#পুষ্পবৃষ্টি,পর্ব-৩
ফারিয়া নাজনীন
“দ্রুত সু’স্থ হয়ে যান, পুষ্প। আর একদম চিন্তা করবেন না। যে হাত আপনাকে মা’রার জন্য উ’দ্যত হয়েছে, যে হাত আপনার অংশকে নিঃ’শেষ করার জন্য অবদান রেখেছে, সে হাত আমি নিজে ভে’ঙে গু’ড়িয়ে দিয়ে এসেছি।”
আমি চম’কে উঠলাম। এমন নরম কণ্ঠে এত ভ’য়’ঙ্কর কথা! তবুও চোখ খুলে মানুষটাকে দেখার শক্তি*টুকু পেলাম না। কিন্তু মানুষটা কে হতে পারে এটা আন্দাজ করতে আমার খুব একটা সমস্যা হয়নি। তার কথা ভাবতেই দুচোখে জল জমতে থাকল।
হাস’পাতালে কিছুদিন থাকার পর বাবা-মা আমাকে বাড়ি নিয়ে গেল। শ্বশুড়বাড়ি নয় আমার নিজের বাড়ি। উঁহু, নিজের বাড়িও নয়। বাপের বাড়ি। শুনেছি এরমাঝে দুই পরিবারের মধ্যে অনেক ঝা’মেলা হয়েছে। বিচা’রও নাকি বসেছে, পুলি’শও জড়িত হয়েছিল। সবশেষে ডিভোর্স হবে এমন ঠিক হয়েছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, এমনই তো হওয়ার কথা ছিল। আমার নিজেরও আর ও সংসারে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা নেই।
বাড়ি আসার পর প্রতিদিনই কত মানুষ আমাকে দেখতে আসে। কেউ আমার ভাগ্যের দোষ দেয়, কেউবা আমার স্বামীর দোষ দেয়, কেউ আবার আমাকেই দোষ দেয়। এমনই একদিন হুট করে আরাফ আমাদের বাড়ি আসে। সাথে ওর মা-বাবা। আন্টি বেশ অনেকক্ষণ ধরে আমার সাথে কথা বলছিলেন। আমার এমন দুর্দ’শায় তিনিও বেশ ব্যথিত। আমাকে অনেক ভালোবাসতেন কীনা। আমার মাও ছিলেন। তিনিও টুকটাক কথা বলে সায় জানাচ্ছিলেন। কিন্তু এই সবকিছুর মাঝে আরাফ একদম নিশ্চুপ। একটা কথাও তার মুখ থেকে বেরোয়নি। তার এমন পরিবর্তনে আমিও অবাক। আমি সবার সাথে কথা বলে ঘর থেকে বের হতে নিলে হুট করে আরাফ বলে ওঠে,
” আমাকে বিয়ে করবেন, পুষ্প?”
চমকে উঠলাম আমি। সবার মাঝে এ কেমন কথা! সবাই ততক্ষণে চুপ করে গেছে। হয়তো পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। সকলের কথাটা হজম করতেই সমস্যা হচ্ছে। হঠাৎ আরাফের মা ধমকিয়ে উঠলেন।
“এ কেমন ব্যবহার, আরাফ? মেয়েটা সবেমাত্র এত বিপ’দ শেষে বাড়ি ফিরল। আর তুই এর মধ্যেই ওর সাথে ফাজলামি করছিস? পরিস্থিতি বুঝিস না?”
আরাফ একবার তার দিকে তাকিয়ে পুনরায় আমার দিকে দৃষ্টি ফেলল।
“প্রশ্নটা আমি আপনাকে করেছি, পুষ্প। উত্তরটাও নাহয় আপনি দিন। বিয়ে করবেন আমাকে?”
আমি নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এমন শান্ত দৃষ্টিতে, নরম কণ্ঠে ছেলেটা কত ভয়’ঙ্কর কাজ করছে, তা কি জানে সে? এর পরিণাম কী হবে সে সম্বন্ধে আন্দাজ আছে ওর? কিন্তু সে চঞ্চল নজরে আমার দিকে আছে। হয়তো উত্তরের অপেক্ষা করছে।
“আরাফ, হচ্ছেটা কী? বলেছিনা এমন ফাজলামি না করতে?”
এবার হয়তো আরাফের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। হঠাৎ দাঁড়িয়ে চিল্লি’য়ে উঠল। চোখে-মুখে সে কী কাঠিন্য’তা! ঘরের সবাই অবাক চোখে তাকে দেখছে।
” ফাজলামি ফাজলামি বলে আমার ভালোবাসা কে আর কত ছোট করবে তোমরা? যে বয়স থেকে ভালোবাসার মানে বুঝতে শিখেছি, সে বয়স থেকে আমি পুষ্পকে ভালোবাসি। ছোট ছিলাম, তাই কত পাগলামি করেছি। কিন্তু সবাই সেটাকে শুধু মজা করা ভেবে নিল। কেউ কোনোদিন আমার অনুভূতি বোঝার চেষ্টাই করেনি। না তোমরা বোঝার চেষ্টা করেছ আর না পুষ্প। কিন্তু তোমরা বোঝার চেষ্টা করনি কেন, মা? শুধু আমি বয়সে বছরখানেকের ছোট তাই? কিন্তু এটা তো আমার দোষ না। আর ভালোবাসা কি বয়স বিচার করে হয়? অনুভূতিগুলো তো এমনিই চলে আসে।”
আমি থমকে গেলাম। এই ছেলেটার ভালোবাসাকে কত অবহেলায় না করেছি! এরজন্য মাফ হবে কি আমার? আরাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ছলছল দৃষ্টিতে সকলে দিকে তাকাল। বোঝায় যাচ্ছে, খুব কষ্ট করে চোখের পানি ধরে রেখেছে।
“যখন প্রথম পুষ্পের বিয়ের খবর পেয়েছিলাম, তখন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার থেকে আমার কলি’জাটা ছিঁ*ড়ে নিয়ে চলে গেছিল। আর যখন পুষ্পকে প্রথম অন্য কোনো পুরুষের পাশে দেখেছিলাম, তখন বিশ্বাস কর এই বুকের ভিতরটা জ্ব’লে-পু*ড়ে যাচ্ছিল। প্রতিনিয়ত দ’হন হচ্ছিল। সইতে পারতাম না, বেঁচে থাকায় ক’ষ্টের হয়ে যাচ্ছিল৷ সারাদিন অন্ধকার ঘরে বসে থাকতাম। কারণ আলো জ্বালালেই তো সামনে পুষ্প আর রাফির প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠত। পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। মা, তুমি না জিজ্ঞেস করেছিলে আমার অমন পরিবর্তনের কারণ কী? কারণ তো পুষ্প। আমার স্বপ্ন যে আমাকে ছেড়ে চলে গেছিল।”
কী প্রগাঢ় অনুভূতির প্রকাশ! এতটাও ভালোবাসাও আমার জীবনে এসেছে! আরাফের ছলছল দৃষ্টির দিকে তাকাতে পারলাম না। কোন স্পর্ধায় তাকাব, কত ছোট করেছি ওর অনুভূতিকে।
“মাগো, একবার আমার ভালোবাসা হারিয়ে গিয়েছিল। তখন জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে ছিলাম। আর আমার ভালোবাসার মানুষের পরিণতিও তো দেখলে। কত কষ্ট দিয়েছে ওই অমানুষটা। মরতে মরতে বেঁচে গেছিল। আমার এখনও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা নিষ্প্রাণ মুখটার কথা ভাবলে শরীর কেঁ’পে ওঠে। বড্ড ভয় হয়। যদি তার কিছু হয়ে যায়, তবে কীভাবে বাঁচব আমি! আমার ভালোবাসাটাকে তোমরা আর হারাতে দিও না, মা। আর হারাতে চাই না আমি আমার পুষ্পকে। আমার বউ করে নিয়ে যাব ওকে। আমার ঘরে সারাজীবন রেখে দেব। অন্য কেউ নিজের জীবন নিয়ে গেলে কি বেঁচে থাকা যায়? এতদিন এই লাশ হয়ে থাকা দেহ প্রাণ ফিরে পাবে এবার। তোমরা আর বাঁধা দিও না।”
ঘরের প্রত্যেকটা মানুষ আরাফের দিকে তাকিয়ে আছে। হযত ওর অনুভূতির পরিমাণ পরিমাপের চেষ্টা করছে। আরাফ কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হতে নিল। হঠাৎ দরজার পাশে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে দৃষ্টি দিল। ওই দৃষ্টি দেখেই বুঝতে পারছিলাম এই আমাকেও কেউ ঠিক কতটা চায়!
“আপনি আমায় কেন ভালোবাসলেন না, পুষ্প?”
কথাটা বলে কিছুক্ষণ উত্তরের আশা করে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু না পেয়ে আবার প্রশ্ন করল।
” বলুন, কেন ভালোবাসলেন না?”
শেষমেশ উত্তর না পেয়ে আফসোসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর দেয়ারো জোরে একটা ঘু’ষি মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন আবেগ মেশানো প্রশ্নের উত্তর কি দেওয়া যায়? এক জীবনে একটু ভালোবাসা পাওয়ার লোভে কত কিছুই না করেছি। কত অপ’মান মুখ বুঝে সহ্য করেছি। আর সব শেষ হয়ে যখন আমি নিঃস্ব তখনই জীবন আমাকে এমন ভারোবাসা উপহার দিল! অবশ্য এই ভালোবাসা তো আগেই পেয়েছিলাম। শুধু বুঝে উঠতে বড্ড দেরি করে ফেলেছি!
____________
দিনকয়েক পরে এক রাতে আরাফ এসে আমার জানালার সামনে দাঁড়াল। ওকে ওখানে দেখেই সেই প্রথম দাঁড়ানোর কথা মনে পড়ে গেল। সেদিনই তো প্রথম তার অনুভূতি সম্বন্ধে জেনেছিলাম। তার আবেগ মেশানো কথা প্রথম আমার হৃদয়ে দাগ কেটেছিল। আর আজকের দিনটা! কতটা তফাৎ এই দিন দুটোর মধ্যে! অথচ দিনদুটোর আবাহাওয়া এক। সেদিনও বৃষ্টি পড়ছিল আর আজও বাইরে তুমুল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির মাঝেই আরাফ নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমিও কিছু বললাম না। থাকুক না ছেলেটা নিজের মতো। কম কষ্টতো পায়নি।
মায়ের কাছে শুনেছি আরাফ নাকি আমার বিয়ের পর প্রথম একবছর শুধু অন্ধকার ঘরে বসেই কাটিয়েছে। বাইরে বেরোনো একেবারে বন্ধ করেছিল। সে বছর কোনো ভার্সিটিতেও ভর্তি হয়নি। ভর্তি দূর, পরীক্ষা পর্যন্ত দেয়নি। পরের বছর একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে এডমিশন নিয়েছিল। সাথে তার বাবার ব্যবসাতেও হাত দিয়েছিল। সারাদিন নাকি কাজ আর পড়াশোনায় ডুবে থাকত। আগের মতো বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানো, আড্ডা দেওয়া সবটা ত্যাগ করেছিল।
“জানেন পুষ্প, আপনি চলে যাওয়ার পর আমার জীবনে অনেক বৃষ্টি এসেছে। তুমুল বৃষ্টি, যে বৃষ্টিতে ভালোবাসা মাখানো থাকে। যে বৃষ্টির দিকে তাকালেই আপনার প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। আমি সেই প্রত্যেকটা বৃষ্টিতে ভিজেছি। একটাও বা দিইনি। একা ভিজিনি কিন্তু। আপনার একটা ছবিও সাথে নিতাম। আরাফ আর আরাফের পুষ্পবৃষ্টি। পুষ্পকে ছাড়া কি আরাফ বৃষ্টিতে ভিজতে পারে? কতবার সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে পরেরদিন জ্ব’রে ভুগেছি তার হিসেবও নেই৷ জানেন, তখন আপনাকে বড্ড মনে পড়তো। দেখতে ইচ্ছে হতো। আবার নিজেই নিজেকে শাসা’তাম। আপনি সুখে আছেন, ভালো আছেন ভেবে আপনার জীবনে নিজের ছায়াও ফেলতে চাইতাম না। আপনি ভালো থাকলেই তো আমি ভালো থাকব। তাই নিজেকে ভালো রাখতে বড্ড ব্যস্তও থাকতাম। কিন্তু ভালো থাকতে পারতাম না। হয়তো আপনি ভালো ছিলেন না তাই।”
আরাফের কথা শুনে চোখ থেকে পানি পড়তে চাইল। বহুক’ষ্টেই তা আটকালাম। এ অনুভূতির সম্মান জানাতে চাই আমি। কিন্তু গ্রহণ করার ব্যপারে যে বড্ড দ্বিধান্বিত! কী করা উচিত আমার? সমাজ নিয়েও যে ভ’য় হয়। একে তো ডিভোর্সি তার উপর আরাফ আমার থেকে বয়সে ছোট এক অবিবাহিত ছেলে। দোষ থাকুক আর না থাকুক আমার এই সমাজ যে মেয়েদের দোষ দিতেই বেশি ভালোবাসে!
” আমাকে বিয়ে করুননা, পুষ্প! ভালোবাসতে তো বলিনি। শুধু আমার নামে হয়ে যেতে বলেছি। সেটাও কি হওয়া যায় না?”
এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বলল,
“জানি না আমি কী আছে অদূরে
জানি আমি কী লেখা জীবনের শেষ লাইনে
শুধু জানি তোমায় আমি বাঁধতে চাই
এক সমুদ্র পরিমাণ ভালোবাসার নামে।”
এবার আমি আর কান্না আটকাতে পারলাম না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।
(চলবে)