পাথরের_মৃত্যু পর্ব-৬

0
219

#পাথরের_মৃত্যু
পর্ব-৬

রুদ্রকে এবার তদন্ত করতে হচ্ছে অনেকটাই গোপনীয়ভাবে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা পরিস্থতি বদলে দিয়েছে। তদন্তটা তাকে নেশার মতো টানছে। মনে হচ্ছে কোনো ভয়ানক ঘটনা লুকিয়ে আছে এর মধ্যে। কী সেটা? খুঁজে বের করতেই হবে। কেন যেন মনে হচ্ছে ইকরাম চৌধুরীর বাড়িটা আরেকটু ভালোভাবে সার্চ করতে হবে। ওই বাড়িতে আরও অনেক কিছু থাকতে পারে যেগুলো তখন চোখে পড়েনি। সে বেরিয়ে পড়ল বাড়িটার উদ্দেশ্যে।

বাড়িটা পুলিশের বেষ্টনীতে ঘেরা৷ তালা খুলে ঢুকল রুদ্র। বাড়িটা থেকে অদ্ভূত একটা গন্ধ আসছে। পুরানো রক্ত আর বদ্ধ ঘরের ভ্যাপসা আবহাওয়া মিলে অসুস্থকর অনুভূতি!

সে শুরু করল বসার ঘর থেকে। এখানটা গতবারই খুব ভালোমতো দু’বার খোঁজা হয়েছে বলে হয়তো এবার কিছুই পাওয়া গেল না৷ তারপর সে চলে গেল পাশের পড়ার ঘরে। এই ঘরটার তিনদিকে তিনটা বুকশেলফ। অজস্র বই। সেদিন বাইরে থেকে কিছু বই বের করে দেখা হয়েছে। কিন্তু আজ সবটাই দেখতে হবে। বইতে যে ক্লু থাকতে পারে এটা তার মাথায় এসেছে তায়েবা তারান্নুমের বাড়িতে গিয়ে। সেই বইটাতে যেমন চিঠি ছিল, এগুলোতেও কি সূত্র থাকতে পারে?

একটা একটা করে বই টেনে বের করতে লাগল সে৷ খুঁজল তাকের ফাঁকফোকর। ঠাসাঠাসি করে রাখা বইগুলোতে ধুলো জমে গেছে। ধুলো ঝেড়ে বই উল্টেপাল্টে দেখতে থাকল এক এক করে৷ লেখকের নিজের বইয়ের সৌজন্য কপি থেকে শুরু করে প্রচুর বিখ্যাত লেখকের বই আছে। অনেক বই উপহার পাওয়া। সেসব বই একটু ভালো করে দেখতে থাকল রুদ্র। কিছু অন্তত পাওয়া উচিত। কোনো ক্লু কি থাকবে না?

একটা বুকশেলফ পুরোটা দেখে ফেলল রুদ্র। তেমন কিছু পেল না। দ্বিতীয় শেলফ ঘাটতে গিয়ে বুঝল এটা ইকরাম চৌধুরীর আসল পড়াশোনার বইতে ভর্তি৷ নানা তথ্যমূলক বই। ইতিহাস, রাজনীতি, ভূগোল, ভাষাতত্ত্ব, যুদ্ধের বইতে ঠাসা। সাথে আছে বাংলা ও বিদেশি সাহিত্যের কিছু ক্লাসিক। আর এক সারিতে শুধুই ডায়েরি। সেগুলো খুব মনেযোগ দিয়ে ঘাটল রুদ্র। তবে সবগুলোই মনে হলো লেখকের গল্পের খসড়া৷ এমনভাবে টেনে টেনে লেখা যে পড়ার উপায় নেই। সাংকেতিক ভাষাও হতে পারে!

দুটো শেলফ দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেছে। আরেকটা জলদি দেখতে হবে। ইতিমধ্যে থানা থেকে অনেকগুলো কল এসেছে৷ সে কী করছে তা যথাসম্ভব গোপন রাখার চেষ্টা করছে বলে প্রতিবার নিজের লোকদের কাছেও অযুহাত দিতে হচ্ছে।

দ্রুত হাত চালাল সে। শেষের বুকশেলফের বইগুলো বের করতে লাগল। উপরের তাক পুরোটা দেখা হয়ে গেলে বইগুলো সাজিয়ে রেখে হঠাৎ কী একটা খটকা লাগায় আবার বইগুলো টেনে বের করল। পেছনের দেয়ালটা ফাঁপা লাগছে না?

তাড়াতাড়ি সব বই শেলফ থেকে বের করল সে। পুরো শেলফটা খালি করে সরিয়ে ফেলল। একধারে ছোট্ট একটা আংটা। সেটা ধরে জোরে টান দিয়েও কিছু হলো না। খেয়াল করল একটুকানি জায়গা আছে যেটা দিয়ে খুব সম্ভবত চাবি ঢোকানো যায়। চাবিটা এই বাড়িতেই থাকার কথা। সে পাশেই ইকরাম চৌধুরীর বেডরুমের টেবিল আর আলমারিতে খোঁজ করতে শুরু করল। টেবিলের ড্রয়েরে অনেকগুলো ফাইলপত্র দ্রুত ঘাটতে গিয়ে আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করল সে। কিন্তু সেদিকে মনোযোগ পরে দেয়া যাবে৷ এই মুহূর্তে গুপ্তকক্ষ তাকে অনেক বেশি টানছে। টেবিলে কিছুই পেল না। আলমারির একটা গোপন ড্রয়েরের নিচের দিকে মখমলের কাপড়ে মোড়া ক্ষুদ্র চাবিটা অবশেষে খুঁজে পেল সে। এবার লাগিয়ে দেখতে হবে মেলে কি না।

তাড়াতাড়ি ছুটে গেল সে সেই দরজার কাছে৷ চাবিটা ঢুকিয়ে কয়েকবার ঘুরিয়েও লাভ হলো না৷ তালা খুলল না। হতাশ হয়ে বসে পড়ল রুদ্র। এই ঘরের চাবি নয় এটা? তাহলে কিসের? কে জানে! চাবিটা কাপড়ে মুড়ে পকেটে রেখে দিল সে। তারপর এলোমেলো বইগুলো একে একে দেখতে শুরু করল। বুঝল এই শেলফটা পুরোটাই ছিল ইকরাম চৌধুরীর স্ত্রী মনিকা চৌধুরীর। মেয়েটা বই কিনতও অনেক আর উপহার পেত বিস্তর৷ হয়তো স্বামীর সুবাদেই তরুণ থেকে প্রবীন লেখক কবিদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল তার৷

একটা বইতে চোখ আটকে গেল রুদ্রের। বইটা মনিকাকে উপহার দিয়েছে জলচর নামের কবি৷ বইটা অবশ্য শরৎচন্দ্রের উপন্যাস ‘গৃহদাহ’। বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা, “ভালোবাসা সুহাসিনীর জন্য।”

বইয়ের ভেতরে উল্টেপাল্টে দেখা গেল অনেক পেন্সিলের দাগ৷ পছন্দের লাইনগুলো মার্ক করে রাখা হয়েছে৷ মাঝে ছোটো ছোটো নোট৷ সবই নতুন প্রেমে পড়ার লক্ষণ৷ এই জলচর লোকটার সাথে কেসের সম্পর্ক আছে বলেই মনে হচ্ছে!

আরেকটা বইতে নতুন আরেকটা জিনিস পাওয়া গেল। একটা নীল রঙের খাম। খামের ভেতর গোলাপের শুকিয়ে যাওয়া কিছু পাঁপড়ি আর একটা চিরকুট। চিরকুটে লেখা, “I can do everything for you!”

একেবারে নিচের তাকে একটা বইয়ের ভেতর আরও একটা চিরকুট পাওয়া গেল। সেটার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল রুদ্র। চিরকুটে লেখা,

“জীবনটা গল্পের চেয়েও রহস্যময়!
– তায়েবা তারান্নুম”

তায়েবা কি এর মধ্যে আগে থেকেই ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? রুদ্র কিছুক্ষণ বসে রইল বিষয়টা হজম করার জন্য। তারপর আবার হাত চালাল।

বইগুলো হাতড়াতে গিয়েই মেঝের একটা গর্ত হাতে ঠেকল। আপাতদৃষ্টিতে সেটাকে সাধারণ ফুটো বলেই মনে হয়। কিন্তু খুব ভালো করে কাছ থেকে খেয়াল করে দেখে রুদ্র বুঝে গেল সেটা কী। পকেট থেকে চাবিটা বের করে তাতে ঢুকিয়ে দিল। খট করে তালা খুলে গেল। সাথে সাথে গর্তের ভেতর থেকে একটা চিকন আংটা বেরিয়ে এলো। সেটা ধরে টান দিতেই উঠে এলো একটা টাইলস। ভেতরে একটা ছোটো গর্তে একটা বাক্স৷ বাক্সের ভেতর পাওয়া গেল আরেকটা চাবি। সেই চাবি দিয়ে খোলা গেল বুকশেলফের পেছনের দরজাটা।

এত সুরক্ষা কেন? কী আছে এখানে? মৃত্যুপুরীর মতো নিস্তব্ধ এই বাড়িতে একা দাঁড়িয়ে রুদ্রর গা টা একটু ছমছম করে উঠল। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। বাইরের আলোর উজ্জ্বলতা কম। বাড়িটাতে গাছপালা আছে, তবে পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে না। এত নিস্তব্ধতা কেন? দরজার পাল্লাটা খুলতে একটু সময় লাগল তার৷ খানিকটা মনোবল জোগাড় করে নিয়ে টেনে খুলল দরজা।

ছোটো একটা ভল্টের মতো জায়গা। বাইরে থেকে দেখলে দুটো ঘরের মাঝের এই জায়গাটুকুর অস্তিত্ব বোঝা যায় না। ভালো ইঞ্জিনিয়ারের কাজ।

ভেতরে পা দিতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলো জ্বলল। রুদ্র মনে মনে বলল, বাহ!

ভেতরে একটা ট্রাঙ্কের ভেতর মেয়েদের জামাকাপড়। রুদ্রর মনে হলে এসব মনিকা চৌধুরীর। একটা ব্যাগে পাওয়া গেল অনেকগুলো জুতো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আরও ব্যাগপত্রে সব মেয়েদের জিনিসপত্র। একটা ছোট্ট আলমারিও আছে। সেটা খুলে দেখা গেল ফাঁকা। ড্রয়ের টেনে খুলে পাওয়া গেল একটা ফাইল। তাতে প্রচুর কাগজপত্র।

একটা পাওয়া গেল ডিভোর্স লেটার। তার মানে কী? ইকরাম চৌধুরী আর মনিকা চৌধুরীর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল? মনে হচ্ছে তাই। পেপারে দু’জনেরই সই আছে।

পরের কাগজটা তাদের বিয়ের কাবিননামা। অনেক পুরানো। এছাড়া পাওয়া গেল মনিকা চৌধুরীর বেশকিছু সার্টিফিকেট। তিনি ফলিত রসায়নে অনার্স মাস্টার্স করেছেন৷

সবশেষে পাওয়া গেল একটা চিঠি। চিঠিটা মনিকা লিখেছিল জলচরকে উদ্দেশ্য করেই। কিন্তু দেয়া হয়নি। অর্ধসমাপ্ত চিঠিতে কয়েকটা অগোছালো লাইন,

“আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারছি না৷ এই বাড়ির অক্সিজেনও আমার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে আসছে। উদ্ধার করো আমাকে। আর আমাদের সন্তানকে। প্লিজ! ও আমাদের মেরে ফেলবে…”

নিজেকে ঘোরগ্রস্তের মতো লাগছে রুদ্রর। এখানে হয়েছেটা কী? কে আসল অপরাধী? কার সাথে কী হয়েছে? মনিকা চৌধুরীর কোনো ডেথ সার্টিফিকেট নেই। আসলে এই চরিত্র নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামানো হয়নি। কেমন করে মারা গেছে সে? সত্যি ইকরাম চৌধুরী মেরে ফেলেছে? আর তার প্রতিশোধ নিতেই কি কেউ…

ফোনটা বেজে উঠতেই চমকে উঠল রুদ্র। ওসি সাহেবের ফোন৷ এতক্ষণ তালবাহানা অনেক করেছে সে। এবার সব বলবে ওসি সাহেবকে। কেঁচো খুড়তে এদিকে র‌্যাটলস্নেক বেরিয়ে যাচ্ছে যে!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here