প্রজাপতি মন (পর্ব-16)

0
915

#প্রজাপতি মন (পর্ব-16)

♡আরশিয়া জান্নাত

আনহার ঘুম ভাঙলো কখন সে নিজেও জানেনা। চোখ মেলে দেখে মৃদু আলো চারপাশে, রাত হয়ে গেছে এইটুকু আঁচ করেছে। বালিশের পাশে ফোনটা হাতড়ে নিয়ে দেখে রাত এগারোটা বাজে। এতোক্ষণ ঘুমিয়েছে সে! হাসিবও ডাকেনি তাকে। অবশ্য ও ডাকার কথাও না, ও জানে ক্লাস শেষে আনহা অনেকক্ষণ ঘুমায়। ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দেখে হাসিব টিভি দেখছে, আনহা দেখে বললো, ঘুম ভেঙেছে মহারাণীর! একটা মানুষ এতো ঘুমাতে পারে তোমাকে না দেখলে জানতাম না।

ডাকো নাই যে! ঘুমালে আমার হুঁশ থাকেনা এ তো জানা কথা। এখন খাওয়ার কি আছে? খুব ক্ষুধা পাইছে।

কপাল আমার কপাল! কোথায় আমারে সার্ভ করবে তা না আমাকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে কি আছে! যাই হোক বসেন আপনার জন্য খাবার আসছে।

তুই খেয়ে ফেলেছিস?

নাহ। আমি এতো আর্লি খাই না।

ওহ। চল তাহলে এখন খাবি।

খেতে খেতে আনহা বলল, সাডেনলি এখানে আসার প্ল্যান করলি কেন?

বহুদিন আসিনা ভাবলাম আসবোই যখন সঙ্গে করে যন্ত্রমানবীরে নিয়ে আসি! সে তো রুগিদের মাঝে থেকে থেকে রুগি হয়ে যাচ্ছে।

ভুল কথা। ঐখানে থেকে আমি মোটেও রুগি হচ্ছি না ইনফ্যাক্ট খুব ভালো লাগে, সবার সেবা করতে পারছি এমনটা মনে হয়।

জনমানবদরদী কলিজার টুকরা! কলিজার তরকারিটা মেখে লোকমা তুলে দে তো।

আনহা কলিজা ভুনার তরকারিটা দেখেই ভাবছিল হাসিব নিশ্চিত বলবে লোকমা তুলে দিতে।

আন্টি বলছিল ইন্টার্নি শেষে ফরেনে যাবি, আমাকে তো কিছু বলিস নি!

এখনো সব ঠিকঠাক হয় নি। হলে জানাতাম।

এটা এতো সাধারণ? মোটেই না।

এখানে জটিলতার কিছু নেই। ডাক্তারী পড়ছি যখন দুদিন পরপর কত ডিগ্রিই লাগবে। সেসবের জন্য বিভিন্ন দেশে যেতে হবে। এটাতো সবাইই জানে।

সবাই জানে তবে আমি তোর বেস্টি প্লাস হাজবেন্ড। আমি আগে জানবো! দেখ আনু তোর সাথে আমার অনেক ঝগড়া তোলা আছে, অনেক বিষয় আমি তুলে রেখেছি হিসাব নিকাশ করার জন্য। প্রথমত বিয়ের বিষয়েই বলি। তুই বিয়ে করে ফেলছিলি অথচ আমাকে বলার প্রয়োজনবোধ করিস নি। সাপোজ পাত্র আমি না হয়ে অন্য কেউ হতো তখন আমি খবর পেতাম বিয়ের পর! এই আমার ভ্যালু? তারপর হলো তোর ক্যাম্পাসে এক ছেলে তোর উপর লাড্ডু, ছেলেটা তোকে সবার সামনে প্রপোজ করেছে। এই খবরটাও আমি তোর কাছ থেকে পাই নি! আমি ভাবতাম আমার মতো তুই ও আমাকে প্রায়োরটি লিস্টে প্রথমে রাখিস। কিন্তু আমি ভুল! তুই ইচ্ছে করে সব করিস, দোষ করিস। আর আমি রাগ করলে,রিয়েক্ট করলেই দোষ হয়ে যায়।

বাপরে এতোদিন এতোকিছু জমিয়ে রেখেছিলি মনে। বলে দিলেই পারতি। আমিতো জানিনা কথা বন্ধ করে বন্ধুত্ব ভেঙেও কেউ আশা করছিল আমি সব খবর দিবো।

হাসিব রেগে বললো, বন্ধুত্ব ভেঙেছে কে? মুখে বললেই কি এতোবছরের বন্ধুত্ব ভাঙে? তোর উপর আমার রাগ ভীষণ রাগ। এই রাগগুলো দমানোর জন্য কয়টা পুশাপ করেছি তোর আইডিয়া নেই।

হাহ! এখন কি চাস কানে ধরে উঠবস করি?করলে রাগ কমবে?

তুই সবসময় উল্টাই বুঝলি। যাক তোর থেকে সোজা কিছু আশা রাখিনা। শোন একটা সোজা হিসাব তোর কোনোকিছুই আমার কাছে থেকে গোপন রাখবিনা। চেষ্টা করেও লাভ নেই সব খবর চলেই আসে। তবুও বলছি কারণ আমি চাই তুই নিজে বল।

আনহা হাসতে লাগলো। পুরনো হাসিব ফিরলো তবে! কতদিন পর হাসিব এমন প্রাণবন্ত হয়ে ঝগড়া করছে!
?????
বলছিলাম কি নিশিকে ক’টা দিনের জন্য আনি বাসায়? কতদিন মেয়েটাকে দেখি না!

এমনভাবে বলছো যেন তোমার মেয়েকে আমি বিয়ে দিয়েছিলাম এখন শ্বশুরবাড়ি থেকে নায়র আনতে যাবো!

এভাবে বলো না। আমি জানি ও যা করেছে অন্যায়। কিন্তু আমরা কতদিন মুখ ফিরিয়ে থাকবো? এই সময়ে ওর একটু যত্নাদী দরকার।

ওদের বংশের সন্তান আসতে চলেছে ওরা তাদের বৌকে যেমন ইচ্ছে তেমন করে রাখুক। আমার কি? আমার জন্য এখন আনহা আর নাহিয়ান ই সব। ও মৃত।

আনিসা আর কিছু বললো না মুখ ফিরিয়ে কান্না করতে লাগলো। নাফিজ সাহেব বরাবরই কঠিন মানুষ। নিশি হয়তো ভাবেনি তার বাবার কোমল রূপের বিপরীতেও কঠিন রূপ আছে। তাই তো এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে।

নিশিথা কিচ্ছু খেতে পারেনা। যাই খাচ্ছে ভয়ঙ্কর গন্ধ লাগে। চারপাশে যেন মাছের আঁশটে গন্ধ। এতো জঘন্য গন্ধে একটু পরপর বমি আসে। ইমরান ওর জন্য এয়ার ফ্রেশনার কিনে দিয়েছে। তাতেও বিশেষ কাজ হয় না। নিশিথা সারাক্ষণ হাতে লেবুপাতা রাখে। নিশিথার খুব ইচ্ছে করে মায়ের হাতের ভুনা খিচুড়ী আর গরুর কালা ভুনা সাথে আমড়ার আচার খেতে। এই সীজনে ওর মা আমড়ার কয়েক রকম আচার বানায়। তাদের দাদাবাড়িতে বিশাল আমড়ার গাছ আছে। নিশিথার বাবার ভাতের সাথে এই আচার ছাড়া চলেই না।
ইমরানকে বলার পর সে আমড়ার আচার আনিয়েছে, খিচুড়ী কালা ভুনাও আনিয়েছে। কিন্তু ঐটার স্বাদ এতো বিদঘুটে লেগেছে সে মুখে তুলতেই বমি করে ঘর ভাসিয়েছে। নিশিথার মনে হয় এইসবই বাবা মাকে কষ্ট দেওয়ার ফল। নাহয় ওর প্রেগনেন্সিতেই কেন এতো যন্ত্রণা হচ্ছে। তার শাশুড়ি উঠতে বসতে বলে আমরা তো পেটে ধরিনাই। এখনের যুগের বৌ-ঝিরা আহ্লাইদ্দা পোয়াতি হইছে! শাশুড়ির কথা নিশিথার কান্না পেয়ে যায়। ইদানীং তার সবকিছুতেই চোখ ভরে কান্না আসে। কেউ একটু জোরে কথা বললেও ভেতর ভেঙে যায়। অথচ নিশিথা আগে মোটেও এমন ছিল না। ওর মা ওকে মারলেও খিলখিল করে হাসতো। বকলেও হাসতো। টিচার ক্লাসে ধমক দিলেও হেসে ফেলতো। সেদিন নিশিথার শাশুড়ি পাশের বাসার চাচীকে বলছিল, এমন এক কপাল করে বৌ আনছি ভাবি। আয়র নায়র তো নাইই এই যে মেয়ের ডেলিভারি কেইস কোনো পাত্তা নাই। কেমন বাপ মা চিন্তা করেন! আমরা হইলে কি পারতাম এমন পাথরের মতো থাকতে? পালাই আসছে দেইখা কি মাথা কাইট্টা নিছে নাকি? এর থেকে গরীবের মেয়ে আনলেও সম্মান পাইতাম। এই যে সামনে সাত মাসের অনুষ্ঠান হইবো বাপের বাড়ি থেইকা কত কি আওনের কথা!

নিশিথা শুনেও না শোনার ভান করে থাকে। আনিসা যদিও ওকে টাকা পাঠায় ও কাউকে বলেনা। এমনকি ইমরানকেও না। সেই টাকা সে নিজে খরচ করে। ওদেরকে টাকা দেখানো মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। এতো বোকা নিশিথা না। যতো যাই বলুক সে নিজের স্বার্থ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। প্রথম প্রথম সে উদারতা দেখিয়েছিল। কিন্তু বেলা শেষে দেখে এসব কিছুরই মূল্য নেই। নদী তবুও তার জিনিস চুরি করে, ইমরান যা আনে তাতেও ভাগ নিতে চায়। তাই এখন সে একদম বেঁকে বসেছে। ইমরান বলেছিল ঢাকায় নিবে, কিন্তু এই অবস্থায় আর নিচ্ছেনা। অথচ নিশিথার মনে হয় এখানে থাকার চেয়ে ঢাকায় একা থাকা শ্রেয়। তবে একজনের কথা বলতেই হয় সে হচ্ছে নিশিথার শ্বশুর। তিনি ওকে অসম্ভব স্নেহ করেন। সবসময় অফিস থেকে ফেরার পথে যা পান ওর জন্য কিনে আনেন। তবুও বৌমাটা কিছু মুখে তুলুক এই প্রত্যাশায় কত কি আনেন! একদিন জ্বরে পড়ে তার কি হালটাই না হয়েছিল। তখন তার শ্বশুর মাথায় পানি ঢেলেছে, ওর জন্য নিজ হাতে রান্না করে মুখে তুলে খাইয়ে ঔষধ দিয়েছিল। এমন করে যত্ন ইমরানও হয়তো করতে পারতোনা। এই মানুষটাকে নিশিথা অনেক সম্মান করে, ভালোবাসে।
?????
হ্যালো আস্সালামু আলাইকুম আপা। কেমন আছেন?

ওয়ালাইকুমুস্সালাম জ্বি ভালোই আপনার কি অবস্থা?

আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। আপা বলছিলাম কি আনু তো কিছুদিন পর সিঙ্গাপুর যাবে। যাওয়ার আগে ওদের রিসিপশনটা করে ফেললে ভালো হয়। মিলি কাল আসবে তাই আমরা চাচ্ছি এই সপ্তাহে রিসিপশনটা করতে। কি বলেন?

মেয়েতো আপনাদের দিয়ে দিয়েছি। এখন আপনারা যা চাইবেন তাই হবে।

তবুও আপনাদের মতামতের গুরুত্ব আছে। ভাইয়ের সময় কখন হবে সেটাও দেখতে হবে। আমরা কাল সন্ধ্যায় আসবো এই বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে, আর মিলি আসলে আনহাকে নিয়ে শপিং করবে।

আচ্ছা আপা। আপনারা আসেন সরাসরি বসেই এসব কথাবার্তা হবে।

তাহলে সে কথাই রইলো রাখি। আল্লাহ হাফেজ।

আনিসার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তার কত শখ ছিল আনহার রিসিপশনে বুঝি নিশি থাকবে! কিন্তু তেমনটা হবার কোনো লক্ষণই আর বাকি রইলোনা।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here