পাথরের_মৃত্যু পর্ব-২

0
337

#পাথরের_মৃত্যু
পর্ব-২

গতদিনের ঘটনা……

বইমেলার রমরমে পরিবেশ। লেখক পাঠকের সমাবেশ অনেকদিন পর জমে উঠেছে৷ লেখকদের আড্ডায় আছেন নবীন পুরাতন অনেক লেখক। প্রতি বছর বেস্টসেলার হওয়া লেখক ইকরাম চৌধুরী এবার একটু পিছিয়ে পড়েছেন৷ অবিশ্বাস্যভাবে তাকে ছাড়িয়ে গেছেন একজন নারী লেখক যার প্রথম বই এবার বাজারে এসেছে। প্রথম তীরেই লক্ষ্যভেদ বলা যায়। বিশাল সংখ্যক পাঠক বইটিকে পছন্দ করেছে৷ মেলার মাত্র পনেরো দিন যেতে না যেতে বইটার চতুর্থ এডিশন বের হয়ে গেছে। একেবারে রমরমা অবস্থা। আজ মেলা প্রাঙ্গণে সেই লেখিকা তায়েবা তারান্নুম স্বয়ং উপস্থিত হয়েছেন৷ উপস্থিত আছেন আরও লেখক লেখিকারা। অন্যরা ভেতরে ভেতরে ঈর্ষায় জ্বলে গেলেও বাইরে কিছুই প্রকাশ করছেন না। হাসিমুখে তার সাথে গল্প করে যাচ্ছেন। আর এটাও স্বীকার করতেই হবে, তার উপন্যাসের বইটাও ছিল অসাধারণ!

অনেকে তায়েবাকে নানা ধরণের প্রশ্ন করছেন। বিভিন্ন ফেসবুক লাইভ বা ইন্টারভিউ এর সুবাদে প্রায় সব লেখকদের সম্পর্কে সবার জানা। কিন্তু তায়েবা বলতে গেলে অধরাই। তার নামটা পর্যন্ত কেউ মেলার আগে জানত না। নানা ধরনের প্রশ্ন আসছে। কোনোটা সাধারণ, কোনোটা ইঙ্গিতে কটাক্ষ করে।

“কবে থেকে লেখালেখি শুরু করলেন?”

“এর আগে কোথায় লিখতেন?”

“পত্র-পত্রিকায় কখনো আপনার লেখা দেখিনি মনে হয়?”

“আপনার পরিবারের কেউ এই লাইনে আছে নাকি?”

“আপনার এত দ্রুত উপরতলায় উঠে যাওয়ার রহস্য কী?”

কারো প্রশ্ন আবার এলো সরাসরি, “যে সাফল্য পেয়েছেন, সেটা ধরে রাখতে পারবেন তো?”

তায়েবা সবার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে যথেষ্ট বিনয়ের সাথে হাসিমুখে। শুধু তার বইয়ের জন্য সে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু তা নয়, তায়েবা দেখতেও আগুন সুন্দরী! যে কারো চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মতো। মেলায় ইতস্তত ঘুরতে থাকা সাংবাদিকরাও জড়ো হয়েছে এখানে। ক্যামেরা তাক করা তায়েবার দিকে। সে তার মুক্তোর মতো দাঁত বের করে হেসে কথা বলছে। লাল জামদানী শাড়ি, গলায় কানে ছোট্ট সোনার গহনা আর লাল লিপস্টিকে তাকে অপ্সরী মনো হচ্ছে। তরুণ এক কবি অনেকক্ষণ ধরেই ভাবছে নতুন কোনো কবিতা..

“পৃথিবীর নও তুমি স্বর্গের ললনা…”

দ্বিতীয় লাইন আসছে না মাথায়।

এদের মধ্যে শুধু একজন গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তার কপালে ভাঁজ। আপাতদৃষ্টিতে তাকে সবকিছুর প্রতি আগ্রহহীন মনে হলেও আসলে তিনি গভীর মনোযোগে শুনছেন সবকিছু। আর চেষ্টা করছেন কখন এই তায়েবাকে জব্দ করা যায়। ঢুকতে না ঢুকতেই মাথায় চড়ে বসেছে! লোকটি আর কেউ নন, ইকরাম চৌধুরী।

ইকরাম একসময় সুযোগ পেয়েই গেল। যখন শুনল তায়েবা বলছে, “আমি খুব বেশিদিন লেখালেখি প্র্যাক্টিস করিনি। ছোটোগল্প আমি চাইলেই তুলে ফেলতে পারি…এই ধরুন এক থেকে দেড়ঘন্টা সময় লাগে। আমার মাথায় কেমন করে যেন গল্পগুলো থরে থরে সাজানো থাকে। আমি শুধু সেগুলোকে বাস্তব রূপ দেই এই আরকি…”

ইকরাম গলা খাঁকারি দিয়ে সেই মুহূর্তে বলে উঠল, “ম্যাডাম, আপনার প্রতিভায় আমরা মুগ্ধ। কিন্তু খালি কথায় চিড়ে ভেজাতে আমি বিশ্বাসী নই। আমাকে প্রমাণ দিতে পারেন যে আপনি এক-দেড় ঘন্টায় একটা আস্ত সফল ছোটোগল্প লিখে ফেলতে পারেন? যা খুশি লিখে যে কেউ সেটাকে ছোটোগল্প বলে চালিয়ে দিতে পারে৷ কিন্তু আমি আপনার কাছে সেই জিনিস চাইছি যে লেভেলের গল্প আপনার বইতে আছে। আপনি কি পারবেন এখন লিখে দেখাতে?”

আসলে ইকরামের ধারণা মেয়েটা কোনো অখ্যাত বিদেশী বই থেকে গল্প মেরে দিয়েছে। এখন মেলার মাঝে বসে আরও বড় বড় গুল দিচ্ছে! কথাটা বলে ফেলার পর মনে মনে তার বেশ আনন্দ হতে থাকল। সে জানে যেটা বলেছে সেটা করা কতটা কঠিন।

ইকরামের কথায় দর্শকদের একদল, যারা তায়েবার প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল, তারা খুশি হলেও অনেকে বেজারও হলো। এটা তো বইমেলা, সেটাকে পরীক্ষার হল বানিয়ে দেবার কোনো মানে হয় না। এটা সরাসরি লেখিকাকে অপমান। এত সুন্দর একটা মানুষকে এরকম বলতে লোকটা বাঁধল না?

তায়েবা বিরক্ত হলেও ঘাবড়ে গেল না। মুখের হাসিটা ঠিকই বজায় রাখল। উল্টে বলে বসল, “আপনিই বলুন, কী বিষয়ে লিখব? সামাজিক, থ্রিলার, প্রেমকাহিনী, নাকি হরর? হিস্টোরিক্যাল, মিথোলজিক্যাল বা পলিটিক্যাল টাইপ কিছু লিখতে বলবেন না প্লিজ। আপনি নিশ্চয়ই আশা করেন না আমি এক ঘন্টায় পড়াশুনা করে তারপর গল্প লিখি। সেটা হয়তো এলিয়েন জাতীয় কারো পক্ষে সম্ভব হতে পারে!”

ইকরামও মুখে একটু হাসি টেনে বলল, “তা তো বটেই! আপনি নাহয় একটা মার্ডার মিস্ট্রি লিখুন।”

তায়েবা একটু আহ্লাদি গলায় বলল, “ওহ। দ্যাটস সো ইজি ফর মি!”

ইকরাম মুখ বাঁকালেও মেয়ের আত্মবিশ্বাস দেখে ভেতরে ভেতরে একটু ঘাবড়েও গেল।

লোকজন ঘিরে রাখলে লেখালেখি সম্ভব না। তাই তায়েবাকে লেকের পাড়ে মোটামুটি নির্জন একটা জায়গা খালি করে দেয়া হলো। হাতে সাদা কাগজ কলম। সময় দুই ঘন্টা দেয়া হলো, কারণ ডিজিটাল যুগে সবাই মোবাইল বা ল্যাপটপে লিখে অভ্যস্ত। একই জিনিস কাগজে লিখতে বেশি সময় লাগারই কথা।

সবাই অধীর আগ্রহে বসে রইল ফলাফল দেখার জন্য। অনেকে সমালোচনা করছে। ঘটনাটাকে ফালতু বলছে। ইকরামের ওপর অনেকেই বিরক্ত। ভালো লেখকও এই ঝামেলার মধ্যে ভটঘট পাকিয়ে ফেলতে পারে। সেখানে মেয়েটার সাথে এরকম!

যাহোক, যেখানে পাত্র পাত্রী রাজি সেখানে বাকিদের মত চলে না।

ঘন্টা দেড় পার হলো গুটি গুটি পায়ে। পৌঁনে দুই ঘন্টায় তায়েবা কাগজ হাতে উঠে দাঁড়াল। সোজা চলে গেল ইকরামের কাছে। কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “পড়ে দেখুন কেমন হলো?”

ইকরাম বসে বসে পড়ছে। তার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। গল্পটা অসাধারণ হয়েছে, কোনো সন্দেহ নেই, শেষের টুইস্ট পাঠককে পুরো ঘোল খাইয়ে দেবে। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা গল্পের শুরুতে একজন লেখকের খুন হয়। সেই লেখকের নাম ইকরাম চৌধুরী।

ইকরামের ইচ্ছে হলো কাজগগুলো ছিঁড়ো টুকরো করে লেকের পানিতে ফেলে দেয়। কিন্তু এমন ছেলেমানুষীর কোনো মানে হয় না। সে লেখাটা পড়ে সেটাকে আরেকজনের হাতে দিল। তার মুখটা ছোটো হয়ে গেছে অপমানে।

গল্পের কাগজ হাতে হাতে ঘুরতে লাগল। অনেকে পড়ে ইকরামের মতো মুখ গম্ভীর করে ফেলল। তবে বেশিরভাগই খুশি হলো। আড়ালে একেকজন টিপ্পনী কাটল, “কেমন জব্দ!”

সেই তরুণ কবি ছন্দ বানিয়ে ফেলল, “কয়েক শব্দ, লেখক জব্দ!”

গল্পটা কে যেন টাইপ করে ফেসবুকে পোস্ট করে দিল। সাথে পেছনের কাহিনী। জিনিসটা ভাইরাল হতে সময় লাগল মাত্র পৌঁনে দুই ঘন্টা।
________________________________

পুরো ঘটনা পড়ার পর রুদ্র কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইল। আদতেই কি গতকালের ঘটনার সাথে আজকের খুনের কোনো যোগসূত্র আছে?

এমন হতে পারে, খুনীর অনেক আগে থেকেই প্ল্যান ছিল খুন করবে। গতকালের কাহিনী দেখে একটু ইচ্ছে হয়েছে ব্যাপারটা নাটকীয় করে তোলার। তাতে তার সুবিধা হলো, পুলিশ ভুল করে মরিচীকার পেছনে ছুটবে, এদিকে তার ট্রেস হারিয়ে যাবে।

না, এটা হতে দেয়া যাবে না। সবদিক নজর রাখতে হবে। এত ইন্টারেস্টিং কেস সহজে হাতে আসে না। আজকের রাতটা ভালো করে ঘুম দিতে হবে। কালকের কাজগুলো একটা কাগজে লিখে ফেলল সে।

১. কাজের মেয়ে সুমাকে জেরা করা।
২. দারোয়ান হোসেন আলীকে কিছু প্রশ্ন করা।
৩. ইকরামের ব্যাংক একাউন্ট, কললিস্টের ডিটেইলস যত দ্রুত সম্ভব বের করে অ্যানালাইসিস করা।
৪. ইকরামের ব্যাংক একাউন্টের খবর নেয়া (যেহেতু নারীঘটিত ব্যাপার আছে, তাই এদিকটা নজর দিতে হবে)
৫. ইকরামের আত্মীয়স্বজন খুঁজে বের করে জেরা করা।
৬. কাজের জায়গায় কোনো ঘোর শত্রু আছে কি না তলিয়ে দেখা।
৭. তায়েবা তারান্নুমের সাথে সাক্ষাৎ।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here