পারবো না ছাড়তে তোকে,পর্ব ৮+৯
রোকসানা আক্তার
পর্ব-০৮
মা টেনেহিঁচড়ে আমায় বাসায় নিয়ে আসেন।তবে,পিছুটান মায়াটা এখনো হৃদয়ে বাঁধছে।নিলয় ভাইয়ার অশ্রুসিক্ত মুখখানা আমার মুখের সামনে বার বার ভাসছে।।
—–কি হলো?আমার প্রশ্নের জবাব যে দিচ্ছিস না?
মায়ের ঝংকার আওয়াজের শব্দ আমার কানে আসতেই টনকটা নেড়ে উঠে।বুঁকের কাঁপনি বেড়ে যায়।এতক্ষণে আমার খেয়ালই ছিল না আমি যে মা-বাবা,রিধির সামনে বসে আছি সোফার উপর…!!অনেক কষ্টে মুখতুলে মায়ের দিকে তাকাই।দেখি মা তেলেবেগুনে মুখখানা আগুন করে কঠোর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।বাবা সাদাফ্রেমের চশমাখানি বা’হাতে আলতো রেখে কপালে হাত গুঁজে নির্বিঘ্নে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছেন।।
—–বুঝছি!!তুই আমার কথার জবাব দিবি না।কারণ,সে মুখতো আর রাখিস নি।ওখান থেকে ডিভোর্স লেটার আসলে তাড়াতাড়ি সই করে দিস!নাহলে, তোর কপালে দুর্গতি আছে!!
মায়ের একথাটি শুনা মাএই আমার বুকের মাঝখানটায় ছ্যাৎ করে উঠে যেন কেউ আমার হৃদপিণ্ডটা একটানে ছিঁড়ে বের করে নিয়েছে।
—-ম-ম্মা,এ-এ-সব তুমি ক-কি বলছো!?
—-আবার বলতে হবে???
—–ম্মা,যা-ই বলো তবে এটা আমি পারবো না।
মা আর একমুহূর্তে বসে না থেকে সোফা থেকে দাড়িয়ে ঠাস ঠাস করে আমার দু’গালে কষিয়ে চড় মারেন।
—–বেয়াদব মেয়ে!!আবার পাল্টা জবাব তোলে।তুই আমাদের মান-সম্মান রাখলি আর?এখন ভাইয়া,রুপাতাকে আমি কিভাবে মুখ দেখাবো!?কিভাবে উনাদের সামনে যাবো!!ওকে যা ভুল করে ফেলেছিস,এখন ডিভোর্স পেপারে সই করে দিস।।
এ বলে মা আমার সামনে থেকে চলে যান।মা চলে যাওয়ার পর আমি গালে হাত রেখে বাবার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিষ্পাপমুখে কাঁদতে থাকি।বাবাও আর দেরী না করে চোখের কোটরে জমা হওয়া পানি কোনোমতে মুছে চশমাটা চোখে এঁটে উনার রুমে চলে যান।আমি হাউমাউ রিধিকে ধরে কাঁদতে থাকি।।
—–রিধিরে,পৃথিবীর সব ছাড়তে পারবো তবে আমি নিলয় ভাইয়াকে পারবো না ছাড়তে।কারণ,আমার প্রতিটি দমের উনিই নিঃশ্বাস যাকে ছাড়া আমি প্রাণহীন।।
——আপুরে আমি জানি!!
——রিধি??সবাই জানলো কিভাবে আমরা যে ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছি?
রিধি চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে,
——আপু দাড়াও সব বলতেছি।নিলয় ভাইয়া যে রুমটি ভাড়া নিয়ে তোমায় লুকিয়ে রেখেছিলেন ,ওই ফ্লাটের মালিক তোমাদের সন্দেহ করেন।কারণ,তোমায় একা ঔ রুমে বদ্ধ রাখায় ঔ মহিলা ভেবেছিলেন তোমরা দেহব্যবসায় জড়িত । অতঃপর সন্দেহভাজনে ঔ মহিলা থানায় গিয়ে পুলিশকে এসব ব্যাপারে বলে আর নিলয় ভাইয়ার ডিটেলস পুলিশদের হাতে তুলে দেয়।
পুলিশরা ডিটেলসটি দেখে অনেকটা ঘাবড়ে যায়।কেননা,উনারা নিলয় ভাইয়াকে চিনে গেছেন।কারণ,ওই থানার পুলিশরাই তোমার নিঁখোজ তদন্তের চেষ্টায়রত ছিলেন।বদ্ধ রাখা ঔ মেয়েটিই কি তুমি হবে?নাকি তুমি পাল্টা পার্ট নিয়ে সবাইকে বোকা বানাচ্ছে! এই ভেবে সন্দেহের জাল বুনে উনাদের মনে।সেই ভেবে উনারা নিলয় ভাইয়াকে অনুসরণ করতে থাকে আমাদের এই তথ্যগুলো গোপন রেখে।।
এট লাস্ট কাল রাতে যখন নিলয় ভাইয়া তোমাকে আনতে যায় ইংল্যান্ড যাওয়ার উদ্দেশ্যে?আর এদিক দিয়ে বাড়িতে নিলয় ভাইয়ার পালিয়ে যাওয়ার কথা ছড়াছড়ি হতে থাকে চারদিক।ওই মুহূর্তে ফ্লাটের ওই মহিলার থেকে সম্পূর্ণ সব জেনে পুলিশ তোমাদের পিছু নেয়।আর এয়ারপোর্ট পর্যন্ত তোমাদের অনুসরণ করতে থাকে।দ্যান,সবটা আঙ্কেলকে খোলসা করে বলে এবং আঙ্কেল,মা,মামানি ছুটে যান এই সংবাদ শুনে এয়ারপোর্টে।।।
এসব বলতে বলতে রিধি হাঁপিয়ে উঠে।।
—-উফস,আপু?ওই শতান মহিলার কারণেই আজ এই দুর্দিন দেখতে হলো!!
—–ওই মহিলার কোনো দোষ নেই রিধি।দোষ আমাদের কপালের….
কান্না দমিয়ে রাখতে না পেরে রুমে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিই ।।বিছানার উপর বসে শুধু হাঁপাতে থাকি।আর বার বার নিজেকে দেখতে থাকি।মনের কোণে কতধরনের ভাবনা আবির্ভূত হতে থাকে।।
—-আজ নাকি আমার বিয়ে হয়েছে!আজ নাকি আমি কবুল বলে অন্যের স্ত্রী হলাম।আজকের রাত নাকি বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর জন্যে অন্যতম রাত!!কই??রুমে যে কোনো ফুল নেই,রুমে যে কোনো সুগন্ধি ফুলের সুভাস নেই??আছে শুধু নিদারুণ কান্নার প্রতিধ্বনি। হে খোদা,তোমার কাছে কি এমন একটা রাতের জন্যে এতটা বছর অপেক্ষা করেছিলাম?বলো??নাকি এটাই তোমার থেকে পাওয়ার যোগ্য!!কেন পোড়াকপালি হলাম……
কাঁদতে কাঁদতে বিছানার উপর আধশোয়া ক্লান্ত গা এলিয়ে দিইই।হঠাৎ চারদিকে ফজরের আযান পড়তে থাকে।।৪ঃ৪৫ বাজে বুঝতে সমস্যা হয়নি।।
বিছানা থেকে উঠে বাথরুমের বেসিনে গিয়ে মুখে একটা পানির ঝাপসা মারি।চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে আছে,চোখগুলো কেমন ফুলে গেছে,মুখটা কেমন বিবর্ন কালার ধারণ করেছে।।অতঃপর আরো দু’তিনটেও পানির ঝাপসা মুখে দিই।
পরমুহূর্তে নামাজের ওযুটা সেরে জায়নামাজ নিয়ে ফজরের নামাজে দাড়িয়ে পড়ি।।মোনাজাতে দু’হাত তুলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আমার মন-দেহ,প্রাণ।
-হে আল্লাহ,পৃথিবীর সব ছাড়তে রাজি,তবে নিলয় ভাইয়াকে আমি ছাড়তে পারবো না।তাকে আমার থেকে আলাদা করো না মাবুদ।নাহলে আমি মরেই যাবো।
হে আল্লাহ,তুমি আমার স্বামীকে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও খোদা।কেন এত কষ্ট দিচ্ছ আমায়,বলো??আমি যে এ কষ্টের ভার আর সইতে পারছি না।।
অনেকক্ষণ অব্দি ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে অতঃপর জায়নামাজ টা ভাঁজ করে রেখে বিছানার উপর কাঁত হয়ে শুয়ে পড়ি।।
সারা শরীর হান্নাতান্না করছে।ঘুম তো চোখ থেকে সেই কখনই উধাও…..
আস্তে আস্তে কালো ভোরের অন্ধকার কাটিয়ে দিনের আলো আমার রুমে উঁকি দেয়।কিছুক্ষণ পর সূর্যি মামার চিকচিক আলোটাও আমার রুমে এসে নাচতে থাকে।
রিধি কিছুক্ষণ পর পর দরজা ধাক্কাছে নাস্তা করতে যেতে।আমি বারংবার নিষেধ নাস্তা করার মুড নেই এখন।তারপরও শুনে নি…এভাবে দরজার ঠেলাঠেলির আওয়াজ মায়ের কান অব্দি পৌঁছায়।
—–ও দরজা খুলছে না??
——ন-না মা!!
——ওর সাহসতো কম না।এখন কাজ ঘটিয়ে আবার নাটক শুরু করলো নাকি??ওকে তাড়াতাড়ি বল দরজা খুলতে,নাহলে আমি আসতেছি..
—-আহা!!তুমি একটু থামো না??মেয়ের এখন নাস্তা করতে হয়তো ভাল্লাগছে না,তাই আসতে চাচ্ছে না।এটার জন্যে এত চেঁচামেচি করা লাগে নাকি??(বাবা)
——এই তোমার আশকারার কারণেই তোমার মেয়ে আজ এত্ত বড় কান্ড ঘটিয়ে এসেছে।
বাবা মায়ের কথায় চুপসে যান।তারপরও আমি দরজা খুলি নি।।রিধি বাধ্য হয়ে চলে যায়য়।।
বেলকনিতে এসে অনেকক্ষণ অব্দি শহরের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশটা দেখতে থাকি।মাঝে মাঝে কিছু মানুষকে খুব সুখী মনে হয়।যারা ভোর না হতে রিক্সা নিয়ে বের হয়,যারা গার্মেন্টসের দিকে ছুটে চলে তড়িৎ বেগে,যারা ইটপাটকেল মাথায় বোজাই করে ছুটে চলে গন্তব্যে তাদের মুখে নিবৃও হাসির রেশ টুকু অবিরল।খুবই ইচ্ছে হয় ওদের মতো যদি আমার মুখে হাসি থাকতো।ওদের মতো যদি স্বাধীন ভাবে চলাচল করতে পারতাম,ওদের মতো যদি কষ্টগুলোকে বিসর্জন দিয়ে আবার পায়ে চলতে পারতাম।
কিন্তু না এখন তো আমি খুঁড়ে,চাইলেও বদ্ধ রুমটা কারাবাস।কারো সামনে যেতেও পারছি না,আবার কারো কথা মানতেও পারছি না।।
এসব ভাবান্তরের মাঝে কানের কাছে সাবিলার কন্ঠস্বর ভেসে আসে।।
—–ফুঁপি??নিলয় মানছে না ডিভোর্স পেপার বানাতে!!প্লিজজ?ডিভোর্স পেপারটা আপনারাই বানান,আর আপনার মেয়েকে বলুন সই করে পাঠিয়ে দিতে নিলয়ের কাছে….।।
—–আমি চেষ্টা করতেছি সাবিলা।আর ভাবি?আপনি কোনো চিন্তা করবেন না,আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
——ওকে ভাবি।সে আশায়ই আছি।জানি আপনি পারবেন।আর নিলয়ের বাবা রাগে কাল থেকে মুখে কিছুই তুলছেন না।উনার বাবাকে দেওয়া কথা উনি কোনেমতেই ফেলতে পারবেন না।দরকার হলে উনার জানটা চলে যাবে,তারপরও উনি উনার বাবার রাখা কথার পরিণতি ঘটিয়েই ছাড়বেনন।(সাবিলার মা)
——-সে ভাবি আমি জানি্আমি নিলয়ের বাবা অক্ষরে অক্ষরে চিনি উনি কেমন ধরনের মানুষ।।
——হু।আপনার মেয়ে কোথায়???
——ও রুমের মধ্যেই ভাবি।
——অউউ,ওকে বলবেন ডিভোর্স পেপারটা বানিয়ে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিতে।ওকে বলবেন,নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে ফ্যামিলির কথা ভাবতে।কারণ ওদের এই নির্মম কাজের জন্যে কতগুলো মানুষের কতটুকু ব্যথা অনুভব করা লাগতেছে।।।
—–আপনি একটু আসেনন তো ভাবি…
এ বলে মা আমার রুমের দিকে ক্রম এগুতে থাকেন।আমি দরজার পাশ থেকে সরে যাইই।।
——মিথিলা??দরজা খোল???
মা দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে থাকেন,আর ধাক্কাতে থাকেন।
——ওই দরজা খোল???কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবি এখানে???
আমি ভয় পেয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরি।আমার কেন জানি কারো সাথে দেখা/কথা বলতে মোটেও ইচ্ছে হচ্ছে না।নিজেকে সবার দৃষ্টি অগোচরে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়।।
এভাবে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে দরজাটা একদম খুলেই যায়।আমি দরজার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠি।।মা আমার দিকে তেড়ে এসে চুলের মুঠি ধরে গালে চার আঙ্গুলের ছাপ বসিয়ে দেয়।।
——বেয়াদব মেয়ে,বেশি বেড়ে গেছিস, না???এখনই তুই ডিভোর্স পেপার বানাতে আমাদের সাথে যাবি,চল???
মা আমার চুলির মুঠি ধরে টানতে টানতে রুম থেকে বের করেন।।আর রুম থেকে বের হওয়ার পরই সাবিলা,সাবিলার মা আমায় আঁকড়ে ধরে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে থাকেনন।
আমার চিৎকার,কান্নার আওয়াজ পৃথিবী যেন থমকে যাচ্ছে।গাছে কোনো পাতা নড়ছে না,পাখিরা তাদের মনে গান গাচ্ছে না,সূর্যটা বিষণ্ন রঙ্গে ছুৃয়ে যাচ্ছে।।
যেই আমায় জোরজবরদস্তি করে গাড়ির মধ্যে ঢুকাবে ওমনি আমি শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে সবাই ছিটকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিই।দৌড়াতে থাকি দ্রতপায়ে।আর রাস্তার অলিগলির মধ্যে দিয়ে একমনে দৌড়ানোর প্রতিযোগিতা চলে আমার।আমি নিজেও জানি না,আমি কোথায় যাচ্ছি!!মন শুধু একটা কথাই বলে নিলয় ভাইয়ার কাছে যেতে চাই নিলয় ভাইয়া আমায় এ থেকে রক্ষা করবে।।ও আমার রক্ষাকারী।। ও আমায় এ বিপদ থেকে বাঁচাবে।
আমার পেছনে পেছনে বাড়ির দারোয়ানও দৌড়াতে থাকে। বেহুতাশ মনে আমার শরীরের ঘামগুলোও লাফাতে থাকে।।।
দৌড়াতে দৌড়াতে একটা বাড়ির সামনে এসে থমকে যাই।কারণ,এমুহূর্তে আমি এখন নিলয় ভাইয়াদের বাড়ির গেইটের সামনে দাড়িয়ে আছি।ওদিকে দারেয়ান প্রায়ই আমার কাছ অব্দি চলে আসছে।
কিছু না ভেবে তরহর গেইটটায় ধাক্কা দিয়ে বাগান,সুইমিংপুল পেরিয়ে মেইন ডোরের সামনে চলে আসি।।।
আর দরজা খোলার জন্যে জোরে জোরে ধাক্কাতে থাকি।।।
——দরজা খুলো??কে আছো দরজা খুলো???প্লিজজ দরজাটা খুলো….
ক্ষণিকে দরজাটি খুলে দেয় খালামণি।খালামণি আমায় দেখামাএই মুখে আতঙ্কের হাত এঁটেন।আমি আর তা পরোয়া না করে উনাকে এড়িয়ে নিলয়ের রুমের দিকে চলে আসি।।
গিয়ে দেখি নিলয় ভাইয়ার রুমের মধ্যে নির্বিঘ্নে বসে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে।।
আমি আর দেরী না করে “নিলয় ভাইয়া”–শব্দটা জোরে উচ্চারণ করে উনাকে গিয়ে জোরে জড়িয়ে ধরি।।
—-প্লিজক নিলয় ভাইয়া, আমাকে বাঁচান?আমাকে বাঁচান উনাদের থেকে।আমি শুধু আপনাকেই চাই।আমি আপনাকে ছাড়তে পারবো না।।
চলবে….
পারবো না ছাড়তে তোকে
পর্ব-০৯
রোকসানা আক্তার
নিলয় ভাইয়ার বুকের উপর মাথা রেখে এসব বলি আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি।।উনি হাত দুটো সরু করে সং-এর মতো দাড়িয়ে আছেন।আমার কথার জবাব তুলছেন না।
এরইমধ্যে সবাই দরজার দিকে চলে আসেন।নিলয় ভাইয়ার মা চোখদুটোকে ধাঁধিয়ে নিলয়কে ধমকের সুরে বলে উঠেন,
—–নিলয়!!!!ভালো হচ্ছে না কিন্তু!
—–নিলয় মিথিলাকে একটু ছাড়িয়ে আমার কাছে নিয়ে আসো বাবা।(বিনয়ের সুরে আমার মা বলেন)
—–মিথিলা,বেশি ন্যাকামো করছিস কিন্তু,পরে এর পরিস্থিতি অনেক ভয়ানক হবে বলে দিলাম।(সাবিলার মা)
তারপরও আমি নিলয় ভাইয়ার কলার ছাড়ছি না।আমি একনাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছি।আমি একবুক আশা নিয়ে এই মানুষটির বুকে ঠায় মাথা পেতে আছি।অন্তত কেউ না বুঝুক,এই মানুষটি তো আমাকে বুঝবে…..।এই মানুষটিতো আমায় রক্ষা করতে পারবে।।
নিলয় ভাইয়া মুখ থেকে জোরে একটা নিঃশ্বাস ভেসে আসে,যেটির প্রতিটি বালুকণার শব্দ আমার মস্তিষ্কে এসে জানান দিচ্ছে।।উনার নিঃশ্বাসের কণায় আমার চুল দুলে উঠে।উনার গরম নিঃশ্বাসে আমার মুখে ধোঁয়া উপড়ে উঠে।
অতঃপর হালকা ঠোঁট নেড়ে সবার দিকে দৃষ্টি এড়ে বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে রাখা মানবটির দিকে তাকান।ডানহাতটা আলতো আমার মাথায় স্পর্শ করে আমায় ছাড়িয়ে নেন উনার থেকে।আমার মুখের চাহনি মুহূর্তের মধ্যে ফ্লোরের দিকে চলে আসে।খেচকি দিয়ে গলাটা হালকা ঝেড়ে নিয়ে বলেন,
—–মা এখন তোমরা আসতে পারো।আমি দরজা বন্ধ করছি।
এ বলেই উনি তরহর করে উনাদের সামনে ঠাস ঠাস করে দরজাটা অফ করে ফেলেন।আমি অবাকের চরম পর্যায়ে নিলয় ভাইয়ার এমনটি দেখে।আমি হাঁক ছাড়ার আগেই উনি আমাকে হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলেন।
——নিলয়,ভালো হচ্ছে না কিন্তু??তোর বাবা অফিস থেকে ফিরে এসে যদি এসব কান্ড দেখে সত্যি তোকে মাটিতে ফুঁতে ফেলবে,নাহয়—–দরজার ওপাশ থেকে নিলয়ের মা বলে উঠেন।
—–উফস মা,আমরা একটু রোমান্স করতেছি।ওহ,এত জ্বালিও নাতো।জানোতো,একই রুমে তোমার ছেলে এবং তোমার বউ এই মুহূর্তে অবস্থান করছে।সো ডোন্ড ডিস্টার্ব আস এন্ড কেটে পড়ো তাড়াতাড়ি।
উনার কথায় আমার মুখটা লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠে।উনি এসব কি বলতেছেন মাথায় কি সব গোবর!!?
তারপর সবাই অনেকক্ষণ অব্দি দরজার সাথে যুদ্ধ করে আর ফেরে উঠতে না পারে এক পাহাড় বিরক্তি মাথায় নিয়ে চলে যায়।
আমি হালকা একটা দম ছাড়ি।নিলয় ভাইয়া মিটিমিটি হেসে আমার দিকে তীর্যক তাকিয়ে বলেন,
—–ভয় পেও না মিথিলা।কিছুই হবে না তোমার।
আমি ডান কানের পেছনে চুলগুলো গুঁজে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ি।নিলয় ভাইয়া আস্তে আস্তে হেটে আমার কাছে আসেন।আর উনি উনার দু’হাত দিয়ে আমার ঘামমিশ্রিত মুখটা উচিয়ে কপালে আলতো একটা চুমু এঁটে দেন।
—-ভীষণ ক্লান্ত তুমি।যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বাথরুমে চলে আসি।বাথরুমের আয়নায় মুখটা রাখতেই আমার চোখ-মুখে ভয় চলে আসে। মুখে মলিনতা একটা ছাপ উপলব্ধি করতে পারি।হুটহাট দমকা ঝড়ে আমার মনটা বিচলিত হয়ে যায়।চোখের কোটরে বিন্দু বিন্দু জমা হওয়া পানিগুলো বড্ড বেমানান। বারংবার আমায় কষ্ট দিয়ে আমার হৃদয় অন্তক্ষরণ করে ফেলে।
নিলয় ভাইয়া ওপাশ থেকে বলতে থাকেন,
——মিথিলা,হ্যান্ডওয়াশ অর অন্যকিছু লাগলে বলবে।
আমি উনার কথায় কেঁপে উঠি।তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধুঁয়ে নিই।কিন্তু হাত-মুখ ধোঁয়ার পরও গায়ে জড়ানো জামার দুর্গন্ধ নাকে আসে।সেই কবে যে শেষ গোসল করেছিলাম ঠিক মনে নেই।আর, আজ ময়লা-আবর্জনা রাস্তা দিয়ে দৌড়েও জামায় প্রায়ই অর্ধেক ময়লার মাখামাখি।। নিলয় ভাইয়াকে এ ব্যাপারে কিছু বলবো?আর বললে উনি কিছু ভাববেন নাতো?যদি এমতাবস্থায় উনার সামনে যাই তাহলেতো দুর্গন্ধে নাক ছিটকাবেন।নাহ, নাহ গোসলটা সেরে নেওয়ায়ই ভালো হবে।তবে,জামা-কাপড় কোথায় পাবো এ মুহূর্তে??উনার রুমেতো মেয়ে মানুষের কোনো জামাকাপড় থাকার কথা না।।আচ্ছা তারপরও বলে দেখি।এ ভেবে বাথরুমের দরজাটা আলতো ঠেলে বাথরুম থেকে বের হই।উনি দু’হাটু গেড়ে কোলের উপর একটা বালিশ নিয়ে ল্যাপটপ ঘাটাঘাটি করছেন।গায়ে সাদা একটা গেন্জি এবং থ্রী কোয়ার্টার টাউজার পড়ে বামহাতটা থুতনির নিচে গুঁজে গভীর মগ্নে ল্যাপটপের দিকে মনোযোগ। উনাকে এই গেটআপে আকাশচুম্বী রাজকুমারের মতে লাগতেছে।সত্যি,আমি বোধহয় উনার সমকক্ষ কখনো সৌন্দর্য ছুঁতে পারবো না।এতটাই উনি সুন্দর।
আমি যখন আর একটু সামনে পা বাড়াই তখন উনার চোখ পড়ে আমার দিকে।আমি উনার থেকে চোখ সরিয়ে এদিকওদিক তাকাতে থাকি।উনি আমার কথার গোছ বুঝতে পেরে বলেন,
——-কিছু বলবে??
——-ম-ম্মা—নে——
——-আচ্ছা হ্যাজিটেশন ফিল না করে ক্লিয়ার বলো আমায়।
———– —— —–
আমার কথার জবাব না পেয়ে উনি ফোঁড়ন কেটে আবারও বলেন,
——-আচ্ছা তুমি এতো লজ্জা পাচ্ছো কেন, বলোতো???এতদিন তো স্বাভাবিক ছিলে।আর আজ এতটা নার্ভাস,বাট হোয়াই???
উনার কথাগুলো শুনেও আমার মাঝে কোনোরকম অনুভূতি জাগার শব্দ আসছে না।এবার উনি বিরক্তিবোধ নিয়ে বলেন,
—–উফস,মিথিলা!!প্লিজজ বলো??
——ম-ম-মানে, নিলয় ভা-ভা-ইয়া আমার জা-জামায়——
এ বলে আবারও চুপসে যাই।আমি কি করবো আমার মুখ দিয়ে তো কোনো কথাই আসছে না।উনি কেন বুঝছেন না!(মনে মনে)
উনি “জামা” কথাটি শুনামাএই আমার দিকে চোখবুলান।আমাকে ভালোভাবে পরখ করেন।
——ওয়েট মিথি?মা কিছুদিন আগে একটা জামদানী শাড়ি আমার রুমে রেখে গিয়েছিলেন,ওটা তোমায় দিচ্ছি পড়ে নিওও।এ বলে উনি ল্যাপটপটা অফ করে ওয়ারড্রবের দিকে অগ্রসর হোন।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নাঁজেহাল অবস্থায় পড়ি।উনার রুমে খালামণি শাড়ি রাখলেন কেন?মনে একটা বিদঘুটে প্রশ্ন আকুপাকু খায়।
—–এই নাও??
আমার হাতে নিলয় ভাইয়া একটা গাঢ় নীল জামদানি শাড়ি তুলে দেন।কারুকাজ খচিত নীল শাড়িটির নকশায় আমি আকস্মিক।তারপর উনার থেকে শাড়িটির নিয়ে বাথরুমের দিকে রওনা করি।উনি পেছন থেকে বলে উঠেন,
——-এই শুনো??আমাকে কিন্তু আর ভাইয়া বলে ডাকবে না।
মনের অজান্তে উনার কথায় আমার মুখে একটা হাসি চলে আসে।আর মাথাটা হেলিয়ে বাথরুমে ঢুকে যাইই।
—
—-শাড়িটা পড়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসি।বের হতেই নিলয় ভাইয়ার নজর পড়ে আমার দিকে।আমি লজ্জায় কাচুমাচু খেয়ে বসি।উনি মুচকি হেসে আবার ল্যাপটপে মনোযোগ দেন।এখন এতটাই ব্যস্ত উনি নতুন মানুষটিকে দেখেও এড়ে যাচ্ছেন।
আস্তে আস্তে বিছানার একপাশে এসে বসি।কিছুক্ষণ পর উনি মাথা থেকে হেডফোন টা সরিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
——-উফস,টেরী একটা প্রজেক্টে আঁটকে গিয়েছিল।ওকে সল্যুশন রুলস দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম।—–টেরী উনার ক্লাসমেট।
আচ্ছা তুমি বসো।আমি গিয়ে গোসলটা সেরে আসি।।
এ বলেই নিলয় ভাইয়া বিছানা থেকে একলাফ মেরে উঠে পড়েন এবং হনহনিয়ে ড্রেস নিয়ে বাথরুমে।
উনার এই বাচ্চামো স্বভাবটা আমার প্রায়শই ভালো লাগে।হুটহাট দুষ্টমিট ছলে সবকিছু সহজ ভেবে নেন।সত্যিই উনার সহনশীল ক্ষমতা অনেক।।
আমি বিছানা ছেড়ে উঠে আয়নার সামনে নিজেকে এই সাঁজে দেখতে থাকি।মুখে হালকা একটা ক্রিম মেখে পাউডার ওয়াশ দিয়ে মুখটা শুষ্ক করে নিই।আর শাড়িটির অগোছালো কুঁচি ঠিক করি।এভাবে অনেকক্ষণ নিজেকে আয়নার দেখতে থাকি।
পেছন থেকে নিলয় ভাইয়া আমার কোমরে হাত রেখে আমায় জড়িয়ে ধরেন।আর টানা টানা গলায় বলেন,
——আমার অধিকারিণী, আজ তোমায় অন্যান্য দিন থেকে অন্যতম লাগতেছে।এত্ত সুন্দর কেন তুমি??
উফস আবার আরেকটা লজ্জা পেলাম।এই ভাইয়াটার মুখের লাগাম কম। যখন মুখে যা আসে তাই বলে ফেলে।যা করতে ইচ্ছে হয় তাই করে।।
——-কথা বলছো না যে মিথি??
তারপর টাল সামলিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করি।
——-ভা-ভা-ভাইয়া??
একথা শুনার সঙ্গে সঙ্গে উনি আমাকে ঘুরিয়ে নেন উনার দিকে এবং আমার ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রাখেন।
——তোমায় না বললাম?আমায় ভাইয়া না ডাকতে??
——হু….
——তাহলে বলো কেন??
——-আ-আ-আসলে,আমার মুখ দিয়ে “ভাইয়া” ছাড়া আর কোনো শব্দ আসছে না।
উনি উদাস হাসিতে ফেটে পড়েন।আমি চোখগুলো পিটপিট করে বলি,
——হা-হাসলেন কেন???
——কারণ,আমি তোমার স্বামী।আর তুমি আমার স্ত্রী।সো আমায় ভাইয়া না ডেকে”নিলয় তুমি ” বলে ডাকবে।ওকে???
এ বলে উনি আমায় কোলে তুলে নেন।আর বিছানার উপর শুইয়ে দেন।উনি শরীরের দিকে ঝুঁকে আসতেই আমি উনাকে বাঁধা দিই।
——এটা ঠিক না!
উনি অনেকটা অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যান।তোতলে তোতলে বলেন,
—–কে-কে-কেন,মিথিলা??
—–আমাকে এবং আপনাকে পরিবারের কেউই স্বামী-স্ত্রী বলে সম্মতি দেয় নি।তাই সে সুবাধে স্পর্শ করার কোনো মানে হয় না ।কারণ,সামনে অনেক পথের সামিল হতে হবে।
এই ঝড়ে হেরে গেলে আমার যে অকূল পাথার।আল্লাহ না চায় যদি কোনো অঘটন ঘটে গেলো,তখন???আর আমিতো সবার বিরুদ্ধে গিয়েছি।জানি না এই ভুবনে যদি আপানকে হারিয়ে ফেলি।।
——মিথি??
উনার উচ্চ আওয়াজের শব্দে আমি তাড়াতাড়ি চোখবুঁজে নিই।ভাইয়া মুহূর্তে আমাকে ছাড়িয়ে বেলকনির দিকে চলে যান।।হয়তো ক্রুদ্ধ হয়েছেন ভীষণ।কিন্তু আমারতো কিছুই করার নেই।আমি যে নিরুপায়!!পরবর্তীতে পরিস্থির টাল না সামলাতে পারলে এই ভালোবাসার উষ্ণতা আমায় তিলে তিলে পুড়াবে।
চলবে…..