পাথরের_মৃত্যু পর্ব-৫

0
250

#পাথরের_মৃত্যু
পর্ব-৫

সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে বসার সাথে সাথে লোডশেডিং হলো৷ আজকাল এই ঝামেলা শুরু হয়েছে। দেশে বিদ্যুৎ সংকট বলে যখন তখন দুনিয়া অন্ধকার করে লোডশেডিং! তবে তিন সেকেন্ডের মধ্যেই শক্তিশালী জেনারেটর চালু হয়ে সবকিছুই আগের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সিসিটিভি ফুটেজ বের করে অফিসারটি রুদ্রকে দেখাতে বসল নির্দিষ্ট অংশ।

রুদ্র মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকল। প্রথমে ভিক্টিমের সঙ্গী হোটেল থেকে বের হয়ে যায়। ঠিক তার পরপরই মেয়েটা বের হয় কালো বোরকা পরে। মেয়েটা ঢোকার সময়ও অবশ্য কালো বোরকা পরিহিত ছিল। তার একটু পর মেয়েটা আবার হোটেলে ঢোকে। সোজা চলে যায় নিজের রুমে। মেয়েটা ঢোকার ঠিক মিনিট পাঁচেকের মাথায় ওর মতো গড়নেরই আরেকজন ঢোকে ঠিক একই রকম বোরকা পরে। চুপচাপ চলে যায় সেই ঘরটাতেই। গিয়ে দরজায় নক করতেই দরজা খুলে দেয়া হয়। পরেরজন ঢোকে। এর দশ মিনিট পর বোরকা পরিহিত খুনী বের হয়ে যায়।

সমস্যা হলো এই বোরকা পরা দুজনের মধ্যে যোগাযোগ কী ছিল? কে এই দ্বিতীয় জন?

রুদ্র প্রশ্ন করল, “খাবারের অর্ডার করা হয় কখন?”

“দুজন ঢোকার পর। তবে খাবার অর্ডার করা হয়েছিল একজনের।”

বিশাল প্যাঁচ! রিসিপশনের মহিলা সে সময় ব্যস্ত ছিলেন৷ তিনি দুজনকেই দেখেছেন কিন্তু ভেবেছেন একজন। হত্যার কোনো মোটিভও পরিষ্কার নয়। ভিক্টিমের পার্সে দশ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। মোবাইল, হাতের ঘড়ি, চেইন, কানের দুল সবই ঠিকঠাক আছে। তাহলে খুনটা করল কিসের জন্য?

অফিসারের নাম শওকত। রুদ্র তার সাথে হ্যান্ডশেক করে কেসদুটোতে একে অপরকে সাহায্য করবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে এলো। জটলা ক্রমশ বাড়ছে।

রুদ্রর মাথায় ঘুরছে একটা প্রশ্ন, খুনী কি তাহলে মহিলা? বোরকা পরা মহিলা কে হতে পারে?

***

রুদ্র দেখা করতে এসেছে ‘আস্থা’ প্রকাশনীর প্রকাশক জীবন তালুকদারের সাথে। জীবন তালুকদার ব্যস্ত মানুষ। দুই হাতে কাজ করছেন। রুদ্র আসার পর ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাকে যেন পাঠিয়েছেন দই মিষ্টি আনতে। হাসিমুখে তিনি যে কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। তবে রুদ্র বিরক্ত হচ্ছে। লোকটাকে সরল মনে হচ্ছে, কিন্তু এ যেন সিরিয়াস কথা বলার জন্য তৈরিই হয়নি।

রুদ্র এবার একটু কঠিন স্বরে বলল, “দরজাটা আটকে দিতে বলুন৷ আপনার সাথে অত্যন্ত জরুরি কিছু কথা আছে। সিরিয়াসলি উত্তর দিতে হবে।”

লোকটা নিজে উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে বসল। মুখের হাসি এখনে আছে, তবে চোখ দেখে মনে হচ্ছে লোকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে তৈরি হয়ে বসেছে।

“আচ্ছা, মন থেকে বলুন তো, ইকরাম চৌধুরী লোকটা কেমন ছিলেন?”

প্রকাশকের মুখের হাসি প্রথমে একটু বিস্তৃত হলো, তারপর তিনি গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, “লোক হিসেবে কেমন ছিলেন বলতে গেলে বলা যায় সৎ ছিলেন, নীতিবানও ছিলেন। লোকজনের সাথে মেশামিশি কম থাকলেও আন্তরিক ছিলেন৷ তবে সমস্যা ছিল দুইটা। এক হলো তিনি লোককে অপমান করে কথা বলতেন৷ সেটা যদিও সবসময় না, তার মেজাজ খারাপ থাকলে। আর দুই, তিনি মুখে যেইটা বলতেন ভিতরে তেমন ছিলেন না৷ এটা তার চেহারা দেখে বোঝা যেত। অন্তত আমি বুঝতে পারতাম৷ এসব কারণে তাকে মানুষ হিসেবে আমি খুব একটা পছন্দ করতাম না। পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার মানুষ সহজে বুঝতে পারে। তিনি জানতেন আমার মনের খবর। তবুও আমার কাছ থেকেই তার বেশিভাগ বই প্রকাশ হয়েছে। তার কারণ আমার লেনদেন একেবারে পরিষ্কার। তবে এসবের মধ্যেও আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল বলা যায়।”

রুদ্র লোকটার কথায় বেশ সন্তুষ্ট ছিল। পুলিশের সাথে লোকজন গুছিয়ে কথা বলে না। কথা আদায় করে নিতে হয়। তাই হঠাৎ হঠাৎ রেডিমেড প্রশ্নোত্তর পেলে ভালোই লাগে।

রুদ্র এবার প্রশ্ন করল, “তার শত্রু বলতে কেউ ছিল? আপনি চেনেন?”

“জি না। তেমন শত্রু দেখি নাই। তবে…”

“তবে কী?”

“একটা ব্যাপার আমি জোনেছিলাম, তবে এখন বলা উচিত হবে কি না..”

“আপনি যদি চান তার খুনের অপরাধীর শাস্তি হোক তাহলে কিচ্ছু গোপন করবেন না। বলে ফেলুন।

“এতদিন তার সাথে কাজ করেছি, তার মধ্যে শুধু একবার একজনের সাথে শত্রুতা হতে দেখেছি। আসলে তিনি একটু চুপচাপ নিজের মতো থাকতেন বলে লোকে তাকে ঘাটাত না৷ যার সাথে ভেজাল লেগেছিল সে একজন কবি। আর ঝামেলা লাগার কারণ তার স্ত্রী কবির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। আমি পুরো ঘটনা জানি না, তবে আভাস পেয়েছিলাম।”

“সেটা তার স্ত্রীর মৃত্যুর কতদিন আগে?”

“অনেকদিন। প্রায় দেড় দুই বছর আগের ঘটনা। সেই ঘটনার পর কবির বই আমি আর প্রকাশ করতে পারি নাই। ইকরাম চৌধুরী বলেছিলেন করলে আমার সাথে সম্পর্ক রাখবেন না।”

“কবির নাম কী?”

“আসল নাম জানি না। ছদ্মনামে লেখে। নাম ‘জলচর’। এই নামেই সব জায়গায় পরিচিত৷”

“তার ঠিকানা, ফোন নাম্বার দিন। তারপর বলুন, ইকরাম চৌধুরীর চরিত্র কেমন ছিল? মানে নারীঘটিত কোনো কেলেঙ্কারি ছিল কী? স্ত্রীর জীবিত থাকাকালীন বা মৃত্যুর পর?”

এবারও জীবন তালুকদার একটু থমকে গেলেন৷ শেষে বললেন, “কেলেঙ্কারি কখনো হয় নাই। তবে তিনি যে সুন্দর মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হতেন এটা ঠিক। আমার প্রকাশনীতে বই ছাপাতে আসা এক মেয়ের সাথে খুব ভাব হয়েছিল৷ এগুলো যদিও ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর আমি অন্যের বিষয়ে নাক গলাই না। যতটুকু চোখে দেখা যায় ততটুকুই৷”

“মেয়েটা কোথায় এখন?”

“এখন তো কানাডা থাকে। বিয়ে করে চলে গেছে। মেয়েটা চলে যাওয়ার পর ইকরাম চৌধুরীকে দেখতাম কয়েকদিন মন খারাপ করে বসে থাকতে।”

“এটা নিয়ে তার স্ত্রীর সাথে ঝামেলা হতো না?”

“সেটা তো বাড়ির ভেতরকার খবর। আমি কী করে জানব বলুন। তাদের দাম্পত্য জীবন তেমন সুখের ছিল না এটা জানি শুধু।”

“আচ্ছা। ধন্যবাদ আপনাকে। আবার প্রয়োজন হলে আসবো।”

***

সেদিন বিকেলে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চলে এলো। রিপোর্ট দেখে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে বসে রইল রুদ্র। সে বিশ্বাস করতে পারছে না এভাবে সব উল্টেপাল্টে যেতে পারে!

বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বেশ কিছুক্ষণ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবল। তারপর ঠিক করে ফেলল করণীয়।

পরদিন কোর্টে কাজের মেয়ে সুমাকে খালাস দিয়ে দেয়া হলো। আর রুদ্র বিশেষ অনুরোধ করে ব্যবস্থা করল যেন কেসের ব্যাপারে আর একটা ছোট্ট তথ্যও মিডিয়া পর্যন্ত না যায়। অন্তত আর এক সপ্তাহ যেন সব গোপন রাখা হয়।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here