#প্রজাপতি মন (পর্ব-১৩)
❣️আরশিয়া জান্নাত
ইমরান ঢাকা গেছে অনেকদিন হলো, এদিকে এতোদিন এখানে মন টিকলেও ইমরানের যাওয়ার পর থেকে কিছুই ভালো লাগেনা নিশিথার। সে সারাদিন কাজকর্ম শেষে বিকালে একটু ফুরসত পায়, তখন আবার নদী আর হুসেইন কে পড়াতে হয়। নিশিথার আজকাল এসব অসহনীয় লাগে। এরা যেন তাকে চব্বিশ ঘন্টা খাটিয়ে মারতেই এসব করছে এমনটাই মনে হয়। সে জানেনা এসব সত্যি নাকি তার নেগেটিভ মাইন্ডের ধারণা। ইমরান আগের মতো ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে কথা বলার সময় পায় না। বিয়ের আগে ঠিকই রাত জেগে কথা বলতো কিন্তু ঢাকা যাওয়ার পর টুকটাক খবর নিয়েই ঘুমিয়ে যায়। তার নাকি এতো ক্লান্তিতে জেগে থাকা অসম্ভব। নিশিথা এসব শুনে বিরক্ত হয়। তার রাত জাগার অভ্যাস আজ নতুন না বহুবছরের, ছয় মাস ট্রেনিং এ থাকাকালীন ও সে মাত্র চার ঘন্টা ঘুমাতো। অযথাই রাত জেগে থাকতো। নিশিথা বিয়ের পর কারো সঙ্গেই ফোনালাপ করেনি, অবশ্য করার প্রয়োজন বা সুযোগ মেলেনি। এখন যখন ইমরান নেই সে একটা সিম অন করে কল করলো একজনকে। বহুদিন পর নিশিথাকে পেয়ে অপরপাশের মানুষটাও গল্প জুড়ে দিলো চললো সারাটি রাত নানান আলাপন।
আনহার ইন্টার্নি চলছে, সে এখন দিনরাত এক করে খাটছে। নাইট শিফটে দু এক ঘন্টার ফুরসতে চেয়ারেই ঘুমায় কখনো বা দেয়ালে হেলান দিয়ে। এর মাঝে হাসিবের সাথে ওর বিশেষ দেখা সাক্ষাত হয়নি। যে কটা দিন হাসিবদের ওখানে ছিল টুকটাক যা কথা বলেছে এরপর একটা দিন ফোন করে খোঁজ নেয়নি আনহাও কল করেনি। তবে ও বাড়ি থেকে ঠিকই রোজ কল আসে, আনহাও তার শ্বশুরশাশুড়ির খোঁজ নেয় সুযোগ পেলেই দেখা করে আসে।
আনিসা মেয়ের এমন কঠোর পরিশ্রম দেখে নাফিজ সাহেবকে বলেন, কি দরকার ছিল মেয়েটাকে এতো খাটুনির কাজ করানোর? বিয়ে হয়েছে এখন লক্ষীমতোন সংসার করবে ছেলেমেয়ে হবে, তা না সে এখন ডাক্তারের পিছে দৌড়াচ্ছে সারাক্ষণ রুগিদের মাঝে থেকে থেকে নিজেও রুগি হচ্ছে!
নাফিজ সাহেব হেসে বলেন, আর তো ক’টা দিন মেয়ে যখন ডাক্তার হয়ে বের হবে তখন দেখো তুমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হবা। সংসার আমার মেয়ে ঠিকই মন দিয়ে করবে। দেখো না এমন ব্যস্ততায়ও শ্বশুরবাড়ির খোঁজখবর নিতে ভুলেনা মেয়ে আমার ব্যালেন্স করতে পটু! মাশাআল্লাহ।
ব্যালেন্স না ছাই! ঘরভর্তি কাজের লোক, মানুষ মাত্র ক’জন তাই তোমার মেয়ে পার করছে নিশির মতো একপাল লোকের ভীড়ে পড়লে বুঝতো, সেখানে কাজ করে দেওয়ার লোক নাই কিন্তু কাজের শেষ নাই। মেয়েটা সংসারে খেটেই মরছে,,,,
নাফিজ সাহেব স্ত্রীর দিকে চুপ করে তাকাতেই আনিসার হুঁশ এলো কাকে কি বলছেন! তিনি তড়িঘড়ি করে কথা পাল্টানো চেষ্টা করলে নাফিজ সাহেব তাকে থামিয়ে বললেন, তুমি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছ আনিসা? আমার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ওর সাথে গোপনে সম্পর্ক রাখছো? আমার বুকের ক্ষত এখনো শুকায়নি আর তুমি কি না!!
ওগো রাগ করোনা প্লিজ। আমি যে মা! আমার প্রথম সন্তান নিশি, ওর মুখেই আমি প্রথম মা ডাক শুনেছি। আমি কিভাবে ওকে উপেক্ষা করতাম? যখন শুনেছি ও ওখানে অনেক কষ্ট করছে, পাটায় পিষে মশলা বাটে, লাইনের গ্যাস নেই সিলিন্ডার গ্যাস সাশ্রয় করতে মাটির চুলায় রাঁধে। বিশ্বাস করো আমি মানতে পারিনা। আমার সোনা মেয়েটা নিজের কতো যত্ন করতো, সে এখন কালির পাতিল ধোঁয়, আগুনের তাপে পুড়ে,,,,, জানো ওদের ওখানে ভালোমন্দ বাজার পর্যন্ত হয় না!
এসব কথা আমি শুনে কি করবো? জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে পুড়বে না? সাফিনের সাথে বিয়ে হলে ওর এই দূর্দশা হতো না। যাক এসব বলে লাভ নেই তকদীর কেউ বদলাতে পারেনা। তবে শুনে রাখো আমি কখনোই ওকে ক্ষমা করবোনা। কথা বলছো বলো তবে আমার একটা পয়সাও যদি ওকে দাও কসম রইলো সেই হিসাব আমি আখিরাতে নিবো।
আনিসা আর ভয়ে বললেন না আজ সকালেই তিনি দশ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন,,,
????
হাসিব রোজ আনহার হসপিটালের সামনে ঘুরঘুর করলেও ভেতরে গিয়ে আনহাকে দেখার সাহস করেনা। আনহার প্রতি রাগটা বহু আগেই পড়ে গেছে যদিও তবু কিছু একটা তাঁকে আটকে রাখছে । তাছাড়া আনহাও তো কম না একটা দিন ভুলেও তাকে কল করেনি, বাসায় যায় অথচ ওকে খবর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনা। ও যে আনহাকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে থাকে এটা কি কখনো বুঝবে এই হৃদয়হীন ডাক্তারটা!
হাসিব ঠিক করেছে যতোদিন না আনহা নিজে ওকে নক করবে ও ছায়াও দেখাবেনা। হাসিবের যদি মরণরোগ হয়, আনহা ছাড়া কোনো ডাক্তার এখানে না থাকে তবুও সে আনহাকে দেখতে দিবেনা। এই নিষ্ঠুর মেয়েকে সে কঠিন শাস্তি দিবে।
বিয়ে কি সে একা করেছে? তার যেমন আনহার জন্য বুক ভেঙে আসে আনহার কি আসেনা? এই যে সে রাতে ঘুমাতে পারেনা, কোথাও আড্ডা দিয়ে শান্তি পায় না।পড়তে বসলেও বিরক্ত লাগে, বিজনেস ডিল হ্যান্ডেল করতে অসহ্য লাগে। এসব তো আনহার হচ্ছে না, সে দিব্যি পড়াশোনা করছে, টপ মার্কস পাচ্ছে। তার সামনে হাসিব তো কিছুই না। হাসিবের আজকাল মনে হয় আনহার হসপিটালে যতো ইয়াং পেশেন্ট আসবে সবাই বোধহয় আনহাকে দেখেই সুস্থ হয়ে যাবে। ওর টোল পড়া গালের মিষ্টি হাসিটা দিয়ে সে যখন প্রেসক্রিপশন লিখবে কত ছেলের হার্টবিট মিস হবে, এই চিন্তায় তার রাগ বেড়ে যায়। আনহা হাসলে ওর চোখ ও হাসে, ওর কাঁচা হলদে গায়ের রংটা দিন
দিন যেন আরো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। এলোমেলো চুলেও কাউকে এতো পরিপাটি লাগে? এই যে ঘুমের ঠিক নেই,খাওয়ার ঠিক নেই, চোখেমুখে রাজ্যের ক্লান্তি। অথচ তবুও ওকে কত্ত সুন্দর দেখায়। এটা কি
বিয়ের পানি পড়ার প্রভাব নাকি হাসিবের চোখেই এসব বিধছে কে জানে?
হাসিব টের পায় তীব্রভাবে টের পায় ওর মনে আনহার জায়গাটা কতোটা গভীর। আগেও এমন টের পেতো কিন্তু এখন সেই সীমা ছাড়িয়েছে। এই অনুভূতির দহনে তার ভেতরটা পুড়ে ছাড়খার হয়। চোখ জ্বালাপোড়া করে, মনে হয় এখুনি বুঝি সবাই দেখবে একখন্ড হাসিব কয়লা হয়ে পড়ে আছে। সে ঠিকই কাগজে লিখে যাবে আনহার দহনে ভষ্মীভূত হাসিব। হুহ!
“তোদের কাহিনী আমি বুঝি না বাপু! উনার বর রোজ নীচে ঘুরঘুর করে অথচ উপরে উঠে আসে না, আর ইনি একটু পরপর সিসি ক্যাম ফুটেজ দেখে যায় তাও নীচে গিয়ে দেখা করেনা। এটা কোন দেশী প্রেমের গল্প আমি বুঝিনা। এতোই যখন জ্বলে একবার গিয়ে কথা বলে আয় না?”
আমি কেন যাবো? সে এতোদূর আসতে পারে আর দু কদম ফেলে উপরে আসতে পারেনা? আর আমি যদি যাই তোর কি ধারণা ও আমার সঙ্গে কথা বলবে? একটা সপ্তাহ ছিলাম ওখানে একটা দিন ভালোমতো কথা বলেছে? আমি যে ওর ওয়াইফ আমার প্রতি ওর কি কোনো দায়িত্ব নেই? একটাদিন খবর নিয়েছে আমার?
আনহা তোর আর হাসিবের এই মান অভিমান কবে শেষ হবে বলতো? তোরা এখন যে সময়গুলো নষ্ট করছিস পরে খুব আফসোস করবি বলে দিচ্ছি। তোরা নিউলি ম্যারিড কাপল! কোথায় তারা ঘুরবে, একসঙ্গে কাপল ফটো তুলে আপলোড করবে, একসঙ্গে ডিনারে যাবে, গিফট আদানপ্রদান করবে তা না! এ ওকে ও একে দোষ দিতে দিতেই সাড়া!
তুই যা না! যা গিয়ে বল তাকে। আমাকেই কেন জ্ঞান দিচ্ছিস? তাকেও বল কিছু।
বলিনি ভাবছিস জিজ্ঞাসা কর এনিকে কতবার বলেছি। হাসিব ভাঙবে তবু মচকাবেনা ভেতরে ভেতরে দেখ গিয়ে সেও ভুগছে, ইগো বেশি যে সেজন্য আগ বাড়িয়ে আসেনা।
হিয়ার সাথে আমি একদম একমত। তুই বরং একবার নীচে যা। ভাব দেখাবি কাজে গেছিস। দেখ না সরাসরি দেখে কি করে?
গুড আইডিয়া! আনহা যা না একবার। এখন তো লেজার টাইম এই ই সুযোগ যা একবার চক্কর দিয়ে আয়। হাসিব তোকে দেখে কেমন রিয়েক্ট করে আমরাও দেখি।
আনহা মনে মনে বললো, দুই মাস তিন দিন ছয় ঘন্টা পাঁচ মিনিট ছাব্বিশ সেকেন্ড হয়ে গেছে হাসিব ওর দিকে তাকিয়ে কথা বলেনি। আর আজ একটু নীচে গেলেই বলবে? এতো সহজ ওর মুখ থেকে কথা বলানো? তবুও মন বলছে একবার গিয়ে দাড়িয়ে দেখ সশরীরে উপস্থিত হবার ম্যাজিকই আলাদা। কঠিন শত্রুতাও নষ্ট হয়ে যায় সরাসরি কথোপকথনে আর এ তো হাসিবই, তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
তাই আর আগপিছ না ভেবে আনহা পা বাড়ালো হাসিবের কাছে যেতে।
কিন্তু বিধাতার ইচ্ছেটা বোধহয় অন্যকিছু। আনহা নীচে নামতে নামতে হাসিব বাইক স্টার্ট করে চলে গেল।
হিয়া আর এনি বিরক্তিতে বলে উঠলো, ওহ শিট! এখনই শালার যাওয়ার ছিল!
চলবে,,,,