পাথরের_মৃত্যু পর্ব-৭

0
280

#পাথরের_মৃত্যু
পর্ব-৭

রুদ্র বাড়িটা থেকে বের হলো রাত নয়টার পর। এখনো দুটো ঘর সার্চ করা বাকি। কিন্তু যা পেয়েছে, আজকের মতো যথেষ্ট। আগে এগুলো নিয়ে কাজ করা যাক।

যেসব প্রশ্ন একে একে জমা হয়েছে সেগুলো একত্র করলে হয়,
১. তায়েবা তারান্নুমের সাথে ইকরাম চৌধুরী আর মনিকা চৌধুরীর আসলে কী সম্পর্ক?
২. যদি আগে থেকেই সম্পর্ক থাকে তাহলে ইকরাম কেন তায়েবাকে সেদিন বইয়ের মাঝে চিঠি দিয়েছিল?
(এখানে সম্ভাবনা আছে তায়েবার সাথে মনিকার সম্পর্ক ছিল, ইকরামের ছিল না)
৩. ইকরাম চৌধুরী আর মনিকা চৌধুরীর কি সত্যি ডিভোর্স হয়েছে?
৪. মনিকা চৌধুরী কীভাবে মারা গেছেন?
৫. তিনি কি সন্তানসম্ভবা ছিলেন?
৬. জলচর লোকটার ভূমিকা এই ঘটনায় কতটুকু?

***

ওসি সাহেবের ঘরে ঢুকে রুদ্র ধীরে ধীরে সবটা বুঝিয়ে বলল। নিজের প্ল্যানও বিস্তারিত বর্ণনা করল। তবে ওসি সাহেব বিশেষ ভরসা দিতে পারলেন না৷ বললেন দু’দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে। কারণ মিডিয়ার চাপ সামলাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। এদের থেকে সবকিছু বেশিদিন লুকিয়ে রাখা সম্ভব না।

***

পরদিন সকালে রুদ্র চলে গেল ‘জলচর’ নামের কবির কাছে। তার গুলশানে বিশাল বাড়ি। বাড়ির নাম ‘জলনিবাস’।

ভেতরে গিয়ে বসার মিনিটখানেক পর ওপর থেকে নেমে এলেন লোকটা। বয়স ত্রিশের কিছু ওপরে। দেখতে বেশ সুপুরুষ। রুদ্র খেয়াল করল লোকটার মধ্যে আকর্ষণ করার মতো যথেষ্ট গুণাবলী আছে৷ চেহারা, টাকাপয়সা, এমনকি ব্যক্তিত্ব।

রুদ্র প্রথম প্রশ্নটা করল, “আপনি কবি জলচর?”

লোকটা হেসে ফেলে বলল, “অনেকে সেই নামে চেনে। তবে পরিচিতিটা এখন মুছে ফেলার চেষ্টা করছি। সবাই কবিতা লিখতে পারে না, আবার কেউ কেউ কবিতা লিখেও কবি হতে পারে না।”

“আপনি কোনটা?”

“দ্বিতীয়টা।”

“পরিচয় মুছে ফেলার কারণ জানতে পারি?”

“আপনি ইকরাম চৌধুরীর সূত্রে আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। আপনার তো জানার কথা। বিশ্রী ঘটনাটার পর আমার মন উঠে গেছে সেদিক থেকে।”

“বাই দ্য ওয়ে, আপনার নামটা জানা হয়নি।”

“আমি জোবায়ের আহমেদ।”

“আপনি কি সেই ইউটিউবার..”

“জি জি।” হাসল জোবায়ের। “কিন্তু আপনি বুঝলেন কিভাবে?”

“আমি আপনার সব ভিডিও দেখি। চলমান বিষয়বস্তু, ক্রাইম এসব নিয়ে এত সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন যে মুগ্ধ হয়ে দেখি!”

জোবায়ের আবার হাসল।

রুদ্র জিজ্ঞেস করল, “এজন্যই আপনার গলা পরিচিত লাগছিল শুরু থেকেই। যাহোক, আমি ভাবতাম সেই মুখোশের আড়ালের মানুষটি কোনো কৌতুহলী তরুণ। কিন্তু এখন দেখছি আপনি!”

“জি আমিই।”

রুদ্র আপনমনে হাসল। তার ধারণা ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা ভিডিও বানায় তারা সব অকাজের লোকজন, সে যত ভালো বিষয়ে ভিডিওই তৈরি করুক না কেন! লোকটা অবশ্য তরুণ, এসবের প্রতি আকর্ষণ থাকা অস্বাভাবিক নয়।

সে বলল, “পরিচিত হয়ে ভালো লাগল জনাব। এবার আপনাকে যে কিছু অপ্রীতিকর প্রশ্ন করতে হয়!”

“করুন। আমি উত্তর দেব।”

“আপনার সাথে ইকরাম চৌধুরীর স্ত্রী মনিকা চৌধুরীর কোনো সম্পর্ক ছিল কী?”

“ছিল।” জোবায়ের অকপটে স্বীকার করল।

“কিভাবে আপনাদের মধ্যে যোগাযোগ হলো? আমাকে পুরো ঘটনাটাই খুলে বলুন।”

“মনিকার স্বামী মোটেও ভালো লোক ছিল না৷ স্যরি, মৃত মানুষ সম্পর্কে বলা উচিত নয়, তবু না বলে পারছি না। লোকটা মনিকাকে প্রচুর টর্চার করত, ফিজিক্যালি অ্যান্ড মেন্টালি। মেয়েটা ভয়ানক ডিপ্রেশনে ছিল যখন আমার সাথে তার পরিচয় হয়।

আমাদের পরিচয় বইমেলায় হয়েছিল। আমিই তার প্রতি আকৃষ্ট হই, তখন যদিও বুঝতে পারিনি সে বিবাহিতা, যখন জানলাম, তবু আকর্ষণ কমেনি একটুও। আমরা কথা বলতে বলতে একসময় একে অপরের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লাম। ও আমার জন্যই ডিপ্রেশন থেকে অনেকটা বের হয়ে আসতে পেরেছিল। আর সেটা নিয়েই ইকরাম চৌধুরীর সাথে আমার দ্বন্দ্ব। সে লেখক-কবিমহলে আমার সম্পর্কে বানিয়ে এত জঘন্য কথাবার্তা ছড়িয়েছে যে ওই সেক্টরে আমার আর যাওয়ার সুযোগ হয়নি।”

“আপনাদের সম্পর্কটা কতদূর গড়িয়েছিল?”

“আমরা গোপনে বিয়ে করেছিলাম।”

রুদ্র ভেতরে চমকে উঠলেও সেটা প্রকাশ করল না। বলল, “আরেকজনের স্ত্রীকে আপনি কিভাবে বিয়ে করতে পারেন?”

“ওদের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। কাজ এগিয়েছিল অনেকদূর। শেষে আর শেষটা দেখা হয়নি৷ মনিকা তার আগেই…আর যেহেতু ডিভোর্স পেপারে সই করা হয়ে গিয়েছিল, ওরা একে অপরকে চাইছিল না, শুধু লিগ্যাল কিছু কাজ বাকি ছিল, তাই আমরা বিয়ে করে ফেলি এই ফাঁকে। কোর্ট ম্যারেজ না, নরমালি কাজি ডেকে বিয়ে।”

“এটা কি ইকরাম চৌধুরী জানতেন?”

“হয়তোবা।”

“বিয়ের পর তিনি কোথায় থাকেন?”

“আমার বাড়িতে।”

“আর তার মৃত্যু কিভাবে হয়?”

জোবায়ের একটু যেন গম্ভীর হয়ে বসে রইল। তারপর বলল, “ও মারা যায়নি স্যার, খুন হয়েছে! ইকরাম চৌধুরী খুন করেছে ওকে।”

“মানে? আপনি কোন ভিত্তিতে এরকম একটা অভিযোগ করছেন?”

“সেদিন মনিকা নিজের কিছু জিনিসপত্র নিতে ওই বাড়িতে গিয়েছিল। তারপর আর ফিরতে পারেনি। গায়ে আগুন লেগে মারা যায়।”

“আগুন কীভাবে লেগেছিল?”

“সেটা তো জানি না। আমাকে এসবের ধারেকাছেও যেতে দেয়া হয়নি। ইকরাম চৌধুরীকে দেখে খুব সাদাসিধা মনে হলেও ওর হাত অনেক লম্বা ছিল। কেউ জানতেও পারেনি তাদের ডিভোর্স হয়েছিল, আমার সাথে বিয়ে হয়েছিল, মনিকা আমার সাথে থাকত, কিচ্ছু না৷ আমার কাছে কোনো প্রমাণও ছিল না। কাবিননামা মনিকার কাছে ছিল। সে কী করেছে আমি জানি না। সবাই জেনেছিল মনিকা ইকরাম চৌধুরীর স্ত্রী হয়ে সেখানেই ছিল৷ একটা এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমি একটা সামান্য কেসও করতে পারিনি লোকটার বিরুদ্ধে। সুযোগই পাইনি।”

রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপনি জানতেন মনিকা সন্তানসম্ভবা ছিলেন?”

জোবায়েরর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ সে বজ্রাহতের মতো চুপ করে বসে রইল। খুব ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

আরও কিছুক্ষণ নিরবতার পর জোবায়ের আবার বলল, “আমার মনে হয় এটাই ওর মৃত্যুর প্রধান কারণ। ইকরাম চৌধুরীর বাবা হওয়ার ক্ষমতা ছিল না। মনিকার প্রেগন্যান্সির খবরে লোকটা ভয়াবহ রকমের ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল।”

রুদ্র নিজে এবার বেশ খানিকটা অবাক হয়ে খানিকক্ষণ বসে রইল। উঠবার আগে সে একটা মাত্র প্রশ্ন করল, “আপনি তায়েবা তারান্নুমকে চেনেন?”

জোবায়ের সাফ জবাব দিল, “না।”

কিন্তু তার চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল সে মিথ্যে কথা বলছে।”

***

দুপুর আর বিকেলের সন্ধিক্ষণে থানায় লোকজন তুলনামূলক কম থাকে। খাওয়াদাওয়ার পর সবার শরীরে ঝিমুনি চলে আসে। সবসময় রমরমা জায়গাটা খানিকটা শুনশান মনে হয়।

এখন বাজে সাড়ে তিনটা। বাইরে টুই টুই শব্দ করে ডাকতে থাকা কোনো পাখি আর সেলের ভেতর থেকে খানিক পরপর প্রচন্ড মার খাওয়া এক অপরাধীর গোঙ্গানি ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

রুদ্র কললিস্ট ঘাটাঘাটি করছে। জোবায়ের আহমেদের কললিস্ট পেয়েও তেমন কাজ হয়নি। সন্দেহজনক কারো সাথে তাকে যোগাযোগ করতে দেখা যাচ্ছে না। তবে লোকটার মধ্যে ঝামেলা আছে। কী সেটা? এতদিন একটা খুনের রহস্য সমাধান করছিল, এখন জুড়েছে আরেকটা!

“আসতে পারি?” দরজার কাছ থেকে একজনের গলা ভেসে এলো।

পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ়। সুপুরুষ চেহারা। আগে পরিচয় না হলেও এক দেখাতে চিনে ফেলল রুদ্র। হাসিমুকে অভ্যর্থনা জানাল ভদ্রলোককে।

“কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি আমার খোঁজ করছেন শুনে নিজেই চলে এলাম।”

“ভালো করেছেন।”

রুদ্র চা কেকের অর্ডার দিয়ে লোকটার মুখোমুখি বসল। বলল, “আপনি নিশ্চয়ই কিছু বলতে এসেছেন?”

“জি। ঠিক ধরেছেন।”

“বলে ফেলুন।”

লোকটা নিচু স্বরে বলল, “আপনি ভুল পথে হাঁটছেন রুদ্র কায়সার সাহেব। এই কেসটা অনেক জটিল আর কঠিন। আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমার পেশা? ভেতরের খবর অনেকটাই জানি৷ তবু চুপ করে আছি। এটা এমনই এক জটিলতা যেখানে কারোরই জড়ানো উচিত নয়। আপনি অনুচিত কাজটা দয়া করে করবেন না। প্রকৃতি যে জিনিসটা যেভাবে ঘটাচ্ছে সেভাবে ঘটতে দিন। আপনার কাছে এটা আমার অনুরোধ।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here