#পোড়া_কপালী,পর্ব_৮
#শতাব্দী_নাওয়ার
১ বছর পর।
-এই যে খালা,আপনার ওষুধ টা কে খাবে শুনি?
-ভুলে গেছি মা,আজকাল মনে থাকেনা ওষুধপাতির কথা।
-কোন সমস্যা নেই,আমি আছি না মনে করিয়ে দেয়ার জন্য,প্রতিদিন মনে করিয়ে দেবো।
-আল্লাহ্ তোকে সুখী করুক মা,
-আর সুখ!পোড়া কপালীর কপালে সুখ লিখা থাকেনা খালা।
-এই যে চাচা,সকালের নাস্তা করেন নি কেন?হুম?
কি হলো?মন খারাপ?
-ছেলেটার কথা খুব মনে পড়ছে রে মা।
-যেই ছেলে আপনাকে তার সাথে রাখতে পারেনি।যেই ছেলে আপনার কথা মনে রাখেনি।তাকে মনে করে কি লাভ?
নিজের শরীরকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ?
নিন হা করুন,
-মারে,তোর মত এত লক্ষী একটা মেয়ের কপালে এত দুঃখ কেন লিখছে আল্লাহ্।
-চাচা,পোড়া কপালী যে আমি।
পোড়া কপালীর কপালে দুঃখ ছাড়া আর কি ই বা লিখা থাকবে।
কিন্তু এখন আমি ভালো আছি।এই যে আপনাদের সবার সাথে আছি।নিজেকে আর অনাথ মনে হয়না।
-আল্লাহ্ একদিন তোকে অনেক সুখী করবেন,দেখিস।অনেক সুখী করবেন।
রিয়া এখন একটা বৃদ্ধাশ্রমের সেবিকা।
যেদিন হসপিটাল থেকে দিশেহারা হয়ে কাঁদতে কাঁদতে খোলা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলো রিয়া,
সেদিন এই বৃদ্ধাশ্রমের এক সেবিকার সাথে রিয়ার দেখা হয়।
রিয়াকে কাঁদতে দেখে তিনি এগিয়ে আসেন রিয়ার কাছে।
-কি হয়েছে তোমার?
-কাঁদছো কেন?
-কি আর হবে দিদি, পোড়া কপালীর পোড়া কপালে যা লিখা ছিলো তাই হয়েছে।
-খুলে বল বোন,কি হয়েছে?
তারপর রিয়া ওই সেবিকাকে সব কথা খুলে বলে।
বলে ওর জীবনের কাহিনী,
ছোট বেলা থেকে এখন অব্ধি ওর সাথে যা যা ঘটেছে।
-সবই তো শুনলাম।
এখন কি করতে চাও?
-জানিনা কি করবো,দুচোখ যেখানে যায় সেখানে যাবার উদ্দেশ্যে বের হয়েছি।
কিন্তু হাঁটছি তো হাঁটছি রাস্তা ফুরোচ্ছেনা দিদি।
-আমার সাথে যাবে?
-কোথায় যাবো?
-আমি একটা বৃদ্ধাশ্রমের সেবিকা।
সেখানে বৃদ্ধাদের দেখা শোনা করি।
ওখানেই থাকি,ওখানেই খাই।চলে যাচ্ছে জীবন।
তুমি চাইলে তুমিও তাদের সেবার কাজে নিয়জিত হতে পারো।
থাকতে পারো সবার সাথে, দেখবে ভালো লাগবে।
আর মাথা গুজার একটা জায়গাও হবে।
যাবে?
-হুম দিদি যাবো।
সেদিন থেকেই এই বৃদ্ধাশ্রমই হয় রিয়ার ঠিকানা।
রিয়া এখানকার মানুষ গুলোকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে।
সবার ভালবাসায় শুরু করেছে নতুন জীবন।
একটা বছর হয়ে গেছে রিয়া এখানে আছে।
কিন্তু একটা মুহূর্তের জন্যও দীপ্তকে ভুলতে পারেনি।
-কিরে এখানে একা একা বসে আছিস যে?
-ভালো লাগছেনা দিদি।
-কি হয়েছে বল আমায়?
-আজ দীপ্তর কথা খুব মনে পড়ছে।
-কেন পারিস না অতীত ভুলে যেতে?
-কিভাবে ভুলবো দিদি?যাকে তিন কবুল পড়ে সারাজীবনের সঙ্গী করেছি।
তাকে কি করে ভুলবো?
-ও কি তোকে মনে রেখেছে,তুই যে রাখবি?
-ও তো আমার কথা ভুলেই গেছে দিদি।যেদিন ও ওর ভালবাসাকে খুঁজে পেয়েছে,সেদিনই।
নিশ্চই ওরা খুব ভালো আছে এখন।
বিয়েও হয়ে গেছে বোধয়।
বোধয় কি,হয়েই গেছে বিয়ে।
হয়তো সন্তানের বাবাও হয়ে গেছে দীপ্ত।
-আচ্ছা দিদি,দীপ্তর কি আমার কথা একবারও মনে পড়েনি?
এত গুলো দিন আমরা এক সাথে ছিলাম।কত স্মৃতি।কিছুই কি ওর মনে পড়েনি কখনো?
আমাকে এত সহজেই ভুলে গেলো ও?
আমাকে ভুলে গিয়ে বিয়ে করে সংসার করছে ওর ভালবাসার মানুষটার সাথে।খুব ভালো আছে ও তাইনা দিদি?
হুম ভালোই থাকুক,এটাই তো চেয়েছি আমি।ভালো থাকুক,ভালো থাকুক,খুব ভালো থাকুক।
-কাঁদিস না বোন।আর কত কাঁদবি?কাঁদতে কাঁদতেই তো বছর কাটালি।
আর কত?
-হয়তো সারাজীবন।
তোমরা এখানে?আর আমি তোমাদের কত জায়গায় খুঁজছি।
-কি হয়েছে খালা?
-আমার ছোট ছেলে এসেছে মা,আমার ছোট ছেলে এসেছে আমাকে নিতে।
-সত্যি বলছেন খালা?
-হুম সত্যি, বড় ছেলে আর বড় বউ আমাকে এখানে দিয়ে গেছে,ছোট ছেলেটা বেকার ছিলো বলে কিছু বলতে পারেনি।এখন নাকি আমার ছোট ছেলে চাকরি পেয়েছে।নিজের টাকায় ছোট একটা ঘর দিয়েছে।
সেই ঘরে আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে।
আমরা মা ছেলে এখন এক সাথে থাকবো।
-আলহামদুলিল্লাহ্।
চলো আমার ছেলের সাথে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেই।
-আপনাকে খুব মনে পড়বে আমাদের খালা।
-আমিও তোমাদের ভুলতে পারবোনা।
তোমরা আমার যে সেবা যত্ন করেছো,ভালবাসা দিয়েছো কোন দিন ভুলতে পারবোনা।
আমি আমার ছেলের সাথে এসে মাঝে মাঝে তোমাদের দেখে যাবো।
-আচ্ছা খালা।
-চলো আমার ছেলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
-চলুন।
এই যে এটা আমার ছেলে তানভীর,
আর এটা হচ্ছে লিপি,আর এই হচ্ছে রিয়া।
-আসসালামু আলাইকুম!ভালো আছেন আপনারা?
-জ্বী ভালো,আপনি?
-জ্বী আলহামদুলিল্লাহ্।
-জানিস বাবা এই রিয়া না আমার অনেক খেয়াল রেখেছে,অনেক যত্ন করেছে আমার।সময় মত খাবার খাইয়েছে,ওষুধ খাইয়েছে।অনেক লক্ষী এই রিয়া।
-হয়েছে খালা,এত সুনাম করতে হবেনা।
এই যে তানভীর সাহেব,
এখন থেকে খালার সমস্ত দায়িত্ব আপনার।
আজ থেকে আপনি তাকে টাইম টু টাইম ওষুধ খাওয়াবেন।
খেয়াল রাখবেন যত্ন নিবেন।
-জ্বী,তাতো অবশ্যই।অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।আমার মাকে দেখে রাখার জন্য।
-ধন্যবাদ দিতে হবেনা,এটা তো আমাদের দায়িত্ব।
-তবুও আজকাল ক’জনই বা তাদের দায়িত্ব ঠিক মত পালন করে।
আচ্ছা আসি।ভালো থাকবেন।
আসবেন আমাদের বাসায়।
-জ্বী আপনিও খালাকে দেখে রাখবেন।
খালার যখন সবার কথা মনে পড়ে খালাকে নিয়ে এসে ঘুরে যাবেন।
-আচ্ছা,আসবো।
-যাই রে মা।
-ভালো থাকবেন।
-তোমরাও ভালো থেকো।
তানভীর তানভীরের মাকে নিয়ে নিজের বাসায় পৌছে।
তানভীরের মা ছেলের নতুন ঘরে উঠে।
চোখে আনন্দের অশ্রু।
পরের দিন সকালে,
-আচ্ছা মা,রিয়া মেয়েটার কি পরিবারের কেউ নেই?এত সুন্দর মেয়েটা বৃদ্ধাশ্রমে জীবন কাটাচ্ছে।
-বলতে গেলে সবই আছে,আবার কিছুই নেই রে বাবা।
-বুঝলাম না।খুলে বলো তো মা।
-ওর জীবনটা অনেক দুঃখের,জানিস বাবা।
এত ভালো মেয়েটার জীবনে এত দুঃখ,কল্পনাও করা যায়না।
তানভীরের মা তানভীরকে রিয়ার জীবন কাহিনী সব খুলে বলে।
তানভীর আর তানভীরের মায়ের চোখ ভিজে আসে।
-তাহলে মা ওকে আমরা কষ্টের জীবন থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি।
কি বলো?
-কিভাবে?
-কিভাবে আবার,তোমার পুত্রবধূ করে।
-সত্যি বলছিস?আমিও এ কথা টা মনে মনে ভেবেছি।কিন্তু তোকে বলার সাহস পাইনি।
কি না কি ভাবিস তুই,
এই ভেবে।
-না মা,তুমি যখন রিয়ার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দাও তখনি ওকে আমার ভালো লাগে।
আর যখন তোমার মুখে শুনলাম তোমাকে খুব যত্ন করেছে ও।তখন মনে মনে ভাবলাম,আমাদের পরিবারে এমনই একটা মেয়ে দরকার।
যে আমাদের পরিবারটাকে আগলে রাখবে।
-সত্যি রে বাবা,ও আমাদের পরিবারে আসলে আমাদের পরিবার টা পূর্ণ হয়ে যাবে।
-তাহলে বিকেলেই চলো বৃদ্ধাশ্রমে। গিয়ে ওকে বলো তুমি।দেখো ও কি বলে।
বিকেলে তানভীর আর তানভীরের মা রিয়ার সাথে দেখা করতে বৃদ্ধাশ্রমে যায়।
-কেমন আছো মা?
-ভালো আছি খালা,আপনি কেমন আছেন?
আজই আমাদের কথা মনে পড়ে গেছে না?
-হ্যাঁ মা।সবার থেকে তোমার কথা বেশি মনে পড়ছিলো।
-তাই বুঝি?
-হুম,তাই ভাবছি আমার সাথে তোমাকে নিয়েই যাবো একবারে।
-মানে কি খালা?বুঝলাম না।
-আমি চাই তুমি আমার ছেলে তানভীরকে বিয়ে করো মা।
আর আমাদের পরিবার টা পূর্ণ করো।
-এ কি বলছেন খালা?
এ হয়না।কিছুতেই হয়না।
তাছাড়া আমি এখনো দীপ্তর স্ত্রী।
আর আমি সারাজীবন ওর স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।প্লিজ আমাকে মাফ করবেন।
সেদিনের মত তানভীর আর তানভীরের মা বাসায় ফিরে আসে।
কিছুদিন পর তানভীর আবার বৃদ্ধাশ্রমে যায়।
-আজ আমি আপনাকে বিয়ের জন্য জোর করতে আসিনি।
এসেছি একটু মার্কেটে নিয়ে যেতে।
আমার মায়ের জন্য কয়টা কাপড় কিনবো।
আমি কাপড় টাপড় চিনিনা,তাছাড়া মুরুব্বি মানুষ কোন কাপড়ে ইজি ফীল করবে তারও তো একটা ব্যাপার আছে।
তাই যদি আমার সাথে একটু যেতেন।
-আচ্ছা চলুন।
রিয়া আর তানভীর শপিং করছে,
মায়ের জন্য কাপড় দেখছে।
আর ওই সময় হঠাৎ রিয়ার বুকের ভেতর কাঁপতে শুরু করে।
চোখ আটকে যায় কারো চোখের পানে চেয়ে।চোখ ভিজে আসে।
অপর দিকের মানুষটা রিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে।
রিয়ার চোখ থেকে পানি পড়ছে।
অপর দিকের মানুষটা আর কেউ নয়,এ যে দীপ্ত।
তবে কি দীপ্ত রিয়াকে চিনতে পেরেছে?
হঠাৎ ই রিয়া ওর চোখের পানি মুছতে থাকে।
যখন রিয়ার চোখ যায়,খয়েরী রঙের শাড়ী পরে দীপ্তর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ঝুমুরের উপর।
রিয়া সঙ্গে সঙ্গে তানভীরের হাত ধরে বলে উঠে,এই শাড়ীটা পরে মা আরাম পাবে।এটা নাও।
আর দীপ্ত এসে বলে উঠে,
-আরে তানভীর তুমি এখানে?
চলবে,