকল সে, “কে? কে ওখানে?”
কেউ জবাব দিল না৷ সে গ্লাসে পানি ঢালল৷ একটা চুমুক দিতে না দিতেই কে যেন বসার ঘরের কাছ থেকে হেসে উঠল। মেয়েলি কন্ঠের হাসির মতো। আবার পুরুষের কন্ঠও হতে পারে। সব গুলিয়ে যাচ্ছে তার। প্রচন্ড অস্থির লাগছে। তার হৃদযন্ত্র খুব একটা সবল নয়৷ একবার হার্ট অ্যাটাকের অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। নিজেকে বোঝাল সে, অস্থির হওয়া যাবে না৷ সব তোমার মনের ভুল। বি কুল!
কিন্তু অস্থিরতা বাড়তে লাগল। মৃত্যুর আগে বোধহয় মানুষ টের পেয়ে যায়৷
পায়ে পায়ে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল সে৷ কোথায় কে? কেউ তো নেই৷ টেলিভিশন চলছে৷ স্বস্তি কেন যেন এসেও এলো না। টেলিভিশন কে চালু করল? সে তো গত কয়েকদিন এই যন্ত্রের ধারেকাছেও আসেনি৷ তবে কি কাজের মেয়েটা? কিন্তু সে তো গতকাল দুপুরে কাজ করে চলে গেছে৷ টেলিভিশন এতক্ষণ ধরে চালু রয়েছে আর সে বুঝতে পারল না?
আবার মনে হলো কেউ আছে আশেপাশে। ঘুরে তাকাতে গেল ইকরাম৷ কিন্তু পারল না৷ মাথায় প্রচন্ড এক বাড়ি গেল। তীব্র ব্যথায় মগজের চিন্তাশক্তি হারিয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। যখন জ্ঞান হলো, তখন সে মেঝেতে পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। রক্ত! এই জিনিস ভীষণ ভয় পায় সে। তার শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে একটা পুকুর তৈরি হয়েছে সাদা টাইলসের মেঝেতে। চোখের সামনে মৃতা স্ত্রীর মুখটা ভেসে উঠল।
***
ইন্সপেক্টর রুদ্র কায়সারের কপালে তিনটে ভাজ। সে তাকিয়ে আছে ইকরাম চৌধুরীর বুকশেলফের দিকে। সাব ইন্সপেক্টর নাজমুলের মাথায় কিছুই ঢুকছে না৷ এরকম সুরক্ষিত একটা বাড়িতে কেউ কেমন করে ঢুকে খুন করে চলে যেতে পারে! তার ওপর সবগুলো দরজা জানালা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল!
সে রুদ্রর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, কিছু বুঝলেন?”
রুদ্র চোখ না তুলেই বলল, “হুম।”
“কী বুঝলেন স্যার?”
“এটাই যে খুনটা কী দিয়ে করা হয়েছে।”
“কী দিয়ে স্যার?”
রুদ্র মুচকি হেসে বলল, “ভারী কোনো দন্ড জাতীয় জিনিস দিয়ে।”
“কিন্তু সেটা তো আমিও বুঝলাম।”
“তাহলে কোনটা বোঝোনি?”
“এইযে খুনী ঢুকল কিভাবে?”
“কেন, দরজা দিয়ে।”
“স্যার হেয়ালি করেন কেন?”
“দরজাটা ভালো করে দেখো। আধুনিক লক সিস্টেম৷ ভেতর থেকে আটকানো থাকলেও চাবি থাকলে বাইরে থেকে খোলা যায়। তবে ছিটকিনি লাগানো থাকলে সেটা সম্ভব না। এই বাড়ির ছিটকিনি লাগানো ছিল না।”
“তার মানে ডুপ্লিকেট চাবি ছিল?”
“অবশ্যই। সেটা কোনো এক অসাবধানতায় ইকরাম চৌধুরীর কাছ থেকেই নিয়ে করা হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।”
“তাই তো স্যার! এটা মাথায় আসা উচিত ছিল।”
“কাজের মেয়েটার কী হলো?”
“অফিসে পাঠিয়ে দিলাম স্যার।”
“হুম। আমি গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করব। এই একটা মানুষেরই এক্সেস ছিল এই বাড়িতে। অনেক তথ্য জানা যাবে তার কাছ থেকে।”
বডি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ফরেনসিকে। মেঝেতে রক্ত শুকিয়ে আসছে। উৎকট গন্ধ বের হচ্ছে সেখান থেকে। কয়েকটা নীল মাছি ঘোরাঘুরি করছে।
“এই জানালাগুলো লাগিয়ে দাও তো!”
জানালা খোলা হয়েছিল তারা আসার পর। একজন জানালা লাগাতে শুরু করল৷ ফটোগ্রাফার এখনো ঘরের নানান জায়গার ছবি তুলছে ৷ প্রথমবারের দেখায় কিছু অস্বাভাবিক বিষয় চোখে পড়েছে। একবার বাড়িটা ভালো করে তল্লাশি করতে হবে।
***
“স্যার, মেয়েদের চুল!”
“নিয়ে নাও। কাজের মেয়েটার হতে পারে, আবার কোনো ছেলেরও হতে পারে। ছেলেদের শখ করে বড় চুল রাখা তো আর নতুন ফ্যাশন নয়।”
নাজমুল কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারা কয়েক রকমের হাতের ছাপ পেয়েছে। একটা লিপস্টিক পেয়েছে যেটা দেখে মনে হয় ব্যবহার হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। খাটের নিচ থেকে পাওয়া গেল অনেকগুলো ব্যবহার করা জন্মনিয়ন্ত্রক ক্যাপ।
নাজমুল বলল, “স্যার ওই শু*** দারোয়ান মিথ্যা কথা বলছে। এই বাড়িতে একটা বা একাধিক মেয়ে আসতো শিওর।”
“যাও তো, ডেকে নিয়ে এসো ওটাকে।” বলল রুদ্র।
দারোয়ানকে একপ্রকার টেনে হিঁচরে নিয়ে এলো নাজমুল। দারোয়ানের নাম হোসেন আলী। বয়স চল্লিশের ওপাড়৷ চাপা ভাঙা চিমসে চেহারার লোক। তার চোখেমুখে তীব্র আতঙ্ক জমে আছে।
রুদ্র প্রশ্ন করল, “সত্যি করে বল তো, ইকরাম চৌধুরী বাড়িতে মেয়ে নিয়ে আসত? তার কোনো প্রেমিকা ছিল?”
হোসেন আলী হাত জোড় করে বলল, “না স্যার। হেয় তো একলাই থাকত। খালি সুমা আইতো দশটার দিকে কাম করতে। আর একটা মাছিও আইতো না স্যারের লগে দেহা করতে৷ সত্যি স্যার, বিশ্বাস করেন।”
“বইয়ের কাজেও কেউ আসত না?”
“না স্যার কেউ না। স্যারে নিজেই যাইত কারো লগে কাম থাকলে। বাড়িত কেউ আইতো না।”
নাজমুল হোসেন আলীর কলার চেপে ধরে তাকে দেয়ালের সাথে ঠেসে বলল, “মিথ্যা কথা কইলে চৌদ্দ শিকের ভিতরে পারমানেন্টলি ঢুকায় দিমু৷ জীবনে আর দিনের আলো দেখা লাগব না৷ কিসের আশায় মিথ্যা কথা কইতাছোছ? তোর স্যার তো মইরা ভূত। সত্যি কথা ক!”
হোসেন আলী কাঁপতে লাগল। তার চেহারা দেখে রুদ্রর মনে হলো লোকটা সত্যি কথাই বলছে। আচ্ছা ধরা যাক লোকটা সত্যি বলছে। তাহলে প্রোটেকশনের প্যাকেট কেন থাকবে? মেয়ে বলতে ওই কাজের মেয়েটা কী? কিন্তু ওই মেয়েকে দেখে নিতান্তই নিরীহ একটা মেয়ে মনে হয়েছে। অবশ্য বলা যায় না, ষোলো সতেরো বয়সের কিশোরী, আর এই লেখকও তো বিপত্নীক ছিলেন, পদস্খলন হতে কতক্ষণ?
মেয়েটাকে তাহলে আর হালকাভাবে নেয়া যাবে না৷ আর দারোয়ানটাকেও কয়েকদিন হাজতে রাখতে হবে। ব্যাটা সব সত্যি বলছে তার কী গ্যারেন্টি?
সেদিন ওই বাড়িতেই বিকেল পর্যন্ত কেটে গেল। নাজমুল ভেবেছিল কেসটা জলের মতো সহজ৷ কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে সব জটিল মনে হচ্ছে। ভিক্টিমের চরিত্রটাই সবচেয়ে বড় রহস্য!
***
সেদিন আর কাজের মেয়ে সুমার সাথে দেখা করার সুযোগ হলো না রুদ্রর৷ আরও দুয়েকটা কেসের জরুরি ফাইল দেখে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল সে। ক্লান্ত লাগছে। মাথার ভেতর মৃত লোকটার চেহারা ভেসে আছে। চোখজোড়া খোলা। তাতে রাজ্যের ভয় আর আতঙ্ক। পুরো মুখে ফুটে আছে মৃত্যুযন্ত্রণার চিহ্ন! পুলিশের চাকরি শুরু করার পর থেকে কতশত লাশ দেখতে হয়েছে তাকে! কিন্তু ইকরাম চৌধুরীকে দেখে তার শক্ত নার্ভেও নাড়া লেগেছে। এমন কোনো বিকৃত লাশ ছিল না, তবে কী যেন একটা ছিল সেই মুখে!
রাতে ফেসবুকে ঢুকতেই আজকের গরম খবর নজরে এলো তার। খবরটা আজকের খুন নিয়েই।
হালের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন এই ইকরাম চৌধুরী। তার প্রেমের গল্পের পাগল ছিল গোটা দেশের লোক। বিশেষ করে তার মেয়ে ভক্তের সংখ্যা অগণিত।
রুদ্রের পুরো টাইমলাইন জুড়ে আহাজারি! এত অল্প বয়সে মরে গেল লেখক! দেশ কত বড় প্রতিভা হারাল। স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও একটা কথা ছিল৷ শেষ পর্যন্ত খুন!
বড় বড় নিউজ চ্যানেলের পেজগুলোতে ভর্তি লেখকের মৃত্যু নিয়ে নানা আজগুবি কথাতে। তবে একটা খবর নজর কেড়ে নিল তার। লেখকের মৃত্যুর সাথে যুক্ত খবরটা এখন আলোচনার শীর্ষে পৌঁছে গেছে। অজস্র শেয়ার হচ্ছে!
ইকরাম চৌধুরীর মৃত্যুর ঠিক আগের দিন একটা ছোটোগল্প লিখেছিলেন লেখিকা তায়েবা তারান্নুম। গল্পে ইকরাম নামের লেখক খুন হয়। আর এই গল্প লেখার পেছনের গল্পটা তার চাইতে বেশি ইন্টারেস্টিং!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু