#প্রজাপতি মন (পর্ব-12)
♡আরশিয়া জান্নাত
নাহিয়ান বেশ কয়েকবার বোনদের রুমে চক্কর দিয়ে এসে মাকে বলল, মা ছোটাপু আসবে না আজকে? একা একা ভাল্লাগেনা তো ওকে ফোন করে বলো তাড়াতাড়ি আসতে।
আনিসা রান্নার পাট চুকিয়ে ছেলের সামনে বসে বললো, তোর ছোটাপু শ্বশুরবাড়ি গেছে। আজ তো ফিরবেনা বাবা। তুই বরং টিভি দেখ বসে বসে।
মা তোমরা দুই আপুকেই বিদায় করে দিয়েছ। আমি বড় হলে আমাকেও শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিবে? তখন তোমরা একা একা মজা করবে তাই না?
ছেলের কথা শুনে আনিসা হাসতে লাগলেন। নাহিয়ান সবে ক্লাস ফোরে পড়ে। দুই বোনকে চোখে হারায় বলতে গেলে। আনহা অথবা নিশিথা কেউ না কেউ ঠিকই বাসায় থাকতো আজ এই প্রথম দুইবোনের একজনও বাসায় নেই। তাই নাহিয়ান এমন ছটফট করছে।
মা ছোটাপু কবে ফিরবে?
এই তো কয়েকদিন পর
আমাকে নিলো না কেন?
তুই স্কুলে ছিলি তাই।
মা হাসিব ভাইয়াকে ফোন করো না। বলোনা আমায় নিয়ে যেতে?
তোর স্কুল আছেনা?বাসায় টিচারো আসবে। এখন ছুটি দেওয়া চলবেনা।
উফফ মা ভাল্লাগেনা।
আনহা অ্যালবাম খুলে বসলো, অ্যালবামের প্রতিটা পাতায় কেবল হাসিব আর তার ছবি সাথে ছোট ছোট ক্যাপশন লেখা। সেই ছোটবেলা থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত যতো ছবি তুলেছে সব এই অ্যালবামে যত্ন করে রাখা। ক্যাপশন গুলো পড়ে ছবি দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে আনহার। প্রতিটা ছবির স্মৃতি অজান্তেই মানসপটে ভেসে আসছে এমনভাবে যেন এই তো সেদিন ঘটলো!
এই অ্যালবামে সব ছবি ইচ্ছাকৃত ভাবে তোলা হলেও দুইটা ছবি ছিল একদম অজান্তে তোলা। আনহা ছবি দুটো ভালোমতো দেখলো, কখন তুলেছে এই ছবিগুলি ভাবতেই চমকে গেল সে।
এটাই তো সেই কাতান ড্রেসটা যেটা পড়ার পর হাসিব বলেছিল এই রঙের জামা আর পড়বিনা!
কিন্তু সেদিন তো হাসিব আর জেবিনের ফার্স্ট ডেট ছিল। ঐখানে তো আনহার ছবি তোলা হয়নি। তবে কখন তুললো? ছবিটার পাশে লেখা,
সবুজ একটা কোমল রং। এই রং দেখলেই চোখ শীতল হয়ে যায়। কিন্তু আজ এই রংটা চোখে বিধেছে খুব!
আরেকটা ছবি ছিল তাদের বিয়ের দিনের। যেখানে আনহা মাথা নিচু করে কাবিনে সাইন করছিল।
“অতঃপর আমার বেস্টফ্রেন্ড বিয়ে নামক কারাগারে বন্দী হলো! Best wishes Mrs Hasib Irhaam”
হাসিবকে সে বরাবরই ছন্নছাড়া ভেবেছে। যদিও তার ক্ষেত্রে সে খুবই যত্নশীল ছিল। কিন্তু হাসিব এভাবে তাদের ছবি জমিয়েছে এটা সে জানতো না। অবশ্য এটা স্বাভাবিক ঘটনা। ছবি থাকা বড় কোনো ব্যাপার না। তবুও মন এই সহজ সত্যিটা মানার বদলে অন্যকিছু ভাবতে চাইছে। হাসিব কি তাকে কেবল বেস্টফ্রেন্ড ভেবেই এতোকিছু লিখেছে নাকি এখানে অন্য কিছু আছে? অন্য কিছু কি থাকবে? আনহাও তো সারাক্ষণ হাসিব হাসিব করতো। কতজন ভেবেছিল আনহা আর হাসিব রিলেশনে আছে! তবুও এই সময়টাতে এই স্মৃতিচারণের খুব দরকার ছিল। গত কয়েকমাসের বিচ্ছেদে আনহা তো ভুলতে বসেছিল কেমন ছিল হাসিবের সাথে তার সময়গুলি!
??????????
হাসিব সারাটা বিকাল অযথাই বাইরে ঘুরে কাটালো, এখানে যাচ্ছে ওখানে যাচ্ছে তবু বাসায় ফিরছেনা। বাসায় ফিরে সে কি করবে? কতক্ষণ এড়িয়ে যাবে? বিয়ে একটা অদ্ভুত সম্পর্কের নাম এই সম্পর্কে বাঁধা পড়লেই যেন দুটো মানুষ অজানা মন্ত্রে বশীভূত হয়ে যায়। সারাক্ষণ ইচ্ছে করে সেই মানুষটার আশেপাশে থাকতে, অথচ আশেপাশে গেলেই দমবন্ধ লাগে। মনে হয় চারপাশে একফোঁটা অক্সিজেন নেই। অক্সিজেনের অভাবে হার্টবিট করা অফ করে দেয়, বুকের মাঝে কেমন শিরশির অনুভূতি হয়। চোখদুটো বারবার সেই মানুষটার দিকেই আটকে থাকে। না না এসব বারবার ফেইস করা হাসিবের পক্ষে সম্ভব না। হাসিব ভাবতো সে তিতলিকে অসম্ভব ভালোবাসে। তার মনে তিতলির জায়গা কেউ নিতে পারবেনা। তবে আনুর ক্ষেত্রে কেন সব উল্টো ঘটছে? আনু তো তার বেস্টফ্রেন্ড সে তো কখনোই আনুকে ভালোবাসেনি। তবে এখন কেন এমন হচ্ছে? এখানের মূলে কে আছে? আনু নাকি বিয়ে নাকি আরাফের বলা কথাগুলো তাকে এমন ভাবাচ্ছে?
কিছুতেই সে নিজেকে স্যাটিসফাইড করার মতো লজিক পাচ্ছেনা।
রাতে বাবার কল পেয়ে বাধ্য হয়ে হাসিব বাসায় ফিরলো। সে ফিরতেই তার বাবা বললো, কেমন আক্কেল তোর হাসিব? সেই কখন বেরিয়েছিস এতক্ষণে ফিরলি? হাসনা তোমার ছেলেকে যদি আমি ফোন না করতাম এখনো ফিরতোনা আমি সিওর। এ কেমন কার্যকলাপ!
হ্যাঁ রে হাসিব আনু সেই কখন থেকে একা একা সারা ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে তুই তো অন্তত ওর সঙ্গে থাকতে পারতি। মেয়েটা এই প্রথম এলো আর তুই মিনিমাম ভদ্রতা দেখাচ্ছিস না? আগে যখন ও বাসায় আসতো তখন তো ভুলেও পাশ ছাড়তি না আর এখন বৌ হবার পর সব চেইঞ্জ?
মা তুমিও বকবা! আমিতো এমনি এমনি বাইরে ছিলাম না। কাজ ছিল বলেই তো,,,
খবরদার একদম কাজ দেখাতে আসবিনা। রাজ্য জয় করে এসেছেন মহারাজ! হাসনা আর কতক্ষণ বসিয়ে রাখবে আমার ক্ষুধায় অস্থির লাগছে।
এই তো আর একটু অপেক্ষা করো।
হাসিব রুমে গিয়ে আনুকে না দেখে ফের ডাইনিং এ এলো। এমন ভাব নিয়ে চারদিকে চোখ বোলাচ্ছে যেন সে এমনিই ঘুরছে। কিন্তু মুখে একবারো বলছেনা আনু কোথায়। মর্জিনা খালা খাবার পরিবেশন করে যাবার পর আনহার দেখা মিললো। শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে আনহা যখন হাসিবের দিকে তাকালো, হাসিব তখন উল্টো দিকে ফিরে আপেল খাচ্ছে। হাসিব মনে মনে বললো, মেয়েটা একদিনেই এমন গৃহবধূ বনে গেল!
?????
আনহার রান্না খেয়ে সকলে অনেক প্রশংসা করলেও হাসিব কিছুই বলেনি। ইনফ্যাক্ট এমন ভাব ধরে খাচ্ছিল যেন খেতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আনহাও কম না যেই বুঝলো হাসিবের খেতে অসুবিধা হচ্ছে ইচ্ছে করে আরো বাড়িয়ে বাড়িয়ে পাতে তুলে দিয়েছে।
“খুব তো খাদক বনেছিস! খা ব্যাটা এই অপছন্দের খাবারগুলোই বেশি করে খা।”
অথচ আনহা বুঝলোনা এতে হাসিবের লসের চেয়ে লাভটাই বেশি হয়েছে। সে তো সেধে গিয়ে বেশি করে নিতে পারতো না। আনু বলদিটা ওর সুবিধাই করেছে! মেয়েটা আসলেই বেশি কিউট বলদি।
আনু সুন্দরমতো সবকিছু গুছিয়ে তার শাশুড়িকে ঔষধ খাইয়ে পানি নিয়ে রুমে এলো। হাসিব ততক্ষণে চিৎপটাং হয়ে পুরো খাট দখল করে শুয়ে পড়েছে।
কি ব্যাপার এমন ছড়িয়ে থাকলে আমি ঘুমাবো কোথায়?
রুম তো একটা না অনেকগুলো রুম খালি পড়ে আছে যেকোনো একটায় গিয়ে শুয়ে পড়লেই পারে!
ওহ তাই? ওকে আমি গিয়ে মা কে জিজ্ঞাসা করি কোন রুমে ঘুমাবো। আমার অবশ্য ভালোই হবে এমন জলহস্তীর সাথে ঘুমানো লাগবেনা। যে জেগে থাকা অবস্থায় এমন চিৎপটাং হয়ে শুতে পারে সে ঘুমোলে না জানি কি করে!!
মা ও মা আমি কোন রুমে ঘুমাবো?
হাসিব লাফ দিয়ে এসে আনহার মুখ চেপে ধরলো।
“পাগল নাকি তুই এভাবে ষাঁড়ের মতো চেচাচ্ছিস! মাকে বলে মাইর খাওয়াবি নাকি? এমনিতেই কম বকা শুনেছি আজ?”
আনহা হাত সরিয়ে বলল, আমি এখানে কাউকে মাইর খাওয়াতে আসিনি। কিন্তু কেউ যেন আমাকে ফর গ্রান্টেড না ভাবে!
আনহা গিয়ে সুন্দর করে বিছানার বামপাশে শুয়ে পড়লো। হাসিব চেঁচিয়ে বললো, এখানে না এটা আমার সাইড।
আনহা যেন শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে চোখ বন্ধ করে রইলো।
অনেক জ্বালিয়েছ মনা এবার বুঝবা আনহা কি চিজ!
হাসিব ও সহজে ছাড়বার পাত্র নয়, সে চুপচাপ অপরপাশে শুয়ে আনহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আনহা কিছু বুঝে উঠবার আগেই তাকে বুকে তুলে ডানপাশে নিয়ে রাখলো।
হাসিব বিজয়ের হাসি দিয়ে বললো , হাসিবের জায়গা দখল করা এত্ত সোজা না!
কিন্তু আনহার দিকে তাকাতেই তার সব হাসি উবে গেল। ঘটনাটা কি ঘটলো টের পেতেই হাসিব অস্বস্তিতে পড়ে গেল। আনহা চটজলদি পাশ ফিরে মুখ লুকালো। এতো লজ্জা সে কোথায় লুকাবে! আচ্ছা হাসিব তার হার্টবিট শুনে ফেলছে না তো?
চলবে,,,,