পোড়া_কপালী।পর্ব_৪।

0
5040

পোড়া_কপালী।পর্ব_৪।
#শতাব্দী_নাওয়ার।

তারপর একদিন সন্ধ্যায় দীপ্ত আর আমি বিয়ের আয়োজন সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম আর ওই মুহূর্তে দীপ্তর মোবাইলে একটা ফোন এলো।
আর দীপ্ত ফোনটা রিসিভ করে কানে দেয়ার সাথে সাথে ওর মোবাইল টা হাত থেকে ফ্লোরে পড়ে গেলো…

-কি হয়েছে দীপ্ত?
এই দীপ্ত কথা বলছিস না যে?
দীপ্ত।
-মা,
-কি হয়েছে বল?
-মা ঝুমুর,
-কি হয়েছে ঝুমুরের?
-মা,ঝুমুর নাকি এক্সিডেন্ট করেছে।ও নাকি ওদের গাড়ী নিয়ে আমাদের বাসায় আসার জন্য বের হয়েছিলো।
-কি বলছিস তুই?
-ঝুমুর কই এখন?কেমন আছে ও?
-হসপিটালে আছে।
-চল তাড়াতাড়ি।

আমি দীপ্তকে নিয়ে হসপিটালে চলে যাই।
কিন্তু হসপিটালে গিয়ে যা দেখি তা দেখার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলামনা।

-ঝুমুর কই আংকেল?আমার ঝুমুর কই?
-ওই যে তোমার ঝুমুর।

আমি আর দীপ্ত একটা বেড এর পাশে যাই,সাদা কাপড় দিয়ে মানুষ টা ঢাকা।
কিন্তু রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে কাপড় টা।

দীপ্ত সামনে গিয়েই কাপড় টা মুখ থেকে সরালো,আর আমার বুকের ভেতর টা কেঁপে উঠলো।ঝুমুর এমন মারাত্মক ভাবেই এক্সিডেন্ট করেছে যে,মুখ দেখে চেনার ক্ষমতাই নেই এটা যে ঝুমুর।

-তোমার ঝুমুর আমাদের ছেড়ে চলে গেছে গেছে বাবা।

এই বলে ঝুমুরের বাবা দীপ্তকে ধরে কাঁদতে লাগলো।
এদিকে আমিও কাঁদছি।
কিন্তু আমি অবাক হলাম তখন,
যখন দেখলাম দীপ্তর চোখে কোন পানি নেই।
নেই কোন কান্নার শব্দ।
ও কাঁদছেনা।
ঝুমুরের বাবা দীপ্তকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে অথচ ও তাকে ধরছেও না।
ও মূর্তির মত দাঁড়য়ে আছে।

ডাক্তার এসে বল্লো,উনাকে তাড়াতাড়ি বাসায় নিয়ে যান।উনি এই শোকটা সইতে না পেরে এমন স্তব্ধ হয়ে গেছেন।উনাকে লাশের সামনে রাখবেন না।

-তারপর কি হলো মা?(রিয়া)
-তারপর ঝুমুরের দাফন কার্য হয়ে গেলো।

কিন্তু দীপ্ত আর স্বাভাবিক হয়না।
ভেবেছি, হয়তো দুই একদিন পর ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু দুই দিন পর দেখি ও অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেছে।
একা একা হাসে,কখনো কাঁদে,একা একা কথা বলে,আমি কাছে গেলে মারতে চায়।ধমক দেয়।ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাই,কিন্তু পারিনা।পরে বাসায় ডাক্তার ডেকে আনি।

ডাক্তার ওকে দেখে বলেন,ও স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।

এরপর থেকেই আমার দীপ্ত এমন।
হাজার চিকিৎসা করেও ডাক্তার রা ওকে পুরোপুরি সুস্থ করতে পারেন নি।
তাই শেষ চিকিৎসা হিসেবে তারা বলেছেন দীপ্তকে একটা সংসারী মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে দিতে।আর তারা মনে করেন যেহেতু ভালবাসার মানুষটাকে হারানোর শোকে ও এমন হয়েছে,
হয়তো ভালবাসার আরেকটা মানুষ পেলে আর তার ভালবাসা পেলে ও ভালো হয়েও যেতে পারে।

আমার কাছে তোকেই ওর জন্য ঠিক মনে হয়েছে।
মনে হয়েছে,তুই ই পারবি আমার ছেলেটাকে সুস্থ করে তুলতে।

-পারবিনা মা?আমার ছেলেটাকে আদর ভালবাসা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে?
পারবিনা আমার আগের দীপ্তকে আমার বুকে ফিরিয়ে দিতে?
-আমি চেষ্টা করবো মা,
আপনি শুধু আমার জন্য দোয়া করবেন।
-আমার দোয়া সব সময় তোদের সাথে থাকবে।

-মা মা,আমার বউ এর সাথে তোমার কথা বলা হয়নি?আমি ভেতরে আসবো।
আমার বউকে দেখতে।ওর সেবা করতে হবে যে।

-ওই দেখ আমার পাগল ছেলেটা ডাকছে,
ওকে দেখে ভয় পাস না কিন্তু।
ও তোর কোন ক্ষতি করবেনা,ও এখন আমাকেও চেনে।জানে ওর মা আমি।যদিও আগের কিছুই মনে নেই ওর।
ডাক্তার বলেছে আমি ওর মা,তাই মা ডাকে আমাকে।
আমি বলেছিনা তুই ওর বউ?বউ ই ডাকবে।আর তোকে কামড় দিবেনা কিংবা আঘাত করবেনা।

আমি যাই এখন তাহলে হুম?
তুই রেস্ট নে।
-আচ্ছা মা।
-আয় ভেতরে আয়,তোর বউর সাথে কথা বলা শেষ আমার।ওকে কিন্তু আর কষ্ট দিস না।ঠিক আছে?এটা তোর বউ।আর বউকে কষ্ট দিতে হয়না,ব্যথা দিতে হয়না।ভালবাসতে হয়,আদর করতে হয়,আগলে রাখতে হয়,রক্ষা করতে হয় আর বউ এর সব দায়িত্ব পালন করতে হয়।

-আচ্ছা ঠিক আছে,সব করবো।
-আচ্ছা আমি তাহলে যাচ্ছি।
-যাও।

-তোমার কি এখন একটু ভালো লাগছে বউ?
-হুম লাগছে।
-সরি,আমি আর কখনো এমনটা করবোনা তোমার সাথে বউ।
-শুধু আমার সাথে না,কারো সাথেই আর এমন করবেন না,মানে কামড় দিবেন না,মারবেন না,আঘাত করবেন না,
মনে থাকবে?
-হুম থাকবে।
-আমি আপনার কি হই?
-মা তো বল্লো,বউ।
-বউ এর সব কথা শুনতে হয় এটা জানেন?
-নাতো।
-তাহলে জেনে রাখুন।বউ এর সব কথা শুনতে হয়,বউ যা যা বলে তাই তাই করতে হয়।
আর মায়ের সব কথাও শুনতে হয়।
কারণ পৃথিবীতে মায়ের মত আপন কেউ হয়না।
-বউ ও না?
-উফ!বউ ও আপন।কিন্তু মা আগে।বউ সারাজীবনের সাথী।
-আচ্ছা বুঝেছি।
-আজ থেকে আমি যা যা বলবো সব শুনতে হবে ওকে?
-আচ্ছা ওকে।
-গুড বয়।
-হি হি।

-আচ্ছা এবার চলুন আমরা খেতে যাই।
-আচ্ছা চলো।

খেতে বসেছি আর আমার মামা মামী এসেছেন।
মা উনাদের দেখে খুশি হলেন।
আমাদের সাথে খেতে বসতে বললেন।
আমি খেতে বসেছি বলে মামী আমাকে বললেন,

-তুই খেতে বসেছিস কেন?
সবার খাওয়া দাওয়া হবে তারপর তুই খেতে বসবি।বাড়ীর বউ তুই,মেয়ে না।
-এ কি বলছো?বউ বলে পরে খেতে হবে কেন?আমাদের সাথেই খাবে,তাছাড়া আমি ওকে বলে দিয়েছি আজ থেকে আমার মেয়ে রিয়া।বউ না।

-তারপরও আপনি ওকে বেশি আশকারা দিয়েন না আপা।বেশি আশকারা পেলে বউ রা মাথায় উঠে যায়।

মা সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন।
রুই মাছের বড় মাথাটা আমার প্লেটে দিতে দেখে মামী বলে উঠলেন,
-এ কি করলেন আপা?ওকে কেন এত বড় মাথাটা দিচ্ছেন?ওকে এসব দিতে হবেনা।

আর তখনি দীপ্ত বলে উঠে,
-আপনার কি সমস্যা হ্যাঁ?আপনার কি সমস্যা?মা ওকে সব গুলো মাছ দিয়ে দাও তো।উনাকে কিছু দিবেনা।উনি পঁচা, ভালোনা।দেখছোনা এসেই আমার বউর সাথে কেমন করছে।

-আপা!ও রিয়াকে চিনে ফেলেছে?
-হ্যাঁ আজই চিনেছে।
-রিয়া কি সব বুঝে গেছে?
-আমিই সব রিয়াকে বলে দিয়েছি।আমি চাইনা ও কোন ঘোরের মধ্যে থাকুক।

এই কথা শুনে মামী মামা মাথাটা নিচু করলেন।
খাওয়া দাওয়া শেষে মামী আমার রুমে এসে বললেন,
ভালো পরিবারে বিয়ে হয়েছে তোর।তাই বলে বেশি উড়িস না।নইলে পা ভেঙে পড়েও যেতে পারিস।

-চেয়েছিলেন তো তাই ই।কিন্তু আমি এত দুর্বল না।আমি পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারি।ছোট বেলা থেকেই যে করে আসছি।
কম তো আর কষ্ট দেন নি আমাকে।
কিন্তু আমি যা ভেবেছিলাম তার উলটো হয়েছে।ভেবেছিলাম মা আপনার আত্মীয়,তাই হয়তো আপনার মতই খারাপ হবে।
কিন্তু না,আপনি যেমন তার পুরো টাই বিপরীত হচ্ছেন মা।
খুব ভালো তিনি।
এমন শাশুড়ি পেয়ে সত্যিই আমি লাকী।

-কি আমি খারাপ?

এই বলে যেই না মামী হাত তুলেছে আমাকে থাপ্পড় দিতে,আর দীপ্ত এসে মামীর হাত ধরে ফেলেছে।
এমন জোড়েই ধরেছে যে আর একটু ধরে রাখলে হয়তো মামীর হাতটাই অকেজো হয়ে যেতো।
ভাগ্যিস বলেছিলাম, বউর কথা শুনতে হয়।

মামী চিৎকার করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।আর আমাকে বলে যায়,আর আসবোনা এই পাগলের বাড়ীতে।আজ আমার হাত টাকেই খেতে বসেছিলো।
কোন দিন আমাকেই চিবিয়ে খাবে তার ঠিক নেই।

-আমার বউকে আপনি মারবেন আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো বুঝি?
যান এখান থেকে,যান।আমার বউকে যে মারতে আসবে,আমিও তাকে মেরে দেবো।

-থাকো তুমি তোমার বউ এর আচল ধরে।
আমি চললাম।

মামা মামী বাসায় চলে যান।
দীপ্ত আমি আর মা পরে বসে বসে গল্প করি।

রাতে খাবার খেয়ে ঘুমাতে যখন যাবো,
তখন দীপ্ত আমাকে ডেকে বলে,

-আমি কি তোমার সাথে থাকবো?
মা বলেছেন আজ থেকে তোমার সাথে শুতে।তুমি নাকি রাতে ভয় পাও।
তাই তোমাকে পাহারা দিতে বলেছেন।

আমি হাসলাম,আর বললাম
-হুম রাতে একা থাকতে ভয় পাই আমি।
আপনি আমার সাথে থাকবেন আজ থেকে।

তারপর আমি বিছানা ঠিক করে মশারি টাঙ্গিয়ে নিলাম।

শুয়ে পরলাম দু পাশে দুজন।
একটা সময় দীপ্ত বকবক বকবক করতে করতে ঘুমিয়ে পরলো,
আর আমি ভাবতে লাগলাম সকাল থেকেই ওকে সুস্থ করার জন্য আমাকে কাজে লেগে পড়তে হবে।
যেভাবেই হোক ওকে সুস্থ করে তুলতেই হবে আমার।

দীপ্ত ঘুমাচ্ছে,
কি নিষ্পাপ একটা মুখ।
আর কতই না ভালো মানুষটা।
কি থেকে কি হয়ে গেছে।

আমিও পাশ ফিরে দুচোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।
তার কিছুক্ষণ পরই দেখি দীপ্ত আমাকে জড়িয়ে ধরছে।
এই কি করছেন আপনি?ছাড়ুন আমাকে,ছাড়ুন।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here