#পূর্ণময়ীর_বিসর্জন
#পর্ব:১১,১২
#মৌমি_দত্ত
আয়ান সাহেব এতোক্ষনে বুঝতে পারলেন পূর্ণ ওখানে পৌছালো কিভাবে। সারা রাস্তা পূর্ণকে তিনি অনেক প্রশ্ন করেছেন। পূর্ণ শুধু কেঁদেছে। কোনো উত্তর দেয়নি। আয়ান সাহেবের এখন রাগ হচ্ছে। তার মেয়ে হয়ে অনুবিকা এতোটা কেয়ারলেস কিভাবে হতে পারে। পূর্ণ এতোক্ষন ধরে তার সাথে নেই এটা কি তার এখনো অজানা? জানা যদি হয়েই থাকে তাহলে একটা কল কারো কাছে গেলো না কেন? তবে কি তিনি যা ভেবেছে তা ভুল? মেয়েকে তিনি নিজের মতো করে গড়ে তুলতে অক্ষম?
পূর্ণ এখনো নীরবে কান্না করছে দেখে আয়ান সাহেব রেহানাকে ইশারায় থামতে বললেন। পূর্ণ সবাইকে সাইড কাটয়ে সিড়ির দিকে যাচ্ছিলো। তখনই থেমে গিয়ে বললো,
– আব্বু, আম্মু?
রেহানা আর আয়ান মাথা তুলে তাকালো পূর্ণর দিকে। পূর্ণ তাদের দিকে না তাকিয়েই বললো,
– কখনো যদি মন থেকে খুব করে তোমাদের কাছে কোনো কিছুর আবদার করি? তাহলে দেবে?
রেহানা আর আয়ান অবাক হলেন। পূর্ণর কথার ধরণ এখন একদম স্বাভাবিক। মানসিক বিকাশের সমস্যাটা যেন কয়েক ঘন্টার মাঝেই বদলে গেছে। আয়ান নিজের শুকনো গলায় একটা ঢোক গিলে ভিজিয়ে বললো,
– কেন দেবো না? তুইও আমার কলিজার একটা অংশ পূর্ণ। তোরও আমাদের উপর অধিকার আছে।
পূর্ণ অপেক্ষা না করে ছুটে গেলো নিজের রুমে। সে কি চাইবে তা গাড়িতেই ভেবে রেখেছে। পূর্ণকে চলে যেতে দেখেই আয়ান সাহেব মোবাইল বের করে কল করলেন অনুবিকাকে। এদিকের এই অবস্থা, অন্যদিকে অনুবিকা শান্তি পাচ্ছে না কিছুতেই। বারবার মনে হচ্ছে মেয়েটার যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায়? আর যাই হোক মেয়ে মানুষ আজকাল রাস্তায়,ঘাটে একটুও সুরক্ষিত না। শপিংয়ে অন্য সবাই মেতে থাকলেও পুরোপুরি ভাবে অস্বস্তি ঘিরে রাখলো অনুবিকাকে। সবাই শপিংয়ের মাঝে বিরতি নিয়ে লাঞ্চ করবে বলে ফুড কোর্টে ঢুকে বসতে না বসতেই টেবিলের উপর থাকা অনুবিকার মোবাইল বেজে উঠলো। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ” বাপি ” লেখাটি। অনুবিকা ভয়ে ভয়ে নিজের বান্ধবীদের দিকে তাকালো। সবাই বুঝালো যে বাহানা গুছিয়েছে তা যেন বলে দেয়। মন না মানতে চাইলেও নিজের ভুল আছে বুঝলো অনুবিকা। নিজেকে বাঁচাতে তাই বলবে সিদ্ধান্ত নিয়ে কল রিসিভ করে সালাম জানালো। আয়ান সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,
– পূর্ণকে মোবাইল দাও। আমি কথা বলতে চাই।
অনুবিকা কাঁপা গলায় বললো,
– পূর্ণ কোথায় তা তো জানিনা।
আয়ান সাহেব বললেন,
– মানে?
অনুবিকা তখন নিজেকে শান্ত করে বললো,
– ও তো অসুস্থ জানোই বাবা। কোথায় না কোথায় গেছে খুঁজে পাচ্ছিনা। দোষটা আমারই, এমন একটা মানুষ নিয়ে ঘোরা যায় নাকি?
আয়ান সাহেবের ভ্রু কুঁচকে এলো। স্পিকারে এতোক্ষন সবটাই শুনছিলেন পাশ থেকে রেহানা। তারও ঘৃণা হতে লাগলো মেয়ের এই কথায়। মেয়েকে কি তবে উনি এই শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন? আয়ান সাহেব স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,
– ওহ। তুমি কি করছো?
বাবাকে এতো স্বাভাবিক দেখে হালকা খটকা লাগলেও মনে মনে খুশী হলো অনুবিকা। ঐ অসুস্থ মেয়েকে হয়তো তার বাবাও পছন্দ করছেন না নিজের ছেলের জন্য।অনুবিকা তাই হাসি হাসি মুখে জবাব দিলো,
– এইতো আব্বু শপিং করছি। এখন ফুড কোর্টে খেতে এসছি।
আয়ান সাহেব স্বাভাবিক গলায় বললেন,
– আচ্ছা সাবধানে বাসায় এসো। রাখছি।
আয়ান সাহেব এই বলেই কল কেটে সোফায় ক্লান্ত ভাবে বসে পড়লেন। যা বুঝার তিনি তা বুঝে গেছেন। আজ সকালে অনুবিকার বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ খানিকটা চোখে বিঁধেছিলো তার। কিন্তু অন্য বিষয় হবে ভেবে পাত্তা দেননি তিনি। পূর্ণকে নিয়েই যে অনুবিকা বিরক্ত এখন তা ঠিক বুঝছেন। পূর্ণ হারিয়ে গিয়েছে এটা নিয়ে তিনি অনুবিকার মাঝে ভাবান্তর পেলেন না। স্বামীর পাশে মন খারাপ বসলেন রেহানাও।
– এখন?
প্রশ্ন করলেন স্বামীকে। কিছুটা ভয়ে আছেন তিনি। তার স্বামী তো অন্যায় মানে না, রাগী মানুষ। তাহলে এখন এমন চুপ কেন? মেয়েটার কপালে কি লেখা আছে? আয়ান সাহেব রেহানার ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকালেন একবার। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে গলার টাই ঢিল দিতে দিতে বললেন,
– ভয় পেয়ো না। মেয়েটা বড় আদরের বলেই হয়তো শাসন সম্ভব হবে না, না শাস্তি দিতে পারবো। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি…..
রেহানা পুনঃরায় অস্থিরতা নিয়ে প্রশ্ন করলো,
– কি?
আয়ান সাহেব একবার রেহানার দিকে তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বললেন,
– ওকে বিয়ে দেবো আমি আগামী মাসের মধ্যেই। ছেলে পরিবার সব ঠিক করে পরশুর মধ্যেই দেখতে আসতে বলবো। তোমার মেয়েকে বলে দিও।
রেহানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার স্বামীর ইচ্ছে ছিলো মেয়েকে কখনোই এতো দ্রুত বিয়ে দেবেন না। রেহানা উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
– খাবার দিচ্ছি তোমাদের। খেতে এসো।
নিজের রুমের দরজার কাছাকাছি গিয়ে পা থেমে গেলো আয়ান সাহেবের। রেহানার দিকে না ফিরেই বললেন,
– বাবা হয়েও ছেলেকে দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না। পূর্ণর দায়িত্ব দিয়ে গেছিলো। পালন করতে পারলাম না। ছেলেটা যাওয়ার ২৪ ঘন্টা হওয়ার আগেই এই অবস্থা? ছেলে ফেরার পর পূর্ণকে বুঝিয়ে না দেওয়া অবধি শান্তির খাবার গলা দিয়ে নামবে না। পূর্ন খাবে কিনা দেখো। তুমিও খেয়ে নিও।
রেহানা বুঝলেন মেয়ের কর্মকান্ডে স্বামীর মনে আঘাত লেগেছে। স্বামী না খেলে আর মেয়ের এমন কাজে তার নিজেরও গলা দিয়ে খাবার নামবে না। তাই তিনি চলে গেলেন পূর্ণর রুমের দিকে।
পূর্ণর রুমের খোলা দরজা। তবুও রেহানা দরজায় আঙ্গূলের সাহায্যে টোকা দিলেন দুইবার। এরপর রুমে ঢুকে দেখলেন পূর্ণ কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। পড়নে ঘরের ড্রেস। অবাক হলেন খুব। ভেবেছিলেন মেয়েটা কেঁদে কেটে ভাসাবে। পূর্ণকে ঘুম দেখে শরীর খারাপ হলো কিনা দেখতে দ্রুত এগিয়ে এসে কপালে হাত রাখলেন। না শরীর স্বাভাবিক তাপমাত্রায়। হয়তো মন খারাপ তাই ঘুমিয়ে গেছে। এটা ভেবেই রেহানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা হালকা ভেজিয়ে দিয়ে চলে এলেন নিচে। রেহানা চলে যেতেই আস্তে করে অশ্রু সিক্ত লাল চোখজোড়া মেলে তাকালো পূর্ণ দরজার দিকে। এরপর কম্বল সড়িয়ে উঠে পড়লো বিছানা থেকে। মোবাইলটা নিয়ে চললো ছাদে। যেখানে গেলে তার মনে হবে রায়ান তার সাথেই আছে।
.
.
অনুবিকা ফিরে এলো সন্ধ্যে ৭ টার দিকে। হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই দেখলো লিভিং রুমের সোফায় বসে আছেন কফি হাতে আয়ান সাহেব। রান্নাঘর থেকে সার্ভেন্টদের আদেশ দেওয়ার আওয়াজ ভেসে আসছে রেহানার। অনুবিকা এই অসময়ে বাবাকে বাসায় দেখে অবাক হলো।আর বাসাটাও কেমন চুপচাপ। অনুবিকা এগিয়ে গেলো সোফায় বসা আয়ান সাহেবের দিকে। রেহানা ততোক্ষনে শাড়ি কাঁধের দিকে চাদরের মতো টেনে দিয়ে লিভিং রুমে এসে মেয়েকে দেখলেন। অনুবিকা একটা সোফায় ব্যাগ রেখে বসতে বসতে প্রশ্ন করলো আয়ানকে,
– তুমি এই সময় বাসায় বাপি? আজ অনেক তাড়াতাড়ি এসেছো।
আয়ান সাহেব কিছু ফাইল দেখছিলেন। সেদিক থেকে চোখ না সড়িয়েই বললেন,
– তোমাকে পরশু দিন ছেলে দেখতে আসবে। তৈরি থেকো।
অনুবিকার ঠিক গালের দুই ইঞ্চি উপরে কানের গহব্বরের মাঝখানে যেন একটা ঠাডা পড়লো জোড়সে। অনুবিকা চমকে তাকালো। তার বাবা বলছে এই কথা? কেও মজা করেও অনুকে বিয়ে দেবার কথা বললে যে আয়ান সাহেব মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বলতেন মেয়েকে এতো জলদি বিয়ে দেবেন না, সেই আয়ান সাহেব বলছেন এই কথা? অনুবিকা অবাক হয়ে বললো,
– এটা তুমি বলছো বাপি?
আয়ান সাহেব চোখ তুলে তাকালো মেয়ের দিকে। এরপর শান্ত কন্ঠে বললেন,
– হুম। কেন? আমাকেও পূর্ণর মতো শপিং মলে যাওয়ার আগের জঙ্গলের রাস্তাটায় ফেলে চলে যাবে অনু?
অনুবিকা চমকে তাকালো। পূর্ণকে ঠিক কোথায় ওরা ফেলে এসেছে তা বাবা জানলো কি করে? অনুবিকাকে চমকাতে দেখে মৃদু হাসলেন ক্লান্ত ভাবে আয়ান সাহেব।
– তুমি আমার মেয়ে না অনুবিকা। হতেই পারো না।
এই বলেই নিজের ফাইল নিয়ে তিনি নিজের রুমে চলে গেলেন। অনুবিকার চোখে জল।
চলবে….