প্রজাপতি মন (পর্ব-11)

0
660

#প্রজাপতি মন (পর্ব-11)

♡আরশিয়া জান্নাত

আস্সালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?

ওয়ালাইকুমুস্সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি তুমি কেমন আছ?

আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।

বাসার সবাই ভালো তো? সেই যে গেলে আর একবারও এখানে এলেনা। কতবার বলেছি আপাকে তোমাকে যেন পাঠায়। আগে তো কতবার আসতে আর এখন ভুলেও আসোনা। তুমি কি কোনো কারণে আমাদের উপর রাগ বাবা?

না না আন্টি তেমন কিছু না।

যাও আনুর রুমে গিয়ে বসো। ও তো যে ধীরগতির মেয়ে। এখনো নিশ্চয়ই কাপড় গোছানো শেষ হয় নি। আমি তোমার জন্য নাস্তা পাঠাচ্ছি।যাও গিয়ে বসো।

হাসিব না চাইতেও বাধ্য হয়ে আনুর রুমের দিকে গেল। আনু তখন সবে শাড়ির আচল পিনড করে দাঁড়ালো। চোখে হালকা করে কাজল দিলো, ঠোঁটে মেরুন শেডের লিপস্টিক আর আইলাইনার লাগালো। চুল ছেড়ে রাখবে নাকি খোঁপা করবে তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে চিরুনি হাতে দাঁড়িয়ে ভাবছে, তখনই খেয়াল করলো হাসিব দরজায় হেলান দিয়ে ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে সে অনেকক্ষণ যাবত আনহার কান্ডকারখানা দেখছে!
হাসিব ভেতরে ঢুকে আনহার হাত থেকে চিরুনিটা নিয়ে এক পাশ থেকে একগাছি চুল নিয়ে হালকা পেঁচিয়ে পেছনে হেয়ার ক্লিপ দিয়ে বেঁধে অপরপাশে চুল খোলা রাখলো। তারপর নিজেই বললো, বাহ আমিতো ভালোই চুল বাঁধতে পারি!
আনহা লজ্জায় লাল হয়ে সরে গেল। হাসিব এই প্রথম তার এতো কাছে এসেছে, তাদের বন্ধুত্ব যতো ভালোই হোক না কেন তারা কখনোই সীমা অতিক্রম করেনি। সবসময়ই একটা দূরত্ব মেইনটেইন করেছে। তাই আজ যখন সে তার চুলে হাত রাখলো আনহার ভেতর অন্যরকম শিহরণ জাগে।
হাসিব চেয়ারে বসে টেবিলের জিনিসপত্র দেখতে লাগলো, সেখানে তাদের বিয়ের ছবিটা নতুন করে ডাবল ফ্রেমে এড হলেও পাশে ছিল ছোটবেলার ছবি। সেখানে আনহার পাশে হাসিব জিভ বের করে ভেংচি দিয়ে রয়েছে। এই ছবিটা হাসিবের কাছে জঘন্য মনে হলেও আনহার সবচেয়ে প্রিয় ছবি।

মায়ের বৌমার জিনিসপত্র গোছানো শেষ হয়েছে? আমি কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে পারবো না। মায়ের বৌমাকে তার কাছে পৌঁছে দিয়ে বেরোতে হবে। সে যেন কচ্ছপের মতো লেট না করে।

আনহা চটজলদি ব্যাগের চেইন বন্ধ করে বললো, আমি মোটেও কচ্ছপ নই। আম্মুই একটু আগে বলেছে। নাহয় রেডি হতে আমার দুই মিনিট ও লাগে না।

তা লাগবে কেন। দাদী আম্মার মতো কোনোরকম চুল আচড়েই যে মেয়ে বের হয়ে যায় তার লেট হবে কেন! ভাগ্য ভালো বলে আমার মতো স্টাইলিশ ছেলে তাকে বিয়ে করেছে নাহয়,,,,

আনহা রেগে বললো, নাহয় কি? আমি দেখতে কোনদিকে খারাপ যে কোনো ছেলে অপছন্দ করবে?

হাসিব তাকিয়ে দেখলো আনহা নামের অসম্ভব মিষ্টি মেয়েটাকে আজ মেরুন রঙের শাড়িতে কেমন বৌ বৌ লাগছে! হাসিবের খুব ইচ্ছে হলো আনহার রেগে লাল হওয়া নাকটাকে টেনে দিতে। একটু আগে যখন সে লজ্জায় লাল হয়ে সরে গেল হাসিবের কয়টা হার্টবিট মিস হয়েছে কেউ কি জানবে? এই মেয়েটা সচরাচর সাজে না কিন্তু যখনই সাজে চারপাশটা একদম সাদাকালো হয়ে যায়। আশেপাশের কিছুই আর নজরে আসেনা। ইচ্ছে করে প্রাণভরে শুধু ওর দিকেই যেন তাকিয়ে থাকে!
আজ পর্যন্ত যতবার ও সেজেগুজে হাসিবের সামনে এসেছে হাসিব তাকে নতুন করে আবিষ্কার করেছে।

কি ব্যাপার বলছিস না কেন?

বলার কি আছে? কেউ কি অন্ধ নাকি আয়নায় দেখে না নিজেকে?

আনহা রাগে ফুঁসতে লাগলো। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে এখুনি দু চারটা ঘুষি নসীবে আছে। কিন্তু আনহার মা এসে সেই দূর্গতি রোধ করলো।

একি আনু এখনো তোর সাজগোজ শেষ হয় নি? কান গলা খালি কেন? তাড়াতাড়ি রেডি হ ছেলেটা সেই কখন এসেছে!
হাসিব দেখি বাবা নাস্তাগুলো খেয়ে নাও। আনু তুই দেখিস ত যেন ঠিকঠাক খায়। কিছু মনে করোনা বাবা তোমার শ্বশুরের একটা ফাইল খুঁজতে হচ্ছে লোক বসে আছে ঐটা নিতে তাই আমি নিজে তদারকি করতে পারছিনা।

আরেহ আন্টি কি যে বলেন আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন আনু আছে তো। ও ঠিকই যত্ন নিবে। না নিলে আপনাকে বলবো নো টেনশন।

আনিসা হেসে চলে গেল।
আনহা ততক্ষণে কানে গলায় জিনিস পড়ে নিলো। সে ঠিকই বুঝেছে এই কথার মানে কি।

আমার শেষ। চলেন এবার

আমার আপ্যায়ন হয়নি এখনো। আগের জামাই আদর খেয়ে নেই তারপর।

তো না খেয়ে বসে আছিস কেন?

আমার শাশুড়ি মা কি বলে গেছে কেউ বোধহয় শোনেনি!

আনহা নাস্তার প্লেট এগিয়ে দিলো, হাসিব ডোন্ট কেয়ার মুডে বললো, বাইক চালিয়ে আমার আঙুল ব্যথা করছে। আমি এখন হাত নাড়াতে পারবো না।

আনহা রাগে কটমট করতে করতে চামচ কেটে সবকিছু মুখে তুলে খাইয়ে দিলো।
হাসিবও যেন নাছোড়বান্দা সে মনের সুখে সবকিছুই সাবাড় করলো। আনহাকে বিরক্ত করতে যেটা সে খেতে পছন্দ করেনা সেটাও খেলো। আনহা মনে মনে বললো, এর শোধ আমি তুলবো, একবার সুযোগটা আসুক মনা!
????
বহুদিন পর আজ নিশিথার শ্বশুরবাড়িতে গরুর মাংস রান্না হচ্ছে। ঘ্রাণে পুরো কলোনী যেন ম ম করছে। নিশিথার শ্বশুর আব্বাস রান্নাঘরের চৌকাঠে বসে বললো, বৌমা কি রান্না করছো গো তুমি। পুরা মহল্লায় যে খবর হয়ে গেল। ঘ্রাণেই তো ক্ষুধা লেগে গেছে।
নিশিথা ছোট বাটিতে দু পিস গোশত দিয়ে বললো, বাবা চেখে দেখেন তো সব ঠিক আছে কি না?

আব্বাস খেয়ে বললো, মাশাআল্লাহ এতো মজার গোশত আমি খাইছি বলে মনে হয় না। তোমার রান্নার হাত আছে মা। যাই তোমার শাশুড়িরেও খাওয়াই আসি।

নিশিথার এই বিষয়টা খুব ভালো লাগে, তার শ্বশুর কোনোকিছুই স্ত্রীকে না দিয়ে খায় না। এমনকি অফিসে কোনো অনুষ্ঠান হলেও সেটা বাসায় নিয়ে আসে। এই ছোট ছোট যত্নগুলোই আসলে ভালোবাসা বাড়ায়। নিশিথা জানে এই পরিবারে টাকাপয়সার অভাব হলেও ভালোবাসার অভাব নেই। রাতে খাওয়ার পর ইমরান বললো, তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি। একটু দাঁড়াও

নিশিথা বিছানা ঠিক করে মশারি টানালো কিন্তু ইমরান তখনো ফিরলো না। বহুক্ষণ পর পাশের রুমে চেঁচামেচিতে নিশিথা উঠে গেল। গিয়ে দেখে ইমরান তার ছোট বোন নদীকে আচ্ছামতো বকছে। সে আর ওদিকে গেল না। সে জানে ওখানে কি হয়েছে। এ আজ নতুন নয়। ইমরান যখনই নিশিথার জন্য কিছু এনেছে নদী সেটা চুরি করে হয় খেয়ে ফেলেছে না হয় ব্যবহার করে ফেলেছে। এ আর নতুন না। কিন্তু এসব নিয়ে চিল্লাচিল্লি করলে কয়েকদিন তার শাশুড়ি মুখ ভার করে রাখে। নিশিথা অনেকবার বলেছে কিছু আনতে হবেনা আর নদীকে বকা দেওয়ারো দরকার নেই। অযথা ঘরে অশান্তি ভাল্লাগেনা। কিন্তু না ইমরান আনা কমায়, না নদী চুরি করা ছাড়ে।
নিশিথা রুমে এসে কানে ইয়ারফোন গুজে শুয়ে থাকে। সারাদিন ভুলে থাকলেও রাতে পরিবারের কথা ভীষণ মনে পড়ে। বিশেষ করে আনহার কথা। কতদিন সবাইকে দেখে না। আনহার কি অবস্থা কে জানে! ওর চলে আসার প্রভাব কতখানি পড়েছে ওর উপর? কিন্তু উত্তর পাওয়ার পথ থাকেনা। আনহা বহু আগেই তাকে সবকিছু থেকে ব্লক করেছে। অন্য নাম্বার থেকে ট্রাই করলেও রেসপন্স পায়নি। মেয়েটা যে অভিমানী এটা আর কেউ না জানলেও নিশিথা ঠিকই জানে। এসব ভাবলে আর কিছুতেই ঘুম আসে না,,,,,

?????

আনু তুই আমার ছেলের বৌ না তুই আমার মেয়ে। আমার ছেলেটা বড্ড পাগলাটে, ওর ধারণা আমি কিছু বুঝিনা। ও কি করে বেড়ায় কোনো খবর আমি পাই না। আমি সবই জানি, এটাও জানি কিছু একটা নিয়ে তোদের মাঝে সমস্যা হয়েছে। কিন্তু মা মনে রাখিস তোরা এখন শুধু ভালো বন্ধু না তোরা এখন স্বামী স্ত্রী। তোদের সম্পর্কের উপর রহমত স্বয়ং আল্লাহপাক দিবেন। তুই আগে বন্ধু হয়ে যেভাবে ওর ভালোমন্দের খেয়াল রেখেছিস এখনো তেমন রাখিস মা। আমার ছেলেটা তোকে যতোটা পরোয়া আর কাউকে করেনা। আমি কতবার ওকে বলেছি কি হয়েছে তোদের কেন স্বাভাবিক লাগছেনা, কিন্তু ছেলে আমার কিছুই বলে না।যাই হোক এটা তোদের ব্যাপার। আমি শুধু বলবো যাই হয়েছে হয়েছে। এখন সব মিটমাট করে সম্পর্কটাকে সুযোগ দে। তোরা কেউই এখন ছোট না।

হুম

রাগ করেছিস মা?

নাহ আন্টি।

কিসের আন্টি। মা বল? শাশুড়িকে কেউ আন্টি বলে? বল মা?

মা!

বাদরটা গেছে কই জানিস?

নাহ।

পালিয়েছে। তুই কি বুঝিস না ও তোর থেকে কেমন পালিয়ে বেড়ায়?

আমি বাঘ না ভাল্লুক যে পালাতে হবে ?

হাহাহা। আর ক টা দিন যাক নিজেই টের পাবি তুই কি!

মা,বাবা ফিরবে কখন?

এইতো একটু পর। বোর লাগছে একা?

নাহ। তোমার সাথে ভালোই লাগছে।

শাড়ি পড়ে থাকতে অসুবিধা হলে থ্রিপিস পড়ে নে।

উহু আমি শাড়িই পড়বো। কত শখ ছিল জানো বিয়ের পর শাড়ি পড়ে ঘুরবো। এখন সেই শখ পূরণ করছি। তোমরা তো কোনো শখই পূরণ করতে দিলে না!

কি করবো বল পরিস্থিতিটাই এমন হয়ে গেল। নাহয় আমি কি আমার ছেলের বিয়ে এমন সাদামাটা করতাম? চিন্তা করিস না রিসিপশনটা বড় করে করবো। তোর মিলি আপু কানাডা থেকে আসলেই রিসিপশন হবে। ওর বরের ছুটি মিলছে না বলেই তো এতো লেট হচ্ছে।

মা তুমি সারাদিন বাসায় এমন একাই থাকো?

মিলির বিয়ের পর একা হয়ে গেছি। অবশ্য ছেলেমেয়ে বড় হলে মায়েরা একাই হয়ে যায়।
আনু ঐ ড্রয়ারটা খুলে দেখ একটা কালো অ্যালবাম আছে। ঐটা রুমে নিয়ে দেখ তো। আশা করি অনেক কিছুই জানবি।

আনহা ভাবতে লাগলো কি এমন আছে সেটাতে? মা এভাবে বললো কেন?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here