পুনর্জন্ম? #পর্ব_০৭

0
393

#পুনর্জন্ম?
#পর্ব_০৭
#আফিয়া_আফরিন

বাবার কথা বুঝতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো মৃন্ময়ীর। বোঝার সাথে সাথে পায়ের নিচের মাটি যেন নেমেছে সরে গেলো। বাবা বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে?

ময়ূরীর বাবা আজিজ আবার বলতে শুরু করলেন, ‘ছেলে কিন্তু খুবই ভালো। দেখতেও বেশ সুন্দর। ওই যে পাশের গ্রামের আলতাব মাস্টারের ছোট ছেলে।’

বাবা অনেক কথা বলছে। মৃন্ময়ীর কর্ণকুহরে কিছুই প্রবেশ করছে না। আটকাতে হবে, বাবাকে আটকাতে হবে। নিজের ভালোবাসা এভাবে শেষ হয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।

আর কিছু না ভেবেই মৃন্ময়ী বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তো বিয়ে করতে পারব না বাবা’

আজিজ হঠাৎ থেমে গেলেন।
কড়া গলায় বললেন, ‘কেন?’

‘এই কেনোর কোনো উত্তর হয় না। আমি সত্যিই বিয়েটা করতে পারবো না বাবা। তুমি যে বিয়েটা ঠিক করেছ, সেটা দয়া করে ভেঙ্গে দাও।’

‘আমি কি করবো না করবো, তুই শেখাস আমাকে? এমনিতেই গ্রামের মানুষজন নানান ধরনের কথা বলছে। তোর নাকি বিয়েই দেওয়া যাবে না। একটা সম্বন্ধ পাইছি, না করবি না।’

বাবার কথা শুনে মৃন্ময়ী চুপ হয়ে গেলো। চোখ দিয়ে অবিরত পানি ঝরতে লাগলো।
বাবা মেয়ের চেঁচামেচি শুনে বিনীতা এগিয়ে এসে স্বামীকে থামালেন, আর মৃন্ময়ী কে ঘরে চলে যেতে বললেন।

সেদিন আর সারারাত ঘুম হলো না মৃন্ময়ীর। তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইলো। চোখের জল গাল দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ল অনেক রাত পর্যন্ত।
.
.
.
সকালবেলা তাওহীদ বাজারের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলো। একটু এগোতেই অনুপম কে দেখতে পেলো।
নিজে গিয়েই অনুপমের পিঠে চাপ’ড় দিয়ে বলল, ‘শেষ পর্যন্ত জে’ল থেকে ছাড়া পেয়েই গেলি, ভাই।’

অনুপম মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘তোকে না মারা পর্যন্ত চার দেওয়ালের গা’র’দের মধ্যে আটকে থাকবো, এটা ভাবলে কি করে?’

অনুপমের কথা শুনে সামান্য ঘাবড়ে গেল তাওহীদ। কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। সেও মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, ‘বাবা, রাজিব মোহন কে মা’রার পর ও আমাকে মা’রার সাধ এখনো আছেই?’

‘তা থাকবে না।’

‘তার মানে খু’নগুলো তুই করেছিস? কিন্তু তোর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না? তুই দিব্যি বাহিরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস?’

‘খু’নিরা খু’ন করলে কখনো তার প্রমাণ রেখে যায় না। আর তুই তো দেখি চরম বে’ক্কল। তুই কোন আক্কেলে আমায় বলিস যে আমি দিব্যি বাহিরে ঘুরে বেড়াচ্ছি? ইচ্ছে করছে তোকে কয়েকটা থা’প্পর দিতে। কিন্তু ছুচো মেরে নিজের হাত গন্ধ করতে চাচ্ছি।
যেখানে তুই নিজে একটা খু’নি, আমার ময়ূরীর খু’নি।’

‘ধুর রাখ তোর ময়ূরী। সুন্দরের দে’মাগ বেশি ছিল। গায়ের রংটা একটু সাদা বলে নিজেকে বিশ্বসুন্দরী ভাবতো। কথা বলতে গেলে মেয়ের পাত্তাই পাওয়া যেত না। অথচ দেখ, শেষমেশ কিনা আমার হাতেই নিজের সতী’ত্ব বিস’র্জন দিতে হলো।’

অনুপম আচমকা এক থাপ্পর বসিয়ে দিল তাওহিদের গালে। শার্টের কলার চেপে ধরে বলল, ‘তোর বাপের কি? ও নিজেকে বিশ্বসুন্দরী ভাবুকবার যাই ভাবুক তাতে তোর বাপের কি? তোরই বা কি? তোর লাগে কোন জায়গায়? কেন ওর জীবনটা নষ্ট করলি? কি দোষ করেছিল ও? শুধুমাত্র তোকে পাত্তা দেয়নি বলেই এত বড় সর্বনাশ করলি। তুই তো পুরো পুরুষ জাতির ক’ল’ঙ্ক রে!’

তাওহীদ ঠান্ডা গলায় বলল, ‘গলা নামিয়ে কথা বল। কার সাথে কথা বলছিস, হিসেব আছে তোর?’

শ্লেষের হাসি হেসে অনুপম বললো, ‘তুই আর তোর বাপ, তোদের মত জা’নো’য়া’রের সাথে কখনোই হিসাব করে কথা বলতে হয় না।’

তাওহীদ অনুপমের হাত নামিয়ে বলল, ‘তোকে আমি দেখে নেবো। তুই আমায় কি মারবি? তোকেই আমি শেষ করবো আগে।’

তারপর রাগে ফুসতে ফুসতে চলে গেল।
.
.
.
সেই রাতে ঘটলো আরেক কাহিনী।
তাওহীদ গ্রামের পাশের রাস্তা দিয়ে হেটে বাড়ি ফিরছিল। নির্জন, নিরিবিলি রাস্তা। রাত হয়ে গেছিল বিধায় মানুষজন তেমন একটা ছিল না।
এমন সময় আচমকা বাইক দিয়ে কেউ তাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিলো। তাওহীদ হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেল। ওই ভাবেই বলল, ‘কে রে শা’লা, দেখে বাইক চালাতে পারিস না? চোখ কি হাতে নিয়ে হাঁটিস নাকি?’

বাইকে যে ছিল সে নামলো। তাওহীদ অন্ধকারে ঠাওর করতে পারল না, আগত ব্যক্তিটি আসলে কে?
কিছু বোঝার আগে মাথায় বড়সড় একটা আ’ঘা’ত পেলো।

তাওহীদ বলল, ‘কে রে ভাই?’

সামনে আগত ব্যক্তিটি কোন কথা বলল না। ইচ্ছামতো কয়েকটা লাথি ঘুসি মেরে বললো, ‘তোর য’ম। আজকে তোকে বাগে পেয়েছি, এত সহজে ছাড়বো না।’

‘কে ভাই তুমি?’

‘বললাম না, তোর য’ম!’

তাওহীদকে আর কোন কথা বলার সুযোগ দিলো না সে। এলোপাথাড়ি মারতেই লাগলো। তাওহীদ পাল্টা কোন আঘাত করতে পারল না। পড়ে পড়ে মার খেতে লাগলো।

সামনে আগত ব্যক্তিটির হঠাৎ মনে পড়ে গেল কিছু বছর আগের কথা। দুঃস্বপ্নের মতো ভেসে উঠলো প্রিয়তমার বী’ভৎস মুখখানি। মুহূর্তেই ক্ষ্যা’পা ষাঁড় হয়ে গেলো।
তাওহীদের নাকে, চোখে, মুখে বেশ কয়েকটা ঘুসি মেরে তারপর থামলো।

তারপর ক্ষী’প্র গলায় বলল, ‘ভাগ্যিস প্ল্যান করে আসি নাই। তাহলে তুই আজকেই শেষ হয়ে যেতি। হাতে কিছু নাই। না হলে গলা কেটে দিয়ে যেতাম। তোর সাত পুরুষের ভাগ্য বেঁচে গেলি আজকে। ছেড়ে দিলাম তোকে। বেঁচে থাক। আরো মানুষের প্রতিশোধ নেওয়া বাকি আছে তো। সব আমি নিলে হবে? আমারটা আজকে হয়ে গেল। কারো জন্য বাদবাকিটা অবশিষ্ট রেখে দিলাম।’

এই বলে সে বাইক স্টার্ট দিল। যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকালো। দেখল তাওহিদ রাস্তায় পরে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখতেও শান্তি! মনটা কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল।

তাওহীদ একদমই কথা বলার অবস্থায় নেই। শুধুমাত্র বড় বড় শ্বাস ফেলছে। কোন মতে পকেট থেকে ফোন বের করে আলিফ কে ফোন করলো। নিজের অবস্থার কথা অল্প কথায় জানিয়ে ঠিকানা দিলো।
.
.
.
দোকানে যাওয়ার আগে আজিজ সাহেব মৃন্ময়ী কে ডেকে পাঠালেন। মৃন্ময়ী বাবার সামনে আসতে চাচ্ছিল না। তবুও বহু ডাকাডাকির পর গেল।

মেয়েকে দেখা মাত্রই আজিজ প্রশ্ন করলেন, ‘কি হয়েছে কি তোর? বিয়ে না করলে কি তোকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেব? কারণ কি? কেন বিয়ে করবি না?’

মৃন্ময়ী বাবার দিকে চোখ তুলে তাকালো। তিনি দেখলেন, মৃন্ময়ী চোখ ফোলা, লাল। সারারাত না ঘুমিয়ে কেঁদেছে বোধ হয় মেয়েটা।

তিনি একটু নরম হয়ে বললেন, ‘বোস এখানে। বিয়ে কেন করবি না সেটা বল?’

‘আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না বাবা।’

‘কাউকে ভালবাসিস?’

‘হু।’

‘কাকে?’

মৃন্ময়ী ইতস্তত করতে লাগলো। বলতে পারছিল না।
তাই দেখে তিনি বললেন, ‘তাহলে আলতাব মাস্টারকে না বলে দেই?’

মৃন্ময়ী কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টিতে তাকালো বাবার দিকে। কোন মতে মাথা দুপাশে নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ সম্মতি দিলো।

বাবা বললেন, ‘যা ভিতরে যা। এক মেয়েকে হারিয়েছি, আরেক মেয়ের উপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে হারাতে চাই না।’

মৃন্ময়ী চলে এলো। এত আনন্দিত সে বোধ হয় বহুবছর হয় নাই। আনন্দটা ঠিক বাবার সামনে প্রকাশ করতে পারল না। কিন্তু নিজের ঘরে এসে কাঁদলো। খুব করে কাঁদলো।
শিশিরকে হারানোর কথা সে যে কোন ভাবেই ভাবতে পারেনা। শেষ হয়ে যাবে, একেবারেই শেষ হয়ে যাবে মৃন্ময়ী!
.
.
.
সপ্তাহখানেক ধরে তাওহীদ বিছানায় শোয়া। গতকাল হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। কিন্তু সেদিন কে তাকে মেরেছে সে জানে না। অন্ধকারে বুঝতে পারে নাই। চেহারা দেখা যায়নি একটুখানিও। তার উপরে হেলমেট পড়া ছিল।
কথা নাই, বার্তা নাই একটা লোক তাকে ভূতের মত রাস্তায় ফেলে মারতে লাগলো। কে হতে পারে?
অনুপমকেও সন্দেহ হয়েছিল প্রথমদিকে। কিন্তু সে না, ওই ব্যক্তির কন্ঠ তো শুনেছে তাওহীদ। চেহারা না দেখুক। অনুপমের কন্ঠ যে সেটা নয়, তাওহীদ এটা ১০০% নিশ্চিত। তাহলে কে হতে পারে?
ওই লোকটার শেষের কথাগুলো বারবার মনে পড়ছিল। প্রতিশোধের কথা বলছিল সে। কিসের প্রতিশোধ?
তবে কি এই লোকটির সাথে ময়ূরী অথবা অরুনিমা কোন ভাবে জড়িত আছে?
এটা কি তাদের সাথে অন্যায়ের শাস্তি?
অভিশাপ কি দিয়েছিল, দুজনের মধ্যে কেউ একজন? অভিশাপ অবশ্য দেওয়া লাগেনা, অতি কষ্টে আপনা আপনি চলে আসে।
তবে সে কখনোই অরুনিমাকে ভালোবাসেনি, কিন্তু অরুনিমার সাথে যা করেছে সেটাও কখনো করতে চায়নি।

অরুনিমা কই আছে, কেমন আছে, আদৌ বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, সেটাই তো জানে না তাওহীদ?

ঠিক তখনই বাকি দুই বন্ধু আহাদ আর আলিফ এলো। হাসপাতাল থেকে তাওহীদ ফেরার পর তারা আর দেখা করে নাই।
তাই আজ তাওহীদকে দেখতে এলো।

আলিফ তাওহীদের পাশে বসতে বসতে বলল, ‘শরীর কেমন এখন?’

‘ভালো। তোদের যে টাকার খোঁজ করতে বলেছিলাম করেছিস?’

‘হ্যাঁ করছি। গতকালের জোয়ারদার সাহেবের কাছে গেছিলাম। উনি বলেছেন রাজীব টাকা তো নিয়ে গেছে।’

‘অথচ আমরা কিন্তু মৃ’তদে’হের কাছে কোন টাকা পাইনি।’

‘এমনটা হতে পারে না, যে খু’ন করছে সে হয়তো টাকার জন্যই খু’ন করছে। রাজিব তো বেখেয়ালি টাইপের। হয়তো বা কাউকে বলেছে ওর কাছে টাকা আছে। এদিকে মোহন এর কাছেও ক্যাশ টাকা না থাকলেও, দামি ঘড়ি, হাতে সোনার আংটি, গলায় সোনার চেইন কিন্তু থাকতো। হয়তো এসবের জন্যই তারা খু’ন হয়েছে। আমরা যাতে কাউকে সন্দেহ না করি এই জন্য চিঠি পাঠিয়েছে।’

আহান হাসতে হাসতে বললো, ‘গা’ধা! মোহনের হাতে কিন্তু ঘড়ি আংটি সব ঠিকঠাকই ছিল। কিছুই খো’য়া যায়নি।’

তাওহীদ ওদের থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘থাম। নিজেদের মধ্যে এমন তর্কা তর্কি কি করিস না। ওদের খুন যে কারণেই হোক না কেন, চিঠির ব্যাপারটা পুরোপুরি ফাজলামি। কারণ দেখ, রাজিব খু’ন হওয়ার দুইদিন পর মোহন খু’ন হয়েছে। তারপর পুরো একমাস পার হতে চললো, আমাদের কিন্তু কিছু হয় নাই। ভবিষ্যতেও হবে না, নিশ্চিত থাক!’

‘তবে খু’নগুলো করছে কে?’

‘সেটাইতো রহস্য। কে করছে খুন? কোন সা’ইকো কি?’

‘আজাইরা। আমাদের গ্রামে কোন সা’ইকো থাকলে আমরা জানবো না?’

‘মনে আছে, ময়ূরী মারা যাওয়ার পর এক রাতে ওই অ’শরী’রীর কথা। আমি তো কোন সমাধানই করতে পারছি না এটার। শুধুমাত্র মাথার মধ্যে ভাবনারা তাল করে পাকিয়ে যাচ্ছে।’

তাওহীদ তোকে থামিয়ে বললো, ‘ওটা মৃন্ময়ী ছিল। ওকে সরাসরি ধরতে পারলে ভালো হতো। দ্বিতীয় বার আর তার দেখা পাই নাই, তাই এই রহস্যের কোন সুরাহা হয়নি।’

‘ও। আচ্ছা আপাতত থাক। তুই সুস্থ হো। তারপর এই শা’লারে খুঁজে বের করবো, যে তোর এই অবস্থা করছে। সাহস কত বড়? সে জানে কে তুই?’

তাওহিদ কোন কথা বলল না। আলিফ আর আহান নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে।

তাওহীদ কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থেকে বলল, ‘অরুনিমার কোন খবর জানিস কি?’

আহান আর আলিফ অবাক হয়ে তাকালো বন্ধুর দিকে।

বলল, ‘ওর খবর দিয়ে এত কাল পর তুই কি করবি? ওর নাম যেন মুখেও তুলিস না। অরুনিমার সাথে তোর যেকোন সম্পর্ক ছিল, কাকপক্ষী টের পেলেই তোর বিপদ। তার চেয়ে চুপ থাক। যে গেছে, গেছে। আর কি?’

তাওহীদ কিছু না বলে নির্বাক চেয়ে রইলো।
.
.
.
.
.
চলবে……

[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here