প্রজাপতির_ডানায়_আঁধার_নামে (পর্ব ৫ শেষ)

0
740

#প্রজাপতির_ডানায়_আঁধার_নামে (পর্ব ৫ শেষ)

১.
‘আজ বিকেলে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। হেডস্যার দুই প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে বাসায় হাজির, সাথে তৃণি, তুতুল, অর্শা সহ ক্লাশের দশ বারোজন। মা তো অবাক। স্যার নিজ হাতে আমাকে আজ মিষ্টি খাইয়ে দিয়ে হাতে রেজাল্ট কার্ড দিতেই সবাই হাততালি দিয়ে ওঠল। স্যার খুশি খুশি গলায় মায়ের দিকে তাকিয়ে যখন বলল, ‘প্রজাপতি এ প্লাস পেয়েছে’, মায়ের চোখেমুখে তখন একটা দারুণ সুখের ছোঁয়া দেখেছি। অনেকদিন পর দুশ্চিন্তার একটা কালো মেঘ যেন এক মুহুর্তে কেটে গিয়েছিল। স্যার মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক দোয়া করে গেলেন, বন্ধুরাও সবাই আজ ওকে জড়িয়ে ধরে ভরসা দিয়ে গেল। রাতে বাবা এসে তো পারলে ওকে মাথায় নিয়ে নেচে বেড়ায়। বাবাটা এমন, পড়াশোনায় যখনই একটু ভালো করত বাবা খুব খুশি হতো। আজকেও তাই হয়েছে। বাবাকে এসএসসির ফরম ফিল আপের কথা বলতেই বাবা আবার সেই আগেরমতো আমতাআমতা করল। আমি জানি আমার আবার হাসপাতালে যেতে হবে কিছুদিন পরেই। সেদিন আসার সময় আমিরুননেসা দাদু ওকে আদর করে বুঝিয়ে বলেছিল ও ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু ইদানিং রাতের বেলা বাবা মায়ের কথাগুলো কানে আসে। ডাক্তার নাকি বলেছে অনেক টাকা লাগবে। মা সেদিন সব গহনাগুলো যে বিক্রি করে ফেলেছে সেটা ও দু’দিন আগেই জেনেছে। বাবা সান্ত্বনা দিয়ে বলছিল আবার গড়িয়ে দেবে। আমার জন্য মাকে শখের গহনাগুলো বিক্রি করে দিতে হলো! কেন এমন হয়! স্কুলের সবাই ভালো আছে, একমাত্র আমিই ভালো নেই। আমার জন্যই বাবা মায়ের এত কষ্ট, এত দুশ্চিন্তা। যদি পারতাম সব কষ্টগুলো হাওয়াই মিঠাইয়ে পালটে দিতে..’

এ পর্যন্ত লিখে প্রজাপতি থামে, ক্লান্ত লাগছে। রাত হয়ে গেছে। মা এখনই আসবে ঘুমোতে, লিখতে দেখলে ঠিক বকা দেবে। প্রজাপতি ডায়েরিটা পাশে রেখে চোখটা বন্ধ করে।

মিতু মনোযোগ দিয়ে একটা খাতায় হিসেব লিখছিল। এখন পর্যন্ত চার লাখ উনষাট হাজার টাকা যোগাড় হয়েছে। হাসানকে বলতেই ও ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘আমি আরও এক লাখ টাকা ধার করতে পারব। কিন্তু এরপরেও যে অনেক টাকা বাকি রয়ে যাবে। মিতু, কি হবে আমার প্রজাপতির?’

মিতু লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘হাসান, আমি পরিচিত প্রতিটা মানুষের কাছে হাত পাতব। ফেসবুকে হেল্প পোস্ট দেব আজই। তোমার ব্যাংক একাউন্ট নাম্বারটা দাও। আর আমার মোবাইলের বিকাশ নাম্বারটা দিয়ে দেব। ওর স্কুলের স্যারদের দিয়ে পোস্টটা শেয়ার করতে বলব।’

হাসান অনেক মায়া নিয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে। মিতুকে বলতে যেয়েও থেমে যায়, এ ধরনের হেল্প পোস্ট প্রতিদিনই ফেসবুকে দেখা যায়। তাতে যে খুব একটা টাকা আসে তা না। হাসান নিজেও এমন অনেক পোস্ট এতদিন দেখে এসেছে, ওর ঠিক মনে পড়ে না ও অচেনা কাউকে বিকাশ করেছে। পরিচিত মানুষ হয়তো এক দু’ হাজার টাকা বিকাশ করবে। তাতে করে চিকিৎসার জন্য বাকি অনেকগুলো টাকা কিছুতেই যোগাড় হবে না।

মিতু সেদিন রাতেই হেল্প পোস্টটা দেয়। হাসান ওকে নিরুৎসাহিত করে না, বরং সাহায্য করে।

সেদিনের পর থেকে মিতু সারাদিন মোবাইল নিয়ে বসে থাকে। একটা মেসেজ আসা মাত্রই আগ্রহ সহকারে খুলে দেখে। কিন্তু বেশিরভাগই বিভিন্ন কোম্পানির বিপণন মেসেজ। প্রথম বিকাশের টাকা যেদিন আসে সেদিন মিতুর কী আনন্দ! হাসান নিজে সেদিন স্কুলে যেয়ে হেডস্যারকে পোস্টটা শেয়ার করতে বলতেই স্যার আগ্রহের সাথেই করেন। এতে কাজ হয়। প্রথম কয়েকটা দিন বেশ ভালো পরিমাণেই টাকা জমা হয়।

মাস শেষে মিতু হিসেব করে দেখে প্রায় দু’লাখ টাকার মতো জমা হয়েছে। ওর সেই বান্ধবী রিনাও হাজার বিশেক টাকা দিয়েছে। হাসান আরও দেড় লাখ টাকা যোগাড় করেছে। তাতে সব মিলিয়ে আট লাখ টাকা হয়ে গেছে।

সেদিন হাসান বাসায় ফিরতেই মিতু আগ্রহের সাথে বলে, ‘হাসান, বেশিরভাগ টাকাটা তো যোগাড় হয়েই গেছে। বাকিটাও হয়ে যাবে। তুমি ডাক্তার তৌফিকের সাথে কথা বলো, আমি আর দেরি করতে চাই না। প্রজাপতির শরীরটা আবার খারাপ হতে শুরু করেছে।’

হাসান মাথা নাড়ে, যদিও বাকি টাকাটা ঠিক কি করে যোগাড় হবে ও বুঝতে পারে না। সাহায্য করার মতো যারা ছিল তারা ইতিমধ্যেই সবাই টাকা দিয়েছে। এদিকে আগের অনেক ঋণ রয়ে গেছে, সেগুলোও যে শোধ করতে হবে।

২.
আজ বহুদিন পর শরীরটা একটু ভালো লাগছে আমিরুননেসার। কেমোথেরাপিগুলো এই বয়সে নিতে ভীষণ কষ্ট হয়। মাঝে তো একটা সপ্তাহ আইসিইউতে কাটাতে হলো। এখন শরীরটা অনেকটাই ভালো। বহুদিন পর মোবাইলটা হাতে নেন, ফেসবুকটা খুলতে যেতেই প্রজাপতি মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটা ওর ফেসবুকের পাসওয়ার্ড ঠিক করে দিয়েছিল।

আমিরুননেসা চশমাটা পরে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ করেই প্রজাপতির প্রোফাইলের একটা পোস্ট চোখে পড়ে। একটা হেল্প পোস্ট, ওর মা মিতু শেয়ার করেছে। আমিরুননেসা চোখ কুঁচকে পোস্টটা পড়ে। আহারে, মেয়েটার চিকিৎসা থেমে আছে টাকার জন্য। মনটা খারাপ হয়ে যায়, এই অসুখে এত এত টাকা লাগে সেটা উনি ছাড়া আর কে এত ভালো বোঝে। ভাগ্যিস নিজে সারাজীবন একটা ভালো চাকরি করতেন। পেনশনের টাকাগুলো এখন অনেক কাজে লাগছে। যদিও ছেলেরা মোটামুটি সামর্থ্যবান, কিন্তু ওরা মায়ের টাকাতেই ভরসা রেখেছে। আমিরুননেসাও এটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি।

আমিরুননেসা মন খারাপ নিয়ে এবার ফেসবুকের অন্য খবরগুলো পড়তে থাকেন। মানুষের জীবন কত রঙিন, তাই দেখতে থাকেন। মনের ভেতর একটা ছোট্ট অস্বস্তি বার বার খোঁচা দিচ্ছে। প্রজাপতি মেয়েটার জন্য কিছু টাকা পাঠানো দরকার। মেয়েটার মায়ের হাতেই দেওয়া যায়। উম, চেকবইটা এখানেই আছে। সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলেন, বিশ হাজার টাকার একটা চেক লিখে মিতুকে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে মিতুর অবাক গলা পাওয়া যায়। প্রজাপতির সাথেও কথা হয়, ও পরীক্ষার রেজাল্ট বলে, আমিরুননেসা খুব খুশি হন। মিতু কথা দেয় ও কাল আসবে চেকটা নিতে।

ফোনটা রেখে আমিরুননেসার মনটা ভালো হয়ে যায়। মিতু মেয়েটা খুব খুশি হয়েছে। বিশ হাজার টাকাটাও যে ওদের জন্য যে অনেক। একটা পরিতৃপ্তি ফুটে ওঠে চোখেমুখে।

সেদিন রাতে ঘুমোতে যাবার আগে আমিরুননেসার হঠাৎ একটা কথা মনে হয়। সেদিন প্রজাপতিকে ও বলেছিল মানুষের জীবনের যোগফল ‘শুন্য’। কিন্তু মেয়েটা কী সুন্দর করে বলল, ও বড় হয়ে এমন কিছু করতে চায় যেটা যুগ যুগ ধরে মানুষের উপকারে আসবে। তাতে জীবনের যোগফল ‘শুন্য’ হবে না। কথাটা মনে হতেই আমিরুননেসা একটা অস্থিরতা অনুভব করেন। নিজের পুরো জীবনটা হাতড়ে হাতড়ে খুঁজেও এমন একটা কিছু খুঁজে পান না যাতে মানুষের নিঃস্বার্থ উপকার হয়েছে। হ্যাঁ, টুকটাক সাহায্য করেছেন কিন্তু মনে রাখার মতো এই জীবনে কিছুই করা হয়নি। হঠাৎ করেই নিজের জীবনের যোগফলটা শুন্য মনে হয় আমিরুননেসার।

পরদিন সকালে মিতু যখন আসে আমিরুননেসা তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবটা শোনেন। আর কত টাকা যোগাড় বাকি সেটাও ভালো করে শুনে নেন। তারপর ওকে বসতে বলে চেকবইটা বের করেন। কাল রাতের লেখা চেকটা ছিড়ে ফেলেন। তারপর চশমাটা পরে গোটা গোটা অক্ষরে নতুন করে চেকটা লিখে সই করে মিতুর হাতে দেন।

মিতু কৃতজ্ঞতায় মাথাটা নিচু হয়ে যায়। চেকটা হাতে নিয়ে আড়চোখে একবার তাকায়, থমকে যায়। তারপর ভ্রু কুঁচকে আবার চেকে লেখা টাকার অংকটার দিকে তাকাতেই চোখে একটা অবিশ্বাস দেখা যায়। নিশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসে, তোতলানো গলায় বলে, ‘আন্টি, আপনি মনে হয় ভুলে পাঁচ লাখ টাকা লিখেছেন।’

আমিরুননেসার মুখে মিটিমিটি হাসি, চোখে একটা দ্যুতি খেলা করছে। মিতুর মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘আমার জীবনের বেঁচে থাকার কোনো মানে ছিল না, প্রজাপতি সেদিন আমাকে বেঁচে থাকার মানে শিখিয়ে গিয়েছিল। ওর স্বপ্ন পূরণ হোক, ও সফল হলেই আমিও ওর সফলতায় বেঁচে থাকব।’

মিতুর হঠাৎ করেই একটা কথা মনে হয়, মানুষের মাঝেই যে সৃষ্টিকর্তা লুকিয়ে থাকেন সেটা বুঝি আজ সত্যিই অনুধাবন করতে পারল ও। সামনে বসা এই মানুষটা যে এমন করে ওর পাহাড়সম বিপদটা সমাধান করে দেবেন তা এক মুহুর্ত আগেও ও বোঝেনি। মিতু আর পারে না, আমিরুননেসাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। আমিরুননেসা পরম মমতায় মিতুর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

৩.
আজ প্রজাপতিকে স্টেম সেল দেবে, বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনের মূল কাজটা এটাই। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রস্তুতি চলেছে। হাই ডোজে কেমোথেরাপি চলেছে এতদিন। ক্যানসার সেলগুলো সব মেরে ফেলা হয়েছে। এখন স্টেম সেল দেওয়া হবে, সেখান থেকে সুস্থ রক্তকণিকা তৈরি হবে, প্রজাপতি ভালো হয়ে যাবে, রঙহীন ডানা রঙিন হয়ে উঠবে। মিতু আজ ভোর থেকেই জায়নামাজে বসে আছে। বুকের ভেতর একটা অজানা ভয় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। হাসান প্রজাপতির হাতটা ধরেই বসে আছে। মেয়েটা আজ কেমন চুপচাপ হয়ে আছে। ভালো লাগছে না কিছুই। কেমন একটা দমবন্ধ করা মুহুর্ত।

ডাক্তাররা বুকের কাছে একটা ছোট্ট কী যেন লাগিয়েছেন। এখান দিয়েই নাকি স্টেম সেল দেওয়া হবে। একটু পরেই ডাক্তার তৌফিক রুমে আসেন। হাসান আর মিতুর দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারেন ওদের মনে কি ঝড় বইছে। মনের এই ঝড়টুকু কমাতেই ওদের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলেন, ‘প্রজাপতি, দারুণ সাহসী একটা মেয়ে। ওর মনোবলের জন্য যুদ্ধটা সহজ হয়েছে। আজকের পর থেকে ও শুধু ভালো হতে থাকবে। কী মা, তুমি রেডি তো?’

প্রজাপতির মুখটা আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেকটা উজ্জ্বল, আত্মবিশ্বাসী। বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অভয়ের হাসি দেয়, তারপর আবদারের গলায় বলে, ‘আমি আমিরুননেসা দাদুর সাথে একটু কথা বলতে চাই।’

ডাক্তার তৌফিক সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন।

কিছুক্ষণ পর একটা হুইল চেয়ারে করে আমিরুননেসা আসেন। এসেই প্রজাপতিকে জড়িয়ে ধরেন, তারপর ফিসফিস করে বলেন, ‘তুই কিন্তু তোর কথা রাখবি। মনে আছে সেদিন আমায় কী বলেছিলি? একদিন এই পচা অসুখটার একটা ভালো ওষুধ আবিষ্কার করবি। তোর এই কাঠখোট্টা দাদুকে ভালো করে দিবি। পারবি না?’

হাসান, মিতু এমন কি ডাক্তার তৌফিকও চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না।

প্রজাপতি চুপ করে দাদুর বুকে মুখ রেখে বসে থাকে, একটা মায়ার ঘ্রাণ পায়। দাদুর হাতটা শক্ত করে ধরে বলে, ‘দাদু, আমি পারব।’

এরপর প্রজাপতিকে যখন BMT ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয় মিতু শেষ পর্যন্ত ওর হাতটা ধরে রাখে। শেষ মুহুর্তে হাতটা ছেড়েই দিতে হয়। হাসান শক্ত করে মিতুকে ধরে রাখে, ধীরে ধীরে BMT ইউনিটের দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। বদ্ধ দরজার এ পাশে দু’জন মানুষ জড়াজড়ি করে বিধাতার কাছে তাদের জীবনের বিনিময়েও প্রজাপতির সুস্থতার জন্য দোয়া করতে থাকে।

৩.
ত্রিশ বছর পর।

আজ বাংলাদেশের প্রতিটি টিভি চ্যানেলে একটা ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে, যে যেখানে আছে সবাই তন্ময় হয়ে খবরটা দেখছে। এ বছর চিকিৎসা শাস্ত্রে কেমব্রিজ স্টেম সেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর দু’জন রিসার্চ ফেলো নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাদের একজন ইউকে এর ড. জর্জ ভিলাসিও, আরেকজন বাংলাদেশের ড. শায়লা শবনম। এই দু’জন লিউকেমিয়া চিকিৎসায় এক নতুন কার্যকরী চিকিৎসা আবিস্কার করেছেন। যেখানে প্রচলিত চিকিৎসার যে অসহনীয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো আছে সেগুলো একেবারেই কমে আসবে। একদম ‘টার্গেট অরিয়েন্টেড’ ভাবে ক্যান্সার সেলগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। এর পাশাপাশি রোগীর শরীরের একধরনের T cell দেওয়া হবে যেটা নিজেই খুঁজে খুঁজে এই ক্যান্সার সেলগুলো মেরে ফেলতে পারবে। এতে করে এই চিকিৎসায় সফলতার হার শতভাগের কাছাকাছি হবে, সেইসাথে চিকিৎসা ব্যয়ও কম হবে।

একজন প্রতিবেদক গলা কাঁপিয়ে সেই মহিয়সী বাঙালি নারীর গল্পই বলছিলেন, ‘চিকিৎসা শাস্ত্রে বাংলাদেশ থেকে কেউ কখনও এই পুরস্কার পায়নি। আজ দেশের জন্য এই অভুতপূর্ব সম্মান বয়ে নিয়ে আসলেন ড. শায়লা শবনম যার ডাকনাম প্রজাপতি। স্কুল জীবনেই ওনার লিউকেমিয়া হয়েছিল। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের ভেতর চিকিৎসা চালাতে গিয়ে হিমসিম খেয়েছেন বাবা মা। সেদিন থেকেই ড. শায়লা শবনম প্রতীজ্ঞা করেন একদিন এই অসুখের একটা কার্যকরী চিকিৎসা খুঁজে বের করবেন। তার এই অদম্য ইচ্ছের কাছে ক্যান্সার হার মেনেছিল। দেশের পড়াশোনা শেষ করে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যান। সেখানেই পিএইচডি করে স্টেম সেল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে যোগ দেন। শৈশবের সেই প্রতীজ্ঞা উনি রেখেছেন। আমাদের ইউকে প্রতিনিধির সাথে আলাপকালে ড. শায়লা বলেন, আমিরুননেসা নামে আরেকজন ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের কাছে উনি প্রতীজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন, এই অসুখটা নিয়ে। যিনি তার চিকিৎসার সিংহভাগ ব্যয়ভার বহন করেন। আলাপকালে ড. শায়লা বলেন, নোবেল পুরস্কারের পুরো টাকাটা দিয়ে দেশে একটা আধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তুলবেন যেখানে চিকিৎসাটা যেন সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের মাঝেই থাকে।’

কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির পাশেই ছোট্ট একটা এপার্টমেন্টের লিভিং এ বসে প্রজাপতি এক হাতে মাকে আরেক হাতে মেয়ে তুতুলকে জড়িয়ে ধরে খবরটা দেখছিল। আসিফ ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে প্রজাপতির কাঁধ ধরে দাঁড়িয়েছিল। মিতুর চোখে জল, ভেজা গলায় বলেন, ‘তোর বাবা আজ বেঁচে থাকলে কী খুশিই না হতো! আর একটা বছর বেঁচে থাকত!’

শেষ কথাটায় একটা হাহাকার ফুটে ওঠে গলায়। প্রজাপতি মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, চোখটা ঝাপসা হয়ে ওঠে। সেই কঠিন দুঃসহ দিনগুলোতে বাবার মুখটা কেমন হয়ে থাকত। ও যখন ভালো হয়ে গেল, তারপর পরীক্ষাগুলোতে ভালো করতে থাকল, তখন বাবার সে কী আনন্দ! ও যখন পিএইচডি শেষ করে সেদিন বাবা বাচ্চাদের মতো খুশি হয়েছিল। জীবনের শেষ সময়টা বাবা ওর কাছেই ছিল। তার প্রিয় প্রজাপতির কোলে মাথা রেখেই চিরনিদ্রায় গিয়েছেন।
প্রজাপতি ভেজা গলায় বলে, ‘মা, মনে আছে যে তুমি প্রায়ই বলতে আমাকে তুমি কখনও হারিয়ে যেতে দেবে না? তুমি আর বাবা মিলে কী যুদ্ধটাই না করেছ! তোমার বিয়ের সব গহনাগুলো বিক্রি করে দিলে। মাগো, তোমার প্রজাপতি হারিয়ে যায়নি।’

মিতু শীর্ণ হাতদুটো দিয়ে সেই ছোটবেলার মতো মেয়েকে বুকে টেনে নেন।

পাশ থেকে তুতুল বলে ওঠে, ‘মাম্মি, তুমি কাঁদছ কেন?’

প্রজাপতি তুতুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে, মেয়েটা এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। না, ওর মেয়েটা অসুস্থ হয়নি ওর মতো, ভালো আছে। কিন্তু প্রতিটা দিন একটা শংকায় কাটত, মেয়েটার একটু অসুখ করলেই হাসপাতালে ছুটে যেতেন। ব্লাড রিপোর্টগুলো ঠিকঠাক আসলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতেন। ভয় যে পিছু ছাড়ে না।

প্রজাপতি চোখটা মুছে বলে, ‘মা, আমিরুননেসা দাদু বেঁচে থাকলে কী খুশিটাই না হতেন। আমি ভালো হবার এক বছরের মাথায় উনি চলে গেলেন। মারা যাবার ক’দিন আগে দেখা করতে চেয়েছিলেন। আমাকে সেদিনও হাত ধরে বলেছিলেন, তুই কিন্তু তোর প্রতীজ্ঞা রাখবি। আমি কথা দিতেই কী একটা পরিতৃপ্তি ফুটে ওঠেছিল ওনার মুখে! বলেছিলেন, আমার জীবনের যোগফলও শুন্য রইল না।’

মিতু হাত বুলিয়ে দেয় ওর মাথায়।

প্রজাপতি এবার পেছন ঘুরে আসিফকে বলে, ‘তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন, আমাদের সাথে বসো। তোমার সাপোর্ট না পেলে আমি আজ এখানে আসতেই পারতাম না। কেমব্রিজে এসে যখন কাউকেই চিনতাম না তখন তুমিই তো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে। সেই হাতটা দিয়ে এখনও আমায় ধরে রেখেছ। আমার এই যুদ্ধে তোমার অবদানও অনেক।’

আসিফ এবার মৃদু বকুনি দিয়ে বলে, ‘এবার তুমি একটু খেয়ে বিশ্রাম নাও, আজ অনেক ধকল গেছে।’

সেদিন রাতে প্রজাপতি ঘুমাতে যাবার আগে পরম মমতায় ওর সেই প্রিয় কালো চামড়ার বাঁধানো ডায়েরিটা বের করে, যেটা বাবা ওকে দিয়েছিল। শেষের দিকে কিছু পৃষ্ঠা এখনও বাকি।

প্রজাপতি লিখতে বসে, ‘প্রিয় বাবা, তোমার প্রজাপতির ডানার আঁধার কেটে আজ লক্ষ কোটি আলোকরশ্মিতে আলোকিত। তোমার প্রজাপতির জন্য পুরো বাংলাদেশ আজ আলোকিত। বাবা গো, আমার সোনা বাবা, তোমাকে যে অনেক ভালোবাসি। তোমার এই ছোট্ট প্রজাপতি যে আজ তোমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। মা, তোমার নতুন করে কিনে দেওয়া চুড়িটাই পরে থাকে। আমি কতবার নতুন কিনে নিয়ে আসলাম, কিন্তু দু’দিন পরেই আবার তোমার চুড়িটাই পরে। বাবা, আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটাই তুমি?

আর আমিরুন দাদু, তুমি এবার খুশি তো? আমি কিন্তু তোমার কথা রেখেছি, তোমার আর আমার জীবনের যোগফল শূন্য হতে দেইনি। ভালো থেকো প্রিয় দাদু।’

এ পর্যন্ত লিখে প্রজাপতি ডায়েরি বন্ধ করে। বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই উজ্জ্বল নক্ষত্রটা দেখতে পায়, প্রজাপতির মুখটা একটা অপার্থিব সুখের আলোয় ভরে ওঠে।

(সমাপ্ত)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here