পাথরের_মৃত্যু পর্ব-১০

0
426

#পাথরের_মৃত্যু
পর্ব-১০

তায়েবা ফেসবুকে বেশ একটিভ ছিল একটা সময়। তখন সে দেশ সম্পর্কে অনেক লেখালেখি করেছে। দেশের নতুন নতুন ইস্যুতে যৌক্তিক আলোচনা সমালোচনা করেছে। আর যেহেতু সে দেশে থাকত না তাই সহজেই এসব লিখতে পেরেছে যেগুলো দেশে থাকা মানুষ লিখতে ভয় পায়। তবে তার লেখাগুলো তুলনামূলক কম মানুষের কাছে পৌঁছেছে। তাই মেয়েটা আলোচনায় আসেনি কখনো। এখন বোঝা গেল দেশে না থেকেও, কখনো বই না প্রকাশ করেও লেখালেখিতে চমৎকার হওয়ার কারণ। লেখার অভ্যাসটা সবসময়ই ছিল তায়েবার।

সে সময় সে কিছু লেখা লিখেছিল যেগুলো রুদ্রকে আকর্ষণ করল। লেখাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লেখাটি-

“আমি কোনো নাম উল্লেখ করব না, তবে খুবই জঘন্য একটা ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করব। আমি সদ্যই এক মেয়ের সাথে পরিচিত হয়েছি, যে ঘটনাটির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

খুবই জনপ্রিয় একজন লেখকের কথা বলছি। হয়তো যারা এই পোস্টটি পড়ছেন, তারা সবাই কখনো না কখনো তার অন্তত একটি বই পড়েছেন৷ আপনারা যদি কখনো শোনেন সেই লেখকের চরিত্র অতি জঘন্য তাহলে আপনি বিশ্বাস করবেন? আপনি বিশ্বাস করবেন, বাংলাদেশের মতো একটা জায়গায় বসে সেই লোক তার স্ত্রীর সামনে বাড়িতে প্রেমিকা নিয়ে আসে? স্ত্রীকে অপমান করে, গায়ে হাত তোলে? বাড়িতে সহধর্মিণী থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত যার যাতায়াত পতিতালয়ে? অথচ সেই মানুষটাকে আপনারা মাথায় তুলে রেখেছেন। বোধহয় ভাবছেন লেখকটা কে? আমি বলব না এখনই। পরে বলব। শুধু জেনে রাখুন, আমরা বাইরে থেকে যা দেখি তা বেশিরভাগ সময়েই সত্যি হয় না। ভেতরটা অনেক ফাঁপা থাকে।”

তার কিছুদিন পরের পোস্ট-

“আরও অনেক কিছু জেনেছি। শুধু রিভিল করা বাকি!”

তার কিছুদিন পর-

“একজন অমানুষ (স্যরি ঘৃণা হচ্ছে লেখক বা মানুষ বলতে) কত সহজে একটা ভ্রুণহত্যা করতে পারে! ওই রক্তাক্ত হাত কি কখনো সাফ হওয়া সম্ভব?”

এই শেষ পোস্টটি ভালোই রিচ হয়েছে। তবু ভাইরাল হয়নি, আলোচনায় আসেনি। হতে পারে নাম বলা হয়নি বলে পাবলিক আগ্রহ দেখায়নি। তাছাড়া এসব মারধোর, পরকীয়া, এবোরশন ব্যাপারগুলো এতটা সাধারণ হয়ে গেছে আজকের দিনে যে কাহিনী খুব ইন্টারেস্টিং না হলে এগুলো তেমন লাইমলাইট পায় না।

একটা জিনিস দেখে মুচকি হাসল রুদ্র। জোবায়ের আহমেদের মন্তব্য। শুরুর লেখাটাতে তিনি কমেন্ট করেছেন, “আমি জানি কার কথা বলছেন৷ ইনবক্সে আপনাকে আরও অনেক কিছু জানাতে পারি চাইলে।”

তায়েবা তাতে রিপ্লাই করেছে, “শিওর!”

আর জোবায়ের কী বলেছিল? সে তায়েবাকে চেনে না। হাহ! কী যে আছে এর ভেতর! ধীরে ধীরে খুলছে পথ।

কিন্তু এরপর আর এ ব্যাপারে তায়েবার পোস্ট দেখা গেল না৷ তার কিছুদিন পর সে বাংলাদেশে চলে আসে।

জোবায়েরের ফেসবুক আইডি থেকে ঘাটাঘাটি করে একসময় মনিকার আইডিও বের করে ফেলল রুদ্র। একটা ফুলের ছবি দেয়া প্রোফাইলে। ভেতরে বলতে গেলে কিছুই নেই। এখান থেকে কিছু পাওয়া গেল না তাহলে।

এখন কি তাহলে তায়েবাকে ধরেই এগুতে হবে? আর কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না!

***

পুলিশ অফিসার শওকতের ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙল রুদ্রর৷ শওকত খুশি খুশি গলায় বলল, “পিংকির খুনী ধরা পড়েছে। দেখতে চাইলে চলে আসুন।”

রুদ্র যতদ্রুত সম্ভব তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল।

লোকটা চিমসে ধরণের, চোখে খুনে দৃষ্টি৷ রুদ্র অবাক হয়ে বলল, “এই লোক?”

“হ্যাঁ এই লোক।”

“কিভাবে কী?”

শওকত হেসে বলল, “এই বিচ্ছুর মার খেয়ে তেজপাতা অবস্থা। আমি সব বলছি। আসুন।”

তারা বসল। চা আর গরম সিঙাড়া আসার পর খেতে খেতে শুরু করল শওকত।

“আমার মনে হচ্ছিল এসব কোনো ভাড়াটে খুনীর কাজ। খুব প্রোফেশনালি বুঝে করা হয়েছে৷ সেজন্য ফেউ লাগিয়েছিলাম খবর নিতে। আন্ডারগ্রাউন্ডে আমার ভালো লাইন আছে। সেখান থেকেই ধরলাম এটাকে৷ এর নাম মোফাজ্জল।

এই ব্যাটা ম্যালা টাকা পেয়েছিল খুন করে। ও আবার পিংকির কাস্টোমারও ছিল৷ আনঅফিশিয়াল কাস্টোমার৷ খানিকটা প্রেম প্রেম সম্পর্ক ছিল বলে এটাকে ফ্রিতে সার্ভিস দিত পিংকি। সেজন্য পিংকির মতো বোরকা পরা আর ওর রুমে চলে যাওয়া সহজ হয়েছে।

পিংকি যার সাথে হোটেলে ঢুকেছিল তাকে বলেছিল ওর শরীর ভালো লাগছে না, একটু পর বের হবে। বলে রয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে ছিল বিলাসবহুল ঘরে ফ্রিতে প্রেমিকের সাথে একটু ফুর্তি করবে। সেরকম প্ল্যান করেই মোফাজ্জলকে ডেকেছিল পিংকি। কিন্তু জানত না ভেতরে কাহিনী ঘটছে তার বিপরীতে। সেধে মৃত্যুদূতকে ডেকে আনছে সে।

তারপর যা হওয়ার তাই। মোফাজ্জল পিংকিকে মেরে আবার বোরকা পরে বেরিয়ে গেল। ব্যাটা হালকা পাতলা আছে। বোরকা পরলে ছেলে না মেয়ে ধরা যায় না সহজে।”

রুদ্র এবার আসল প্রশ্ন করল, “কিন্তু কেন?”

“ওইযে টাকা..টাকা পেলে এসব ছোটোলোকের কাছে প্রেমটেম কিছুই না। নিজের বউকেও মারতে বাঁধবে না।”

রুদ্র অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করল, “সেই টাকাটা দিল কে?”

“কেন? আপনাদের ভিক্টিম ইকরাম চৌধুরী। হা হা হা! খুনীর খুন! বুঝতে পারছেন প্যাঁচ?”

“সে কেন এই কাজ করল?”

“এটা তো ভাই বের করা আপনার দায়িত্ব। মোফাজ্জল টাকার বিনিময়ে কাজ করে। ভেতরের খবর রাখতে যায় না। তাই এর পেটে তেমন কথা নেই। টুকটাক যা ছিল বের করে নিয়েছি। এবার আপনি পাত্তা লাগান! অনেকদিন তো হলো, কেস কতদূর?”

রুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “জানি না। জল গড়াতে গড়াতে বোধহয় এবার বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়বে।”

“পড়ুক! আমরা নাহয় জাহাজে করে বেড়াতে যাব রহস্যের সমূদ্রে! হা হা হা! আরে..সব ঠান্ডা হয়ে গেল। নিন নিন..”

শওকতের অফিস থেকে বের হয়ে রুদ্র নাজমুলকে ফোন করল। নাজমুলকে সে সবটাই খুলে বলেছে৷ কিছু কাজ দিয়েছিল তাকে। সেটা হয়েছে কি না তারই খোঁজ নিচ্ছে।

ইকরাম চৌধুরীর বাড়িতে দুবার দুই রকমের চুল পাওয়া গেছে। একটা খুনের দিন মেঝেতে, অন্যটা তোষকের ভেতর সেলাই করা অবস্থায়। সেগুলোরই ল্যাব টেস্ট করানো হচ্ছে।

নাজমুল জানাল, “কোনো চুলের স্যাম্পলই তায়েবার সাথে মেলে না। আবার কাজের মেয়েটার সাথেও না।”

“আর হাতের লেখা?”

“স্যার হাতের লেখাতে একটু গন্ডগোল লাগছে।”

“কী গন্ডগোল?”

“জীবনটা গল্পের চেয়েও রহস্যময়!
– তায়েবা তারান্নুম
এই লেখার সাথে তায়েবার লেখার মিল নেই। এটা লিখেছে ইকরাম চৌধুরী।”

“এটা কীভাবে সম্ভব?”

“জানি না স্যার। এমনকি গৃহদাহ বইয়ের ভেতরের নোটগুলো ইকরামের করা। আর বাইরের ‘ভালোবাসা সুহাসিনীর জন্য’ লেখাটা জোবায়ের আহমেদের।”

“আমার কিছুই মাথায় ঢুকছে না নাজমুল।”

“তারচেয়েও আজব একটা ব্যাপার আছে।”

“বলো।”

“আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারছি না৷ এই বাড়ির অক্সিজেনও আমার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে আসছে। উদ্ধার করো আমাকে। আর আমাদের সন্তানকে। প্লিজ! ও আমাদের মেরে ফেলবে…-এই চিরকুটের লেখাটাও ইকরামের।”

“হোয়াট! ঠিক বলছ তুমি?”

“একদম ঠিক।”

“আর তায়েবার বই থেকে যে চিরকুট পাওয়া গেছে সেটা?”

“সেটা ইকরামেরই লেখা।”

রুদ্র ফোন কেটে দিল। সব নাটের মূল কি এই ইকরাম চৌধুরী? সেই কি সব প্ল্যান করে করেছে? এতকিছু তো পরিকল্পনা মোতাবেক হয় না। তাহলে কি অন্য কোনে ঘাপলা আছে? নাকি ইকরাম চৌধুরী সত্যিই ভীষণ ধূর্ত ছিলেন?

আজ সকালে তায়েবার পোস্টটা যদি ইকরামকে নিয়ে হয় তাহলে লোকটার চরিত্র ফার্স্টক্লাস প্রতারকের চেয়ে কম হবে না।

কিন্তু এত প্ল্যানিং সে করেছে কেন? তার এতে লাভ কোথায়? এমন লোককে কে মারার সাহস করতে পারে?

***

বিকেলে তায়েবার সাথে রুদ্র দেখা করতে গেল।

তায়েবা প্রথম দেখাতেই একটু হেসে বলল, “একি! আপনি এত চুপসে গেছেন কেন?”

“মানে?”

“মনে হচ্ছে খুব মন খারাপ? মাথায় প্রচুর চিন্তা।”

রুদ্র গলে গেলেও গড়িয়ে গেল না। একটু শক্ত হয়ে বলল, “আমার চিন্তা কমাতে সাহায্য করতে পারেন ম্যাডাম। আমাকে বিভ্রান্ত করবেন না প্লিজ। যেটা জিজ্ঞেস করব সত্যিটা বলবেন।”

রুদ্র নিজের মোবাইল থেকে তায়েবার সেই পোস্টগুলোর স্ক্রিনশট দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে এই লেখক?”

তায়েবা খুব স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিল, “ইকরাম চৌধুরী।”

“ঘটনা আপনি কার কাছ থেকে জানলেন?”

“তনয়া আফরিনের কাছ থেকে। গতকালই তো জিজ্ঞেস করলেন তার কথা।”

“আর এইযে জোবায়ের আহমেদের কমেন্ট? আপনি কি তাহলে গতকাল মিথ্যে বলেছেন যে তাকে চেনেন না?”

“জি। আরও অনেক কিছুই মিথ্যে বলেছি।”

“কী কী?”

“সব বলব। আপনাকে বলার সময় হয়েছে।”

“কী বলবেন বলে ফেলুন।”

“আজ নয় রুদ্র সাহেব। আগামীকাল। আগামীকাল এই সময়ে এখানে চলে আসবেন। সব জানাব আপনাকে।”

“কেন, আজ কী সমস্যা?”

“না আজ কিছু জানানো যাবে না৷ তাছাড়া আপনি ডিউটিতে নেই এখন৷ বাবার কাছে সব শুনেছি। আপনি চাইলেও আমাকে জোর করতে পারেন না।”

রুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে! দেখা হবে কাল।”

তায়েবা সুন্দর করে হাসল। রুদ্র পাত্তা দিল না। আজ তায়েবার হাসিটাও ভালো লাগছে না। কী হবে কাল?

এদিকে মিডিয়া সব জেনে গেছে। ইকরাম চৌধুরীর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ফাঁস হয়ে গেছে। কেসের এখনো সুরাহা হলো না!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here