পারবো না ছাড়তে তোকে,পর্ব-২৫(শেষ পর্ব)
রোকসানা আক্তার
আড্ডার আমেজ কেটে গেলে যে যার রুমে শয়ন গ্রহণ করতে চলে যায়।তবে জেরিন আপু, এন্জিলা সিস্টার এবং আমি এখনো সোফার উপর গা গেঁথে বসে আছি।সবার আড্ডা শেষ হলেও আমাদের আড্ডায় বোধহয় আজ ভোর কেটে যাবে।
কিছুক্ষণ পর সাবিলা কিচেন থেকে এসে কফি হাতে আমাদের সামনে আলবোলা ভঙ্গিতে দাড়ায়,আর গলায় খেচকি টেনে বলে,
–সারারাত জেগে জেগে আড্ডা দেওয়ার আরেক নাম গরম কফি।এই দেখো,রাত ১২টা না বাজতেই আমার চোখের পাতা নিস্তেজ হয়ে আসে,তাই তা থেকে মুক্তি লাভের একমাএ উপায় এই কফি খাচ্ছি।চাইলে তোমরাও টেস্ট করতে পারো।
আমরা সাবিলার কথাশুনে খিলখিল হেসে উঠি।জেরিন আপু হাঁক ছেড়ে বলেন,
–মন্দ বলোনি মোটেও।
–ওকে, তাহলে আমি আজ আমার নিজহাতে তোমাদের কফি করে খাওয়াবো।খুশি সবাই?
–ওকে…
পরে সাবিলা আমাদের তিনজনের জন্যে ৩ কাপ কফি করে নিয়ে আসে।আমরা স্বাদের আয়েশে চুমুক দিয়ে দিয়ে সবটা শেষ করি।
কোথা থেকে নিলয় ভাইয়া এসে আমাদের সামনে ধপ্পাস করে সোফার উপর বসে।আর হাত দিয়ে চুলগুলোকে নেড়ে বলেন,
–কি ব্যাপার সবাই ঘুমাবা না?
জেরিন আপু চোখগুলোকে আড়নয়ন করে বলেন,
–ওহ রে–তোর ঘুম পাচ্ছে নাকি রে?নাকি ভাবীকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছিস?
আমি বিষম খেয়ে বসি।এই আপুটার মুখে একদম লাগাম নেই। মুখে যখন যা আসে তাই বলে।
নিলয় ভাইয়া বলে উঠেন,
–হুমম.. আজ বউকে ছাড়া কিভাবে ঘুমাবো তা-ই ভাবছি।তোদের বলেও কি লাভ!তোরা তো আর আমার মনের কষ্টটা বুঝবি না।
–ও-মা তাই নাকি??কাল তো তোর বাসর।কাল নাহয় ভাবীকে নিয়ে একসাথে ঘুমাইস।কালকের জন্যে কোনো বাঁধা নেই।
–কাল তোমরা বাঁধা দিলেও বউ আমার।হিহিহি
আহা,,সবাই মুখখুলে হাসছে।আর আমি লজ্জা কানঠাঁসা।এদিক দিয়ে আমার অবস্থাটা কেউ দেখলো না।
জেরিন আপু আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলেন,
–কি ভাবী তুমি কি বলো?
আমি চোখদুটোতে পিটপিট ভাব এনে সবার উদ্দেশ্য বলে উঠি,
–আমার না একটু কাজ আছে। একটুপর আসছি…
এ বলে উড়াধুরা পা ফেলে আমার রুমে চলে আসি।আর সবাই আমার লজ্জা দেখে আরো বুক ফুলিয়ে হাসে।
সকাল হয়।।
যে যার কাজে ব্যস্ত।বাসায় একে একে অতিথি আসতে থাকে,আর আঙ্কেল সদরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে উনাদের সাদরে বরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা।
দুপুরের দিকে বিউটিশিয়ান আমায় বধূ সাঁজ দেয়।এখনো আমি জড়োয়া গয়না সম্মেত বসে আছি।নড়াচড়া একদমই করতে পারছি না।দমটা যেন শেষ শেষ অবস্থা।
এন্জিলা আপু কোথা থেকে এসে আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।আর আয়নার সামনে মুখটা তাঁক করে বলেন,
—কত্ত সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়!লাইক এ কুইন!লুক,লুক..?
আমিও আপুর কথায় এতক্ষণ পর আয়নার দিকে তাকাই।।নিজেকে নিজে অন্যরূপে দেখে চোখগুলোকে আর স্থির রাখতে পারিনি।
এখন কেন জানি নিজেকে খুব বউ বউ মনে হচ্ছে!আজ মনে হয় আমি অন্যের ঘরের অর্ধাঙ্গিনী।
এভাবে জেরিন আপু,রিধিকা,সাবিলা এবং অন্যান্য সাবিলা আমাকে একে দেখে যায়।
তারা সবাই চলে যাওয়ার পর আমি এখনো আয়নার সামনে ধাবমান।হুট করে পেছন থেকে কেউ বলে উঠে।।।
–তোমাকে এখন দেখতে খুব আক্রোশ জমেছে মনে।তবে ডিসিশন নিয়েছি একেবারে আজ বাসরেই তোমাকে মনভরে দেখবো।।এখনের জন্যে রেহাই দিলাম,আসল খেলা বাসর ঘরে।
সো নো হেজিটেশন ফিল,,ওকে?
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে একটা মুঁচকি হাসি দিই।কিছুক্ষণ হাসার পর মাথাতুলে পেছনের দিকে তাকাই।চোরটা এসব বলে হনহন তখনই চলে গেছে।
তারপর বিয়ের সকল এরেন্জে মোটামুটি শেষ হয়।প্রায়ই সন্ধের দিকে আমার বাবা নিলয় ভাইয়ার হাতে আমায় তুলে দেওয়ার পালা।
বাবা যখন আমার হাতটা নিলয় ভাইয়ার হাতে রাখতে যাবেন,ওমনি বুকফাটা কান্না করে দেন।আর কাঁদো মুখল বলেন,
–বাবারে,আমার মেয়েকে কখনো কষ্ট দিও না।আমি আমার মেয়েকে খুব ভালোবাসি।অনেকগুলো ট্রমার মধ্যে দিয়ে আমার মেয়ে তোমাকে পেয়েছে।তার আশাতীত জীবনে কখনো দুঃখের ছায়া ঘেঁষতে দিও না।
–বাবা আপনি আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন।আমার এই দেহে প্রাণটুকু থাকা পর্যন্ত আমি মিথির মুখটা কখনোই কালো হতে দিবনা।
নিলয় ভাইয়ার বাবা বলে উঠেন,
–মিথিলা মেয়েটাকে আমি আগে বুঝিনি।ওর মাঝে আমি যে মাতৃত্বের আভা দেখেছি,তা শত নারীকে হার মানাবে।
ওর carefulness , loving attitude, responsibility তা শত শত মেয়ের মাঝেও নেই।সত্যিকার অর্থে আমার ছেলের মিথিলার যোগ্য না।বেহাই সাহেব,মিথিলার সাদা মনে আমরা কখনোই কালির ফুটো পড়তে দিবনা।আর মা…তুই আজ আমাকে একটু বাবা বলতো?তোর মুখ দিয়ে কোনোদিন বাবা ডাক শুনি নি।
উনার কাতর মনের কথায় নিজেকে আর সামলাতে পারিনি।উনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠি,আর বলি
–আপনিও আমার বাবা এবং আমার বাবার সমতূল্য। আর খালামণি আজ থেকে আমার মা এবং আমার মায়ের সমতূল্য….
এখন রাত ১১ টা বাজে।আমি হাঁটু গেড়ে ফুলসজ্জা বিছানার উপর বসে আছি। মনে নানানও ভাবনা কাজ করছে।নিলয় ভাইয়া আমাকে নিয়ে এখন কি ভাবছেন?আমাকে আজ কি বলবেন?আমি কি আজ উনার কাছে নতুন কেউ নাকি পুরনো সেই মিথি…
এসব ভাবতে ভাবতে রুমের মধ্যে কারো গলার কাশি পাই।উনি আমার এটেনশন পাওয়ার জন্যে কাশির একটা ভান করলেন বৈ-কি।
আমি তড়িঘড়ি মাথাটা নিচু করে আনি।আর লাজুক মুখ করে সামনের দিকে ঘোমটাটি আরো বেশি টেনে দি। উনি টি-টেবিলের উপর পাগড়ীটি রাখেন।
কিন্তু টে-টেবিলের উপর উনার পাগড়ী রাখার সাথে সাথে আমার আমার উপর দিয়ে ঝড় উড়ে যাচ্ছে।বুকের হার্টবিটের গতি ১০০ গুণ হচ্ছে,সাথে রক্তিম লজ্জা আভা।
উনি এখন একদম আমার কাছে চলে আসেন।আর গলাটা পরিষ্কার করে বলে উঠেন,
–মিথি??
আমি কোনো শব্দ না করে মাথাটা নিচু করেই রাখি।
–এই মিথি?ডু ইউ হিয়ার মি?
এখন আমি আলতো মাথানাড়ি।তারপর উনি আমার কাঁধে হাত রেখে মাথাটা সোজা করেন।মাথার ঘোমটা টা সরিয়ে দেন।
ঝিলিক দাঁতে হেসে বলেন,
–এই মুগ্ধতা সৌন্দর্যের প্রশংসা হৃদয়ে।বললে ও শেষ হবে না।তারচেয়ে বরং আসল কাজটা সেরে ফেলি।
।আমি উনার কথায় থতমত খেয়ে উঠি। আর তোতলে তোতলে বলি,
–ম-মানে??
–ম-মানে হলো….আজকের এই রাতটা আমাদের জন্যে স্পেশাল রাত।আমিতো ভাবলাম,এই ফুলসজ্জা রাতটি আমাদের আর কপালে জুটবে না।কিন্তু বিধাতার দয়ায় সীমাহীন।
বায় দ্য ওয়ে আজকের রাত নিয়ে তোমার প্লান কি?
আমি শতানীর ছলে বলে উঠি,
–ঘুমানো..
উনি চোখগুলোকে খাঁড়া করে আমার দিকে অভিমান করে তাকিয়ে থাকেন।হয়তো তিনি আমার থেকে অন্যকিছু চাইছেন…
তারপর উনাকে ইগনোর করে উনাকে বলে উঠি,
–আচ্ছা সরে তো…আমি এখন ঘুমাবো।ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।
এ বলে বিছানার উপর থেকে একটা বালিশ টেনে জবুথবু কাত হয়ে শুয়ে পড়ি।
আমিও একটু অভিনয় নাহয় করলাম।কিন্তু অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পরও উনার কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না।ব্যাপার কি উনি আবার পালিয়ে গেলেন নাকি?কিছুতো একটা উপস্থিতির অস্তিত্ব পাওয়া যাবে।
তারপর মাথাটা ঘুরিয়ে আগের স্থানে তাকাই।ও’মা তিনি যে এখানে নেই।তাহলে কোথায় গেছেন..
এটা ভাবতে ভাবতে বেলকনির দিকে পা বাড়াই।পেছন থেকে কেউ আমার কোমরে হাত রেখে কোলে তুলে নেয়!
আর বলতে থাকে,
–ভালোবাসা দিবে না,না?আজ করে ভালোবাসা আদায় করবো,,হুম!!নাহলে আমার নাম নিলয় চৌধুরী নয়!
আমার মুখে অজান্তে হাসি চলে আসে।
উমমম…এই ভিজেবিড়াল টার একদম লজ্জা-সরম নেই।।
আমি লজ্জায় চোখের উপরে হাত রাখি।উনি সড়াৎ করে আমায় বিছানার চিৎ করে ফেলে দেন।তারপর শুরু হয় উনার ভালোবাসার আক্রমণ।
আজ আমারও কেন জানি উনাকে মনখুলে ভালবাসতে ইচ্ছে করছে। আর উনার ভালোবাসা নিতে ইচ্ছে হচ্ছে।আজ কোনো বাঁধা দিইনি।শুধু মন বলে–আরো বেশি ভালোবাসুন যে ভালোবাসা আমার প্রতিটি অস্তিত্বকে বিলীন করে দিবে।।
সমাপ্ত….