প্রজাপতির_ডানায়_আঁধার_নামে (পর্ব ১)

0
1279

#প্রজাপতির_ডানায়_আঁধার_নামে (পর্ব ১)

১.
‘মাথার উপর ছোট্ট একটা চৌকো মেশিন থেকে মৃদু শব্দ হচ্ছে। প্রতিদিন সকাল হয় এই যান্ত্রিক শব্দে। এত ক্লান্ত লাগে আজকাল। কতদিন এই হাসপাতালের বিছানায় বন্দি! আমার কি হয়েছে কেউ কিছুই বলছে না। মা যে চুপিচুপি কান্না করে এটা বেশ বুঝতে পারি। সারারাত শরীরে হাত বুলিয়ে দেয়, আর কি কি যেন দোয়া পড়ে সারা শরীরে ফু দিয়ে দেয়।

আর বাবা জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতে যেয়ে মুখটা আরও বেশি করুণ হয়ে যায়। ইদানিং বাবা আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না, কেমন একটু লুকিয়ে থাকা মুখ করে রাখে। এই যে কতদিন ধরে বাবাকে বলছি আমার সামনে এসএসসির টেস্ট পরীক্ষা, একটু অংকটা দেখিয়ে দিতে, তাতেও বাবা কেমন যেন আমতাআমতা করে, অজুহাত দেখায়। নাহ, সবাই কিছু একটা লুকোচ্ছে আমার কাছ থেকে। আমিও কিছু বলব না, এই যে ডাক্তার সাহেব যখন ইঞ্জেকশনগুলো দেয় কী ভীষণ কষ্ট হয় আমার, বমি হয়ে যায়। মনে হয় মারা যাচ্ছি। আর সারা শরীরে এত এত ব্যথা হয়। এগুলো আর কিছুই বলব না। কতদিন স্কুলে যেতে পারি না; তৃণি, তুতুলদের সাথে দেখা হয় না, গল্প হয় না। আচ্ছা, আমার জীবনটা হঠাৎ করেই এমন হয়ে গেল কেন..’

এ পর্যন্ত লিখে প্রজাপতি ডায়েরিটা বন্ধ করে। ডায়েরিটা গত বছর জন্মদিনে বাবা দিয়েছিল। ডায়েরির প্রথম পাতায় বাবা গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছিল, ‘আমার প্রজাপতি মায়ের জন্য’।

সেবার কালো চামড়ার বাঁধানো ডায়েরিটা হাতে দিয়ে বলেছিল, তোর মনের কথা এটাতে লিখে রাখবি। যখন বড় হবি তখন দেখবি এগুলো পড়তে অনেক ভালো লাগবে। ব্যাপারটা খুব ভালো লেগেছিল। প্রথম প্রথম তো প্রতিদিন ও ডায়েরি লিখত, ক্লাশে কোন স্যার পড়ানোর সময় অদ্ভুত শব্দ করেন, কুন্ড স্যারের ভুড়ির জন্য বেল্টটা অনেক নিচুতে নেমে আছে, তুতুল ক্লাশে লুকিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে এসেছিল আজ, এইসব। তারপর লেখাটা ধীরে ধীরে কমে যায়। ক্লাশ টেনে পড়াশোনার চাপটা আসলে বেশি। তা পড়তে প্রজাপতির খুব ভালো লাগত। কথাটা মনে হতেই আবার মন খারাপ হয়ে যায়। আজ কতটা দিন ও পড়তেই পারছে না। অনেক জোরাজোরি করে এই হাসপাতালে বই আনিয়েছে। কিন্তু পড়তে গেলেই কেমন মাথাটা ঘুরে ওঠে, মনোযোগ বসে না।

প্রজাপতি একটা লম্বা নিশ্বাস নেয়, তারপর দু’হাতে ভর দিয়ে উঠে বসে। হাতের দিকে তাকায়, কেমন কালচে ছোপ ছোপ পড়ে গেছে হাতে। ইদানীং প্রায়ই এমন হচ্ছে, খুব অল্পতেই গায়ে এমন কালচে ছোপ পড়ে যায়। প্রজাপতি একবার পুরো কেবিনটায় তাকায়, মা নেই। নিশ্চয়ই সকালেই ডাক্তার আংকেলে কাছে গেছেন।

প্রজাপতি হাত বাড়িয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের বইটা বের করে। সকালে ওর পদার্থ বিজ্ঞানটা পড়তেই ভালো লাগে। পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ও ‘শব্দ’ এর অধ্যায়টা বের করে। এই অধ্যায়টা আগেও পড়েছে। এখানে একটা মজার জিনিস আছে, প্রতিধ্বনি শুনতে হলে কত দূরে দাঁড়িয়ে শব্দ করতে হবে। অংকগুলোও এখান থেকে আসে। একটা পাহাড়ের কত দূরে দাঁড়িয়ে শব্দ করলে তার প্রতিধ্বনি শোনা যাবে। প্রজাপতির খুব ইচ্ছে হয় একদিন ও সুস্থ হয়ে উঠলে একটা পাহাড়ের কাছে যাবে। ফিতে দিয়ে মেপে নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে শরীরের সব শক্তি দিয়ে ‘কুউউ’ শুব্দ করবে, প্রতিধ্বনি শুনবে। আচ্ছা ও কবে সুস্থ হবে? পাহাড়ের কাছে কি আদৌ যেতে পারবে?

এই যখন ভাবছে ঠিক তখন মিতু কেবিনে ঢোকে, মেয়ের হাতে বই দেখে একটু বিরক্ত হন, ‘এই সকালেই হাতে বই নিয়ে বসেছিস? ক’টা দিন না পড়লে কী হয়? এই শরীরে পড়লে আরও খারাপ হয়ে যাবে।’

প্রজাপতির মনটা খারাপ হয়ে যায়, মুখে একটা অসন্তুষ্টি ফুটে ওঠে। বইটা বন্ধ করে পাশে রাখে, তারপর শরীরটা টেনে নিচে নামিয়ে শুয়ে পড়ে। মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে হাসপাতালের পাতলা সাদা চাদরটা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে।

মিতু একটা কাগজের প্যাকেট থেকে গরম গরম পরোটা বের করে, আরেকটা পলিথিন থেকে ডালভাজি। মেয়েটা হাসপাতালের খাবার খেতেই চায় না। সকালের নাস্তাটা পাশেই একটা হোটেল থেকে মাঝে মাঝেই কিনে আনে ও। একটা ছোট বাটিতে ডালভাজিটা রেখে প্রজাপতিকে ডাকতে যেয়েই থমকে যায়। বুকটা ধক করে ওঠে, সাদা চাদরে মুড়ে প্রজাপতি এমন করে ঘুমোচ্ছে যে হঠাৎ দেখলে মনে হয়…। নাহ, শব্দটা ভাবতেও চায় না মিতু। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশে বসে মুখের উপর থেকে আলতো করে চাদরটা সরিয়ে দিতেই প্রজাপতি ফিক করে হেসে ফেলে, দুষ্টুমির গলায় বলে, ‘কী ভয় পেয়েছ মা? আমি একদম নিশ্বাস বন্ধ করে পড়েছিলাম। জানতাম তুমি ঠিক এসে মুখের উপর চাদরটা সরিয়ে দেবে। ও মা, এত ভয় পাও কেন? আমি ভালো আছি তো।’

মিতুর বুকটা খামচে ধরে কেউ, প্রজাপতির মুখটা কোলের উপর তুলে নেন। ঝুঁকে কপালে চুমু খেয়ে মুখটা চেপে ধরেন মেয়ের গালে। মনে মনে বলেন, প্রজাপতি নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবে, আগেরমতো আবার উড়ে বেড়াবে। এমন ভয়ংকর দিন আসবে স্বপ্নেও ভাবেনি মিতু। কয়েক মাস ধরেই মেয়েটা বলত ওর নাকি খুব ক্লান্ত লাগে। আর ঘন ঘন ঠান্ডা লাগত, একবার তো নিউমোনিয়াই হয়ে গেল। তখনই হাসপাতালে ভর্তি করার পর একদিন ডাক্তার জরুরি কিছু বলার জন্য হাসান আর ওকে ডেকে পাঠায়। সেদিন অনেক প্রশ্ন করেছিলেন ডাক্তার, তারপর সেই ভয়ংকর কথাটা বলেছিলেন, ‘আমরা সন্দেহ করছি আপনার মেয়ের লিউকেমিয়া হয়েছে। দ্রুত একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ দেখান।’

মিতুর সেদিন মনে হয়েছিল এই ডাক্তার সাহেবের ভুল হচ্ছে, উনি নিশ্চয়ই কোথাও কোনো ভুল করেছেন। সেদিনই ও হাসানকে বলে প্রজাপতিকে আরেকজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু উনিও যখন একই কথা বলল, তখন মিতুর নীল আকাশটা কালো মেঘে ভরে গিয়েছিল। সেই কালো মেঘের আঁধার আজও কাটেনি।

মিতু এবার প্রজাপতির কানে ফিসফিস করে বলে, ‘তোর ভালো লাগলে বই পড়িস, আমি আর বকব না।’

প্রজাপতি দু’হাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খায়, বলে, ‘আমার লক্ষ্মী মা।’

মিতু এবার ওর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘শিগগির নাস্তা করে নি, পরোটা ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

প্রজাপতি এবার বাধ্য মেয়ের মতো খেতে বসে, কিন্তু আধখানা পরোটাও খাওয়া হয় না, কেমন বমি বমি লাগে। মুখের ভেতর ঘা, খেতেই পারে না যে!

মিতু অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। ক’দিন আগেও হোটেলের এই পরোটা সবজি মজা করে খেত মেয়েটা। কিন্তু এই কেমোথেরাপি শুরু হবার পর মেয়েটা কিছুই খেতে পারে না। মুখেও ঘা হয়ে যায় প্রায়ই। কত শখ করে হাসান ওর নাম রেখেছিল প্রজাপতি, আজ সেই সুন্দর মেয়েটার চেহারার দিকে তাকানোই যায় না। চুলগুলো পড়ে যাচ্ছে, মুখে রাজ্যের ক্লান্তি, কেমন বিষাদ একটা চাউনি।

মিতু আর জোর করে না। প্রজাপতিকে পানি খাইয়ে এবার ও নাস্তা করে নেয়। তারপর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘আমি তাহলে একটু বাসায় যাই। অনেক কাপড় জমেছে, ধুতে হবে। আর দুপুরে এখানকার খাবারটাই কষ্ট করে খেয়ে নিস। রাতে আমি তোর প্রিয় কলিজা ভুনা নিয়ে আসব নে।’

প্রজাপতি এবার হাসে, আদুরে গলায় বলে, ‘আচ্ছা মা। আর শোন, আমার তুষিকে নিয়ে এসো। কতদিন ওকে দেখিনা।’

মিতু চোখ বড় করে তাকায়, তারপর বলে, ‘হাসপাতালে বিড়াল আনব? তুই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি? এরা বিড়াল দেখলেই অভিযোগ করবে। তোর তুষি ভালোই আছে। তোকে অবশ্য খুঁজে মাঝে মাঝে। সুযোগ পেলেই তোর বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাকে।’

প্রজাপতি হাসে, হ্যাঁ তুষিটা এমনই। একদিন স্কুল থেকে ফিরছিল, হঠাৎ দেখে ঝোপের ভেতর একটা বিড়ালছানা ‘মিউ’ ‘মিউ’ করে কাঁদছে। একেবারেই লেদা একটা বাচ্চা। প্রজাপতি সাথে সাথে এটাকে কোলে করে নিয়ে এসেছিল। মা তো একদমই বিড়াল দেখতে পারে না। পারলে তখনই ফেলে দেয়। কিন্তু প্রজাপতি যখন বলল, ‘মা, ছোট্ট বাবুকে কেউ ফেলে দেয়? ও তো মরে যাবে। একটু বড় হোক তখন ফেলে দেব।’

তা তুষি বেশ বড় হয়েছে গত একবছরে, কিন্তু আর ফেলা হয়নি। প্রজাপতির গা ঘেঁষে ঘেঁষে থাকে সবসময়।

মিতু একটা ব্যাগে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বের হয়। কি ভেবে একবার হাসপাতালের বিল সেকশনে যায়। প্রজাপতির কেবিন নাম্বারটা বলতেই ওরা একটা কাগজে হিসাবটা ওর হাতে ধরিয়ে দেয়। মিতু বিলের কাগজের নিচের দিকে তাকাতেই কপালে একটা ভাঁজ পড়ে, তেতাল্লিশ হাজার তিনশ চুয়ান্ন টাকা বাকি। হাসান তো এটা দিয়ে দেবার কথা ছিল। তাহলে কি ও টাকাটা এখনও জোগাড় করতে পারেনি?
চিন্তিত মুখে ভাবতে ভাবতে ও বাসার দিকে এগোয়।

২.
একাউন্স ম্যানেজার মাহাবুবুল হকের সামনে হাসান মাথা নিচু করে বসে আছে। স্যার কি যেন জরুরি একটা কাজ করছে। আজ সকালেই মিতু ফোন করেছিল, হাসপাতালে অনেকগুলো টাকা বাকি আছে। দু’ একদিনের মধ্যেই বিলটা দিতে হবে।

মাহবুবুল হক এবার মুখ তোলেন, গম্ভীরমুখে বলেন, ‘বলো, কী বলতে এসেছ?’

হাসান নরম গলায় বলে, ‘স্যার, আমার প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে এক লাখ টাকা ওঠাব। আপনি তো জানেন আমার মেয়েটা অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি।’

মাহাবুবুল হক মাথা নাড়েন, বলেন, ‘হুম, খুবই ডেলিকেট ইস্যু। আপনি একটা এপ্লিকেশন করেন। আপনি নিজেও তো একাউন্সেই কাজ করেন, জানেন তো, এই ব্যাপারগুলো ক’টা দিন সময় লাগে। আপাতত একটু চালিয়ে নিন।’

হাসান নিজের টেবিলে ফিরে এসেই দরখাস্তটা লেখে। টাকার প্রয়োজন কেন এই ঘরটা পূরণ করতে গিয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে। প্রজাপতির এমন অসুখ করল! আমার ছোট্ট মেয়েটা।

এই যখন ভাবছে ঠিক তখন জুনিয়র অফিসার আশরাফ এসে বলে, ‘হাসান ভাই, এত কি ভাবছেন? ম্যানেজার স্যার আপনাকে ব্যাংকে যেতে বলল, কিছু ক্যাশ টাকা জমা দিতে হবে। দেরি হয়ে গেল আজ।’

হাসান দরখাস্তটা উল্টিয়ে রাখে। তারপর বলে, ‘গাড়ি রেডি? কত টাকা?’

আশরাফ দশ আঙুল তুলে সংকেত দেয়, দশ লাখ টাকা। হাসান মাথা নাড়ে, তারপর ধীরেসুস্থে বের হয়। টাকা জমা দেবার দায়িত্বটা সবসময় ওর উপরই পড়ে।

হাসান টাকাগুলো নিয়ে গাড়িতে ওঠে। টাকার ব্যাগটা কোলের উপর রেখে শক্ত করে ধরে থাকে। এতে দশ লাখ টাকা আছে, অনেক টাকা। গাড়ি চলতে শুরু করতেই হাসানের ঝিমুনি আসে। ইদানীং রাতে ঘুম হয় না একদমই। ঝিমোতে ঝিমোতে ভাবে ডাক্তার ওকে বলেছে প্রজাপতির চিকিৎসায় প্রায় লাখ দশেক টাকা খরচ হয়ে যাবে। এমন কি আরও বেশিই হতে পারে। কিন্তু এত টাকা ও কোথায় পাবে? প্রভিডেন্ট ফান্ডে সব মিলিয়ে লাখ দেড়েক টাকা আছে। আর এমনি দু’একটা ডিপিএস ছিল তা থেকে খুব বেশি হলে লাখ খানেকের মতো পাওয়া যাবে। কিন্তু বাকি টাকা? এমন কিছু নেই যা বিক্রি করে টাকাটা যোগাড় করা যায়। কেমন একটা হাঁসফাঁস লাগে, ঝিমুনিটা চলে যায়। টাকার ব্যাগটার দিকে চোখ যেতেই হঠাৎ করেই মনে হয়, আচ্ছা, ও যদি টাকাটা নিয়ে পালিয়ে যায়? টাকাটা যদি কোথাও লুকিয়ে রাখে, তারপর মিতুকে বলে রাখবে। পুলিশ হয়তো ওকে ধরে ফেলবে, অনেক মারবে। তা মারুক, ও যদি কিছু না বলে তাহলে তো টাকার হদিস কেউ পাবে না। ভাবনাটা ভাবতেই হাসান একটা উত্তেজনা বোধ করে। ওর প্রজাপতি ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু প্রজাপতি যখন জানবে ওর বাবা চোর, তখন কি ওকে ঘৃণা করবে? সবাই যে আমার প্রজাপতিকে চোরের মেয়ে বলবে।

এমন যখন ভাবছে ঠিক তখন গাড়িটা ব্রেক করে, একটা ঝাঁকুনি লাগে গায়ে। হাসান গাড়ির গ্লাস দিয়ে দেখতে পায় ব্যাংকে চলে এসেছে ও। মাথাটা নাড়ে, কিসব আবোল তাবোল ভাবছিল এতক্ষণ। হাসান শক্ত হতে ব্যাগটা নিয়ে নামে, তারপর দৃঢ় পায়ে ব্যাংকের ভেতর ঢুকে যায়।

৩.
বিকেল বেলাটা অস্থির লাগে প্রজাপতির। হাসপাতালটা কেমন শুনশান হয়ে যায় এই সময়। বাসায় থাকলে এ সময়টা ও ঠিক ছাদে যেত, তুষিকে নিয়ে। বাড়িওয়ালা হাশেম চাচা খুব ভালো মানুষ। অন্য বাড়িওয়ালার মতো ছাদে তালা দিয়ে রাখে না। ওনাদের ছাদটা খুব সুন্দর। অরিন আপু যে কত রকমের গাছ লাগিয়েছে। প্রজাপতিকে খুব আদর করত। সারাক্ষণ পড়াশোনা করে বলে আপু ওকে ‘আঁতেল’ বলে খেপাত। আপু একটা অজানা ফুল দেখিয়ে বলত, ‘বল তো এটার নাম কি?’

প্রজাপতি সাথে সাথে ফুলটার ছবি তুলে গুগলে সার্চ করত। দেশি ফুলের কিছু সাইট আছে যেখানে সব ধরনের ফুলের নাম ধাম দেওয়া আছে। ও ঠিক খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলে। কথাটা মনে হতেই প্রজাপতির হঠাৎ করেই মনে হয় আচ্ছা ওর কী অসুখ হয়েছে সেটা বের করা যায় না?

ভাবনাটা ভাবতেই ও সন্তর্পণে একবার আশেপাশে দেখে নেয়। তারপর ওর বেডের পাশে রাখা ‘প্যাশেন্ট ফাইল’টা নিয়ে দ্রুত লেখাগুলো দেখতে থাকে। নানান ধরনের ওষুধের নাম লেখা। প্রজাপতি এবার একটা একটা করে নাম সার্চ দেয়। একটা ওষুধ, সেটার নাম লিখে সার্চ দিতেই দেখে এটা বমির ওষুধ। আরেকটা ওষুধের নাম লিখতেই দেখে এটা ‘কেমোথেরাপি’র ওষুধ। শব্দটা নতুন, এর আগে ও শোনেনি। প্রজাপতি এবার কেমোথেরাপি শব্দটা গুগলে লিখতেই প্রথমে যে লাইনটা আসে তা দেখে ও থমকে যায়, ‘Chemotherapy is a type of cancer treatment..’.

নিশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসে প্রজাপতির। এবার যেন ও সব বুঝতে পারে কেন মা বই হাতে দেখলেই বিরক্ত হতেন। বাবা কেন ওর স্কুলের টেস্ট পরীক্ষার ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতেন। ও তো মরেই যাবে, তাই বুঝি ওর স্কুলের বই পড়ার কোনো গুরুত্ব নেই! এজন্যই বুঝি মা চুপিচুপি কাঁদে, বাবা কেমন যেন হয়ে গেছে, সেই প্রাণখোলা হাসিটা আর হাসে না।

প্রজাপতি কেবিন থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। মা এখনও আসেনি। চারদিকে দিনের আলো নিভে গিয়ে আঁধার নামছে। সেইসাথে প্রজাপতির মনের ডানাতেও আজ সত্যিকারের আঁধার নামতে থাকে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here