#পোড়া_কপালী,পর্ব_৬
#শতাব্দী_নাওয়ার
একদিন দীপ্ত আর আমি শপিং করে বাসায় ফিরছিলাম।
কিছু জামা-কাপড় কেনাকাটা করে।
আমার হাত থেকে একটা ব্যাগ পড়ে যায় বলে আমি ব্যাগ টা উঠাতে থাকি আর দীপ্ত ৩ ৪ কদম সামনে চলে যায়।
আর তখনি একটা বাস এসে দীপ্তকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।
আর আমি দীপ্ত বলে চিৎকার করে উঠি…
-প্লিজ আমার দীপ্তকে কেউ হসপিটালে নিয়ে চলুন।প্লিজ,নিয়ে চলুন আমার দীপ্তকে হসপিটালে।
আমার চিৎকার শুনে আশেপাশের কিছু লোক দীপ্তকে আমার সাথে হসপিটালে নিয়ে যায়।
আমি হসপিটালে পৌছেই মাকে ফোন দেই।
মাও হসপিটালে চলে আসেন।
দীপ্ত মাথায় আঘাত পায়।ডাক্তার ট্রিটমেন্ট করেন।
-ডাক্তার,কি অবস্থা এখন দীপ্তর?
-জ্ঞান ফিরলেই বলা যাবে।যদিও মাথায় ছাড়া আর কোথাও তিনি আঘাত পাননি।আর মাথার আঘাতটাও তেমন গুরতর নয়।আর এই আঘাত থেকে সে তার স্মৃতি শক্তি ফিরেও পেতে পারে।দোয়া করুন আল্লাহ্র কাছে।
আমরা দীপ্তর জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।
কিছু ক্ষণ পর দীপ্তর জ্ঞান ফিরে।
আমি আর মা দীপ্তর পাশে দাঁড়ানো।
দীপ্ত চোখ খোলে,
চোখ খোলেই বসে পড়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,ঝুমুর তুমি ঠিক আছো?ঠিক আছো তুমি ঝুমুর?
তুমি জানো আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম?থ্যাংক্স টু আল্লাহ্ তোমার কিছু হয়নি।
আমি অবাক হয়ে দীপ্তর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মায়ের দিকে তাকাতেই দেখি মা হেঁটে কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
মা সামনে যেতেই মেয়েটা মাকে জড়িয়ে ধরলো।
মেয়েটা কাঁদছে,সাথে কাঁদছে মা ও।
দীপ্তও বেড থেকে উঠে গিয়ে মা ও মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
আর আমি অসহায়ের মত তাদের দিকে তাকিয়ে আছি।
কিছু ক্ষণ পর মা আমার দিকে তাকালেও ইশারা দিয়ে কোন কথা বলতে বারণ করেন।
আমিও কোন কথা বলিনা।
-কি হয়েছিলো তোমার হুম?
কি হয়েছিলো?আংকেল যে ফোন করে বল্লো তুমি এক্সিডেন্ট করেছো।
কোথাও লাগেনি তো তোমার?
-আমি ঠিক আছি দীপ্ত।তোমার কি হয়েছে?তুমি ঠিক আছো তো?
-কিজানি,বুঝতে পারছিনা আমার কি হয়েছে।কিছুই তো মনে করতে পারছিনা।
-দীপ্ত রোড এক্সিডেন্ট করেছে ঝুমুর, ডাক্তার বলেছেন জ্ঞান ফিরলেই আর সমস্যা নেই।
-কিন্তু তুমি এখানে?কিছুই বুঝতে পারছিনা।তুমি বেঁচে আছো?
-ঝুমুর ঝুমুর,কই গেলি রে মা তুই?
এই যে মা তুই এখানে,আর আমি তোকে কত ক্ষণ যাবত খুঁজছি।চল ডাক্তার এসে গেছেন।
-বাবা,এই দেখো দীপ্ত।
-তুই ঠিক হয়ে গেছিস মা?আমাকে বাবা বলে ডাকলি?দুই টা বছর আমি এই ডাক টা শোনার জন্য কত অপেক্ষা করেছি।কিন্তু তুই একটা বারও আমায় ডাকিস নি।
তুই ঠিক হয়ে গেছিস মা তুই ঠিক হয়ে গেছিস।
-ভাই সাহেব,কি হচ্ছে এসব?ঝুমুর কে না দাফন করা হয়ে গেছে দুই বছর আগে?তবে ও আজ এখানে কি করে?আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা।
-আমি বলছি আপা,আমি সব খুলে বলছি। (ঝুমুরের বাবা)
দুই বছর আগে যেদিন ঝুমুর ড্রাইভ করে আপনাদের বাসায় আসছিলো।
সেদিন ওর সাথে আমাদের কাজের মেয়েটাও ছিলো।আর ও ঝুমুরের সমবয়সীও।
ঝুমুর ওকে নিয়েই আপনাদের বাসায় যাচ্ছিলো।
কিন্তু রাস্তায় যখন ওদের গাড়ীটা এক্সিডেন্ট করে তখন আমাদের কাজের মেয়েটা মারাত্মক ভাবে আহত হয় আর হসপিটালে আনার পর ডাক্তার বলেন ও মারা গেছে।
আর এদিকে ঝুমুরও মাথায় আঘাত পায়।ফলে ও স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে।
তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই এখনি ওকে আমি দীপ্তর জীবন থেকে সরিয়ে ফেলবো।
না ও এখন কাউকে চিনবে,না দীপ্তর জন্য পাগলামো করবে।
আর তাই আপনাদের ফোন করে আসতে বলি,
আর আমাদের কাজের মেয়ের লাশ দেখিয়ে বলি ঝুমুর আর নেই।
ওর মুখটা আঘাতে পুরো নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো বলে কারোই বোঝার ক্ষমতা ছিলোনা আসলে এটা কি ঝুমুর নাকি অন্য কেউ।
তাই আপনারাও বুঝতে পারেন নি।
আর আমার প্ল্যান সাক্সেসফুল হয়।
-ছিঃ ভাইজান ছিঃ,এত টা নিচে নামতে পারলেন আপনি?কেন করেছেন এমন আপনি?কেন?
উত্তর দিন।
-কারণ আমি দীপ্তর সাথে ঝুমুরকে বিয়ে দিতে রাজি হলেও মন থেকে দীপ্তকে মেনে নিতে পারিনি।
তাই আমি এক্সিডেন্টের সময় এই প্ল্যান করে আমার মেয়েকে দীপ্তর জীবন থেকে সরিয়ে আনতে চেয়েছি।
আর পেরেছিও বটে।কিন্তু সমস্যা ছিলো এই যে, এই দুইটা বছর আমার মেয়ে মুখ দিয়ে একটা শব্দ পর্যন্ত করেনি।
একটা বার বাবা বলে ডাকেনি।
চুপচাপ ঘরেই বসে থাকতো।
ভুলে গিয়েছিলো সমস্ত অতীত।
তাই আমি মাঝে মাঝেই ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসি।
আজও তাই নিয়ে এসেছি।
কিন্তু ও যে হঠাৎ দীপ্তকে দেখে স্মৃতিশক্তি ফিরে পাবে তা বুঝতে পারিনি।
দীপ্তকে যখন সবাই নিয়ে আসছিলো তখন আমার সাথে সাথে ঝুমুরও ওকে দেখেছে।হয়তো ওটা খেয়াল রেখেই ও ফলো করতে করতে এখানে এসে গেছে।
কিন্তু দীপ্তকে দেখে যে এত তাড়াতাড়ি ওর অতীত মনে পড়ে যাবে তা আমি ভাবতেও পারিনি।
-ছিঃ বাবা ছিঃ তুমি আমার সাথে এমনটা করতে পারলে?
-মারে আমাকে মাফ করে দে।আমার ভুল হয়েছে।
-আপনি জানেন সেদিনের ওই ঘটনা আমার ছেলের জীবনটাকে পুরো পাল্টে দিয়েছে?
আমার ছেলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে সেদিন।
সইতে পারেনি ঝুমুরের মৃত্যুর আঘাত।
সইতে না পেরে
আমার ছেলেটা পাগল হয়ে গিয়েছিলো।
কত ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েছি তবুও কোন ভাবে ঠিক হচ্ছিলোনা।পরে…
থাক সে সব কথা।
আপনি কাজটা মোটেও ঠিক করেন নি ভাইজান।
আল্লাহ্ আপনাকে কোন দিন মাফ করবেনা।
-আপা আপনি আর দীপ্ত আমাকে মাফ করে দিন।
আমি আমার ভুল স্বীকার করছি।
আর আমি দুদিন পরই ওদের বিয়ে দিতে চাই।
যেই ভুল আমি দু বছর আগে করেছি,সেই ভুল আমি এখন শুধরাতে চাই।
এই কথা শোনার পর মা আমার দিকে তাকান।
আমি মাকে হাত আর চোখ দিয়ে ইশারা করি কিছু না বলতে।
মা কোন কথা বলেনা।
ডাক্তার সেই মুহূর্তে এসে বলেন,
-বাহ্ পেসেন্টের জ্ঞান ফিরেছে?
-ও ডাক্তার সাহেব,আমার ছেলে আগের স্মৃতিশক্তিও ফিরে পেয়েছে।
-বাহ্ ভেরি গুড।আপনি বিছানা থেকে উঠেছেন কেন?শুয়ে পড়ুন পড়ুন।
দীপ্ত শুয়ে পড়ে।
ডাক্তার ওকে দেখে।
-ডাক্তার,আমি আজই বাসায় চলে যেতে চাই।
-কিন্তু আজ তো আপনাকে থাকতে হবে।
-না ডাক্তার প্লিজ,আমার তেমন সমস্যা হচ্ছে না।আমাকে রিলিজ দিয়ে দিন প্লিজ।প্লিজ ডাক্তার।
-আজকের দিনটা থেকে গেলে ভালো হতো।
-ডাক্তার আমার খারাপ লাগলে আমি আবার চলে আসবো।
আচ্ছা ঠিকাছে,সন্ধ্যায় আপনাকে রিলিজ দেয়া হবে।
আপাতত থাকুন।
-ধন্যবাদ ডাক্তার।
দীপ্ত বেডে শুয়ে আছে,ঝুমুর দীপ্তর হাত ধরে বসে আছে।
দুজন তৃপ্তির হাসি হাসছে।ভালবাসার মানুষকে ফিরে পাওয়ার যে কি আনন্দ তা যেন ওদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
দীপ্ত ওর অতীত ফিরে পেয়েছে।ভুলে গেছে ওর বর্তমান আমি টাকে।
আমি দীপ্তর কোন দোষ দেইনা,ওর তো কোন দোষ নেই।দোষ আমার কপালের।
আমি যে পোড়া কপালী।এই পোড়া কপালীর কপালে কি আর সুখ থাকতে পারে?পোড়া কপালীর যে সুখ সয়না।
আমি কেবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছি।
মা ও আমার পেছন পেছন আসলেন।
-জানেন মা আমি আজ খুব খুশি।দীপ্ত ওর স্মৃতিশক্তি ফিরে পেয়েছে।
আমরা স্বার্থক তাইনা মা?
-কিন্তু ও যে তোকে ভুলে গেছে রে মা।
-আমি জানি মা, সমস্যা নেই।ও সুস্থ হয়ে গেছে এটাই অনেক।
-সব তোর জন্য রে মা,তোর সেবা,আদর যত্ন,ভালবাসায় আমার ছেলেটা সুস্থ হয়ে গেছে।ফিরে পেয়েছে ওর স্মৃতিশক্তি।
-সাথে ওর হারানো ভালবাসাও,তাইনা মা?
মা চুপ করে আছেন।
-কিছু বলতে হবেনা মা।দেখেছেন ওরা দুজন আজ কত খুশি দুজনকে পেয়ে?দীপ্তকে দেখে রাখবেন মা।আর দীপ্ত সুস্থ হলেই ওদের দুজনের হাত এক করে দিবেন।
যদিও এখনো ওরা হাত ধরেই বসে আছে।
আমি বোঝাতে চেয়েছি দুজনকে বিয়ে করিয়ে দিয়েন,দীপ্ত একটু সুস্থ হলেই।
-কিন্তু তুই?
-থাক মা,আমার কথা ভাব্বেন না।
আমার মত পোড়া কপালীর কপালে যা আছে তাই হবে।
কিন্তু একটা কথা কি জানেন মা?
এই পোড়া কপালীটা না আপনার ছেলেটাকে খুব ভালবেসেছে।খুব।
আমি ওর সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলোর স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকবো মা।
ভালো থাকবো।
-রিয়ারে,মা আমার।
-কাঁদবেন না মা।ভালো থাকবেন আপনারা।দেখে রাখবেন আমার দীপ্তকে।
ও যেন আর কোন আঘাত কোন দিন না পায়।
তাহলে কিন্তু আমি ওই ঝুমুর কে ক্ষমা করবোনা।
আসি মা।
উঁহু মা কাঁদবেন না।
এই পোড়া কপালীটা আপনাকে আর আপনার ছেলেকে কোন দিন ভুলবেনা।
কোন দিন না।
মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম,
দূর থেকে দীপ্তকে এক নজর দেখে নিলাম।
এখনো ঝুমুরের হাত ধরে শুয়ে আছে।
এ হাত কোন দিন ছেড়োনা দীপ্ত,কোন দিন ছেড়োনা।
পা বাড়ালাম খোলা রাস্তায়,হেঁটে যাচ্ছি হেঁটে যাচ্ছি।
কোথায় যাবো আমি এখন?কার কাছে যাবো?কে আছে আমার?
না বাবা,না মা,না ভাই,না বোন,আর না স্বামী।স্বামীটাতো এখন অন্য কারোই হয়ে গেলো।দুঃখ ছাড়া কেউ রইলোনা এই জীবনে।
বিধাতা,এই পোড়া কপালীর কপালে কি এইটুকুন সুখও লিখোনি তুমি?
এতটাই অপয়া আমি?
মোবাইল টা নিয়ে এসেছি আমি।
দীপ্ত কিনে দিয়েছিলো আমায়,
নিজে দামাদামি করে।
এটাও আনতাম না,যদি না এটাতে দীপ্তর আর আমার শত শত ছবি না থাকতো।
দীপ্তটা সেল্ফি পাগল একদম।
কতই না ছবি তুলেছি আমরা এক সাথে।
আমি রান্না করছি,ওখানেই সেল্ফি,মশারি টানাই,সেখানেও সেল্ফি,শপিং করি সেখানে সেল্ফি।
হায়রে সেল্ফি।
কত স্মৃতি।
আর কোন দিন ছবি তোলা হবেনা দীপ্ত।
আর তুলবেনা তুমি কোন ছবি আমার সাথে।
এখন তোমার মোবাইল জুড়ে,জীবন জুড়ে অস্তিত্ব জুড়ে থাকবে শুধু ঝুমুর আর ঝুমুর।
চলবে…