প্রজাপতি মন,পর্ব:০১

0
2314

#প্রজাপতি মন,পর্ব:০১
#আরশিয়া জান্নাত

২০০৮ সাল,
স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগ রেখে ফ্রিজ থেকে পানি বের করে গ্লাসে ঢালতে ঢালতে আনহা বললো, হাসিব টা দিনদিন বদের হাড্ডি হচ্ছে। নতুন কয়টা ছেলে ভর্তি হইছে ওদের সাথে মিশে মিশে ব্যবহারই বদলে গেছে। কিছু বললে বলে, তুই বাচ্চামেয়ে বাচ্চাই থাক। আমিতো আর মেয়ে না। আমাদের ছেলেদের অনেককিছু জানতে হয় বুঝছোস। এটা কোনো কথা বল আপু?

নিশিথা কম্পিউটারে টাইপ করতে করতে বললো, এই বয়সটাই এমন বুঝছোস। ছেলেমেয়েদের নতুন পাখা গজায়। চোখে রঙিন চশমা।

আনহা, তাই বলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের এমন বখে যাওয়া আমি চুপচাপ দেখবো? জানিস সেদিন দেখি গলির চিপায় আগুন লাগলে যেমন ধোঁয়া হয় তেমন ধোঁয়া করে সিগারেট টানতেছে। শুধু তাই না আঙ্কেলের থেকে প্রাইভেটের নাম করে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে নোকিয়া ৪২ বাটনের ফোন কিনছে! গোল হয়ে বসে কিসব দেখে আর হাসে। আবার জেবিনকে নাকি লাভ লেটারো দিছে!

নিশিথা এবার নড়েচড়ে বসলো। খানিকটা চিন্তার রেখা ফুটিয়ে বললো, হাসিব খুব মেধাবী ছেলে। আর বেশি ভালো বুঝলি। আর অতিরিক্ত ভালো ছেলেদের একটা দোষ হলো এরা খুব সহজেই অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এদের ম্যানুপ্লেট করা একদম ইজি! ছেলেদের গ্রুপে একটা অদ্ভুত সাইকোলজি আছে। আমরা যেটাকে খারাপ বলি ওরা ঐটা করাকে প্যাশন ভাবে। ধর স্মোকিং এর বিষয়টা। যদি পাঁচটা ছেলের গ্রুপে একজন নোন স্মোকার হয়, বাকি চারজন ওরে এমনভাবে টিজ করে লাইক ও ছেলেই না। আমার অনেক ফ্রেন্ড আছে যারা এই ছেলেভাব দেখানোর জন্য সিগারেট টানে! তাছাড়া বয়সের চেয়ে বেশি পাকনা ছেলেগুলো এদের লিডার হয়। নিজের মতো বাকিগুলোরেও পাকনা বানায়। তোর ফ্রেন্ড হাসিব সেই চক্করেই পড়েছে।

“এখন উপায়?”

“উপায় আর কি। এই আগুনে পুড়ে যেইটুকু পারে টিকবে নাহয় হারিয়ে যাবে! This world doesn’t keep loser.”

“আপু এভাবে বলিস না। তুই কিছু একটা উপায় বের কর না। যাতে ঐ ছেলেদের সাথে মেশা বন্ধ করে দেয়। আগের মতো নামায পড়ে ভদ্র ছেলে হয়ে যাক।”

নিশিথার ফোনে তখন রিং বেজে উঠলো। ঠোঁটে মুচকি হাসি টেনে গলার টোন বদলে কথা বলতে লাগলো একজনের সাথে। আনহা জানে এখন আর দুই ঘন্টার আগে বোনকে পাওয়া যাবেনা। তাই ড্রেস পাল্টে মায়ের রুমে চলে গেল।

নিশিথা আর আনহা দুই বছরের পিঠোপিঠি দুইবোন। আনহা যতোটা সহজসরল নিশিথা ঠিক ততোটাই জটিল। নিশিথার অনেকগুলো সিমের মতো তার গলার টোনও অনেক রকম। সে একেক সিম থেকে একেক ছেলের সাথে কথা বলে। যখন যার সাথে কথা বলার ইচ্ছে হয় সে সেই সিম ওপেন করে। এই ঘটনা এই পৃথিবীর আর কেউ জানেনা আনহা ছাড়া। বোনের এমন বিভিন্ন গলার স্বর আনহাকে অবাক করে দেয়। সে বিস্মিত হয়ে দেখে একটা মানুষ কিভাবে এতো ছেলের সাথে কথা বলে, সে মনে রাখে কিভাবে কার সাথে কোন টোনে কথা বলতে হয়?!
সন্ধ্যার পরেই তাকে পড়াতে আসে কাইয়্যুম। সে নিশিথার ক্লাসমেট, টিউশনের দরকার ছিল বলে নিশিথার ছোটবোনকে পড়ানোর দায়িত্ব পেয়েছে।কাইয়্যুম নিশিথার জন্য পরাণ দেয় টাইপ পাগল। বিষয়টি নিশিথার চোখে না পড়লেও আনহার চোখ এড়ায় না। রোজ ক্লাস না করেও প্রতিটি ক্লাসের নোট নিশিথার বুকশেল্ফে পড়ে থাকে। কাইয়্যুম নিজের নোটের পাশাপাশি নিশিথার নোটও করে। শুধু নোট না যেকোনো কিছু সে দুইটা করে কালেক্ট করে। শুধুমাত্র তার জন্য ক্লাসের কেউ নিশিথাকে প্রপোজ করার দুঃসাহস দেখায় না। কাইয়্যুম একদম পারফেক্ট ছেলে বলা যায়। লম্বা চওড়া হিরোর মতো ছেলে তার উপর দারুণ মেধাবী। বদরাগী বলে পরিচিত হলেও নিশিথার সামনে সে ভেজাবিড়াল। আনহা মনে মনে হিসেব কষে কাইয়্যুম ভাইয়ের সম্পর্কে বাসার সবার যে সুধারণা আছে তাতে সে চাইলেই খুব সহজে আপুর বর হতে পারে। কিন্তু নিজের বোনের উড়ুক্কু মন নিয়েই তার যতো চিন্তা। কোথায় গিয়ে যে সে স্থির হবে সে জানেনা। আনহা দশম শ্রেণীর ছাত্রী হলেও বেশ ম্যাচিওর মেয়ে বলা চলে। তার বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে জমানো টাকার অভাব নেই। বাসায় টাকার সংকট পড়লে সবাই আগে তার কাছেই আসে। অবশ্য আনহার জমানো টাকার অর্ধেকটাই যায় নিশিথার হাতে। সে খুব ট্রেন্ডি আর খরুচে স্বভাবের মেয়ে। মার্কেটে যেই উড়না নতুন বের হবে সেই উড়নাই সে কালেক্ট করবে।
সে সেলাইয়ের কাজ শিখেছে বহু আগেই। নিজেই নিত্যনতুন ডিজাইনের জামা বানিয়ে সবাইকে তাক করে দেয়। এমনসব ডিজাইন আবিষ্কার করে যেটা দেখে শুরুতে সবাই হাসাহাসি করলেও পরে দলবেঁধে সবাই ঐ স্টাইলের জামা-ই বানায়। পাড়ায় সবাই তাকে ফ্যাশন ডিজাইনার বলে ডাকে। নিশিথা ভীষণ চটপটা মেয়ে। সাধারণত সংসারের বড় মেয়েরা এমন হয় না। ও যেমন চঞ্চল তেমনই গুণী। রূপচর্চা থেকে শুরু ঝকঝক করে পাতিল মাজা পর্যন্ত সব তার বা’হাতের খেল। তার তড়িৎগতির কাজের জন্য সবাই তাকে বেশ পছন্দ করে। আনহা ঠিক তার উল্টো। সে একটা প্লেট ধুতেও অনেক সময় নেয়। ধীরগতিতে যত্ন করে কাজ করে বলে তার নিকনেইম কচ্ছপ।
দুই বোন, ছোট ভাই আর বাবা-মা নিয়ে তাদের সুখী পরিবার। তাদের বাবা নাফিজ আহমেদ পুলিশের ক্যাশিয়ার পদে আছেন, আর মা আনিসা বেগম গৃহিণী।তাদের দুজনের অতি আদরের তিন ছেলেমেয়ে।
রাতে খাবার খাওয়ার পর বিছানা ঠিক করতে করতে
নিশিথা বললো, কাল বের হবি আমার সাথে? একটা পার্সেল এসেছে কুষ্টিয়া থেকে।

আনহা বই বন্ধ করে বোনের দিকে তাকিয়ে বললো, কুষ্টিয়ায় ও তোর আশিক আছে! তুই কি ঠিক করেছিস দেশের সবকয়টা জেলায় একটা করে আশিক বানাবি?

দেখ আনু আমি কাউকেই আশিক বানাই নাই। আমি জাস্ট গল্প করি তাদের সাথে। এখন কেউ যদি গিফট পাঠাতে চায় আমি না করবো কেন বল?

তুই আসলেই চিজ একটা! কেমনে পারিস এতোজনের সাথে কথা বলতে? তাও এতো আস্তে যে আমি পাশে থেকেও শুনিনা!

ফোনে কথা বলতে পারাটা আর্ট। তুই সেটা পারবিনা। তুই যে জোরে হ্যালো বলিস উত্তর পাড়ার হামিদা পর্যন্ত শুনতে পায়! আচ্ছা আনু একটা কথা বলতো হাসিব প্রেম করে?

করছিল একটার সাথে টিকে নাই।

তুই যে বললি কারে লাভলেটার দিছে ঐটা কে?

ওর কথা বলে লাভ আছে? আন্দাজি একজনকে দিছে।

ওহ! আচ্ছা তুই পড় আমি ঘুমাই।

তুই আজকে এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাবি?

হ্যাঁ। আজকে কারো সাথে কথা বলার মুড নাই। ঘুমাবো এখন।

বালিশে মাথা রাখতেই ঘুমের অতলে হারিয়ে গেল নিশিথা। আনহা এগারোটা পর্যন্ত পড়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লো। মাথায় চলতে থাকলো সারাদিনে ঘটা ঘটনা।


দোস্ত আমার ভাগ্য খুইল্লা গেছে। জেবিন আমার প্রপোজাল একসেপ্ট করছে। দেখ কি সুন্দর পারফিউমের ঘ্রাণ চিঠিতে!

বলেই হাসিব চিঠিটা নাকের সামনে ধরে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলো। আনহা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, তোরে হঠাৎ জেবিনে পছন্দ করলো ক্যামনে? ওর কি মাথা নষ্ট হইছে?

বলছিলাম না সবই তাহেরের ছোঁয়া। ওর সাথে মিশার পর আমার গেটাপটাই বদলে গেছে দেখস না? এজন্যই এখন যারেই বলমু সেই রাজী হইবো প্রেম করতে। ওয় ঠিকই বলে। মেয়েরা ভদ্রছেলেদের ভালোবাসেনা।

বলছে তোরে?!

তোর সামনে জ্বলন্ত উদাহরণ দাঁড়াই আছি তাও বিশ্বাস করোস না?

তুই থাক তোর বিশ্বাস লইয়া আমি যাই।

আরেহ আরেহ দাঁড়া। শোন আমরা পরশুদিন ঘুরতে যামু। তুইও যাবি প্লিজ। বুঝোস তো একা গেলে বাই চান্স যদি কেউ দেখে আমি শেষ।

তোরা যাবি তো যাস না আমারে লাগবো ক্যান? জেবিনের বান্ধবী নাই? ওরে বল কাউরে আনতে।

অন্য দশটা মাইয়া আনলেও লাভ নাই। প্যারা খামু ঠিকই। তুই গেলে আর প্যারা নাই। সবাইতো তোরে চিনেই। ইনফ্যাক্ট তুই বাদে গেলে কৈফিয়ত দিতে হইবো। তুই না আমার লক্ষী বান্ধবী রাজী হোস না প্লিজ!!

দেখি কাল জানামু।

দেখি না যাইতেই হইবো তোরে।

ঠেকা পড়ছে তো আমার?

এভাবে বলোস কেন। তুই তো আমার জানপাখি।

আবার শুরু করিস না ফুট এহান তে।

হাসিব হাসতে হাসতে চলে গেল। এদিকে আনহা টেনশনে পড়ে গেল ছেলেটা আবার কোন জালে ফাঁসে সাথে তারেও ফাঁসায়!

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here