পূর্ণময়ীর_বিসর্জন #পর্বঃ৯

0
940

#পূর্ণময়ীর_বিসর্জন
#পর্বঃ৯
#মৌমি_দত্ত

খানিক বাদে ছাদে সেই অবস্থায় পূর্ণর ঘুম চলে এলো চোখজুড়ে। রায়ান মৃদু হেসে পূর্ণকে কোলে নিয়ে নিচে চলে এলো।এমনিতে আগে সব যখন ঠিক ছিলো তখন পূর্ণ তার আর অনুবিকার মাঝামাঝি রুমে ঘুমাতো। এখন গত কয়েক দিন ধরে সে হাসপাতালে আর বাসায় রায়ানের রুমে ঘুমিয়েছে। কিন্তু আজ কি হবে? আজও কি আলাদা ঘুমানোর জন্য রুমে রেখে আসবে? ভালোবাসা সবসময় সরল রেখার গতিতেই চলে না।কিছু জেদি ইচ্ছেরা মাথা নত করতে জানেনা। সঠিক ও ভুলের পার্থক্যও তারা মানে না। তেমনি রায়ান পূর্ণকে নিজের রুমে নিয়ে এলো। বুকে নিয়ে খাটেই শুয়ে পড়লো। রায়ানের ফ্লাইট ভোরে। তাই এলার্ম দেওয়া ছিলো। এলার্মের আওয়াজ হতেই রায়ান লাফিয়ে খাটের পাশে থাকা মোবাইল থেকে এলার্ম অফ করলো। সতর্ক চোখে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো পূর্ণ এখনো ঘুম। শান্তির এক নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর দ্রুত উঠে তৈরি হয়ে নিলো। রেহানা আর আয়ান সাহেব আর অনুবিকা এতোক্ষনে উঠে গেছে। সবাই নিচে।রেহানা নাস্তা বানাচ্ছেন। আয়ান সাহেব ছেলের নামার জন্য বসে আছেন। আর অনুবিকা নিজের মনেই হাসছে। নিজের মতো করে সে সাজিয়ে নিয়েছে তার পরিকল্পনা। এখন শুধু রায়ানের লন্ডনে যাওয়ার অপেক্ষা।
.
.
তৈরি হয়ে শেষবার পূর্ণকে মন ভরে দেখে নিলো। ঘুমের মাঝেও তাকে নিষ্পাপ লাগে। সাহিত্যের ধারে কাছে রায়ান কখনো ছিলো না। কিন্তু কোনো এক কবির উক্তি হিসেবে সে পড়েছিলো,
– যে নারী ঘুমন্ত অবস্থায় সুন্দর। সেই প্রকৃত সুন্দরী।
কথাটা কি পূর্ণর ক্ষেত্রেও খাটে না? রায়ান এমন আজগুবি বাচ্চামো ভরা ভাবনায় হেসে ফেললো। পূর্ণকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখেই সে নিচে নেমে এলো লাগেজ নিয়ে। রেহানা ছেলেকে নাস্তা করতে দিলেন। অনুবিকাও ভাইয়ের পাশে বসে নাস্তা করতে লাগলো। এতো সকালে নাস্তা করবার অভ্যেস আয়ান সাহেবের নেই। তাই তিনি কফি খাচ্ছেন আর ছেলের সাথে কথাবার্তা বলছেন,
– এবার বলোতো, লন্ডনে যাওয়ার প্রধান কারণ কি?
আয়ান সাহেবের এমন প্রশ্নে মুচকি হাসলো রায়ান। এরপর বললো,
– পূর্ণ হাইস্কুল পর্যন্ত পড়েছে ওখানে। ওর সব প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস আমি নিয়ে আসবো। ওকে এখানেই একটা কলেজে ভর্তি করে দেবে। ওখানের হাই স্কুল অনুসারে এখানে কলেজ ধরা হয়। তাই লন্ডন যাওয়া।
আয়ান সাহেব মৃদু হাসলেন। রেহানা খুশীই হলো পূর্ণ কোথাও যাচ্ছে না বুঝতে পেরে। অনুবিকা খানিক বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলো না। আয়ান সাহেব হাসিমুখেই বললেন,
– আমি তোমার বাবা হই। বুঝতে পারছো তো কথাটা?
আয়ান সাহেবের এমন কথার কারণ আচমকা অনুবিকা আর রেহানা না বুঝলেও রায়ান অজানা আশংকায় মাথা নিচু করে রইলো।
– মেয়েটি এখনো তোমার সাথে স্ত্রীর সম্পর্কে আবদ্ধ না। তাই নেক্সট টাইম ছাদ থেকে নেমে তাকে তার রুমে পাঠিয়ে দেবে। ওকে সোনা?
আয়ান সাহেবের এমন কথায় রায়ান হালকা লজ্জা পেলো। রেহানা আর অনুবিকা এখনো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রেহানা নিজেকে সামাল দিতে না পেরে প্রশ্ন করলো,
– বাবা ছেলে কিসব সাংকেতিক কথা বলছো?
আয়ান সাহেব মৃদু হাসলেন। রায়ান নিজের মতো করে লজ্জা লুকিয়ে খেতে লাগলো। আয়ান সাহেব বললেন,
– ছেলের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। পূর্ণ সুস্থ হলেই রায়ানকে অন্য আঁচলে ট্রান্সফার করে দিতে হবে তোমার।
রেহানা এতোক্ষনে সবটা বুঝতে পেরে অবাক হয়ে তাকালেন ছেলের দিকে? পরক্ষনেই খুশী হয়ে বললেন,
– তাহলে আগে ভাগেই বলে দিই, কখনো যদি পূর্ণ ওর জন্য কষ্ট পায় আমি পূর্ণকে দূরে পাঠিয়ে দেবো।
পূর্ণর দূরে যাওয়ার কথা শুনে রায়ানের যেন বুক কেঁপে উঠলো। তবুও রায়ান নিজেকে বোঝালো, এটা সামান্য মজা ছিলো। কিন্তু অনুবিকা অবাক না হয়ে পারছে না। কেমন মা বাবা এরা? নিজের ছেলেকে অসুস্থ এক মেয়ের সাথে বেঁধে দিতে এদের দ্বিধা হচ্ছে না? নিজের মাঝেই চাপা রাখলো অনুবিকা রাগটা।
.
.
সকাল ৮ টার দিকে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেলো পূর্ণর। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো দ্রুত। আশপাশে তাকিয়ে বুঝলো সে রায়ানের খাটে শুয়ে আছে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে রায়ানকে না দেখে আর রায়ানের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর অনুপস্থিতি দেখে পূর্ণ বুঝে গেলো রায়ান নেই, বের হয়ে গেছে। পূর্ণর মন খারাপ হয়ে গেলো। তাকে না বলেই চলে গেলো? চোখ ভিজে এলো পূর্ণর। হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো সে। প্রথম সকালটাই রায়ানকে ছাড়া যেখানে এমন যাচ্ছে বাদ বাকি দিনগুলো কেমন যাবে?
.
.
পূর্ণ প্রায় ঘন্টা খানেক পর ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো। দেখলো অনুবিকা ও তার কিছু বান্ধবী বসে আছে লিভিং রুমের সোফায়। আয়ান সাহেব এতোক্ষনে অফিসে চলে গেছেন ভালোই জানা আছে পূর্ণর। সে সোজা রান্নাঘরে চলে গেলো। পূর্ণকে চোখে পড়লো অনুবিকার। চোখ দেখেই বুঝে নিলো কেঁদেছে। মোক্ষম সুযোগটা সে কাজে লাগাবেই। বান্ধবীদের আরেকবার বুঝিয়ে দিলো কি কি করতে হবে।
.
.
রেহানার কাছে এসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো পূর্ণ। রেহানার মাঝে সে মায়ের শরীরের গন্ধ পায়। রেহানা না দেখেই বুঝে নিলো এটা পূর্ণ।
– পূর্ণময়ীর মন খারাপ কেন?
– রায়ান চলেছে?
পূর্ণর ভুল বাংলায় মৃদু হাসলো রেহানা। পূর্ণর হাত ধরে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলো। এরপর নাস্তা পূর্ণর সামনে রেখে বললো,
– রায়ান চলেছে না, বলো রায়ান চলে গেছে?
পূর্ণ মলিন হেসে বললো,
– রায়ান চলে গেছে?
রেহানা পূর্ণের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন। এরপর বললেন,
– তুই ঘুমোচ্ছিলি। তাই চলে গেছে।
পূর্ণ মাথা নিচ করে নিলো। তার আবারও কান্না পাচ্ছে। সে নীরবে নাস্তা করতে লাগলো। তখনই রেহানা একটা মোবাইল ফোন এগিয়ে দিলো তার দিকে। রেহানার হাতের মোবাইলটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো পূর্ণ বুঝবার জন্য সবটা। তখনই রেহানা বললো,
– রায়ান এটা তোর জন্য দিয়ে গেছে। এতে সিম কার্ড আছে। ও পৌছে কল করবে। আর হোয়াটসঅ্যাপ ও আছে।
পূর্ণ আবারও মলিন হাসলো। রেহানা আর কিছু বললেন না। উঠে চলে গেলেন। পূর্ণ খাওয়া শেষে মোবাইলটা হাতে তুলে নিজের রুমের দিকেই যাচ্ছিলো। তখনই অনুবিকা ডাকলো পূর্ণকে। পূর্ণ মাথা নিচ করে গিয়ে দাঁড়ালো অনুবিকার সোফার কাছে।
– পূর্ণ, যাও রেডি হয়ে নাও। আমরা বের হবো।
পূর্ণর যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তবুও কোনোমতে মাথা দু’দিকে দুলালো। অনুবিকাকে সে আঘাত করতে চায় না। সে সিড়ি বেতে নিজের রুমে এলো। তখনই ৯:৩৫ মিনিটের এলার্ম বেজে উঠলো। চমকে উঠলো পূর্ণ মোবাইলের স্ক্রিনে এলার্মের নামেরজায়গা লেখা রয়েছে “চেক গ্যালারি “। পূর্ণ অবাক হলো খুব। এলার্মটা অফ করে গ্যালারিতে ঢুকে দেখলো একটা মাত্র ভিডিও শো করছে। ভিডিওটা চালু করবে কি করবে না তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলো যেন। পরমূহুর্তে সব দ্বিধা ঝেড়ে ভিডিওটি ওপেন করলো। ভিডিওটা ওপেন করতেই রায়ানের মুখ ভেসে উঠলো। মূহুর্তেই চোখে পানি জমলো পূর্ণর। বাম হাতের উলটো পিঠে দুইগালে সরু ধারা হয়ে পড়তে থাকা জলগুলো লেপ্টে মুছে খাটের কিনারে বসে পড়লো। ভিডিও দেখতে লাগলো।
– পূর্ণময়ী?? এভাবে কেঁদো না প্লিজ। আমার কষ্ট হবে অনেক। আমি তোমার অতো সুন্দর ঘুমটা ভাঙ্গতে পারিনি। তাই না বলে আসতে হলো। এতে আমি কতোটা পুড়ছি তা তুমি আন্দাজ করতে পারবে না। মিস ইউ এ লট। নিজের প্লিজ খেয়াল রেখো। আমি সময়ে সময়ে কল করবো। আর হুম, বাংলাটা শিখে নাও এতোদিনে। প্রমিজ করেছো কিন্তু। আর শুনো তোমার ঐ দু’চোখ দিয়ে আমার নামে জল ঝড়বে এটা আমি চাইনা। আমি চাই তোমার ঐ ঠোঁটগুলো খুশীতে প্রসারিত হোক আমার নাম করে। এখন কপালটা কাছে আনোতো। আহা! দ্রুত আনো না।
পূর্ণ আবারও চোখের জল মুছে কপালটা স্ক্রিনের কাছে নিলো।কানে এলো চুমু খাওয়ার শব্দ। মূহুর্তের জন্য পূর্ণর মনে হলো সত্যিই রায়ান যেন অন্যান্য বারের মতো চুমু খেলো তার কপালে। ভিডিও শেষ হয়ে গেলেও পূর্ণ সেভাবেই মাথাটা মোবাইলে ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগলো হু হু করে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here