পিছুটান,পর্বঃ ০২
লেখকঃ আবির খান
স্যারের প্রশ্নে আরশি ঘোর থেকে বের হয়। তার উপর স্যারকে একদম চোখের সামনে দেখে ও অনেকটা ঘাবড়ে যায়। তাও নিজেকে সামলে লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে বলে,
~ জি স্যার।
— আচ্ছা দাঁড়িয়েছো কেন? কোন সমস্যা?
আরশি আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সবাই ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আসলেই তো ও দাঁড়িয়েছে কেন? আরশি নিজেই জানে না এই প্রশ্নের উত্তর। ও লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। স্যারটা হয়তো ওর অবস্থা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে। তাই তিনি আর কথা না বাড়িয়ে বললেন,
— আচ্ছা এখন বসে পড়ো। মনে পড়লে পরে বলো।
আরশি দ্রুত বসে পড়ে। আর মনে মনে খুব খুশি হয়ে। স্যারটাও আরশির দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে আবার সবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলেন,
— তো এবার আমার পরিচয় দেওয়া যাক। আমি নিয়ন আহমেদ। আপনাদের একাউন্টটিং লেকচারার। আমার কাছ থেকেই আপনারা সবাই একাউন্টটিং এর সবকিছু শিখবেন। আমি এই ভার্সিটি থেকেই পড়াশোনা শেষ করেছি। জানি না কেন হয়তো আমার রেজাল্ট ভালো থাকায় আবার এই ভার্সিটিতেই আমি লেকচারার হিসেবে জবটা হয়ে যায়। সবই মহান আল্লাহর ইচ্ছা। তাই বলা যায় এই ভার্সিটির সাথে আমি অনেকটা বছর যাবৎ জড়িত আছি। সুতরাং কারো কোন সমস্যা হলে নির্ভয়ে আমাকে বলবেন। আমি সাহায্য করার চেষ্টা করবো। আমি কিন্তু আপনাদের শিক্ষক হয়ে এখানে আসি নি। এসেছি আপনাদের বন্ধু হয়ে৷ তবে হ্যাঁ, বন্ধু শুধুমাত্র আমি পড়া শেখানোর সময়। পরীক্ষার সময় কিন্তু আমি একজন দায়িত্ববান শিক্ষক। অবশ্যই সেটা মাথায় রাখবেন৷ তাহলে এবার একে একে আপনাদের পরিচয় জানা যাক৷ আপনি শুরু করুন৷
ক্লাসের প্রতিটি স্টুডেন্ট নিয়ন স্যারকে অনেক পছন্দ করেছে৷ তার এত সুন্দর ব্যবহার, কথা আর বন্ধুসুলভ আচরণ সবাইকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে। সবচেয়ে বেশি করে আমাদের আরশিকে। ও তো স্যারের নাম শুনে শুধু নিয়ন নিয়ন করছে৷ পাশ থেকে অনু বলে উঠে,
~ দোস্ত স্যারটা আসলেই অনেক হ্যান্ডসাম আর অনেক ভালো তাই না?
~ হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছিস। আমি তো অনেক ভয়ে ছিলাম। কিন্তু এরকম একটা স্যার পাবো আমি ভাবতেও পারিনি৷ তাই না আরশি?
~….. (আরশি শুধু স্যারের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে)
~ এই আরশি কি হয়েছে তোমার? (তন্নি)
অন্নির ডাকে ওর হুশ হয়। ও বলে,
~ প্রেমে পড়েছে মন প্রেমে পড়েছে। অজানা ওই স্যারের প্রেমে পড়েছে।
~ কি বলছো? (অনু)
~ আরে এই তো সেই স্যারটা যিনি সকালে আমাকে বাচিঁয়েছেন। যার উপর আমি ক্রাশ খেয়েছি। উফফ! কি কিউট উনি।
~ বলো কি? (তন্নি)
~ হুম। (লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে)
~ আসলেই স্যারটা অনেক কিউট। যে কোন মেয়েই ওনার জন্য পাগল হয়ে যাবে। তাই না তন্নি? (তন্নি)
~ হ্যাঁ একদম। (অনু)
~ হলে হোক। উনি শুধু আমার এবং আমার। আর কারো না৷ (আরশি)
~ আচ্ছা ঠিক আছে৷ যাও আমরা দুজন ভাগ উঠিয়ে নিলাম। কিন্তু বাকিরা কি উঠাবে?
~ উঠাতেই হবে৷ নাহলে খবর করে ফেলবো। হুহ।
~ হাহা। (ওরা দুজন হেসে দেয় আরশির কথা শুনে)
এরপর সবাই সবার পরিচয় দিতে দিতে আরশির পালা আসে। আরশি লজ্জাসিক্ত মুখখানা নিয়ে দাঁড়িয়ে স্যারের দিকে তাকিয়। কিন্তু লজ্জায় কিছু বলতেই পারছে না। নিয়নকে দেখে শুধু ও হারিয়ে যাচ্ছে বারবার। পাশ থেকে অনু হঠাৎ করে গুতো দেওয়ায় আরশি থতমত খেয়ে বলে উঠে,
~ আ…আমি আরশি খান৷ * কলেজ থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়ে এইচএসসি পাশ করেছি। (দ্রুত স্বরে বলল)
— ওহ! খুব ভালো। সবসময় মন দিয়ে পড়াশোনা করবে৷ বসো। নেক্সট..
আরশি নিয়নের দিকে তাকিয়ে বসে পড়ে। তন্নি ওর পরিচয় দিচ্ছিল। কিন্তু নিয়নের সাথে বারবার আরশির চোখাচোখি হচ্ছিল। হবেই বা না কেন? আরশি বেশ মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে মুগ্ধ হয়ে নিয়নের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিয়ন না চাওয়া স্বত্ত্বেও আরশির দিকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল। ও দ্রুত সবার পরিচয় জেনে পড়াশোনা নিয়ে কথা বলা শুরু করে। আর আরশি চাতক পাখির মতো শুধু নিয়নকে দেখতে থাকে। ওর কথা শুনতে থাকে। এভাবে ওদের একাউন্টটিং ক্লাস শেষ হয়।
— তাহলে কাল তোমাদের সাথে আমার আবার দেখা হচ্ছে। অবশ্যই সবাই বই নিয়ে আসবে৷ (নিয়ন)
— ওকে স্যার। (সবাই)
বলেই নিয়ন চলে যায়। যাওয়ার সময় আবার আরশির সাথে ওর চোখাচোখি হয়। আরশির তো খুশিতে নাচতে মন চাচ্ছে। ও যে কি করবে বুঝতেই পারছে না৷ অনু আরশিকে বলে,
~ এখন কি করবে? তোমার ক্রাশ স্যার তো আমাদের সাথে চারটা বছর থাকবে৷ কোন প্ল্যান করেছো? (মজা করে জিজ্ঞেস করল)
~ সেটাই ভাবছি। কিভাবে ওনার চোখের মনি হবো? কিভাবে ওনার কাছে জাবো? এই তোমরা দুজন আমার অনেক ভালো বান্ধবী। প্লিজ তোমরা আমাকে হেল্প করবে তো?
অনু অবাক হয়ে বলে,
~ তুমি সত্যিই সিরিয়াস নিয়ন স্যারকে নিয়ে?
~ হ্যাঁ। তাহলে কি আমি মজা করছি নাকি! ওনাকে আমার চাই ই চাই।
~ ওর মাথা গেছে অনু। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে৷ (তন্নি)
~ আসলেই ঠিক বলেছো। (অনু)
~ তোমরা যাই বলো উনি আমারই হবে দেখো। (আরশি)
~ হুম দেখবো নি। আমরা আছি তো তোমার সাথে সবসময়। (তন্নি)
~ হ্যাঁ আমিও (হাসি দিয়ে অনু বলল)
~ আচ্ছা স্যার কোন বইটার নাম বলেছিল যেন? (আরশি)
এরপর ওরা এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে বলতে দ্বিতীয় স্যার চলে আসে। তবে সে অনেক বয়স্ক। তাই তাকে নিয়ে কেউ তেমন একটা মাথা ঘামায় নি। তবে স্যারটা অনেক ভালো ছিল। দ্বিতীয় ক্লাস শেষ হলে ওদের ছুটি হয়ে যায়। আরশি, অনু আর তন্নি একসাথে ক্যাম্পাসে হাঁটছে। আরশির চোখ শুধু নিয়নকে খুঁজছে। কিন্তু কোথাও দেখছে না৷ মেয়েটার মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়৷ এরপর ওরা আরশির গাড়ির কাছে চলে আসে। আরশি বলে,
~ আচ্ছা তাহলে আমি যাই। তোমাদের কি নামিয়ে দিব?
~ না না৷ থ্যাংকস। আমরা দুজন একসাথেই যেতে পারবো। তোমার উল্টো পথ হয়ে যাবে৷
~ সমস্যা ছিল না। আচ্ছা ঠিক আছে। আসি।
~ আচ্ছা৷
আরশি ওর বান্ধবীদের বিদায় দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে৷ তারপর ড্রাইভার ওকে নিয়ে বাসার দিকে রওনা হয়। আরশি তো শুধু নিয়নের কথা ভাবছে। কিভাবে নিয়নকে পটাবে সেই চিন্তা করছে। ওর মাথায়ই আসছে না যে নিয়ন ওর শিক্ষক। জীবনে এই প্রথম ও কারো উপর ক্রাশ খেয়েছে। শুধু তাই না মনেও ধরে গিয়েছে। একেই হয়তো বলে, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। নিয়নকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে আরশি ওর বাসায় চলে আসে। গাড়ি পার্কিং লটে আসতেই নায়লা এসে উপস্থিত। ও নিজেই গাড়ির দরজা খুলে দেয়। আরশি বেশ সুন্দর একটা হাসি মুখে গাড়ি থেকে নামে। নায়লা আরশির এই হাসি দেখে বলে ফেলে,
~ ওমা আমার আপুমনিটাকে এত হাসিখুশি লাগছে কেন? কিছু হয়েছে নাকি?
আরশি মাথা নাড়িয়ে লজ্জাসিক্ত মুখখানা করে হ্যাঁ বলে। নায়লা ওর কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
~ কি হয়েছে? কি হয়েছে? আমাকে বলবেন না?
আরশি নায়লার কানে কানে বলে,
~ আমার রুমে গিয়ে বলবো।(খুব লজ্জা পেয়ে)
~ আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে চলুন৷
নায়লা আর আরশি দুজনের মিটমিট করে হাসতে হাসতে বাসার ভিতরে চলে যায়। আরশি মা ভিতরে ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল। ওকে দেখে বলে,
~ এসেছিস মা? কেমন হলো ক্লাস?
~ অনেক অনেক ভালো। বিশেষ করে স্যাররা তো অনেক ভালো।
~ বাহ! তাহলে তো খুব ভালো। মন দিয়ে পড়াশোনা করবি কিন্তু। একদম ফাকি দিবি না।
~ আম্মু…আমি কখনো ফাকিবাজি করেছি নাকি? (ন্যাকামি করে)
~ না না মা। এমনিই বললাম। যাতে আরও মন দিয়ে পড়াশোনা করিস।
~ আচ্ছা করবো।
~ গুড। যা এখন ফ্রেশ হয়ে আয় তারপর লাঞ্চ করবি।
~ ওকে। নায়লা আন্টি তুমি আসো তো আমার সাথে।
~ জি জি।
নায়লা আরশির পিছু পিছু যায়। ও খুব উত্তেজনা নিয়ে আছে যে আরশি কি এমন বলবে ওকে। ওরা রুমে আসতেই আরশি আগে দরজাটা টুক করে লাগিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে নায়লার দিকে তাকায়। নায়লা দেখে আরশির চোখ মুখ কেমন লাল লাল হয়ে আছে। মানে ও লজ্জা পাচ্ছে। নায়লা আরশির কাছে এসে বলে,
~ ও মা! এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? বলেন না আজ কি হয়েছে?
আরশি আস্তে আস্তে লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে বলে,
~ আণ্টি আমি তো প্রেমে পড়ে গিয়েছি।
~ কি! সত্যিই? (খুব খুশি হয়ে)
~ হ্যাঁ। (লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে)
~ ছেলেটা কে? আপনার ক্লাসের বন্ধু?
~ না। আমাদের একাউন্টটিং স্যার। (লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলে)
আর এদিকে নায়লা পুরো স্তব্ধ হয়ে যায়। ও স্বপ্ন তো দূর কল্পনাও করতে পারে নি আরশি শেষমেশ একটা স্যারের প্রেমে পড়বে। ও রীতিমতো ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। নায়লা একদম চুপ মেরে বসে আছে। ওর কোন সাড়া শব্দ না পাওয়ায় আরশি চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দেখে নায়লা পুরো হতবাক হয়ে আছে। আরশি দ্রুত নায়লার কাছে গিয়ে বলে…
চলবে..?