পাথরের_মৃত্যু পর্ব-৩

0
228

#পাথরের_মৃত্যু
পর্ব-৩

সুমা মেয়েটা দেখতে হালকা-পাতলা, গায়ের রঙ শ্যামলা, চুল উষ্কখুষ্ক। একরাত হাজতে থেকে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। তাকে দেখতে একেবারে বিধ্বস্ত লাগছে। রুদ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। সমস্যা চোখে পড়ছে, আবার পড়ছে না৷ তবে আপাতদৃষ্টিতে মেয়েটাকে সরল মনে হচ্ছে। দেখা যাক কী হয়।

রুদ্র গম্ভীর গলায় বলল, “যা যা বলব ঠিক ঠিক জবাব দেবে। কোনো অতিরিক্ত কথা বলবে না।”

সুমা ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানাল।

“কতদিন ধরে কাজ করছ ইকরাম চৌধুরীর বাড়িতে?”

“দুই বছরের উপরে হইব।”

“তার স্ত্রী বেঁচে থাকাকালীন সময় থেকে?”

“জি স্যার।”

“তিনি কেমন মানুষ ছিলেন?”

“সাহেব না আফা?”

“সাহেব।”

“ভালা মানুষ আছিলো।” সুমার গলায় একটু ইতস্তত ভাব।

রুদ্র সামনের দিকে ঝুঁকল। “সত্যি করে বলো তো? কোনো গন্ডগোল ছিল না তো?”

“না স্যার, সত্যি।”

“আর তোমার আপা কেমন ছিলেন?”

“আফা আছিল খুব ভালা মানুষ। মন ছিল দরদ দিয়া ভরা।”

“তোমার আপার মৃত্যুর পর সাহেবের কোনো প্রেমিকা হয়েছিল?”

“না তো স্যার।”

“হতেও তো পারে।”

“স্যার থাকলেও আমি জানি না।”

“বাড়িতে কখনো কোনো মেয়েকে দেখোনি?”

“না, বাড়িতে কেউ আইতো না।”

“কেউ না?”

“নাহ।”

“কখনো কাজ করতে গিয়ে কোনো চিহ্ন পাওনি? চুল, কানের দুল বা এ জাতীয় কিছু?”

“না।”

“সাহেব কি বদমেজাজি ছিলেন?”

“না স্যার। ভালা মানুষ আছিল। এক্কেবারে ঠান্ডা মানুষ।”

রুদ্র এবার আরও একটু ঝুঁকে এসে বলল, “সাহেব কখনো তোমার সাথে জোরজবরদস্তি করার চেষ্টা করেছে? কিংবা কোনোভাবে ইঙ্গিতে..”

সুমা একেবারে আঁতকে উঠল, “না স্যার, সাহেবের চরিত্র ভালা আছিল। আমারে সবসময় বইনের চোখে দেখছে। কোনোদিন কিচ্ছু কইতো না।”

রুদ্র লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে। এবার বলো সাহেব যেদিন খুন হয়েছে সেদিন সকালে কোথায় ছিলে?”

“বাড়িতে। আম্মার শরীল ভালা আছিল না। সকালে রাইন্ধা, ঘরের কাজকাম কইরা তারফর গেছি সাহেবের বাড়িতে।”

“গিয়ে কী দেখলে?”

“হোসেন ভাই গেট খুইলা দিছিল। অন্যান্য দিনের মতো কথাও কইছিল। তারপর ভিতরে গিয়ে বেল চাপলাম। সাহেব খুলল না। অনেকবার বেল দেওনের পরেও দেহি খুলে না৷ সাহেবের শরীলডা কয়দিন ধইরা এট্টু খারাপ মনে হইতাছিল। আবার বেশি খারাপ হইল নাকি ভাইবা জানালা দিয়া দেখতে গেছি৷ ডইংরুমের জানালা দিয়ে তাকাইয়া দেহি রক্ত দিয়া ভাইসা যাইতাছে। আর সাহেব পইড়া আছে…” বলতে বলতে কেঁদে ফেলল সুমা। কেঁপেও উঠল বার কয়েক।

সে একটু স্থির হলে রুদ্র জিজ্ঞেস করল, “এরপর কী করলে?”

“হোসেন ভাইরে ডাইকা দেহাইলাম। সে কইল পুলিশে খবর দিতে। তারপর তো…”

“আচ্ছা, যাও আজকের জেরা এই পর্যন্তই।”

***

দারোয়ান হোসেন আলীর জ্বর হয়েছে। সেলের কোণে তেল চিটচিটে কম্বল গায়ে কাঁপছে সে। বাইরে থেকেও সেই কাঁপুনি বোঝা যাচ্ছে। গতদিন মারটার খেয়েছে বোধহয় নাজমুলের হাতে। নাজমুলের ধারণা এই ব্যাটাই যত নষ্টের মূল। অতএব, হোসেন আলীর জেরা করা গেল না।

নাজমুলকে ডেকে পাঠাল রুদ্র।

“স্যার!”

“কললিস্ট জোগাড় হয়েছে?”

“জি স্যার।” বলে নাজমুল কাগজটা এগিয়ে দিল রুদ্রের দিকে।

রুদ্র আপনমনেই বলল, “লাস্ট কল..তৈয়বুর রহমান..কে এটা?”

“স্যার প্রকাশক।”

“লাস্ট কল করা হয়েছে মৃত্যুর আগের দিন দুপুরে। তারপর তাকে বইমেলাতে দেখাও গেছে। কিন্তু সেখান থেকে ফেরার পর সে কাউকে ফোন করেনি।”

“জি স্যার।”

“এটা কে? এই নাম্বারে অজস্রবার কল করা হয়েছে গত চার মাস ধরে।”

“স্যার ট্রেস করার চেষ্টা করছি, এখনো পাইনি। নাম্বারটা রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি। এখনকার দিনে রেজিস্ট্রেশন বাদে সিম বিক্রিই করে না লোকে। এটা কিভাবে জোগাড় করেছে বা চালু রেখেছে কে জানে!”

“সিম কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেছ?”

“জি স্যার। নাম্বারটা ট্র্যাক করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা বন্ধ।”

“রহস্যজনক! আর ব্যাংক একাউন্ট?”

“প্রচুর টাকা স্যার! এই লোক বেস্টসেলার ছিল। বছরে কয়েক দফায় টাকা ডিপোজিট হতো ব্যাংকে। লাইফস্টাইল দেখে বোঝার উপায় নেই এত টাকার মালিক সে।”

“সেসব টাকা ইদানীং কোথাও ট্রান্সফার হয়েছে? লেনদেন হতো কিভাবে?”

“উনার প্রয়োজন হলে টাকা তুলে নিতেন। কিন্তু কারো একাউন্টে এর মধ্যে পাঠানো হয়নি। এমনকি তিনি নিজেও বড় অঙ্কের টাকা তোলেননি গত কয়েক মাসের মধ্যে।”

“আর উনার আত্মীয়- বন্ধু- শত্রু এসবের খবর?”

“স্যার লোক লাগিয়েছি। আজ কালের মধ্যে বেরিয়ে যাবে ডিটেইলস।”

“হুম।”

রুদ্র মাঝা ঝাঁকাল। এই বন্ধ ফোন নাম্বার ধরেই এগিয়ে যেতে হবে। আর কোনো সূত্র আপাতত পাওয়া যাচ্ছে না। ফরেনসিকের রিপোর্ট আগামীকালের আগে আসবে না। তারপর সেই জন্মনিয়ন্ত্রণ ক্যাপগুলোর টেস্ট রিপোর্টও এখনো আসেনি। সেগুলো আসলেই ইকরামের ব্যবহার করা কিনা সেটা নিয়ে কিঞ্চিৎ সন্দেহ হচ্ছে রুদ্রর।

আপাতত একটা জরুরি কাজ বাকি। তায়েবা তারান্নুমের সাথে দেখা করা। তার বাড়িতে একবার ঢু মারতে হবে আজই।

***

কিছু কয়েদি আর পুরানো কেস ফাইল দেখতে দেখতে অনেকটা দেরি হয়ে গেল। বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা নামছে তখন রুদ্র বের হলো তায়েবার বাড়ির উদ্দেশ্যে। সাথে আছে নাজমুল।

তায়েবার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে যতটা জানা গেছে তাতে মেয়েটার খারাপ কোনোকিছু উঠে আসেনি। ওর মা বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল অনেকদিন আগেই। তায়েবা মায়ের সাথে চলে গিয়েছিল কানাডা। বাবা রয়ে গিয়েছিল দেশে। ওখানেই মা মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পর মাস ছয়েক হলো তায়েবা দেশে এসে বাবার সাথে বাস করছে পুরান ঢাকায়৷

রুদ্রকে একটা কথা ভাবাচ্ছে, এত লম্বা সময় বিদেশ থেকে সেখানে পড়াশুনা করে আসার পর একটা মেয়ে দেশে আসার ছয় মাসের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে কী এমন লিখে ফেলল যেটা আলোচনার শীর্ষে উঠে গেছে? অবশ্য এমন হতে পারে মায়ের থেকে বাংলার প্রতি টান। তবু ব্যাপারটা একটু অদ্ভূত। বইটা পড়ে দেখা উচিত ছিল। মেয়েটা যদি সত্যিই অত মেধাবী হয় তাহলে সেই অনুযায়ী প্রস্তুতির একটা ব্যাপার থাকে!

দরজায় দুবার কলিংবেল চাপলে দরজা খুলল। না চাইতেও রুদ্রের ভাবভঙ্গিতে অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি স্মার্টনেস দেখা যাচ্ছে।

দরজা খুলল স্বয়ং তায়েবা তারান্নুম। তার পরনের আকাশী সুতির শাড়ি গায়ের ফর্সা রঙের সাথে মিলে মানুষটাকে আকাশের মতো দেখাচ্ছে। চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁট লিপস্টিক ছাড়াই লালচে রঙের। গতকাল ফেসবুকে দেখা ছবিতে তার রূপ আন্দাজ করা গেলেও এতটা বোঝা যায়নি কোনোভাবেই। রুদ্র কয়েক পলকের জন্য ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। তবে দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে ঢোক গিলে বলল, “আপনার সাথে জরুরি কথা আছে আমাদের।”

বলে আবারও বার কয়েক ঢোক গিলল। নিজের গলা নিজেই চিনতে পারছে না। হলোটা কী?

তায়েবা মুক্তোঝরানো হাসি দিয়ে বলল, “আসুন ভেতরে। আমার মনে হচ্ছিল আপনারা আসবেন।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here